আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মরিতে চাহি না এই সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই-------

“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, ‍স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” গত রাতে গান শুনছিলাম- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী, আমি অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি”। শুনতে শুনতে এক অপার্থিব জগতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। কথাটাকে একটু ঘুরিয়ে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিচ্ছিলাম- “তুমি কেমন করে লিখো হে লেখক, আমি এক অবাক পাঠক, কেবল পাঠক”। ব্লগিং করার আগে কলেজ ম্যাগাজিনে একটু আধটু লিখলেও খুব বেশি আগ্রহ কখনো বোধ করিনি। ব্লগিং করতে এসেই বিন্দু বিন্দু করে লেখার অভ্যাসটা হয়েছে।

অন্য ব্লগারদের লেখা পড়তে গিয়ে খুব লজ্জায় পড়ে যেতাম, এখনো বিনত হই- তারা এতো অদ্ভুত সুন্দর লিখে! আমি পারি না। মুক্তগদ্য পড়তে গিয়ে অনেক প্রিয় ব্লগারদের ভাষার কারুকাজ দেখে বিস্মিত হই, তাদের মতো লিখতে গিয়ে আমি ব্যর্থ হই। অনেকে কবিতা লিখে মোহনীয় ছন্দে, আমি সেখানে অপাংক্তেয়। অন্যরা যেখানে লেখার মাধ্যমে খুব সহজে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, সেখানে আমি নিরুপায়। শুরু করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের খুব বিখ্যাত একটি গান দিয়ে, চলে গেছি অন্য রাস্তায়! আমি আগে জানতাম, রবীন্দ্রনাথ বোধহয় কোনো একজন গুণীকে নিয়ে এই গানটি লিখেছিলেন।

ভাবতাম, কে সেই গুণী? আমার জানায় ভুল ছিলো। ১৯০৮-৯ সালে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের এক সংগীতগুণীর সভায় সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর বক্তৃতার পর মঞ্চের পাশে যারা ছিলেন, তাঁরা সকলে কবিকে ধরে বসলেন একটি গান গাইবার জন্য। কবি গাইতে চাইলেন না। তিনি বললেন, শরীর খুব ক্লান্ত, আর আগের মতো স্বরও নেই।

তাছাড়া যে ওস্তাদের (কেউ কেউ বলেছেন এনায়েত খাঁ, কেউ কেউ বলেছেন ইমদাদ আলী খাঁ) গান পরিবেশনা হচ্ছিল, তাঁর সামনে উনি গান গাইতে অস্বস্তিবোধ করছিলেন। যারা কবির কাছ থেকে গান শুনতে চাচ্ছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি একটু ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বলেই ফেললেন, “আপনার ভালো গাইতে পারেন বলে অহংকার আছে। সেই অহংকারে পাছে কোন দিক দিয়ে ঘা লাগে, সেই ভয়ে গাইতে চাচ্ছেন না”। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর “না” করতে পারলেন না।

প্রথমে হারমোনিয়াম দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন,পরে খালি গলাতেই গাইলেন এই বিখ্যাত গানটি। ********** রাতে বৃষ্টি হওয়ায় ঘুমটা খুব গাঢ় হয়েছে। তাই সকালে নিদ্রাদেবী বেশ খানিকটা দেরীতেই আমার ঘর ছাড়লো। তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে এসে দেখি Mortality Meeting (প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার সপ্তাহের যে রোগীগুলো মারা যান, কিভাবে মারা গেলো, বাঁচানো যেতো কি না- সেটা নিয়ে একটি সভা হয়) শুরু হয়ে গেছে। এই সপ্তাহে আমাদের দুইজন রোগীকে নিয়ে আলোচনা করার কথা, যাদের একজন মারা গেছেন ঈদের ছুটিতে।

পত্র পত্রিকায় দেখা যায়, ঈদের সময় হাসপাতালগুলিতে ডাক্তারদের অনুপস্থিতির সচিত্র সংবাদ। এই হাসপাতালও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরা ডাক্তাররা সবাই চলে যাই ঈদের আনন্দ উদযাপনে, খুবই নগণ্য সংখ্যক ডাক্তার (তাও তাঁদের হতে হবে অন্য ধর্মের!) কিছু সময়ের জন্য থাকেন হাসপাতালে। মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়, কখনো যদি ঈদের সময় আমার কিছু হয়! কোথায় চিকিৎসা পাবো? গত সপ্তাহে এক রোগী ভর্তি হয়েছিলেন আমাদের বিভাগে, তাঁর সমস্যা নিউরোসার্জারীর নয়, নিউরোলজী বিষয়ক। আমাদের বিভাগের এক নার্সের আত্মীয় হওয়াতে evaluation- এর জন্য অনেকটা জোর করেই ভর্তি হয়েছেন।

তাঁর history নিয়ে দেখা গেলো, শেষ দেড় বছর একজন নামকরা নিউরোলজীর ডাক্তার তাঁকে দেখেছেন, কিন্তু তিনি রোগই সণাক্তকরণ করতে পারেন নি। তাঁর ঘাড়ের পিছনে এক জায়গায় দুই তিনটি টিউমারের মতো জিনিস ছিলো ( enlarged cervical lymph node), যা সেই নিউরোলজিষ্ট দেড় বছরে লক্ষ্য করেন নি! আমরা বায়োপসি করে দেখলাম, তাঁর ক্যান্সার হয়েছে, খারাপ পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে। রোগীর এবার হজে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে ছিলো, সম্ভবত টাকাও দিয়েছিলেন। তাঁর ছেলেদের দিকে লজ্জায় তাকাতে পারিনি, আমাদেরই মতো এক ডাক্তারের দেড় বছরের ব্যর্থতার জন্য। আমার বাসায় স্ত্রীকে বলা হয়েছে- আমার যদি কখনো সড়ক দুর্ঘটনায় ব্রেনে সমস্যা হয় কোথায় নিতে হবে, স্পাইনে সমস্যা হলে কোথায় যেতে হবে, হাত পা ভেঙ্গে গেলে কি করবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমাদের দেশের ডাক্তাররা ভালো জানেন না, সেটা একজন ডাক্তার হিসেবে আমি কখনই বলবো না। কারণ, আমি জানি, তাঁরা অধিকাংশই ভালো জানেন। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। আমাদের খুব কম ডাক্তারই তাঁর জানা জিনিসটাকে রোগীর অবস্থার সাথে খুব ভালোভাবে co-relate করতে চায় না (না কি, পারেন না?)। তাঁরা এতো অল্প সময়ে এতো প্রচুর রোগী দেখেন যে, রোগীকে নিয়ে একটু চিন্তা করারও ফুরসত মিলে না।

আমাদের রোগীরাও নামকরা ডাক্তার বা ব্যস্ত ডাক্তার ছাড়া অন্য কাউকে সহজে দেখাতে চান না। এমনকি সিরিয়াল দিয়ে যদি দুই-তিন মাস পর মাত্র এক মিনিটের জন্যও সেই নামকরা ডাক্তারকে দেখানো যায়, তারা মহাখুশী হয়ে উঠেন। একবারও চিন্তা করেন না, এই এক মিনিটে রোগীকে ডাক্তার কি দেখবেন! ডাক্তারদের নিয়ে একটি বিশাল অভিযোগ হচ্ছে – ব্যবহার। পত্র পত্রিকায় প্রায়শই এই নিয়ে সংবাদ হয়। এই ব্যাপারটাতে আমার প্রতিক্রিয়া মিশ্র।

আমার কথাই বলি- আমি চেষ্টা করি রোগী বা রোগীর লোকদের সাথে ভালো ব্যবহার করার জন্য, চেষ্টা করি ভালোভাবে counseling করার। কিন্তু যখন দেখি, একই রোগীর বিভিন্ন লোক কিছুক্ষণ পরপর রোগী সম্পর্কে একই প্রশ্ন বার বার করছে (যার রোগী হাসপাতালে ভর্তি থাকে, জানি সে কতটা মানসিক অস্থিরতায় থাকে), তখন নিজেকে শান্ত রাখা খুব কষ্টকর হয়ে উঠে, নিজেকে রোবটের সাথে তুলনা করতে হয়। তবুও আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, রোগীকে ডাক্তারের উচিৎ খুব সময় দেওয়া, তার কথা ভালোভাবে শোনা, ব্যবহারটা ভালো করা। মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, একদিন সেইদিন আসবে। ***************** আজকে কোনো লেখা লিখবো চিন্তা করিনি।

তাও আবার রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বা ডাক্তার নিয়ে। এমনিতেই গত সপ্তাহে লেখা একটি লেখার সমালোচনার ধরণ নিয়ে খুব মানসিক অস্থিরতার মধ্যে আছি। পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি- ধর্ম বিষয়ক কোনো লেখা আমি আমার নিজস্ব ব্লগ ছাড়া আর কোথাও পোষ্ট করবো না। ধর্মীয় বিশ্বাসটা নিজের কাছেই থাক। ঠিক করেছিলাম, লেখালেখিতেও একটা বিরতি আনবো।

কিন্তু হলো না! দেড় মাস আগে এক মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি ভর্তি হলো আমাদের নিউরো আইসিইউতে। সড়ক দুর্ঘটনায় স্পাইনাল কর্ডের উপর প্রেশার হয়ে Phrenic nerve (শ্বাস নেওয়ার জন্য প্রধান নার্ভ) প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। কবে এটা ঠিক হবে আমরা কেউ জানি না। রোগী শ্বাস নিতে পারছে না, কিন্তু সম্পূর্ণ সজাগ। শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য তাকে মেশিনের সাথে সংযুক্ত করা হলো (এই সিদ্ধান্তে আমাদের ডিপার্টমেন্টের কোনো ডাক্তারই রাজী ছিলাম না, রোগীর লোকদেরকে বলেছিলাম- Let him die. কথাটা খুব কঠিন মনে হতে পারে, এমনকি আমিও হয়তোবা পরিস্থিতিটা সঠিকভাবে বোঝাতে ব্যর্থ হতে পারি।

শুধু এটুকু বলি, পরিস্থিতিটা ছিলো এরকম, মেশিনে না দিলে রোগী বাঁচবে না, আবার মেশিনে দিলেও ঠিক হবার সম্ভাবনা খুবই খুবই কম), দেড় মাস হয়ে গেলো মেশিনে। চিকিৎসার খরচ বাড়লো, কিন্তু রোগীর phrenic nerve আর ঠিক হলো না। রোগী সবকিছু বুঝতে পারছে, আমাদের দিকে তাকাতে পারছে, কিন্তু মেশিনের সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে শ্বাস আর নিতে পারছে না! আজ রোগীর লোকেরা বললো, তারা আর মেশিনের খরচ বহন করতে পারবেন না। আমরা যেনো মেশিন থেকে খুলে দেই। তাদেরকে বলা হলো, মেশিন থেকে খুললেই রোগী মারা যাবেন।

উনারা উনাদের অর্থনৈতিক অসহায়ত্বের কথা বললেন। ঠিক হলো, আগামীকাল (শুক্রবার) সকালে রোগীকে মেশিন থেকে খোলা হবে। কিছুক্ষণ আগে যখন রাউন্ডে রোগীর কাছে এসেছিলাম, খুব কান্না পাচ্ছিল আমার। তিনি কিছুই জানেন না, তার জীবন সম্পর্কে জাগতিক ব্যাপারে যাদের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আছে, তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। এখন শুধু অপেক্ষা সেই সর্ব শক্তিমান কি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন, সেটা দেখার।

আমি শুক্রবার সকালেই ঢাকায় চলে আসবো। প্রতি সপ্তাহেই তাই করি আমি। আজ ভাবছি, এই শুক্রবারে ঢাকায় চলে আসাটা আমার জন্য খুবই আশীর্বাদস্বরূপ। প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে লেখা এই লেখাটার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। মনের কষ্টটাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই লিখতে বসেছিলাম, কিন্তু এখন মনে হলো কষ্টটা যেনো পাহাড় সমান হয়ে বুকে চেপে বসছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.