আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মরিতে চাহিনা আমি এই সুন্দর ভুবনে, মানবের তরে আমি বাঁচিবার চাই / ইমন

জ্বলে উঠার অপেক্ষায় নিভু নিভু প্রদীপ।

হায়রে নিয়তি! ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে গতরাতে আমাকে হাসপাতালে যেতে হল। বিকেলে পেটের নিচে (আ্যপেনডিক্সের ব্যাথা মনে হয়েছিল) একটু একটু ব্যাথা অনুভব হয়েছিল। মনে করেছিলাম এমনিতে চলে যাবে। ব্যাথা থেকে মুক্তি পেতে অনেক পানিও খেলাম।

তারপরও ব্যথা কমে না। আমার খারাপ অবস্থা দেখে এক কলিগ তখনই হাসপাতালে চলে যেতে বলেছিল। তাকে বললাম হাসপাতালে যাওয়ার মত কিছু হয়নি। সন্ধ্যার দিকে এই ব্যাথা তীব্র থেকে তীব্রতরে রুপ নেয়। অগত্যা কাজ শেষে সন্ধ্যায় হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিলাম।

তখন ব্যাথা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলছিল। তারপর হাসপাতালের পৌছে জরুরী বিভাগে রিপোর্ট করলাম। পরে ওয়েটিং রুমে বসে প্রায় আধাঘন্টা অপেক্ষার পরে এ্যপ্রন পরিহিত একজনের মুখে আমার নাম শুনে তাকে অনুসরণ করে চলে গেলাম ইন্টারভিউ রুমে। কিভাবে ব্যাথা শুরু হয়েছে, কতক্ষণ ধরে ব্যাথা করছে এসব জিগ্গেস করতে করতে জান বের হয়ে যাওয়ার অবস্থা (ভাগ্যিস দুটো ব্যাথানাশক ট্যাবলেট সেবন করতে দিয়েছিল) তারপরও ভাবলাম ডাক্তার যখন এসেছে আর কোন ভয় নেই। কিন্তু, এতকিছুর পরে জানলাম তিনি ডাক্তার নন।

এটা একটা প্রাথমিক ইন্টারভিউ ছিল মাত্র। তারপর তিনি হাতে ছোট্ট একটা কৌটা (ইউরিন টেষ্টের জন্য) হাতে ধরিয়ে দিয়ে অপেক্ষমান রোগীদের সাথে আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। এরপর থেকে শুরু হল আমার ধৈর্য্য পরীক্ষা। শনিবার রাতে হাসপাতাল অনেক ব্যস্ত থাকে। বসে বসে ডাক্তারের অপেক্ষা করছি আর আশেপাশের মানুষের ব্যাথার ক্রন্দন শুনছি।

অপেক্ষমান রোগীদের মধ্যে দেখলাম অনেকেই এসেছে অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে। ডাক্তারের কলের অপেক্ষায় সেখানে বসে মাঝে মাঝে ব্যাথা নিয়েও হাসি পাচ্ছিল। একটা মেয়ে বেড থেকে উঠে বাংলা সিনেমার নায়িকার মত ডাক্তারকে জিগ্গেস করছিল 'আমি এখন কোথায়'। আরেক ভদ্রলোক ডাক্তার আসতে দেরী হচ্ছে বলে বেড থেকে উঠে চলে যেতে চাচ্ছিল কিন্তু ভাঙ্গা হাত নিয়ে উঠতে পারছিলেন না উল্টা আবার ব্যাথা পেয়ে চিৎকার মারেন। এসব দেখে ঠিক যে সময় হাসি পাচ্ছিল তখনই আবার আমার ব্যাথা শুরু হয়ে যায়।

মানুষ যে কতটুকু ব্যাথা সহ্য করতে পারে সেটা হাসপাতালে নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। একটা সময় এমন ব্যাথা শুরু হয়েছিল, চোখে কিছুই দেখছিলাম না। ঘেমে রীতিমত ভিজে গিয়েছিলাম। বেহুশ হতে হতে হই নি। ব্যাথা সইতে পারছি না দেখে একজন নার্সকে বললাম কিন্তু কোন লাভ হল না।

পেটে হাত দিয়ে আবার চেয়ারে বসে পড়লাম। অন্যদিকে ক্ষিদায় মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। সেই কবে সন্ধ্যায় একটা স্যান্ডউইচ খেয়েছিলাম। পকেটে ক্যাশ টাকা আছে কিন্তু বাইরে যেতে পারছি না। সাথে কেউ থাকলে বাইরে থেকে কিছু এনে খেতে পারতাম।

রিপোর্টিং করে বন্ধুদের ফোন করেছিলাম। রাসেল, জুনায়েদ আসতেও চেয়েছিল। পরেরদিন ওদের কাজ আছে তাই আমি না করেছি। যাইহোক, অপেক্ষা করতে করতে ভোর ৩ টা। আগের রাতে চার ঘন্টাও ঘুমুতে পারিনি।

সারাদিন কাজ করে শরীর অনেক ক্লান্ত। এখন প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু ঘুমুতে পারছি না। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরে বিধাতা দয়া করে একজনকে পাঠিয়েয়েছেন। এর আগে যতবারই কারো নাম ধরে ডাকছে মনে হলো এইতো আমাকে ডাকছে।

যাইহোক, এক ইন্ডিয়ান মেয়ে এসে আমার নাম কনফার্ম করলেন। দেখে আমার সমবয়সী মনে হল। প্রথমে ভাবলাম আবার ইন্টারভিউ হবে হয়ত। পরে জানতে পারলাম তিনিই ডাক্তার। তারপর পরীক্ষা শুরু হল।

প্রথমে কিডনী সংক্রান্ত কোন জটিলতা হতে পারে এমনটাই বলেছিল। আমি অসুখ বিসুখের ব্যাপারে খুবই দূর্বল মনের মানুষ। কিডনী সংক্রান্ত জটিলতার কথা শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণের জন্য মাথার ভিতরে মৃত্যুর ভয় ঘুরপাক করছিল। পঁচিশ বছর বয়সেই কি আমার জীবনের বাতি নিভে যাবে।

এখনো অনেক স্বপ্নপূরণ হয়নি। না, আমি মরতে চাই না। তাছাড়া কিডনী ছাড়াই তো কত মানুষ দিব্যি বেঁচে আছে। আমিও বাঁচবো। 'মরিতে চাহিনা আমি এ সুন্দর ভুবনে, মানবের তরে আমি বাঁচিবার চাই'।

চোখের সামনে তখন মা-বাবার ছবি ভাসছিল। দেশে থাকতে অল্প জ্বরেও আমি বিছানায় শুয়ে থাকতাম। নিজে থেকে কখনো ডাক্তারের কাছে যেতাম না। বাবা বাসায় ডাক্তার নিয়ে আসতেন আর মা আমাকে সেবা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। কিন্তু এখানে তো আর মা-বাবা নেই।

পরে ইউরিন টেষ্ট, আমার অতীত মেডিক্যাল হিস্ট্রি থেকে শুরু করে আমার মা-বাবার মেডিক্যাল হিস্ট্রি সব দেখে শুনে বললেন এটা বড় ধরণের কিছু নই বলে ওদের ধারণা। জানতে চাইলাম কি হতে পারে। কিছু বলতে পারলেন না। তারপর একজন ব্লাড টেষ্ট নিতে আসলেন। ব্লাড দেখলে আমি চোখে আর কিছু দেখি না।

'I am scared' বলার পরে তিনি আমার সাথে আজাইরা কথা বলতে শুরু করলেন। কথা বলার ফাঁকে সুঁই দিয়ে কবে যে রক্ত নিয়ে নিয়েছে আমি বুঝতেও পারিনি। যাক, বাঁচলাম। সবশেষে একজন স্পেশালিষ্ট এসে দেখলেন। তিনিও কিছু বলতে পারলেন না।

শুধু বললেন বিপদজনক কিছু হয়নি, হবে না। তারপর ব্লাড টেষ্টের রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করতে বলে তিনি চলে গেলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে রেজাল্ট নিয়ে তিনজনের একটা টিম হাজির। তাদের কাছে 'ইট হ্যাস নো এক্সপ্লেনেশন' শুনে জিগ্গেস করেছিলাম ব্যাথা হওয়ার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে। তাদের কথা এটা নাকি হাজার কারণে হতে পারে।

মনে হল পৃথিবীতে এখনো মানুষের অজানা অনেক কিছুই আছে। যাইহোক, নেগেটিভ কোন কিছু না পাওয়ায় আমাকে কিছু ব্যাথানাশক ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। ভবিষ্যতে ব্যাথা বাড়লে আবার যেতে বলে রিলিজ করলেন। ততক্ষণে আমার ব্যাথা অনেকখানি চলে গেছে। রাস্তায় বের হয়ে ক্যাব নিয়ে বাসায় আসতে আসতে ভোর পাঁচটা।

তারপর কিছু খেয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে আমার মনে হচ্ছে আমি নতুন এক জীবন পেলাম। সবকিছু অনেক সুন্দর মনে হচ্ছে। আজ বাসা থেকে বেরোয় নি। ডাক্তারের কথামত রেষ্ট নিচ্ছি।

সামনের মাসে আমার পরীক্ষা আছে। তাই ভয়টা কাটছে না। যারা লেখাটি পড়ছেন, প্লিজ আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে সিরিয়াস ব্যাথা নিয়ে আমাকে আর হাসপাতালে যেতে না হয়। সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতগ্গতা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.