আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফেরা...

মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে... তখন বাবা চাকুরী করতেন ঢাকায়। আমরা ২ ভাই। আমি সিক্সে পড়ি আর ও থ্রিতে। রোজার মাস শুরু হতেই ২ ভাইয়ের মধ্যে চূড়ান্ত কম্পিটিশন। কে বেশী রোজা রাখতে পারে! আমি অবশ্য সেই প্রতিযোগিতায় কখনোই জিততে পারতামনা, আজ অবধিও না।

বংশের বাত্তি হিসেবে সকলেই যেখানে একটা পুত্র সন্তানের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, সেখানে বড় চাচা, মেঝ চাচা, নয়া চাচা এমনকি আমার খালাদেরও পুত্র সন্তানের কোন খবর নেই (আমার সমবয়সি অবশ্য বড় খালার ছেলে একটা আছে)! দীর্ঘ পুত্র সন্তানের খরায় বংশের বাত্তি যখন নিভে যাওয়ার প্রবল আশংকা, তখুনি আল্লাহ পাক যেন মুখ তুলে চাইলেন! শুকনা-পটকা-রোগা যাই হইনা কেন আলটিমেটলি ছেলে বলে কথা!! হীরের আংটি নাকি বাঁকাও ভালো! আমার দাদী যেন হাতে আকাশের চন্দ্র সূর্য সব এক হাতে পেলেন! সেই দাদী কোনভাবেই আমাকে রোজা রাখতে দিবেন না। আমিও নাছোড়বান্দা! তখন তিনি জায়নামাজের কোনায় ডেকে নিয়ে আমাকে অন্ধকারে আলোর দীপ্তি ছড়ানো তজবীহ দেখিয়ে ফিস ফিস করে বলতেন, 'ভাই, দাদা ভাই, তুই যদি দিনে এট্টা (১টা) রোজা রাখস তাইলেতো অন্যগো লগে পারবিনা। তুই দিনে তিনডা রোজা রাখবি। তাইলেত তুইই ফার্স্ট!' বুদ্ধি আমার হেভি পছন্দ হোল। কষ্ট কম, রেজাল্ট তিন গুন! আমার সেই দাদী, আমরা 'বু' বলতাম, সেই বু দশ বছর ধরে বিছানায় পরেছিলেন।

কি অমানবিক কষ্ট যে করেছেন! চোখে দেখতেন না, কানে শুনতেন না। বিছানায় বাথরুম করতেন। কাউকে চেনেন না। অথচ প্রতিবার যখন বাড়ীতে যেতাম, পাশে গিয়ে বসতাম, দুই হাত দিয়ে মুখখানা বুকের সাথে চেপে ধরে রাখতাম। বু নাখ দিয়ে শুকে শুকে ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করতেন।

তার রক্তের ঘ্রাণ? আমার গায়ের ঘ্রাণ। হাত বাড়িয়ে আমার সারা মুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতেন। তারপর কাঁপা গলায় বলতেন'- বাই, আইছত?'। গা ভর্তি গন্ধ, মুখভর্তি গন্ধ, সেই গন্ধওয়ালা মুখে বু একটার পর একটা চুমু খেতে থাকতেন। তারপর ভ্যা ভ্যা করে কান্না।

আমার সেই বু আর নাই। বু, আবার যে রোজা এলো, চলেও গেলো... ঈদ এলো... আপনি কই বু!! ভোর রাতে ঢাকা থেকে লঞ্চ এসে ভেড়ে আমার ছোট্ট আড়িয়াল খায়। আব্বা আসবে! আব্বা!... আমরা দুই ভাই ফজরের আজানের আগেই উঠর পড়ি। বু আমাদের দু ভাইয়ের হাত ধরে অন্ধকারে নিয়ে যান নদীর ঘাটে। লঞ্চ থেকে কত মানুষ নামে! আব্বা নামেন না।

ওই বুঝি আব্বাকে দেখা যায়। কিন্তু কই! আব্বা নাতো!! লঞ্চ আসে, লঞ্চ যায়... আব্বা আসেনা! তারপর হঠাত আব্বা নামেন। আমরা দুই ভাই স্থান কাল ভুলে গিয়ে তারস্বরে চেচাই... আ...আ...ব...ব...বা... বু হাসেন। আব্বা প্রথমেই তার মাকে জড়িয়ে ধরেন। আমার ছোট ভাইকে কলে তুলে নেন।

তারপর আমার হাত ধরে রওয়ানা দেন বাড়ির দিকে। আম্মা, বু পাশে বসে থাকেন হাসি মুখে। আব্বা ব্যাগ খুলছেন, আমরা দুই ভাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি- ঈদের জামা! কি রঙ! দেখতে কেমন! বু হাসেন, আম্মা হাসেন! সেই বু নেই! আমাদের সেই অপেক্ষাও নেই! সেই অপেক্ষার পালা এখন বদলেছে। রোজার ৫ টা হতেই আম্মার প্রতিদিন ফোন। প্রতিদিন এক-ই প্রশ্ন,' কবে আসবি!।

' ছোট বোনের ফোন,'ভাইয়া, কয়টা জামা কিনছ? কি রঙ!' আব্বার ফোন-' জামা কাপড় কিন্না টাকা নষ্ট কইরনা । বারিতে টাকার অনেক কাম আছে!' আজ বাড়ী যাচ্ছি। গতকাল সন্ধায় রিকশায় ফিরছিলাম । হাত ভর্তি শপিঙের ব্যাগ। কলেজ গেটের সামনে হঠাত রিকশার উপর উঠে গেল দুরন্ত গতির মাইক্রো বাস।

মুহূর্তে দুটুকরো রিকশা থেকে ছিটকে পড়লাম। তারপর রাস্তায়। মাথার পাশ দিয়ে শাঁই করে ছুটে গেল বাস, প্রাইভেট কার। ইঞ্চিখানেকের ব্যাবধান! মৃত্যু এত কাছে!! মায়ের অপেক্ষার মুখ, ব্যাকুল চোখ খানা নিমিষেই ভেসে ওঠে বুকের ভেতর। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাই, রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, মায়ের শাড়ি, স্যান্ডেল, ঘরের জিনিস।

পথচারীরা ছুটে আসে। আমি কিছু বুঝতে পারিনা। কনুই চুইয়ে রক্ত ঝরে, হাঁটুর কাছে জিন্স ছিরে কাঁচা মাংস উকি দেয়। হাতের তালুতে পুকুরের মত গর্ত, জমাট বাধা রক্ত! সোহরাওয়ারদি হাসপাতালে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়। অল্পের ওপর দিয়ে গেছে! রাতে বাসায় এসে ব্যান্ডেজ খুলে ফেলি।

কিন্তু এই ব্যান্ডেজ নিয়ে বাড়ি যাওয়া যাবেনা! আমার মা, আমার বাবা, ছোট বোন, ওরা অপক্ষায় আছে। সেই অপেক্ষার দৃশ্যে ব্যান্ডেজ বাধা হাত বড় বেমানান। ওরা মুখ ভর্তি আনন্দের অপেক্ষায় আছে, হাত ভর্তি ব্যান্ডেজ সেখানে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু ভোর হতেই আবার ব্লিডিঙ। আবার ব্যান্ডেজ।

ব্যান্ডেজ নিয়ে বাড়ির পথ। আমার চোখে মায়ের তৃষ্ণার্ত চোখ, বাবার প্রত্যাশার অপেক্ষা, বোনের চঞ্চল চাহনী। আমি দুরু দুরু বুকে গাড়িতে উঠি... কিভাবে লুকোব হাত! মা আমাকে দেখে কেমন করবে। তার অপেক্ষায় এই ব্যান্ডেজ আমি কিভাবে লুকোব? আমি ভয় পাই! ভয়ে ভয়ে আমি বা হাতের ব্যাগ ডান কাঁধে নেই... প্রতিবার বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথে মা আমার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বিরবির করে আওরান, ইন্নাল্লাহা বিন্নাসি লা রউফুর রহিম। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়া এই দোয়াটার অর্থ জানিনা।

তবে এই মুহূর্তে সেই দোয়াটা বুকের ভেতর কোথা থেকে যেন ভেসে আসে। আমি আনমনে আওরাই- ইন্নাল্লাহা বিন্নাসি লা রউফুর রহিম। মা, তোমার জন্য... ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।