শুদ্ধতার আগুনে যেন সতত পুড়ি নাসিমাকে দেখতে পেলেও প্রথমে বাড়তি কোনো কৌতূহল প্রকাশ করেনি রাফাত। কিন্তু তাকে অতিক্রম করে আসার পরই মনে হলো, তার একটি চোখ যেন কেমন ফোলা ফোলা দেখাচ্ছিলো। তবে নিশ্চিত হতে পারছিলো না কোন চোখটি ফোলা অথবা মেয়েটি সত্যিই নাসিমা কি না? একবার মনে হচ্ছিলো ডানের চোখটি। আবার পর ক্ষণেই মনে হচ্ছিলো যেন বামের চোখটি। যখন সে কোনোমতেই নিঃসন্দেহ হতে পারছিলো না, তখনই তার মনে হলো ফিরে গিয়ে আরেকবার দেখে নেওয়াটাই ভালো।
সেই সঙ্গে কারণটাও জেনে নেওয়া যাবে। কোনো একটি বিষয় নিয়ে সন্দেহের দোলাচলে থাকাটা খুবই অস্বস্তিকর। আর এ কথা মনে হতেই সে অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো।
একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো আরোহী অবরোহী সিঁড়ি দুটো বিপরীত মুখী চলছে। তবে কোনোটাতেই মানুষ ছিলো না।
উপরের ফ্লোরে ব্যস্ত লোকজনের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে নাসিমার দেখা পেলো না সে। এত দ্রুত সে কোনদিকে গেল? নাকি ওপরে গিয়ে দেখবে? অবশ্য নাসিমা কোনদিকে গেছে তা নিশ্চিত হতে পারলে খুঁজে পেতে সুবিধা হতো। এই ভিড়ের ভেতর কোথায় খুঁজবে তাকে? ঈদের বাজারে বিনা প্রয়োজনেও অনেকে ঘোরাফেরা করে। কিন্তু নাসিমার চোখ ফোলা কেন? ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে রাফাত বেরিয়ে আসে মার্কেট থেকে। একবার ইচ্ছে হয় সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলে ভালো হয়।
অবশ্য ফোন করেই ব্যাপারটা সুরাহা করে নেওয়া যায়। পকেট থেকে ফোন বের করে সে নাসিমার নাম্বারে রিঙ করলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তখনই আরেকটা নতুন জিজ্ঞাসার ভার চাপে তার ভাবনায়, ফোন কেন বন্ধ? সে তো ফোন বন্ধ রাখার মেয়ে না।
হাতে ধরে রাখা ফোনটা হঠাৎ নড়ে উঠতেই সে দেখে বাসা থেকে মায়ের কল। মা জানতে চাচ্ছেন, একটা পাঞ্জাবি কিনতে তোর সারাদিন লাগে?
- মা, পছন্দ হচ্ছে না।
আর যেগুলো পছন্দ হচ্ছে সেগুলোর দাম প্রচুর। যা দিয়েছো সে টাকায় কুলাবে না।
- তাহলে চলে আয়। আরো টাকা নিয়ে যা।
- আমার আসতে দেরি হবে।
একজন বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করছি।
- সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরবি কিন্তু!
- চলে আসবো। তুমি ভেবো না।
মায়ের সঙ্গে কথা বলে ফোন বন্ধ করতে করতে তার চোখে পড়ে নাসিমা একটি হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবে উঠে গেল। ধুর, সময়টাই নষ্ট! বিরক্তি আর হতাশা একই সঙ্গে তাকে চেপে ধরে যেন।
বেলা বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে গরমও বাড়ছিলো। শরীর থেকে ঘামও বের হচ্ছিলো বেশ। একবার ইচ্ছে হয় বাসায় ফিরে যায়। কিন্তু নাসিমার ব্যাপারটা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে অনবরত। কী হলো তার?
রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে মনে মনে ঠিক করে যে, এবার পাঞ্জাবি কিনবে না।
ঈদের দিন পুরোনো কাপড় দিয়েই চালিয়ে নেবে। ঈদের দিন নতুন কাপড় পরতে হবে কেন? নতুন কাপড় না পরলে কি ঈদ হবে না? আর ঈদ তো সবার জন্যে জরুরি না। এবার আর নতুন কাপড় নয়। টাকাটা নষ্ট না করে বরং মায়ের হাতে তুলে দেবে। এতে মায়ের মন খারাপ হলেও খুব বেশি হবে না।
ক’দিন আগে বলেছিলেন, বাবার অফিসে কী একটা ঝামেলা চলছে। বেতন বোনাস সময় মতো নাও হতে পারে।
সে হাঁটতে হাঁটতে কখন রিকশা স্ট্যান্ড পার হয়ে যায় বুঝতে পারে না। হঠাৎ থমকে গিয়ে টের পায় বেশ কিছুটা পথ চলে এসেছে। এখন উলটো ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।
সে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। চলতি রিকশাকে থামানো যায়। কিন্তু আর কিছুটা এগোলেই বাস স্ট্যান্ড। যদিও এখন কোনো বাস দেখা যাচ্ছে না, টিকেট হাতে কিছুটা সময় দাঁড়াতে হতে পারে। খানিকটা দ্রুত পায়ে সে এগিয়ে যায় কাউন্টারের দিকে।
বেশ লম্বা লাইন। বাস এলেও তাতে উঠতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। তবু টিকেট নিয়ে সে লাইনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।
পকেটের ভেতর ফোনটা হঠাৎ কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে। হয়তো মা আবার ফোন করেছেন।
না। ফোনটা বের করে সে দেখতে পায় নাসিমার নাম্বার।
- তুই কি বাসায়?
- না। বাইরে আছি।
- বাইরে কোথায়?
- এই বাটা সিগন্যালের কাছে।
- ওখানেই থাক। আমি এক্ষুনি আসছি!
রাফাতের যে কোনো কথা থাকতে পারে, তা না ভেবেই লাইন কেটে দিলো নাসিমা। সে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেই কেন তার দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? অথচ সে যখন তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলো, তখন তার ফোন বন্ধ ছিলো। এখন নিজের প্রয়োজনে ফোন চালু করেছে। ভেতরে ভেতরে নাসিমার ওপর রাগ করতে চাইলেও সে পারে না।
বাস চলে এসেছে। প্রায় খালি বাস। লাইনের সব যাত্রী এঁটে যাবে মনে হয়। তবু লাইনের পেছন পেছন এগোয় সে। শেষপর্যন্ত বাসে না উঠে দাঁড়িয়েই থাকে।
নাসিমার জন্য খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয় না। দ্বিতীয় বাসটা আসার সঙ্গে সঙ্গেই নাসিমাকে নামতে দেখা যায় ক্যাব থেকে। ভাড়া পরিশোধ করে সে এদিক ওদিক তাকায়। হয়তো দেখতে চেষ্টা করে রাফাতকে। রাফাত তখনই একটি হাত তোলে নাসিমার উদ্দেশ্যে।
এগিয়ে এসেই সে জানতে চায়, তোর পাসপোর্টটা কি আছে?
রাফাত অবাক হয়ে জানতে চায় পাসপোর্ট কেন?
- আছে কিনা বল আগে!
- হয়তো আছে। খুঁজে দেখতে হবে।
- বাড়ি চল, খুঁজে দেখবি।
- কী এমন জরুরি?
- আছে। আগে চল! বলতে বলতে নাসিমাও নিজের জন্যে একটি টিকেট নিয়ে আসে।
তারপর রাফাতকে বাসে ঠেলে দিয়ে নিজেও উঠে পড়ে।
দুজনের একটি খালি আসনের দিকে যেতে যেতে বলে, এদিকে চলে আয়!
রাফাত নাসিমার পাশে বসতে বসতে বলে, ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। তোর কথাও বুঝতে পারছি না। সেই সঙ্গে সে খেয়াল করে নাসিমার বাম চোখটা ফোলা। যেন কিছুর সঙ্গে ঠুকে গিয়েছিলো।
চোখের নিচটাতেও হালকা কালশিটে দাগ দেখা যাচ্ছে।
- ব্যাপার কিছুই না। তোর বাসায় গিয়ে সব বলবো।
- তাহলে বল, তোর চোখে কি হয়েছে? দেখে মনে হচ্ছে কিছুর সঙ্গে লেগেছিলো। সাধারণত ঘুষি লাগলে এমনটা হয়।
রাফাতের কথা শুনেই হয়তো নাসিমা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। কিন্তু চোখের পানি আটকাতে পারে না। চট করে চোখের পানি মুছে নিলেও রাফাতের কাছে আড়াল থাকে না ব্যাপারটি। সে এখন কী করবে বুঝতে পারে না। নাসিমার ব্যক্তিগত জীবন যাপনের কিছুই জানে না সে।
খুব বেশি জানে না তার পারিবারিক ব্যাপারও। এমন কি চেনে না তার ঘর-বাড়িও। অথচ তারা দুজন খুবই ভালো বন্ধু। কেউ কি কথাটা বিশ্বাস করবে নাসিমার কিছুই তার জানা নেই? হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কেমন বন্ধু? হ্যাঁ, বন্ধু যে তাতে ভুল নেই। নাসিমা নিজ থেকে তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলোর যা বলেনি বা বলে না, সেই ব্যাপারে সে কখনোই কোনো কৌতূহল প্রকাশ করেনি।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যে, নিজ আগ্রহেই তাকে বেশ কিছু ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলো। এমন ভাবনা মাথায় এলেও কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে অনাবশ্যক কৌতূহল প্রকাশ ভব্যতার সীমা লঙ্ঘন। তাই নাসিমার চোখে পানি দেখলেও তার মন সায় দেয় না এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে। যেহেতু চোখের ফুলে থাকা নিয়ে এরই মধ্যে জিজ্ঞেস করে ভব্যতাকে মেরে ফেলেছে, সেহেতু স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নটা চলে আসে, চোখে পানি কেন?
হয়তো নাসিমার মন শুনে ফেলে রাফাতের অন্তর্গত জিজ্ঞাসা। তাই সে বলতে পারে, মানুষের জীবনে অনেক কিছুই অজানা থাকে।
যেমন ক্লাস নাইন থেকে আমরা পাশাপাশি ক্লাস করছি, অথচ তুই জানিস না আমার বাড়ির ঠিকানা। সেখানে কে কে আছে। আচ্ছা, তুই কেমন মানুষ, আমার ব্যাপারে যার কোনো কৌতূহল নেই?
রাফাত এখন ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই বলতে পারে নাসিমাকে। কিন্তু সে পথে না গিয়ে বললো, কৌতূহল নেই বলাটা ঠিক হবে না। এই যেমন এখন জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, তোর চোখে পানি কেন? কিন্তু জিজ্ঞাসাটা করা ঠিক হবে না।
তুই যদি নিজ থেকে কিছু না বলতে চাস সেখানে জিজ্ঞাসাটা এক রকম বাড়াবাড়ি। এর নাম কৌতূহল না।
- আচ্ছা, তোর কথাই মেনে নিচ্ছি। তবে বাসের ভেতর এসব নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো।
- ঠিক আছে।
- তোদের বাড়ি আর কত দূর?
নাসিমার কথা শুনে হেসে ওঠে রাফাত। বলে, টিকেট কেটেছিস, তুই তো ভালো জানার কথা? কোথাকার টিকেট নিয়েছিস?
- টিকাটুলি! তোদের বাড়িটা ওদিকে না?
- না তো! আমি ইত্তেফাক নেমে ওয়ারী যাই।
- সে তো একই হলো। তারপর নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে নাসিমা আবার বলে, আমাকে গাধা পেয়েছিস, না?
রাফাত নিঃশব্দে হাসে।
বাস মতিঝিল ছাড়িয়ে গেলে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে মিছিলের মুখে পড়ে।
শেয়ার কিনে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া লোকগুলো হতাশা আর ক্ষোভ থেকেই মিছিল করছে। কিন্তু কে শুনবে তাদের কথা? কেউ কি আছে? সবাই তো নিজের আখের গোছানোর তালে থাকে। এর আগেও শেয়ার মার্কেটে লগ্নি করে অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়েছিলো। সেবারও নিঃস্বদের কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলো এবারের মতই। দু বারের একটি প্রধান মিল হচ্ছে যে, এবার যেমন ক্ষমতায় আছে আওয়ামি লিগ, সেবারও ক্ষমতায় ছিলো আওয়ামি লিগ।
সেবার দোষ চেপেছে মাড়োয়ারিদের ওপর, এবার দোষ চাপানো হচ্ছে সিন্ডিকেটের ওপর। কেউ দোষী হোক আর নির্দোষ হোক, সর্বস্বান্ত মানুষগুলোর তো এতে কোনো উপকার হচ্ছে না।
রাফাতের ভাবনা হয়তো থামতো না। নাসিমা বলে উঠলো, চল, নেমে পড়ি।
- নিচে নামলে যদি বোমা ফাটে বা ইট-পাথর ছোঁড়া-ছুড়ি শুরু হয়?
- বাসে বসে থাকলে যে আগুন দেবে না তার নিশ্চয়তা কী? নিচে নামলে দৌড়ানোর সুযোগ থাকবে।
বাসে বসে থাকলে সেই সুযোগটাও থাকবে না। পত্রিকায় দেখিস নাই পোড়া বাসের জানালায় পুড়ে যাওয়া মানুষের বেরিয়ে থাকা পা?
নাসিমার যুক্তিতে কোনো ফাঁক নেই। ওরা সেখানে নেমে হেঁটে এগিয়ে যায় বাকি পথটুকু। তেমন কোনো বিপদ ঘটে না।
বাড়ির গেট খোলাই ছিলো।
সিঁড়ির কাছে দুজন অচেনা বয়স্ক মানুষ দেখতে পেয়ে রাফাত জিজ্ঞেস করে, আপনারা?
বেশি বয়স্ক লোকটি বললো, আমরা রঙের কাজ করি। ভিতরে আমাগো লোক গেছে।
- আচ্ছা, আমি দেখছি! বলে, পেছন ফেরে রাফাত। নাসিমাকে বলে, চলে আয়!
দরজায় দাঁড়িয়ে মা সুরাইয়া খাতুন একটি কিশোর বয়সের ছেলেকে বলছিলেন, এখন যা। সামনের বুধবার সকাল আটটায় লোকজন নিয়ে চলে আসিস।
- আইচ্ছা! বলে, কিশোরটি সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় রাফাতের পাশ দিয়ে।
পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলো নাসিমা। সুরাইয়া খাতুন ছেলেকে বললেন, তোর পেছনে কে এটা?
- নাসিমা। আমার ক্লাসমেট। বলে, রাফাত নাসিমার দিকে ফিরে বললো, আমার মা।
নাসিমা সালাম দেয়।
সুরাইয়া খাতুন দরজা থেকে সরে গিয়ে বললেন, আয় তোরা।
দুজনে ভেতরে ঢুকলে রাফাত নাসিমাকে বললো, তুই বসে মার সঙ্গে কথা বল, আমি দেখি ওটা পাওয়া যায় কিনা। বলেই, নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে রাফাত। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে জানায়, আমার ঘরে তো নেই।
তারপরই মা সুরাইয়া খাতুনকে বলে, মা, আমার পাসপোর্টটা কি তুমি রেখেছো?
- হঠাৎ পাসপোর্ট দিয়ে কী করবি তুই? সুরাইয়া খাতুন অবাক হয়ে তাকান ছেলের দিকে।
পাশ থেকে নাসিমা জানায়, আমি বলেছি।
- তুমি? তিনি যেন আরো বেশি অবাক হলেন।
নাসিমা বললো, আমি ইউকেতে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করবো, আমি চাচ্ছিলাম রাফাতও করুক। আমাদের স্পন্সর করার মানুষ আছে।
সহজে হয়ে যাবে।
সুরাইয়া খাতুন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কিছু বললেন না। নিঃশব্দে উঠে গিয়ে কিছুক্ষণ পর হাতে পাসপোর্ট নিয়ে ফিরে এসে তা ছেলের হাতে দিতে দিতে বললেন, আমি আসছি।
সুরাইয়া খাতুন চলে গেলে, রাফাত নাসিমার সামনা-সামনি টি টেবিলে বসে বললো, কথাটা তুই আগে বললেও পারতি। মাকে বলেছিস কেন? আমি দেশের বাইরে যাই মা মনে মনে চান না।
- ও কিছু না। সব মা এমনই।
- চা খাবি? ভাত নাস্তা কিছু?
নাসিমা কণ্ঠস্বর নামিয়ে বলে, কিছু খেতে দে আগে!
মাকে বলি গিয়ে।
- আমি বলেছি, এটা বলে দিস না গাধা!
রাফাত পাসপোর্টটা নাসিমার হাতে দিয়ে বললো, তোর কাছে রাখ!
রাফাত ভেতরে গিয়ে ট্রে হাতে ফিরে আসে। বলে, মা বলেছে ভাত খেয়ে যাবি!
- দেরি হয়ে যাবে না? বিকেলের আগেই অ্যাম্বেসিতে আমাদের পৌঁছুতে হবে।
- আচ্ছা, যাওয়া যাবে। এখন আস্তে আস্তে বলে ফেল তো তোর চোখের সমস্যাটা?
- খুবই সিম্পল। বিয়েতে রাজি ছিলাম না। বাবা-মার কথায় রাজি হলাম। লেখা-পড়া ছাড়তে চাচ্ছি না দেখে ওর সঙ্গে আজ ঝগড়া হয়ে গেল।
পাগলটা শেষপর্যন্ত আমার গায়ে হাত তুলেছে!
- বলিস কি?
- এটাই মেয়েদের জীবন। আমিও সোজা বেরিয়ে এসে কোর্টে ডিভোর্স পেপার জমা দিয়ে এসেছি। নব্বই দিন পর কাজ হয়ে যাবে। ততদিনে আমার কাগজপত্রও এসে যাবে আশা করি।
রাফাত বললো, নে জুসটা আগে খেয়ে নে, ইলেক্ট্রিসিটিও নেই।
বললে অবশ্য হাত-পাখা এনে দিতে পারি।
- তোর মত এতটা চর্বি আমার গায়ে নেই। তুই এখানেও ঘামছিস!
- আচ্ছা বল, আমাকে টানছিস কেন? তুই বিদেশের নামে পালিয়ে যেতে চাচ্ছিস, যা। দেশের বাইরে আমার ভালো লাগবে না।
- তুই কি একটা কথা বললি, রাফাত? নাসিমার মুখে যেন মেঘের ছায়া ঘনায়।
বলে, তোকে পাশে না দেখলে কি ক্লাসে আমার মন বসবে? এতটা বছর পড়াশুনার ব্যাপারে তোকে বাদ দিয়ে কিছু করেছি, না ভেবেছি; তুই নিজে বুঝতে পারছিস না?
- এত পড়ে কী ঘোড়ার ডিম হবে? বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডার হয়ে যাবো।
- আমার তো ঘরই নাই। দেশের প্রতি কি আর টান থাকে, নাকি ক্যাডার-ফ্যাডারে আগ্রহ থাকে?
- একটু মানিয়ে নিতে চেষ্টা করতে পারলি না?
- অশিক্ষিত হলে না হয় ভাবতে পারতাম খাওয়া-পরার জন্য প্রয়োজনে মারধোর খেয়েও আপস করতে হয়। খাওয়ার জিনিস হলে সব কিছু খাওয়া যায় বলে এঁটোও কি খেতে বলবি?
- আমি দেখেছি মা দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়ে খেয়ে দিচ্ছেন, বাবা সেটা ঢক ঢক করে গিলে ফেলছেন। আবার বাবা হয়তো সবটা চা খেতে পারলেন না।
কাপটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিলেন। মা সেটা সাবাড় করে দিলেন।
নাসিমা হঠাৎ হেসে উঠলো। বললো, তুই ওসব বুঝবি না, সেই বয়স তোর হয় নাই!
- হ্যাঁ দাদি আম্মা, কেবল তুইই পেকে গেলি অকালে!
- মানুষটাকে ভালো বাসতে পারি নাই রে! চেষ্টা করেছি। সুযোগ পেলে তোরা ছেলেরা লাম্পট্য করবিই।
বউয়ের অগোচরে বহু-গামী হবিই। কিন্তু সেটা স্বীকার করার সৎ সাহস তোদের সবার থাকে না। সংসার করতে গিয়ে সংসার বাঁচাতে মেয়েরা অনেক কিছুই সহ্য করে। প্রমাণ ছাড়া মুখের কথাতেই বিশ্বাস করে অনেক কিছু। মেনেও নেয়।
কিন্তু প্রতারণাটা মানা খুবই কঠিন। আমার পক্ষে আর সম্ভব হলো না।
- মেনে নিচ্ছি তোর কথা। তোর সিদ্ধান্ত ভুল তাও বলি না। তুই যে ভাবে পারিস সুখী হ।
তোর জীবন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট তোকেই মানায়। কিন্তু মাকে কী করে মানাবো? বাবাকে না হয় মানানো গেল। মা তো আমাকে ঘরের ভেতরই না শুধু, পারলে খাঁচায় রেখে পুষতেন!
- সে ভার আমার ওপর ছেড়ে দে। মায়েদের কেবল মেয়েরাই বুঝতে পারে। তুই চেয়ে দেখ কী ভাবে রাজি করাই! তবে, আমার সঙ্গে প্রমিজ করতে হবে যে, পড়া ছেড়ে পালিয়ে আসবি না!
- আগে কাজ হোক তারপর দেখা যাবে।
মাকে রাজি করা, নইলে কাগজ-পত্র জমা দেওয়া তো দূরের কথা, পাসপোর্ট সাইজ ছবিও তোলা যাবে না!
- কাজটা আজই করবো। তবে শর্তটা থাকবে।
- কী শর্ত?
- ওই যে বললাম, পালিয়ে আসতে পারবি না!
- ওকে! মা’কে রাজি করা পারলে!
- উনি কোথায়?
- কিচেনে।
নাসিমা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, কিচেনটা দেখিয়ে দে। আমাদের আলাপ নিজের কানে শুনতে চাস?
- না।
আমি জানি, তুই পারবি! ওদিকে সোজা চলে যা।
কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে ছোট্ট করে কাশি দিয়ে নাসিমা বললো, আন্টি আসবো?
- এসো। কোনো কথা আছে?
- তেমন কথা না। একা একা বসে আছি তাই চলে এলাম।
- বাঁদরটা কোথায়?
- বললো, কাজ আছে।
সুরাইয়া খাতুন চুলা থেকে একটি হাঁড়ি নামিয়ে একটি কড়াই চড়িয়ে দিয়ে বললেন, বাঁদরটাকে পাঠিয়েছিলাম পাঞ্জাবি কিনতে। এখন দেখি খালি হাতেই ফিরে এসেছে। রাস্তা-ঘাটে কখন কী হয় তা কি আগে থেকে বলা যায়!
- জি আন্টি! আসার সময় দেখলাম স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে মিছিল হচ্ছে। বাসে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে, সেই ভয়ে নেমে হেঁটে এলাম। কিন্তু হেঁটে আসতে আসতেও ভয় পাচ্ছিলাম যে, বোমা ছুঁড়ে মারে কিনা বা ঢিল ছুঁড়ে মারে কিনা!
সুরাইয়া খাতুন কড়াইতে তেল ঢালতে ঢালতে বললেন, মানুষ আজকাল কেমন যেন হয়ে গেছে।
নিষ্ঠুর। অস্থির। লোভী।
- লোকজনের দোষ দিয়ে কী হবে আন্টি? আমাদের নেতা-মন্ত্রীরা ভালো না হলে সরকারও ভালো হবে না। চারদিকে গুলি, বোমা, আগুন আর খুন খারাবির খবর ছাড়া কোনো সু-খবর নেই।
এই যে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি, সত্যিই বেঁচে-বর্তে সুস্থ অবস্থায় ফিরতে পারবো কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সুরাইয়া খাতুন সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলেন, বালাই ষাট, কু-কথা মুখে এনো না তো! ছেলেটা ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর ফোন ধরতে দেরি হলে বা ফিরতে দেরি হলে বুকের ভেতর ধড়ফড় করতে থাকে। দেশটার যে কী হচ্ছে দিন দিন! এ অবস্থার কি বদল হবে না?
- তাই তো আমি ঠিক করেছি এই দেশেই থাকবো না! যেখানে আইন-কানুন ঠিক নেই, মানুষের ভেতর সততা নেই, ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে ফিরে আসার কোনো নিশ্চয়তা নেই, এমন দেশ আমার দেশ হতে পারে না। ইয়োরোপে আর যাই হোক মানুষের প্রতি অন্যায় করে কেউ বেঁচে যেতে পারে না। এই যে লিমন ছেলেটাকে র্যা ব গুলি করলো, একেবারে নিরীহ একটা ছেলে।
কোনো দোষ না থাকলেও পুলিশ বা র্যাব ধরে নিয়ে গিয়ে সন্ত্রাসী বানিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে, নয়তো ক্রসফায়ারের নামে খুন করে ফেলছে। কোনো মা কি চাইবেন তার ছেলেটা এমন অনিশ্চয়তার বিপদ মাথায় নিয়ে চলাফেরা করুক, নাকি এমন অবস্থায় কোনো মায়ের চোখে ঘুম থাকে?
হঠাৎ সুরাইয়া খাতুনকে দেখা যায় আঁচলে চোখ মোছেন। তখনই নাসিমা ফের বলে ওঠে, খুনি-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো সরকারই স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কোনো বাবা-মা কি চান তাদের সন্তান কোনোদিন বেওয়ারিশ লাশ হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকুক?
- তুমি মা ঠিকই বলেছো। আমার বাঁদরটাকে দেখ রাজি করাতে পার কি না।
কোনো স্কলারশিপ ছাড়া এমনি এমনি কি বিদেশে পড়তে যাওয়া যায়? বলে, সুরাইয়া খাতুন ঘুরে নাসিমার মুখোমুখি হন।
- এটা তো কোনো ব্যাপারই না আন্টি! আমার ছোট চাচা আছেন সেখানে। তিনি তো বলেছেন মাস তিনেক সময় লাগতে পারে।
- তোমার কথায় খুব ভরসা পাচ্ছি মা! বলে তিনি নাসিমার মাথায় হাত রাখলেন। তারপর আবার বললেন, দেখ, বাঁদরটা যদি রাজি হয়।
না দেখার কষ্ট মেনে নিতে পারবো, যদি জানি ছেলে ভালো আছে!
- এ নিয়ে ভাববেন না আন্টি। যে ভাবেই হোক রাজি করাবো।
সুরাইয়া খাতুন বললেন, যাও, দেখ গিয়ে, বাঁদরটার কাজ শেষ হলো কি না!
কিচেন থেকে বের হয়ে আসার সময় প্রায় বোঝা যায় না, এমন একটি সূক্ষ্ম হাসি ফুটে ওঠে নাসিমার মুখে।
(শেষ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।