আমার চক্ষু কেন সৌন্দর্য খুঁজে পায় না জ্যোৎস্না রাতে, কেন অপার সৌন্দর্যে অভিভূত দেখা পাইলে একথালা ভাতের !!! [আলহামদুলিল্লাহ] হাসিমুখে নি:সঙ্কোচে সমালোচনা করুন, কারণ বোকামন অতি নগণ্য সাধারণ । । । সতর্কীকরণ: লেখার ভাষা আপনার বিরক্তির কারণ হতে পারে।
নাম আমার মেন্টাল সুরুজ।
পেশায় ছা-পোষা পিয়ন। ছা-পোষা কেরানী হইতে পারলে ছা-পোষা পিয়ন হইবোনা কেন ? যদিও ছা-পোষা শব্দটা ব্যবহারে আমার আপত্তি; কেমন জানি ছাগল-পোষা ছাগল-পোষা একখান ভাব আসে। যাইহোক বায়োডাটার বাকি বর্ণন আরেকদিন হবে। মূল প্রসঙ্গে আসি- প্রসঙ্গ আমার নাম কেন “মেন্টাল সুরুজ”
বাড়ি হইতে অদূরেই আমার পিচ্চিকালীন বন্ধু মন্টু থাকে। বাড়ির মালিকের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হইয়া আমার বাস হইলেও বন্ধু মনটু নিজ বাড়িতে রাতের বেলা ঘুমায়।
জী ঐ সময়টুকুই ওর বাড়িতে অবস্থান করিবার সময় পায়। বাকি সারাটাদিন পার্টি অফিসে তৈল মর্দনে ব্যস্ত থাকিতে হয়। মাঝে মধ্যে মিটিং মিছিলের বাঁশেও তৈল মর্দন করিয়া থাকে। মন্টু তৈল মর্দন করিয়া নিজবাড়িতে আসিতেছিলেন, আর আমি সারাদিন পিয়নগিরি করিয়া অন্যের বাড়িতে আসিতিছিলুম। পথে ক্রস কানেকশন ঘটিতেই, চিক্কুর পারিয়া মন্টু বাক্য বর্ষণ করিল- সুরুজ খাড়া, খাড়া দোস্ত কথা আছে।
কথা শুনবার নিমিত্তে হোক আর মন্টুর চেহারা দেইখাই হোক, আমি ডান পা সামনে আগানো বন্ধ করিয়া দিলুম।
-কী কথা আছে তাড়াতাড়ি কো, বাইত্তে তোর ভাবী আছে।
তাইনি !! হ হ বাসায় তোর বউ আছে এইডা তোর বিয়া যেদিন খাইছি, হেইদিনতেই জানি। নতুন কইরা কওনের কী হইলো ! কাজের কথা হোন, মজা করবি না।
-আইচ্চা আইচ্চা কো দিহি কী কবি
আমগো নেতার বাপ মরছে একবছর হইবো কালকা।
এই উপলক্ষে স্মরণশোভা বা শোকসভা যেইডাই কছ কালকে অনুষ্ঠান আছে।
-তোর নেতার বাপ মরছে ঐ ব্যাডারে আমার স্মরণ কইরা লাভ কী আর
নিজের শোকেই বাঁচি না আবার আরেকজনের শোকসভা !!
আরে সুরুজ পুরা কথাডা হুনবি তো আগে। অনুষ্ঠান শেষে ভালো খানা-পিনার আয়োজন আছে। দুইঘন্টা বইয়া থাকবি, পেট ভইরা খাবি আইবার কালে দুইডা পটলা হাতে ধরাইয়া দিমু... ব্যস বাইত্তে ভাবী-বাচ্চারাও খাইতে পারবো।
অভাবে নষ্ট স্বভাব কর্তৃক প্ররোচিত হইয়া নির্দ্বিধায় মন্টুর নিকট সম্মতি জ্ঞাপন করিলাম।
মাসে খুব একটা ভালো খাবার আমার পরিবারের জুটেনা। অন্তত বাচ্চা দুইখান ঐ খাবার পাইয়া খুশী তো হইবো! আর আমারও জীবনে খুব একটা বড়লোকদের শোকসভায় যাওয়া হয় নাই। তাই পরদিন সকাল থেইকাই অনুষ্ঠানে থুক্কু স্বরনসভায় কি পরিধান করিয়া যাইবো তাহা নিয়া অস্থির হইয়া গিয়াছিলাম। গত বছর ঈদে শ্বশুর বাড়ি হইতে উপহার পাওয়া একখানা শার্ট বউ আলমিরা হইতে বাহির করিয়া চক্ষুর সামনে ধরিয়া কহিল-
এইডা পইড়া যাইবা, এইডা পরলে তোমারে সাব সাব লাগে।
-তোমার বাপে দিছেনা, পড়লেতো সাবই লাগবো ! তোমার বাপের উচিত আছিলো শার্ট পড়ন ছাড়াই সাব লাগে এমন একখান সাবের লগে তোমারে বিয়ে দেওয়া !!
শার্টখানা বিছানায় ছুড়ে ফেলিয়া লক্ষী বউ আমার চোখের জল মুছিতে মুছিতে রুম ত্যাগ করিলো।
আমি আয়নার কাছাকাছিই দাঁড়াইয়া ছিলাম, তাই মুখ ঘুরাইতেই আয়নায় নিজ চেহারাখানা দেখিতে পেলুম। পাশের বাসার জানালা দিয়ে সক্কাল সক্কাল চায়না মেশিনে গানের সুর ভাসিয়া আসিতেছে-
“যাবার আগে কিছু বলে গেলে না….....”
সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর, ছাতা বগলদাবা করিয়া, মাথার উপর একহাত সূর্যের চারখানা আঙুল সঙ্গী করিয়া হাটা দিলাম বড়বাড়ির উদ্দেশ্যে। নেতার বাপের বাড়ি; বিশাল তার আয়তন ! তাই সবাই বড়বাড়ি বলিয়াই ডাক-খোজ পারে। যথাসময়ে সভায় হাজির। মন্টু আমারে দেখিয়া বেশ খুশী হইলো।
প্যান্ডেলের শেষ প্রান্তে জনসাধারণের বসিবার স্থানে বসিয়া সামনের দিকে উকি-ঝুঁকি মারিতেছিলাম। অবাবা! মহামান্য মহাশয়দের আগমনে শোকসভাস্থলের সামনের আসনগুলি চকচক করিতেছিল। মূল স্টেজে মৃত ব্যক্তির বৃহৎ-কার ছবির পাশে লেখা –“আমরা গভীরভাবে শোকাহত” এবং একখানা শোকচিহ্ন! শোক আমার গভীরে প্রবেশ করিতে না পারিলেও সভাস্থলের অনেকের মুখেই শোক উপচে পড়িতেছিলো। ছোট ছোট বর্ণে আরো জানি কি লিখা আছে, দুর হইতে স্পষ্ট দেখিতে পারিতেছিলাম না। স্মরণসভা শুরু হইলো।
এক একজন বক্তা স্তুতি এবং ভালো মানুষিগিরির সার্টিফিকেট পাঠ করিতে করিতে মুখে ফেনা তুলছিলেন। ডিটারজেন্টের ফেনার সাথে এই ফেনার পার্থক্য হইলো ডিটারজেন্টের ফেনা কাপড়ের ময়লা সাফ করে, আর মহামান্য অতিথিদের প্রশংসা বাক্যের ফেনা অপকর্মের দাগ পরিষ্কার করে। বড় বাড়িতে বড় সাইজের কুকুর আছে, কুত্তাডা ছরি কুকুরটি মাঝে মধ্যে বক্তব্যের মাঝে মাঝে ঘেউ ঘেউ করিতেছিল। বড়কর্তার নির্দেশে মুহূর্তেই কুকর নামের প্রাণীটিকে বাড়ি হইতে অজ্ঞাত স্থানে স্থানান্তরিত করা হইলো। আহারে কুকুর তুই বুঝিলেও মানুষ বুঝিতেছে না।
বক্তা বদলাইতেছে কিন্তু বক্তব্য একই ভাষায় চলিতেছে। বাংলা সিনেমার নাম- “বড় ভালো লোক ছিলো” বাক্যটির বিশ্লেষণে এইট পাশ নেতা হোক আর পিইচডি ডিগ্রীধারী ডক্টর কেউই কম যাচ্ছিলেন না। আমার পেটে তো ক্ষুধা বাবাজী ডাকাডাকি শুরু করিলো। কী মুশকিল আগেতো স্মরণে স্মরণে ভরন হইবে তারপর ভোজনপর্ব! বিষয়টা ক্ষুধা-বাবাজী মানিতে না পারিলেও আমি মানানোর চেষ্টা করিয়া যাইতেছিলাম। বাবজীর সাথে নিত্যই সংগ্রাম করিয়া আমাদের মত মানুষের জীবন- যাপন করা হইয়া থাকে।
বক্তব্য চলিতেছে শোকে শোকে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিছে পরিবেশ। নেতার চোখ লাল হইয়া উঠিয়াছে, পাশে বসা আরেক নেতা পিঠে হাত বুলাইয়া সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করিতেছে। বড়ই করুণ দৃশ্য। বড়ই করুণ সে দৃশ্য !! সবার শেষে নেতা তার ভুরি বের হওয়া পেট আগে বাড়াইয়া মাইক্রোফোনের সামনে উপস্থিত। খানা-পিনার সময় ঘনাইয়া আসিতেছে, মন আমার খুশীতে নাচিয়া উঠিলো।
নেতা তাহার বাবাকে স্মরণ করিতেছে, শুনিয়া আমার বাবার কথাও মনে ভাসিয়া উঠিলো। বাপজানের স্মৃতি হঠাৎ আমাকেও শোকাগ্রস্থ করিয়া তুলিলো মুহূর্তেই। তাই আর নেতার শোক মার্কা ভাষণে মনোযোগ দিতে পারিতেছিলুম না।
“আমার বাবা একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন.. দেশ স্বাধীন করেছেন.. যুদ্ধে উনি একটি পা হারিয়েছেন.. যত জীবন বেঁচেছিলেন দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন .....”
নেতার ভাষণের বাক্য-দ্বয় আমার কর্ণকুহরের তরল পদার্থে কম্পন সৃষ্টি করিতেই ব্রেন সিগন্যাল পাঠাইলো বুকে বা পাশটাতে। আমি দাঁড়াইয়া গেলাম, মুখ দিয়া কথা বাহির হইতেছিলোনা, তবে কাজ করিতে করিতে কর্মঠ হইয়া উঠা দুই হাতে তালি বাজিয়া উঠিলো।
অট্টহাসির ন্যায় অট্রতালি। কয়েক সেকেন্ডের জন্য পুরো সভাস্থলে কবরস্থানের নীরবতা ভর করিলো। উপস্থিত অতিথি শোকসভায় হঠাৎ এহেন তালির আওয়াজ পাইয়া হতবিহব্বল হইয়া পিছনে দৃষ্টিপাত করিলো।
এক সেকেন্ড … দুই সেকেন্ড ....... দশ সেকেন্ড
আমার তালি বাজানো বন্ধ হইতেছিলনো। অত:পর সভার ভলান্টিয়ার বাহিনী নেতার রক্তচক্ষু নির্দেশে হেঁচকা টানে আমাকে সভাস্থল হইতে বাহির করিয়া আনিলো।
চার-পাঁচজন মিলিয়া উত্তম-মধ্যম বাগধারার প্রয়োগ আমার খেটে খাওয়া শরীরের উপর চালাইতে থাকিলো। বাবাজান উত্তম-মধ্যম দিয়েছিলেন ছোটবেলায়, মানুষের গাছের আম চুরির শাস্তি হিসেবে। আজ অনেককাল পরে সেই ঘটনা মনে পড়িয়া গেল। উত্তম-মধ্যম চলিতেছে, আমার চোখে নদী বহিয়া যাইতেছে, নাহ্ আঘাতে না, বাবার কথা মনে পড়িয়া ....
ত্রাণকর্তা হইয়া বন্ধু মন্টুর আগমন ঘটিলো। প্রায় অজ্ঞান হইয়া যাওয়া আমি শুধু শুনিতে পাইলাম “ওরে চিনি আমি, ছোডবেলা থেইকাই মাথায় ওর সমস্যা আছে মেন্টাল …. মেনটাল … তার ছিঁড়া ….
আমারে বাঁচাইতে বন্ধু মন্টুর প্রচেষ্টা সার্থক হইলেও, আমার নামের সাথে মেন্টাল শব্দখানা জুড়িয়া গিয়াছিলো সেইদিন থেইকাই।
উত্তম খাবার খাওয়া না হইলেও, উত্তম-মধ্যমে একহাত ভাঙিয়া গিয়াছিলো। সেই হাত তালির মর্মার্থ অনেকেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন, বিশেষ করিয়া উপস্থিত জনসাধারণ। পরবর্তীতে নেতার আন্তরিক ভালোবাসায় আমাকে ছয়মাস পাবনা মেনটাল হসপিটালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হইয়াছিলো। তা না হইলে প্রমাণ হইতো কী করিয়া। শোকসভায় তালি বাজানোর কারণ ছিলো আমি মেন্টাল… তার ছিঁড়া।
যারা জানিতো আমি মেন্টাল নহে তাদের পক্ষে কিছুই করার ছিলোনা। যদি করিতো তবে তাহারাও মেনটাল বলিয়া গণ্য হইতো। আমার শোকে, লক্ষী বউ আর আমার পোলা-মাইয়াও মেন্টাল হইবার দশা হইয়াছিলো। একবছরেরও বেশী সময় দুই-একবেলা আহার করিয়া উত্তম খাবার খাইবার লোভ করার প্রায়শ্চিত্ত করিয়াছিলো আমার পরিবার।
যাইহোক সেই থেইকাই আমার নাম মেনটাল সুরুজ।
সুরুজ নামখানা আমার বাবা রাখিয়াছিলো। স্বাধীন দেশের লাল সূর্যের সাথে মিলাইয়া “সুরুজ মিয়া”
আমার বাবাজান একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বলিতেন দেশমাতার জন্য যুদ্ধ করিয়াছি, সার্টিফিকেট দিয়ে কী হবেরে সুরুজ ? অনেকবার তাহার মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনিয়াছি। সত্য গল্পের সত্য যুদ্ধের সত্য রাজাকার ছিলো ঐ নেতার বাপ। ধর্ষণ করিতে যাইয়া বটির আঘাতে পা গেছিলো।
বাকি গল্পটা সবারই জানা …………..
মেন্টাল উপাধি পাইলেও আমি দু:খী নই, পরজনমে বাবার সাথে দেখা হইলে বলিতে পারিবো বাবা আমি চুপ করিয়া বসিয়া থাকি নাই ……….
→অণু-গল্প বা গল্প নহে একান্তই বোকামন ভাবনা
→ ভাষা/শব্দ ব্যবহারে বিভ্রাট/দূষণে পোস্ট-দাতা বরাবরের মতই ক্ষমা-প্রার্থী। কারণ জানতে চাইলে নিচের লিংকে ক্লিক করুন।
View this link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।