হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে এত বেশি রঙিন দিন পার করেছি যে স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে। তার সঙ্গে এত স্মৃতি রয়েছে, যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। বর্তমানে যতটুকু ভালো থাকা সম্ভব ততটুকু ভালো আছি। ছোট ছেলেটির বয়স তিন হলো। সে আসলে এখন কিছুই বুঝতে পারে না, বুঝতে পারার কথাও নয়।
তাদের বাবাও বাচ্চাদের কাছে ওরকম বোকাসোকা সেজে থাকত। ইংরেজি জানি না, এ রকম বলত। বাবা তো ইংরেজি জানে না, বাবার যদি পানি খেতে ইচ্ছা করে বাবা কার কাছে পানি চাইবে, বাবাকে কি আমরা হাসপাতালে রেখে যাচ্ছি।
তাহলে বাবা বাসায় এসে আমাকে খুঁজবে না— আমি ওই মুহূর্তে এত প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হুমায়ূন আহমেদের দাফনের সময় সে ছিল, দেখেছে বাবাকে। সে বলেছিল একটি গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাবাকে।
একবেলার রান্না হুমায়ূন আহমেদ কখনো আরেকবেলা খেতেন না। তার মা-ও বলতেন, ছোটবেলায় খাবারের জন্য মাকে খুব জ্বালিয়েছেন তিনি।
কিছু যদি খাবার না থাকত তারপরও তাকে একটা ডিম হলেও ভেজে খাওয়াতে হতো। এটি বিয়ের পরও লক্ষ্য করেছি। আমার হাতে ডিম ভাজাটা পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, আমার ডিম ভাজাটা নাকি একটু বেশিই ফুলে ওঠে। তিনি কখনো একা খেতেন না।
দেখা গেল, ১২ জনের রান্না হয়েছে, তিনি তার চেয়েও বেশি মানুষ নিয়ে বসে পড়তেন। শেষমেশ দেখা যেত, বুয়াদের খাবারের জন্যও আর কিছু নেই। তার জন্মদিনের দিনটিতে অনেক রকম রান্না হতো। কিন্তু সব আইটেম থাকত খুব সাদামাটা। জন্মদিনে তিনি লাউপাতা দিয়ে শুঁটকি খেতে একটু বেশি পছন্দ করতেন।
এ ছাড়া কাঁচা পেঁপেকে আলুর মতো গোল গোল করে কাটা হতো তার জন্য। এগুলো দিয়ে মুরগির মাংস রান্না করা হতো। চিতল মাছের কোপ্তাটাও পছন্দ করতেন তিনি।
হুমায়ূন আহমেদ শিল্পীদের ভীষণ পছন্দ করতেন। রহমত আলী নামের একজন শিল্পী আছেন যিনি কাতল মাছের মাথা ভীষণ পছন্দ করেন।
তাই রহমত আলীর জন্য কাতল মাছের মাথা খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন তিনি। এতে রহমত সাহেব এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, তিনি কেঁদে ফেললেন আর বললেন, ‘স্যার আপনি আমার জন্য কাতল মাছের মাথার ব্যবস্থা করেছেন। ’ প্রিয় মানুষের আনন্দ দেখতে তিনি খুব পছন্দ করতেন। তার প্রচুর মুখোশের কালেকশন ছিল। এগুলো পরে তিনি বাচ্চাদের চমকে দিতেন।
একদিন মাটিতে শুয়ে আছেন। শোয়া অবস্থায় বললেন, ‘আমার শরীরে চাদর জড়িয়ে দাও’। চাদর দিয়ে তার শরীর মুড়িয়ে দেওয়ার পর মাথা এবং পায়ের দুই পাশে মুড়িয়ে তিনি কুমিরের মতো ভঙ্গি করলেন। এভাবে তিনি বাচ্চাদের সঙ্গে কুমির কুমির খেলতেন। বাচ্চারা এতে খুব আনন্দ পেত।
তারা বুঝত এটি হুমায়ূন আহমেদ। তারপরও বাচ্চারা আনন্দ পেত। সবচেয়ে বড় কথা বাচ্চাদের আনন্দ দিতে তিনি ভীষণ পছন্দ করতেন। এ ছাড়া তিনি বাজার করতে পছন্দ করতেন। নিউ মার্কেটের নির্দিষ্ট দোকান থেকে মাছ ও মাংস কিনতেন।
হুমায়ূন আহমেদ উপহার দিতেও খুব পছন্দ করতেন। তবে সবকিছু কেনার লিস্ট আমাকে দিতেন। লিস্ট অনুযায়ী আমি উপহারগুলো কিনতাম। একবার আমাকে বললেন, লিস্টের বাইরে দুটি পাঞ্জাবি কিনতে হবে। আমি বললাম, কার জন্য কিনতে হবে, তিনি কিছু বললেন না।
পাঞ্জাবি কেনার পর সেটি নিয়ে চলে গেলেন সোজা নিউ মার্কেটে। সেই মাছ বিক্রেতার হাতে তুলে দিলেন সেটি। এতে মাছ বিক্রেতা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আরেকটা পাঞ্জাবি দিলেন মাংসের দোকানের সেই কসাইকে। তাদের খুশি দেখে হুমায়ূন আহমেদেরও চোখ ভিজে গেল।
তাই তাড়াতাড়ি গিয়ে ওঠেন গাড়িতে। মানুষের আনন্দ দেখতে তিনি ভীষণ পছন্দ করতেন। আবার শুটিং ইউনিটের কারও জন্মদিনে তিনি প্যাকআপ করে জন্মদিন পালন করতেন। ইউনিটের মধ্যে যারা ভালো রান্না করতে পারতেন তাদের দিয়ে রান্না করাতেন। একবার হলো কি, ‘চন্দ্রকথা’ ছবির শুটিংয়ের সময় তিনি চম্পা আপাকে রান্না করতে বললেন।
তিনি খুব ভালো রান্না করতে পারেন। চম্পা আপা তাকে রান্না করে খাওয়ালেন। খাওয়া-দাওয়ার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি খেতেন অল্প কিন্তু বিভিন্ন ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করতেন। ঠিক তেমনি অন্যদেরও খাইয়ে তৃপ্তি পেতেন।
তবে কাজের সময় ভীষণ সিরিয়াস থাকতেন। এমনকি আমি কোনো কিছু না পারলে আমাকেও ধমক দিতেন। কাজের সময় তিনি আমাকে কখনো স্ত্রী বলে মনে করেননি। তাই আর ১০টা শিল্পীর মতো আমাকেও বকতেন। হুমায়ূন আহমেদ যখনই কোনো বই লিখতেন, সেটিই আমাকে পড়ে শোনাতে হতো।
গল্পের বই হোক, ব্যক্তিগত বা কোনো ইস্যুকেন্দ্রিক বই হোক তার সামনে পড়তে হতো। আমার পড়ার ধরন দেখে তিনি বোঝার চেষ্টা করতেন লেখাটি ঠিক হয়েছে কিনা। হাসির ঘটনাগুলো পড়ে হাসলে তিনি প্রশ্ন করতেন, হাসলে কেন? তা বুঝিয়ে দিতে হতো। আবার কান্নার কোনো দৃশ্যে একই কাজ করতেন। হুমায়ূন আহমেদ সবসময় আমার মন্তব্য নিতেন।
তার কিছু কিছু উপন্যাস পড়তে পড়তে শেষ হয়ে গেলেও মনে হতো যেন তা শেষ হয়নি। তার গানগুলো সব যেন জীবনের সঙ্গে মেশানো। তিনি আলাদাভাবে দু-একটি ছাড়া গান লেখেননি। যে গানগুলো লিখেছেন সেগুলো সব সিক্যুয়েন্সের মতো আলাদা গান নয়। তবে তিনি গানের চিত্রায়নের দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দিতেন।
বিয়ের পর ৮ বছর আমি তা করেছি। যেমন যমুনার জল দেখতে কালো, আমার ভাঙা ঘরে, ভাঙা চালা, নিশা লাগিল রে, এগুলো সব সিক্যুয়েন্সের গান, আলাদা কোনো গান নয়। আসলে হুমায়ূন আহমেদের গানে মাটির গন্ধ পাওয়া যেত।
হুমায়ূন আহমেদ ডাক্তারের কাছে যেতে ভয় পেতেন। সেটা নিজের অসুস্থতার ক্ষেত্রে যেমন, অন্যদের ক্ষেত্রেও তেমনি।
আমার শাশুড়ি যতবার অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি ছিলেন ততবার তাকে জোর করে সেখানে নিয়ে যেতে হতো। বিকালে যেতেন আবার চলে আসতেন। হসপিটালের ওষুধের যে গন্ধ, এটা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। এমনকি সুখকর মুহূর্ত— মানে আমার যখন বেবি হলো তখনো তিনি মাত্র ১০ মিনিট থেকে সেখান থেকে চলে এসেছেন। তকে আসলে চেকআপ করাতে হতো।
২০১১ সালে মায়ের পায়ের নি-রিপ্লেসমেন্ট করানোর কথা। তো এটা করার কথা ছিল রোজার মাঝামাঝি সময়ে। হুমায়ূন আহমেদ যখন শুনলেন তখন বললেন, তোমার মায়ের নি-রিপ্লেসমেন্ট হবে সিঙ্গাপুরে, কে যাচ্ছে সঙ্গে? তখন আমি যথারীতি বললাম বাবা যাচ্ছে। কারণ আমার ভাই দেশে থাকে না। তখন হুমায়ূন আহমেদ বললেন না, আমিও যাব সঙ্গে।
তখন তিনি আমার মাকে বললেন, আপনার নি-রিপ্লেসমেন্ট হবে আপনি একা যাবেন কেন? আমিও যাব আপনার সঙ্গে। তার কারণেই মার অপারেশনের তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হলো। তারপর আমরা সিঙ্গাপুরে ঈদের পরের দিন গেলাম আমার মায়ের নি-রিপ্লেসমেন্ট করাতে। তো মা চেকআপ করছে, হঠাত্ এ রকম দুই-তিন দিন পরে আমি যাওয়ার আগে ভাবলাম হুমায়ূন আহমেদের চেকআপ করানো দরকার। চেকআপ প্রতি বছর টুকটাক হয়।
দুই বছর আগেও একবার হার্টের চেকআপ হয়েছে। আমি তাকে বার বার বলতে থাকলাম, এসেছি যখন একটি চেকআপ করে যাই। ওটা ছিল একটি রুটিন চেকআপ। কোনো উপসর্গ ছিল না হুমায়ূন আহমেদের। হঠাত্ করে রক্ত পরীক্ষায় সিইএলএল লেভেলটা অনেক বাড়তি পাওয়া গেল।
ওই বাড়তি পাওয়ার পরেই আমরা ডাক্তারদের চেহারায় একটা ভয় দেখতে পেলাম। হুমায়ূন আহমেদের চেহরায় আসলে ভয় ছিল না। আমরাও আসলে ব্যাপারটার ভয়াবহতা বুঝতে পারিনি। তিনি তাড়াতাড়ি আমাদের সিটিস্ক্যান করতে বললেন। সিটিস্ক্যান করা হলো।
সিটিস্ক্যানের রিপোর্টে দেখা গেল টিউমার আছে এবং তাত্ক্ষণিকভাবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হলো কোলোনস্কোপির। কারণ টিউমারটা দেখা গেছে ক্লোনে। এই টিউমারটায় ক্যান্সার আছে কিনা দেখা দরকার। এটা দেখার জন্য ওখান থেকে স্পেসিস আনতে হবে। কোলোনস্কোপি করতে যাওয়ার সময় হুমায়ূন আহমেদ খুব হাসিমুখে গিয়েছিলেন এবং বলছিলেন যে, কী এক টিউমার হয়েছে, এটার জন্য এতকিছু করতে হচ্ছে, টাকা নেওয়ার ফন্দি।
কোলোনস্কোপির পর আসলে আমরা নিশ্চিত হলাম যে, হুমায়ূন আহমেদের কোলোন ক্যান্সার, যেটি কোলোন ছাড়িয়ে ব্লাডস্ট্রিমে চলে গেছে এবং লিভারে ছড়িয়ে পড়েছে। যেটাকে বলা হয় স্টেজ ফোর ক্যান্সার। এভাবেই ধরা পড়ল। এর পরের সংগ্রামের অধ্যায়টা অনেক কষ্টকর।
ক্যান্সার এমন একটা রোগ, যেটা কেমো দিয়ে পুরোপুরি সেরে তোলা সম্ভব নয়।
ডাক্তার বললেন, কেমোগুলো খুবই পেইনফুল। এগুলো দিলে হাতের রগগুলো কালো হয়ে যায়। বারোটা কেমো দেওয়ার পর ডাক্তার বললেন, এই কেমোটা দিলে কোনো রকমে বেঁচে থাকতে পারবে ছয় মাস। এটার জন্য আমরা আসলে অপেক্ষা করছিলাম না। হুমায়ূন আহমেদের মানসিক অবস্থা এমন ছিল যে, তিনি ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
যখন আটটা কেমো দেওয়া হয়ে গেল তখনো তিনি সার্জারির জন্য পুরোপুরি ফিট নন। হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন মানুষ ছিলেন যে, সে নিজেই নিজের মৃত্যু নিয়ে খুব বেশি রসিকতা করতেন। অসুস্থ হওয়ার পরেও করেছেন এবং অসুস্থ হওয়ার আগে তো অনেক করেছেন। আমি গত আট বছরে কমপক্ষে ২০ বার তার মুখে কবর নিয়ে গল্প শুনেছি। ২০-২৫ বারের সব গল্পই ছিল নুহাশ পল্লীকে ঘিরে।
তার ‘আমি’ বইটার ১৮৪ পৃষ্ঠায় তিনি নিজেই মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন। ‘...স্বপ্নে দেখছি নুহাশ পল্লীর সবুজের মাঝে কবর। তার গায়ে লিখা...। শ্বেতপাথর দিয়ে যে হবে এটাও লিখেছেন এবং কি লিখা থাকবে তাও লিখেছেন। নুহাশ পল্লীতে তার যে শোবার ঘরটি ছিল, সেখানে তিনি সকালে বসতেন এবং সন্ধ্যায় বসে চা খেতেন।
সেখান থেকে বসে লিচু গাছটা দেখা যায়। তিনি প্রায়ই সেখানে বসে বলতেন, ওই যে লিচু গাছ ওখানেই আমার কবর হবে। উনি আমাকে বলতেন নুহাশ পল্লীর প্রতিটা গাছই আমাকে চেনে। অপারেশন হওয়ার আগে কারও কাছে ক্ষমা চাওয়া, অসম্পন্ন কাজগুলো সম্পন্ন করে যাওয়ার কথা যখন বলতেন তখন আমি তার সঙ্গে ছিলাম। আমাকে তিনি যে কথাটি বলে গেছেন আমার দায়িত্ব তার সেই কথাটা রাখা।
তিনি নুহাশ পল্লীকে কত ভালোবাসতেন এটা আমি জানি, আমি তার সঙ্গে মিশছি, তার পরিবারের প্রত্যেকটি লোক জানেন। আমি নিশ্চিত আমার চেয়ে একটু বেশি হলেও জানেন তার মা। হুমায়ূন নুহাশ পল্লীকে কতটা ভালোবাসতেন। তিনি শেষের বার যখন বাংলাদেশে এলেন, তখন এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যাননি। ২২ ঘণ্টা প্লেনে চড়ে কেমো দেওয়া শরীর নিয়ে একটু কাহিল হননি।
সব সাংবাদিক এবং টিভি চ্যানেল দেখেছে, প্লেন থেকে নেমে গাড়িতে উঠে সরাসরি চলে গেলেন নুহাশ পল্লীতে এবং নুহাশ পল্লীতে যাওয়ার পর তিনি বিশ্রাম নিতে ঘরে ঢোকেননি। সরাসরি চলে গেলেন গাছগুলোর কাছে।
২০১২ সালের ১৯ জুলাই তিনি যখন মারা গেছেন আমার বাঁ হাতটা তার মাথার নিচে ছিল। তার ডান হাতটা আমার ডান হাত দিয়ে ধরা ছিল। যারা ওখানে ছিলেন তারাই দেখেছেন এবং তারাই জানেন।
তেমন একটা ভয়ঙ্কর মুহূর্ত দেখে আসা, আমার বড় ছেলের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। এগুলো আসলে বলার মতো নয়। তার ওপর আবার আসার জন্য প্লেনের টিকিট পাচ্ছি না। তখন শুধু শুনেছি আমাদের টিকিট দেওয়া হবে। কোন ক্লাসের টিকিট দেবে এমন প্রশ্ন করার মতো মানসিকতা ছিল না তখন।
আমাদের টিকিট পাওয়া গেছে ২০ জুলাই আর হুমায়ূন আহমেদের টিকিট পাওয়া গেছে ২১ জুলাই। তখন আমি বললাম হুমায়ূন আহমেদকে রেখে আমি কোথাও যাব না। এটা আমি বলেছি। আমি তার সঙ্গে একই প্লেনে এসেছি। একই প্লেনে ফিরব।
ওখানে যারা ছিলেন তারা শুনেছেন। নিউইয়র্কের বাইরের একটি ট্রাভেল এজেন্সির কারণে অনেক কষ্টে হলেও আমরা টিকিট পেয়েছিলাম। আমি তখন খুব অসুস্থ ছিলাম, আমাকে হুইল চেয়ারে করে প্লেনে উঠতে হয়েছে, নামতে হয়েছে। আমি নিজেও টের পাইনি, সারা দিন আমার পেটে কিছুই পড়েনি। আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা, আমার মা আমাকে শুধু স্যালাইন খেতে দিয়েছিলেন।
আমার কনফিডেন্সের উত্স একজনই। একজন হুমায়ূন আহমেদ। যিনি চাইলে অনেক কিছু করতে পারতেন। কিন্তু করতে পারতেন না। আমি এ রকম ফিল করেছি।
তিনি আমাকে এ রকমটা ফিল করিয়েছেন যে তার একজন সাপোর্ট বলব না— পথচলার একজন সঙ্গী দরকার। আরেকটা প্রশ্ন ছিল তার রাজকীয় জীবন। সত্যিকার অর্থেই তিনি রাজকীয় ছিলেন। তিনি যত গরিবই থাকুন না কেন পকেটে অল্প কিছু টাকা এলেই বন্ধুবান্ধব নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। কখনো একা বেড়াতেন না।
দলবল নিয়ে এ টাকাটা খরচ করতেন। বিদেশ চলে যেতেন। বিদেশ যাওয়ার যখন সামর্থ্য হয়নি তখন কক্সবাজার চলে যেতেন। এমনকি স্কলারশিপের টাকা পেয়েও তিনি একা কক্সবাজার ঘুরতে গেছেন। এটা তার বইতেই আছে।
হুমায়ূন আহমেদের পকেটে কিছু টাকা জমলেই নাকি তার পকেট কচকচ করত। তিনি ভাবতেন কি করি কি করি। টাকাগুলো খরচ করা দরকার। একটু বেড়িয়ে আসি। হুমায়ূন আহমেদ রাজকীয়ভাবে সব সময়ই চলতে চাইতেন।
ইচ্ছাগুলো কখনোই অপূর্ণ রাখতেন না। আমিও সমর্থন করতাম। হুমায়ূন আহমেদের এই যে রাজকীয় চাওয়া ব্যক্তিগত খরচে বন্ধুবান্ধব নিয়ে বিদেশ যাওয়া এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে আমার অবদান বলব না, তবে আমার সায় ছিল। তার আনন্দে আমার সব সময় সায় ছিল। সেটা যদি আমার জন্য কিঞ্চিত্ নিরানন্দও হয়, তবুও আমার সায় ছিল।
বিশেষ করে তার জন্মদিনের স্মৃতি আমাকে নয়, সবাইকেই নাড়া দেয়। কারণ জন্মদিনের দিনটাতে তার দরজা সবার জন্য খোলা থাকত। ১২ তারিখ রাত থেকেই শুরু হয়ে যেত ভক্ত ও পাঠকদের আনাগোনা। পর দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত চলত এই হইহুল্লোড়। তিনি ভীষণ সুন্দর করে গল্প বলতে পারতেন।
সবাই মুগ্ধ হয়ে তার গল্প শুনত। তার গল্প সবাইকে হাসাতো, কখনো কখনো চোখের পাতা ভিজিয়ে দিত। আরেকটি কথা না বলেই পারছি না। জোর করে কখনো কেউ তাকে কেক খাওয়াতে পারতেন না। তিনি অনেকটা লাজুক স্বভাবের ছিলেন।
তবে বিশেষ এই দিনটাতে মায়ের তুলে দেওয়া কেক মুখে দিতেন তিনি। অবশ্য আমিও বেশ কয়েকবার তাকে নিজ হাতে কেক খাইয়েছি। বলতে পারেন অনেকটা জোর করেই। হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে কী উপহার দেব তা সবসময় ভেবে রাখতাম। তার জন্মদিনে বেশির ভাগ ভাস্কর্য বা মূর্তি জাতীয় উপহার দিতাম।
কখনো কখনো বইও দিয়েছি। তবে ২০০৭ সালের একটা ঘটনা বলি, তখন আমার বড় ছেলে হয়েছে। তিনি নিষাদের ছবি তুলতে খুব পছন্দ করতেন। সুযোগ পেলেই সন্তানের ছবি তুলতেন। তা ছাড়া ছবি তোলার অনেক ম্যাটেরিয়ালস ছিল তার কাছে।
তিনি শিলা ও বিপাশারও অনেক ছবি তুলেছেন। তিনি শুধু ছবিই তুলতেন না, সেগুলো আবার প্রিন্ট করে বড় করতেন। তাই মনে হলো তাকে স্পেশাল একটা ক্যালেন্ডার বানিয়ে দেব। এটাই হবে জন্মদিনের বিশেষ উপহার। আমার আট মাসের ছেলেকে হিমু, শুভ্র ও দেবদাস সাজিয়ে বিভিন্ন ছবি তুললাম।
এর পর এসব দিয়ে চার পাতার একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করলাম। নাম দিলাম ‘হুমায়ূন ক্যালেন্ডার’। ক্যালেন্ডার তো শুরু হয় জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে আর শেষ হয় ডিসেম্বরের ৩১-এ। কিন্তু আমি ক্যালেন্ডারটি বানিয়েছিলাম ১৩ নভেম্বর থেকে পরের বছরের ১২ নভেম্বরের তারিখ দিয়ে। এ উপহার পেয়ে তিনি ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলেন।
এটি ১০০ কপি করিয়ে প্রিয়জনদের উপহার দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, তোমরা এভাবে ক্যালেন্ডার বানিয়ে অন্যদের সারপ্রাইস দিতে পার। তিনি খেতেন খুব অল্প। কিন্তু তার খাবারের মেন্যুতে বিভিন্ন ধরনের আইটেম থাকত।
তার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করছি। আপনজনদের সবসময় কাছে পেয়েছি।
শক্তি কতটুকু আছে তা জানি না। তার অসম্পূর্ণ লেখা আর নেই। আর থাকলেও তা সম্পূর্ণ করার ক্ষমতা কারও নেই। তার শিশুসন্তান দুটিকে চোখের সামনে বড় হতে দেখতে না পারাটা তার আরেকটি অসম্পূর্ণ কাজ। এই কাজটিকে যথার্থ ও পূর্ণাঙ্গভাবে শেষ করতে হবে।
হুমায়ূন আহমেদের তখনো রোগ ধরা পড়েনি। কিন্তু জানি না তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কিনা। সবসময় বলতেন নিষাদ, নিনিত বোধহয় বেশিদিন তাদের বাবাকে পাবে না। তখনো বুঝতে পারিনি সত্যি সত্যি সবাইকে ছেড়ে চলে যাবেন। এ ছাড়া নেত্রকোনায় শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ নামে তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
এটি সম্পূর্ণ নিজের অর্থায়নে চালাতেন। এই স্কুলকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। তিনি চাইতেন স্কুলটি ঢাকার স্কুলের সঙ্গে ফাইট করুক। একজন স্থাপত্যের মানুষ হিসেবে স্কুলটির ডিজাইন আমি করেছি। এটি ছিল আমার প্রথম কাজ।
আমার নিজেরই স্কুলটির প্রতি মায়া পড়ে গেছে। স্কুলটি এখন ভালোভাবে চলছে। আমার স্বপ্ন এটি ভবিষ্যতে এমপিওভুক্ত হবে। কিছু মানুষ স্কুলের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। চেষ্টা করছি সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ চেষ্টা চালিয়ে যাব।
অনুলিখন : শামছুল হক রাসেল
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।