আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোমল পানীয় সত্যই ‘কোমল’ নয়....তাই পরিহার করা উত্তম

আমি একা নই......আরও অনেকে আমার সাথে । ‘কী খাবেন, ড্রিংকস, নাকি জুস?’ কাউকে এমন প্রস্তাব দেওয়া হলে খুব কম লোকই উত্তর দেবে, ‘না, আমার এক গ্লাস সাদা পানি হলেই চলবে। ’ কারণ আমাদের প্রচলিত ধারণা, এক গ্লাস কার্বনেটেড ড্রিংকস (কোমল পানীয়) বা ফলের রস অনেক বেশি ক্যালরি-বর্ধক। আর সাদা পানি তো কেবল সাদা পানিই। এছাড়া বাজারে হাতের নাগালেই পেয়ে যাবেন নাম জানা-অজানা নানান কোমল পানীয় অর্থাৎ যাকে আমরা আদর করে ডাকি এনার্জি ড্রিকংস।

আমরা অনেকেই জানি না যে এই সব এনার্জি ড্রিকংস গুলোতে আসলে কি থাকে। তবে খেতে অবশ্য বেশ মজা পাই। কারণ কোমল পানীয়গুলো আসলে খেতে ভারি মজাদার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নাম কোমল পানীয় হলেও তা কি সত্যি আমাদের দেহের জন্য কোমলীয়? না একদম না। কোমল পানীয় আমাদের দেহের জন্য মারাত্তক ক্ষতি কর।

তথ্যগত বিভ্রান্তির ফলে আমরা অনেক সময় আমাদের আচরণে চূড়ান্ত বোকামীর প্রকাশ ঘটাই। এর মধ্যে সবচেয়ে হাস্যকর বোকামীটি হচ্ছে বিয়ে ও নানা সামাজিক উৎসবে ভরপেট খাওয়ার পর কোমল পানীয় পান। আমাদের অধিকাংশেরই ধারণা হলো তখন কোমল পানীয় পান করলে খাবারটা ভালো হজম হবে। এ ধারণার অসারতা বুঝতে কিছু তথ্য জানা প্রয়োজন। খাবার সবচেয়ে ভালো হজম হয় যখন পাকস্থলীর তাপমাত্রা থাকে ৩৭ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড।

এ তাপমাত্রায় পাকস্থলীর এনজাইম খাবার হজমের জন্যে সবচেয়ে উপযোগী অবস্থায় থাকে। কিন্তু ভরপেট খাওয়ার পরই আপনি যখন আপনার পাকস্থলীতে শূন্য থেকে চার ডিগ্রী তাপমাত্রার কোমল পানীয় ঢেলে দেন তখন স্বাভাবিকভাবেই হজমের পুরো প্রক্রিয়াটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। হজমের বদলে তখন পাকস্থলীতে থাকা খাবার গাঁজন প্রক্রিয়ায় পঁচতে শুরু করে। কোমল পানীয় পানের কিছুক্ষন পর খাবার হজমের লক্ষন মনে করে আপনি যে তৃপ্তির ঢেকুরটি তোলেন তা আসলে খাবার পচনের ফলে সৃষ্ট গ্যাস। বর্তমানে তরুন প্রজন্মের মধ্যে কোমল পানীয় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

মিথ্যা প্রচার আর মন মাতানো বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে এ যুগের মানুষ কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকসের প্রানঘাতী ফাঁদে পা দিয়েছে। জনগণের মাটির তলার পানি বোতলে ভরে ভরে রং আর চিনি দিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে আজ মানুষকে ঢালিউডের নায়ক, কাল বলিউডের নায়িকা, পরশু হলিউডের ভিলেন বানানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকসসহ এরকম যত কৃত্রিম ও প্যাকেটজাত পানীয় রয়েছে তাতে কোনো উপকারী উপাদানতো নেই-ই বরং এগুলোতে প্রচুর ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে। তাই এসব জঞ্জাল শরীরের জন্যে সত্যিকার অর্থে অপ্রয়োজনীয়। কারণ শরীরে পানির চাহিদা মেটাতে সাধারণ বিশুদ্ধ পানীয় জলই যথেষ্ট।

আপনি আপনার বন্ধুদের একটা জাদু দেখাতে চান। আপনার ধবধবে সাদা মুক্তোর মতো দাঁতগুলোকে আপনি ১ ঘণ্টার মধ্যে স্থায়ীভাবে হলুদ করে ফেলবেন। কিছুই না, এক ঢোক কোলা মুখে নিয়ে ১ ঘণ্টা ধরে রেখে দিন। ব্যস, এনামেল ক্ষয়ে দাঁতগুলো হলুদ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, টয়লেট পরিস্কার করতে হারপিক না নিয়ে একটি কোক নিয়ে যান।

কোকটা ভেঙ্গে টয়লেটে ঢেলে দিন। এক ঘন্টা অপেক্ষা করে ওয়াস করুন। দেখবেন হারপিকের চেয়ে বেশী পরিস্কার হয়ে গেছে। মটর সাইকেল কিংবা গাড়ির নাটবোল্ট আটকে গেছে। একটু কোক ঢেলে দিয়ে অপেক্ষা করুন।

ব্যাটারীতে জং ধরেছে, তাতেও কোক দিন। কাপড়ে মাংসের ঝোল পড়লেও কোক ব্যবহার করতে পারেন। কবরে মানুষের দাঁত বহু বছরেও নষ্ট হয় না। এক গ্লাস কোকের ভেতর মানুষের একটি দাঁত রেখে দিন। দেখবেন এক সপ্তাহের মধ্যে দাঁতের অস্তিত্ব খুঁজে পাবেন না।

দ্রুত বৃদ্ধ হতে চাইলে নিয়মিত কোক খান। কোমল পানীয়তে নেশার উপকরণ মিশিয়ে শিশু-কিশোরদের নেশাযুক্ত পানীয়তে অভ্যস্ত করে তোলার নীলনকশা তৈরি করা হয়েছে বেশ আগে থেকেই। গবেষণা ও পরীক্ষাগারে সিংহভাগ কোমল পানীয়তে নেশার উপকরণ ক্যাফেইন থাকার প্রমাণ মিলেছে। এ কারণে শিশু-কিশোররা একবার কোমল পানীয় পান করলে বারবার তা পান করতে উৎসাহিত হয়। আর এ আসক্তির মূল কারণ হলো ক্যাফেইন।

কয়েক বছর আগে একটা পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রচ্ছদ করেছিল > কোমল পানীয় চুমুকে চুমুকে শরীর ক্ষয়। ইন্টেরেস্টিং ব্যাপার হলো পত্রিকা প্রকাশের পরের দিন একটা পত্রিকাও বাজারে খুঁজে পাওয়া যায়নি এর কারণ হচ্ছে কোমল পানীয় কোম্পানিগুলো বাজার থেকে সব পত্রিকা কিনে নিয়েছে। এই কোমল পানীয় পান না করলে আমাদের স্ট্যাটাস রক্ষা হয় না, কারো ভাব থাকে না। আসলে কি আছে এইসব পানীয়তে কেনই বা সব পত্রিকাগুলো কিনে নিল । বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কোমল পানীয় সেবনের ব্যাপারে কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।

তাদের মতে, কোমল পানীয় পানে অভ্যস্ত হলে মূত্রাশয়, মস্তিষ্ক ও পাকস্থলীতে ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, হাঁপানিসহ ফুসফুসের নানা জটিল ব্যাধি এবং ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন কোমল পানীয়তে নেশাকর পদার্থ ছাড়াও বিষাক্ত পদার্থ থাকতে পারে বলে দীর্ঘদিন থেকে যে সংশয়-সন্দেহ জনমনে দোলা দিচ্ছিল তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। হার্ভার্ড পাবলিক স্কুলের গবেষকরা বোস্টনের ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, যে যত বেশী কোমল পানীয় পান করে, তার ভায়োলেন্ট হবার সম্ভাবনা তত বেশী। যারা সপ্তাহে এক ক্যান বা তারও কম কোমল পানীয় পান করেন, তাদের মধ্যে ২৩% সাথে ছুরি বা বন্দুক রাখেন, ১৫% তাদের প্রেমিক বা প্রেমিকাকে শারীরিক নির্যাতন করেছেন, আর ৩৫% সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মারামারি করেছেন। অন্যদিকে যারা সপ্তাহে ১৪ ক্যান কোমল পানীয় পান করছেন, তাদের মধ্যে ৪৩% সাথে ছরি বা বন্দুক রাখেন, ২৭% প্রেমিক প্রেমিকাকে শারীরিক নির্যাতনভাবে করেছেন এবং ৫৮% এরো বেশী সহপাঠী বন্ধু-বান্ধবদের সাথ মারামারি করেছেন।

সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই) ২০০৩ সালে কোমল পানীয় হিসেবে বিক্রীত ১১টি ব্র্যান্ড নিয়ে একটি গবেষণা করে দেখেছে, ওইসব পানীয়তে কীটনাশকের পরিমাণ অনেকগুণ বেশি। কোক-পেপসির ৫০ শতাংশ বোতলেই ম্যালাথিয়ন বিষ পেয়েছে। এই বিষ শহর এলাকায় মশা ও পোকামাকড় মারার জন্য ব্যবহৃত হয়। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই পশ্চিমা বিশ্বকে আমাদের অগ্রপথিক মনে করি কিন্তু আমরা সবাই কি জানি, আমেরিকা ও কানাডার অধিকাংশ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে কোমল পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকস বিক্রয়ের মেশিন বাধ্যতামূলক ভাবে অপসারণ করা হয়েছে? অনেক ক্যাম্পাসে কামল পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকস বিক্রিও নিষিদ্ধ। মনোলোভা আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের মোহে শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সের ভোক্তারা কোমল পানীয় কিনে নিজের অজান্তে সস্নোপোয়েজন শরীরে প্রবেশ করাচ্ছে।

কোমল পানীয়ের ভোক্তা ও বিপণন নেটওয়ার্কের ব্যাপক প্রসার জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। জনমত গড়ে না উঠলে কোমল পানীয়ের ভোক্তা ও বিপণন নেটওয়ার্ক বিস্তার রোধ দুরূহ হবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কোমল পানীয়ের বাজার সম্প্রসারণে বিপুল অর্থ ব্যয় করে। কোমল পানীয়ের বিক্রয় মূল্য অপেক্ষা উৎপাদন মূল্য একেবারেই সামান্য। কোমল পানীয়ের বিজ্ঞাপনে ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ উৎপাদন ব্যয়ের বহুগুন।

বিজ্ঞাপনে ব্যয়িত অর্থ যোগ করে বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করা হয়। ভোক্তাদের অর্থে মনোলোভা বিজ্ঞাপন দিয়ে কোমল পানীয়ের নামে বিষ ভোক্তাদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে কোমল পানীয় বাণিজ্যিক বিলাসী পানীয়তে পরিণত হয়েছে। কেবলমাত্র জনমত তৈরি করেই বাণিজ্যিক বিলাসী পানীয়তে পরিণত হওয়া নীরব ঘাতক কোমল পানীয়ের সহজলভ্যতা কমিয়ে আনা সম্ভব। আমাদের দেশে কোমল পানীয়ের বৃহদাংশের ভোক্তা শিশু-কিশোর।

বলা যায় কোমল পানীয়ের ক্ষতির শিকার হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকরাই। এই ক্ষতির পরিমাণ যে অপরিমেয় তা সহজেই অনুমেয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর উচিত নিজেদের নাগরিকদের এই ধরনের পানীয় কম খেতে উদ্বুদ্ধ করা। বিষাক্ত কোমল পানীয় বেচা-কেনা বন্ধে সরকারের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। জাতিকে সুস্থ, সবল ও নেশামুক্ত রাখা সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।

জনস্বাস্থ্যের ভাবনা মাথায় রেখে নরওয়ে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডসহ বিশ্বের আরো কয়েকটি দেশে কোমল পানীয় উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশেও সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা যায় কিনা তা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। দেশব্যাপী খাদ্যে ভেজাল, ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার বিষয়ে যে রাষ্ট্রীয় মনোযোগ তৈরি হয়েছে সেখান থেকেই এসব কর্পোরেট পানীয় বিষয়ে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং পাশাপাশি আমাদের জনগণের ভেতর প্রচলিত পানীয় রীতিকেই আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগে আরো জোরদার কায়দায় যুক্ত করতে হবে। সুত্র: লিঙ্ক  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।