তার নাম ঢাফিক রিজকি। ২৯ বসন্তের টগবগে যুবতী। পরনে তার টি-শার্ট। তাতে কার্টুন আঁকা। কোমরে পরে আছেন কোঁচকানো জিন্স।
পায়ে সুন্দর স্যান্ডেল। দেখে যে কেউ ধরে নেবেন তিনি শিল্প এলাকা বেকাসিতে কোন চাকরিতে যাচ্ছেন। এই বেকাসিতে রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের শিল্প কারখানা। রয়েছে কনভার্স ও স্যামসাং-এর মতো প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রিজকিকে নিয়ে কেউ যদি ভেবে থাকেন যে তিনি ওই এলাকায় চাকরি করতে যাচ্ছেন তাহলে তার ধারণা ভুল।
বেকাসি’র একটি এলাকা টেন্দা বিরু। সেখানে রিজকি বারে যান। সেই বারে প্রতি রাত ৯টা থেকে ভোর ৩টা পর্যন্ত তাকে নাচতে হয়। দূর দূরান্ত থেকে সেখানে সমবেত ট্রাকচালক ও কারখানার শ্রমিকদের মনোরঞ্জনে তাকে এতটা সময় নাচতে হয়। শুধু কি তাই! না, তাদের চাহিদা অনুযায়ী রিজকি তার দেহ বিলিয়ে দেন।
বিনিময়ে পান অর্থ। চার বছর আগে তিনি পশ্চিম জাভায় অবস্থিত তার বাড়ি ছেড়ে এই শিল্প শহরে এসে মাথা গুঁজেছেন। বেছে নিয়েছেন যৌনকর্মী, বার নর্তকির কাজ। তিনি বলেন ভাই, সে এক লম্বা ইতিহাস। আমি তো এ পেশায় আসতে চাইনি।
ইন্দোনেশিয়ায় গরিব নারীদের এটা একটি সাধারণ ঘটনা। গরিব টিনেজ মেয়েদের বিয়ের পরই তার বেশির ভাগ ভেঙে যায়। ফলে তারা বাধ্য হয়ে দেহ ব্যবসা বেছে নেয়। রিজকি বলেন, এই সংকীর্ণ পথে, ঘৃণিত পথে তিনি এখন তার নিত্যদিনের কাজ করে আনন্দই পান। প্রতি রাতে তিনি দু’ থেকে তিন জন করে খদ্দের পান।
সপ্তাহান্তে তা পাঁচে দাঁড়ায়। ফলে এক সপ্তাহে রিজকির আয় হয় ৫০ ডলার পর্যন্ত। এ দিয়ে তিনি বাসা ভাড়া এবং তার ‘সর্দারনি’কে পাওনা পরিশোধ করেন। কিন্তু এ পথে এইডসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। রিজকি ও তার বান্ধবী মেলি (২৫) দু’জনই বলেছেন, তারা এইডস থেকে সুরক্ষিত।
কারণ, তারা খদ্দেরকে নিরাপদ দৈহিক মিলনে উদ্বুদ্ধ করেন। মেলি বলেন, যদি খদ্দেররা কনডম পরতে রাজি না হয় তাহলে তাকে আমরা দূরে সরিয়ে দিই। রিজকি ও মেলি এইডস থেকে মুক্ত থাকলেও সেখানে যে ২৫০ জন নারী কাজ করে তার মধ্যে ২৫ জনের দেহে আছে এইচআইভি। লন্ডনের অনলাইন ইন্ডিপেন্ডেন্ট এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে এসব কথা।
এশিয়ায় সবচেয়ে দ্রুত গতিতে যেসব দেশে এইডস ছড়িয়ে পড়ছে তার মধ্যে ইন্দোনেশিয়া অন্যতম।
এখন তা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। এখন সেখানে এইচআইভিতে আক্রান্তের হার শতকরা ০.২ ভাগ। এ হার এখনও আফ্রিকার অনেক দেশের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু গত ৬ বছরে সেখানে নতুন এইডস আক্রান্তের হার বেড়ে গেছে তিনগুণ। উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ শারীরিক সম্পর্ক।
ইনট্রাভেনাস ড্রাগ (যা ইনজেকশনের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়) ব্যবহারও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। টেন্ডা বিরু এলাকায় বিনামূল্যে কনডম সরবরাহ দেয়া হয় একটি এনজিও থেকে। এই এনজিওটি এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়া মোকাবিলায় অর্থ পেয়ে থাকে গ্লোবাল ফান্ড থেকে। এছাড়া তারা তিন মাস পর পর বিনা পয়সায় ভ্রাম্যমাণ কিনিকের মাধ্যমে এইচআইভি পরীক্ষা করে থাকে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতি অনুযায়ী, কনডমের ব্যবহার একটি বড় সমস্যা।
পুরুষরা এ জিনিসটি ব্যবহার করতেই চায় না। অন্যদিকে নারীরা অসহায়। তারা এক্ষেত্রে তার পুরুষ সঙ্গীকে কনডম ব্যবহারে বাধ্য করতে পারে না। তাই ইন্দোনেশিয়ায় আক্রান্তদের তিন-চতুর্থাংশ এইচআইভিতে আক্রান্ত হচ্ছেন অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের কারণে। এক হিসাবে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ায় ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের কারণে এইচআইভিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে কনডমের ব্যবহার নিয়ে এখন চলছে আদর্শগত লড়াই। ইসলামী গ্রুপগুলো এর বিরোধী। আফ্রিকায় ক্যাথলিক চার্চের যাজকরা এরকম অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা তখন অজুহাত তুলেছিলেন যে, ভাইরাস কি এতই ুদ্র যে পাতলা একটি পর্দা দিয়ে তাকে ঠেকানো যাবে। ইন্দোনেশিয়ার নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. নাফসিয়া মোই।
তিনি জাতীয় এইডস কমিশনের সাবেক প্রধানও। গত জুনে তিনি সরকারে যোগ দিয়েছেন। তারপর থেকেই তিনি যেন অগ্নিপরীক্ষার মুখে রয়েছেন। তিনি ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের শারীরিক সম্পর্ককে নিরাপদ করার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু ইসলামপন্থি ইসলামিক ডিফেন্ডারস ফ্রন্ট (এফপিআই) এজন্য পারে তো তাকে রাজপথে নামিয়ে এনে ঝাল ঝাড়ে।
হালের পশ্চিমা দুনিয়ার বহুল আলোচিত সংগীত শিল্পী লেডি গাগার একটি কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল রাজধানী জাকার্তায়। কিন্তু এফপিআই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তা থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। নিরাপদ যৌন সম্পর্ক নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোই ইউটিউবে একটি ভিডিও পোস্ট করে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। এতে তিনি বলেন, তিনি হাইস্কুল পড়–য়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা পয়সায় কনডম বিতরণের কথা বলেছেন। কারণ, শিশুসহ যে কোন বয়সী মানুষই অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের কারণে এইচআইভিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এজন্য তাকে পার্লামেন্টে তলব করা হয়। সেখানে তাকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। কিন্তু পার্লামেন্টে তিনি সংগঠিত হিজবুত তাহরিরের প্রতিবাদের মুখে পড়েন। তারা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ‘ফ্রি সেক্সে’ উদ্বুদ্ধ করার দায়ে অভিযুক্ত করে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যে পদক্ষেপ নিয়েছেন সে বিষয়ে ইন্দোনেশিয়ার মহিলা বিষয়ক সাবেক মন্ত্রী তুতি আলায়িয়া জাকার্তা পোস্টকে বলেন, কনডম বিতরণ করা হলে তাতে বিবাহ-বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ককে উৎসাহিত করবে।
তিনি বলেন, জাতীয় মূল্য বোধকে জাগ্রত করে এই রোগ থেকে দূরে থাকা যায়। এইচআইভি প্রতিরোধ ঠেকাতে ইতিবাচক পথ আছে। তাহলে কেন আমরা পশ্চিমা ধারা অনুসরণ করব?
বেকাসিতে যে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় সেখানে কোন পশ্চিমা ধারা নেই। খদ্দেররা সবই ইন্দোনেশিয়ার। একই ধারায় সারা ইন্দোনেশিয়ায় যৌন বাণিজ্য বিস্তার লাভ করছে।
এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, এমন কোন বাস টার্মিনাল নেই যার পাশে কোন পতিতালয় নেই। যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে একটি পরামর্শদাতা গ্রুপ। এটি পরিচালনা করেন আলদো সারাগি। তিনি রক্ষণশীলদের তীব্র সমালোচনা করেন। বলেন, তারা যৌন শিক্ষা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে না দিয়ে এবং জাতীয়ভাবে সে শিক্ষা না দিয়ে যৌন বাণিজ্যকে আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
যৌনকর্মীদের শতকরা মাত্র ৩০ ভাগ বিশ্বাস করেন যে শারীরিক সম্পর্কের আগে কনডম ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে পুরুষের শতকরা হার মাত্র ১০ ভাগ। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ধর্মীয় গ্রুপগুলো এইচআইভিকে অপরাধের ফল বলে দাবি করেন। কিন্তু এ ব্যবসা চলছে এবং চলবে। কারণ এর যথেষ্ট চাহিদা আছে সমাজে।
যখনই কোন হোটেল, গাড়ি পার্কিংয়ের স্থানে যৌনকর্মীদের আস্তানা ভেঙে দেয়া হয় তখন তা এইচআইভি/এইডস সৃষ্টিতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। রিজকি ও মেলির মতো যৌনকর্মীরা এ পেশায় আসতে বাধ্য হয়েছেন। গত ১০ বছরে ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতিতে ঋণখেলাপি, বিধ্বস্ত অর্থনীতি থেকে ফিরে এসেছে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়, যেখানে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৬ ভাগ। এতে জাকার্তায় দেখা দিয়েছে মেগামল। বাড়ছে হাই রাইজ বিজনেস হোটেল।
তাতে বোঝাই এশিয়া প্রশান্ত অঞ্চলের বিনিয়োগকারীরা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার শৈশব কাটিয়েছেন এখানে। তিনি তারপর প্রথম যখন এখানে ফিরে গিয়েছেন তখন তিনি এর অনেক কিছুই চিনতে পারেননি। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু ধর্মীয় সহিষ্ণুতার অভাব বৃদ্ধির পাচ্ছে।
এজন্য লেডি গাগার কনসার্ট বাতিল হয়েছে। এসব কারণে ইন্দোনেশিয়ায় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে হুমকি দেখা দিয়েছে। গত কয়েক মাসে খ্রিষ্টানদের চার্চ ও মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় জাতিগত সহিংসতায় লিপ্ত। কোন কোন এলাকায় নারীদের নিরাপদে চলতে বলা হয়েছে। গত মাসে ফেসবুকে সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য লেখার জন্য এক নাস্তিক সরকারি কর্মচারীকে জেল দেয়া হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ায় এইডসবিরোধী প্রচারণায় আন্তর্জাতিক দাতারা বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢালছে। ২০০২ সাল থেকে এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়া মোকাবিলার জন্য জেনেভাভিত্তিক গ্লোবাল ফান্ড ইন্দোনেশিয়াকে দিয়েছে ৫০ কোটি ডলার। কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামির কাছে এ বিনিয়োগ বা উদ্যোগ ধোপে টিকছে না। পশ্চিম জাভার ন্যাশনাল এইডস কমিশনের মুখপাত্র ত্রি ইরাওয়ান্দা মাওলানা বলেন, নিরাপদ যৌন সম্পর্কের জন্য আমাদের কমিউনিটি রেডিওতে প্যাকেজ প্রচারণা দরকার। এখনও আমরা কনডমের ব্যবহার নিয়ে লড়াই করছি।
ধর্মীয় নেতারা এ জিনিসটি ব্যবহারের বিপক্ষে। এমনকি প্রাদেশিক ভাইস গভর্নর প্রকাশ্যে কনডম ব্যবহারের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। পশ্চিম জাভার জনসংখ্যা ৪ কোটি ৩০ লাখ। ইন্দোনেশিয়ার অন্য স্থানের তুলনায় এখানে এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ব্যানডাঙ্গ এলাকার হাসান সিদিকিন হাসপাতালের এইচআইভি কিনিকের ডাক্তাররা বললেন, বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যৌনকর্মীদের মধ্যে এই সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে তার চেয়ে বিবাহিত নারীদের আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। ওই কিনিকের প্রধান ড নির্মলা কেসুমাহ বলেন, স্বামীর কারণে বিবাহিত নারীরা সংক্রমিত হচ্ছে। ২০০৯ সালের পর এরকম সংক্রমণ বাড়ছে। এইচআইভি আক্রান্ত অন্তঃসত্ত্বা মায়ের দেহ থেকে যাতে তার সন্তানের সংক্রমণ না ঘটে সে জন্য সিজারিয়ান সেকশনে অর্থ দেয় গ্লোবাল ফান্ড। তা সত্ত্বেও ওই কিনিকে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শতাধিক শিশু আছে, যারা এইচআইভি আক্রান্ত।
ডাক্তার রুডি উইসাকাসানা বলেন, এসব শিশুকে কি করে বলব যে, তোমার দেহে এইচআইভি আছেÑ এমন কোন অভিজ্ঞতা আমাদের নেই।
ধর্মীয় বিধিনিষেধ ছাড়াও ইন্দোনেশিয়ায় এইডস একটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। এ দেশটিতে রয়েছে ২৩ কোটি মানুষ। তারা ১৭ হাজারেরও বেশি দ্বীপপুঞ্জে বসবাস করছে। তাদের রয়েছে আলাদা সংস্কৃতি।
আলাদা ভাষা। আচেহ থেকে দেশের অন্যপ্রান্ত পশ্চিম পাপুয়ায় বিমানেই যেতে সময় লাগে ৮ ঘণ্টা। এখানে এক দ্বীপের সঙ্গে আরেক দ্বীপবাসীর যোগাযোগ কঠিন। মানুষের এই যে বিস্তৃতি এতেই তাদের আচরণে পার্থক্য এনে দিয়েছে। এতেই এইডস বিরোধী কর্মকাণ্ড প্রচারণায় বিরাট একটি বাধা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।