আমরা নিজেদের জীবনযাত্রার মানকে ক্রমোন্নত করতে চেয়েছি। যেভাবে বেঁচে আছি তার চেয়ে ভালভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছি। আমাদের এই স্বপ্ন বা চাওয়াটা পরবতী প্রজন্মের জন্যে আশিবাদ নয় অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। টাকার লোভে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ, বাড়ছে রোগ, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনগন ও সরকারের চিকিৎসা খরচ। কোন দিকে যাবে অসহায় মানুষ? রোগ, পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি করছে দরিদ্রতা।
কিন্তু উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার রূপকথার কাছে পরিবেশ,মানুষের স্বাস্থ্য স্থান পায় নি। গুটি কয়েক মানুষের ব্যবসা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের পরিবেশ ও জনগন। সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে যে শারিরীক, মানসিক, সামাজিক, পরিবেশ, অর্থনীতির মতো বিষয়গুলোতে গুরুত্ব প্রদান করা জরুরি-সেটা মোটেই বিবেচনা করা হয়নি।
আমার মনে হচ্ছে আমরা দূরদশিতার অভাবে জীবনকে সুন্দর করার নিরলস প্রচেষ্টার ফলাফল হিসাবে জীবনকে মূলত: ধ্বংসের দাঁড়প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছি। পরিবেশ দূষণ, বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণ, খাদ্যাভ্যাস ও জীবন-যাত্রার পরিবর্তনের ফলে আশঙ্কাজনক হারে রোগ বিস্তার ঘটছে।
বিশেষ করে বাড়ছে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, কিডনি সমস্যাসহ অন্যান্য দুরারোগ্য রোগ। সামর্থবান ক্যান্সার আক্রান্ত একজন রোগী চিকিৎসার জন্য কোটি টাকার উপরে খরচ করলেও যিনি দুবল সামথ্যের তাকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হচ্ছে। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য ঔষধ, যন্ত্রপাতি ও অবকাঠমো তৈরিতে বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে। তারপরও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি দূরারোগ্য রোগী সুস্থ হলেও রোগী ও তার পরিবারবর্গ, সমাজ ও রাষ্ট্র নানাভাবে মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
একজনকে বাঁচাতে যেয়ে পুরো পরিবার পথে বসার দৃষ্টান্তও রয়েছে।
এই সুন্দর বসুন্ধরায় বাঁচতে চেয়ে আমরা মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। কেন যে দিন দিন আমরা কোন এক অজানা সুখের নেশায় মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ায়ে চলছি। গবেষকেরা বলছেন, মনুষ্য প্রজাতি গত ২৫ বছরে ৩৫টি নতুন সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এ সকল ব্যাধি জনসংখ্যার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িছে পড়ছে।
রোগ তত্ত্ববিদেরা বলছেন, পৃথিবীর মানুষ নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্ক উলহাউস ২৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন, এই সময়ে মানুষ ৩৮টি নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এই রোগগুলো মানুষের মধ্যে পূর্বে ছিল না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কতক ‘গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস: এ রিভিউ অব দ্য লিংকেজ’ শীষক পযালোচনায় দেখা যায়, ১৯৯৫ সাল থেকে ৩০টি নতুন ও পুরোনো রোগ “নতুনভাবে আবির্ভূত হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, রৈখিক জলবায়ু পরিবর্তন, বড় বড় বাধ নির্মান, বন উজাড় হওয়া, বিস্তীর্ণ ভূমি ন্যাড়া হওয়া-এসব কারনে রোগের আবির্ভাব হচ্ছে।
প্রতি আট মাসে আসছে একটি নতুন রোগের ঝুঁকি, প্রতিরোধে দেশের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়।
দেশের জনগনকে সুস্থ্য না রাখতে পারলে কি আর তা সম্পদে রূপান্তর হবে। অসংক্রামক রোগ উন্নয়নশীল দেশেও বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশের মোট মৃত্যুর প্রায় ৬৬% এ অসংক্রামক রোগের জন্য দায়ী। মধ্য আয়ের দেশগুলোতে এ সকল অসংক্রামক রোগের জন্য অপরিকল্পিত খাদ্যাভাস, কায়িক শ্রমের অভাবের পাশাপাশি অপুষ্টিও একটা প্রধান কারণ।
অপরিকল্পিত খাদ্যাভাস, কায়িক শ্রমের অভাব, অপুষ্টির পাশাপাশি তামাক ও ধূমপানের মতো ক্ষতিকর দ্রব্যের ব্যবহার, কোমল পানীয়, ফাস্টফুড ও জাঙ্কফুড, খাদ্যদ্রব্য, রাসায়নিক ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অসংক্রামিত রোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
বিলাসী জীবন যাপন বা অতিরিক্ত আরামপ্রিয়তার ফলে কি আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনছি না? বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ দিন দিন বাড়ছে। আমাদের কর্মব্যস্ত জীবনে পরিকল্পিত খাদ্যাভাস গড়ে তোলার পরিবর্তে আমরা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, কার্বহাইড্রেট, ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুডে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। ফলে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি ডায়াবেটিস এবং অতিরিক্ত মোটাজনিত রোগে। বাংলাদেশের ২০ বছরের উর্দ্ধো বয়সী মানুষের মাঝে গ্রামের ৭% এবং শহরাঞ্চলের ১৭ % লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মোট মৃত্যুর ৬.২% ভাগ মৃত্যু হয় ডায়াবেটিসের কারনে।
এছাড়া মানুষের মাঝে সচেতনতা কম হওয়ার কারনে, তারা পরিকল্পিত খাদ্যাভাস সম্পর্কে অজ্ঞ এবং অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল হওয়ার কারনে তারা অপুষ্টিতে ভুগছে।
আমাদের দেশে কায়িক শ্রমের অভাবে একটি বড় অংশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ জনিত সমস্যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ১৮ উর্দ্ধবয়সীদের শতকরা ১৩% (পুরুষ ৯.৮% ও মহিলা ১৫.৬%) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হচ্ছে। তাছাড়া মোট মৃত্যুর শতকরা ২.৪ ভাগ হার্ট অ্যটাক. ৩.৬ ভাগ স্ট্রোক এবং ৬.৫ ভাগ অন্যান্য হৃদরোগ অর্থাৎ সর্বমোট ১২.৫ % মৃত্যুর কারণ নানাবিধ হৃদরোগ। বাংলাদেশে বায়ুদূষনের কারণে বেড়ে যাচ্ছে শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী রোগ।
দেশের জনগনের প্রতি হাজারে যথাক্রমে পুরুষ ও মহিলাদের ৪৫ ও ২২ জনের হাপাঁনি বহির্ভূত শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী রোগ রয়েছে। ফলে এই রোগের কারণে মুত্যুর পরিমান মোট মৃত্যুর ৩%।
বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মাঝে গ্রামাঞ্চলের ৪৩% ও শহরের ৯০% অপর্যাপ্ত কায়িক শ্রম করেন। তাছাড়া বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে বেশীরভাগ মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্য পায়না, কিন্ত শহরাঞ্চলে চাহিদার ৫৮% অধিক শর্করা ও ১৬% অধিক চর্বি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের শতকরা ৩ ভাগ মহিলা ’’বিপাকীয় উপর্স’’ বা মেটাবেলিক সিনড্রোমে ভোগে।
বাংলাদেশে ২০ উর্দ্ধ গ্রামের মহিলাদের ৬.৫% এবং শহরের মহিলা ও পুরুষদের যথাক্রমে ৫০% ও ৩১% ওজনাধিক্যে ভুগছে। কোমল পানীয়, জাঙ্কফুড এবং ফাস্টফুড ক্যান্সার ও অতিরিক্ত মোটা হওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে এই ধরনের খাদ্যদ্রব্য গ্রহনের অভ্যাস ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সকল পন্যের নিত্য নতুন বিজ্ঞাপন মানুষকে এ সকল খাদ্যদ্রব্য গ্রহনে উৎসাহী করছে। শুধু শহরে নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে এ সকল খাদ্যের ব্যবহার।
যা জনস্বাস্থ্যকে হুমকির সম্মুখীন করছে।
কৃষিজ ও প্রাণীজ খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্য বহুলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, সংরক্ষনসহ বিভিন্ন কাজে অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। রাসায়নিক সার, ঔষধ ও কীটনাশনের ব্যবহার আজ আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে।
একজন মানুষকে সুস্থ্য থাকতে হলে প্রতিদিন নূন্যতম ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে কর্মব্যস্ততার কারণে কিংবা অলসতার কারণে ব্যায়ামের জন্য আলাদা করে সময় দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনা অনেকেরই। ব্যায়ামে উৎসাহী না হয়ে নিজের শরীর-দেহ-স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে এমন ব্যস্ত থাকার কিইবা মূল্য আছে? মানুষকে ব্যায়ামে উদ্বুদ্ধ করতে হলে অবকাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। যেমন শহরে যাতায়াতের জন্য যদি হাঁটা বা সাইকেলের পথ উন্নত করা হয় তবে মানুষ কর্মস্থলে হেঁটে বা সাইকেলে যেতে উৎসাহী হবে। এ ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন মানুষকে কায়িক পরিশ্রমে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ও যানজটের মতো সমস্যাগুলোর সমাধানে সহায়ক হিসাবে কাজ করবে।
শিশুদের মাঝে অতিরিক্ত মোটাজনিত সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশুরা একটি উল্লেখযোগ্য সময় স্কুলে থাকে। স্কুলে ও অন্যান্য পাঠ কার্যক্রমের পর কোন শিশুর পক্ষে আলাদাভাবে ব্যায়াম করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। যদি স্কুলে শিশুদের ব্যায়াম ও খেলাধূলার সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, তবে আলাদাভাবে কায়িক পরিশ্রম করানোর প্রয়োজন হবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শহরের অধিকাংশ স্কুলে খেলার মাঠ নেই, মাঠ-পার্কগুলো দখল হয়ে গেছে, বাড়ীগুলোতে খেলার স্থান নেই।
শিশুরা বড় হচ্ছে কম্পিউটার, ভিডিও গেমস বা বন্ধ ঘরে। যা তাদের মানসিক ও শারিরীক সমস্যার সৃষ্টি করছে। প্রতিটি বাড়ীতে শিশু থাকা স্বত্বেও কোন বাড়ীতেই খেলাধূলার স্থান নেই। আর এ অবস্থায় সচেতনতার মাধ্যমে শিশুদের মোটাজনিত সমস্যার সমাধান অবান্তর।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন দূষিত করছে পরিবেশ।
বাংলাদেশের পানি, নদী, জলাশয়, বায়ু আজ মারাত্মক দূষণের শিকার। পানি বাহিত রোগ প্রকট আকার ধারণ করছে। পরিবেশ দূষণের কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও সাময়িক অর্থনৈতিক ক্ষতির আশংকায় পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। অপর দিকে নিত্য নতুন স্থাপিত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে পরিবেশ দূষণ না করে সে বিষয়েও পদক্ষেপ সীমিত। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ কথা বলা যায়, শিল্প দূষণের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে না,শিল্পদূষণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছেনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।