প্রিয় বাবা,
প্রতিদিন বলা হয় না, আজ তোমাকে কিছু আগোছালো কথা শোনাই।
একটা সময় ছিলো যখন তোমার ঘুম থেকে ওঠার শব্দ শুনে জেগে যেতাম, তবু অপেক্ষা করতাম তোমার মুখে মামনি ডাক শুনে আর একটা পাপ্পি নিয়ে ঘুম থেকে ওঠার। ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাসটা তোমার কাছ থেকেই এসেছে। হাঁটতে যাওয়ার অভ্যাসটাও। আম্মু বলে আমি পুরোটাই তুমি, কিন্তু আমার তা মনে হয় না।
তোমার হয়তো অনেক কিছুই পেয়েছি কিন্তু ধৈর্যটা পাইনি। পেলে আমি হয়তো পুরোটাই তুমি হতাম।
কিন্ত বাবা তুমি কখনো আমাকে বলোনি যে আমি তোমার মতো হয়েছি। তোমার কি আমার প্রতি অভিমান আছে বাবা? আমার আছে, অনেক অনেক। যেমন মনে কর, তুমি এখন অনেক দ্বায়িত্ব নিয়ে চলো, কেন তোমাকেই আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের সবার দ্বায়িত্ব নিতে হবে? তার বদলে কি তুমি আমার সাথে বিকেল বেলা চুপিচুপি আইস্ক্রিম খেতে পারো না? একটু গল্প করতে পারো না? প্রতিদিন যখন দূরালাপনে তোমার সাথে কথা বলি তখন একটু সময় দিতে পারো না? তোমার সাথে কাটানো সবগুলো মুহুর্ত আমার কাছে প্রচন্ড দামি বাবা।
আমরা তিনজন ছাড়াও তোমার অগনিত সন্তান আর আমাদের সাথে তুমি কম সময় কাটানোর সুযোগ পেতে। আমার মাঝে মাঝেই তোমার ছাত্রছাত্রীর প্রতি হিংসা হত, কারন আমাদের চেয়ে ছাত্রছাত্রীর সাথে তোমার সখ্যতা বেশি ছিলো। বাবা, তোমার হিসেব আছে প্রতি মিনিটে রাস্তায় কি পরিমান সালামের জবাব তুমি দিতে? আমি আর ভাইয়া সেগুলোর হিসাব করতাম, আর বাসায় এসে রীতিমত গবেষণা চলতো। একারণে তোমাকে নিয়ে বের হতে আমাদের অস্বস্তি হতো, আমি ভাইয়া আপু কেউ শিক্ষক হতে চাই নি তোমার অবস্থা দেখে। কিন্তু বংশের ধারা বলে কথা, শেষ পর্যন্ত ভাইয়া আপু দুজনেই শিক্ষক হয়েছে, আর তুমি মহা আনন্দে ভেসেছ।
বাবা, তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। কিন্ত মার সাথে ঝগড়া হলে আমি সব ভোট মা’কেই দিয়ে দেই। কেন জানো? কারন মা না থাকলে তুমি কিছুই না। তোমার কিছুই ঠিকঠাক চলে না। তুমি একজন আদর্শ শিক্ষক হতে পারো, ভালো বা পঁচা বাবাও হতে পারো কিন্তু তোমার পেছনে যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে মা।
আমরাও অনেক সময় তোমার সাথে রাগ করেছি সময়ে অসময়ে সমাজ সেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য, কিন্ত মা করেনি। মা যদি তোমাকে কোন কারনে কিছু বকা দিতে চায় তাহলে সেটা তোমার প্রাপ্য।
বাবা, আমাদের বাসায় সব কিছুতেই সবার মতামত নিতে তুমি, গণতন্ত্রের পচা দিকগুলো তাই খুব ছোটবেলাতেই বুঝে ফেলেছি আমরা। যেদিন ঝামেলাময় কিছু নিয়ে ভোটাভুটি হতো সেদিন আমরা কেউ একজন উপস্থিত থাকতাম না, তাহলে ভোটের ভারসাম্য ঠিক থাকতো। বেশিরভাগ সময় সেটা হতাম আমি।
ভাইয়া আমাকে ক্রিকেট খেলতে বাসার বাহিরে পাঠাতো। তুমি কি আমাদের এই ফাকিবাজি বুঝতে পারতে বাবা?
বাবা, তুমি তারপর আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। সত্যি বলছি, আমার সবগুলো গোপন কথা তোমাকেই বলা হয়। তোমার মনে আছে বাবা, আমার কোনো ছেলেকে পছন্দ হলে সবার আগে বলতাম। তুমি খুব মজা করে শুনতে, দু’দিন পরপর পছন্দ পাল্টে যেতো তুমি হাসতে।
বাবা এখন আমি বুঝি, আমার পছন্দ পাল্টে যেত কারন তাদের বৈশিষ্ট্য তোমার সাথে মিলতো না। আমি তখন বুঝি নি, কিন্তু যখন বুঝেছি তখন মনে হয়েছিলো আমি তোমাকে প্রচন্ড অনুসরণ করি। ভালোওবাসি বাবা, আমার সবটুকু জুড়েই তুমি।
বাবা, তুমি আমাকে কখনো কিছুই হতে বলো নি, এটা করো না, অটা ভালো না এসবও বলোনি, অন্য কারো মতো ভালো ফলাফলের জন্য চাপ দেওনি, পরীক্ষার ফলাফল দেখে তোমার মুখের ভাবও বুঝতে পারতাম না। তবে মা বলতো তুমি অনেক খুশি হতে।
আমার সবগুলো ক্রেস্ট তোমাকে নিতে পাঠাতাম, তোমাকে বক্তব্য দিতে শুনলে বোঝার চেষ্টা করতাম তুমি খুশি হয়েছ কিনা, কিছু বুঝতাম না। মা আর তুমি একসাথে একবার আমার পক্ষ থেকে ক্রেস্ট নিয়েছিলে কলেজ থেকে, মা বলেছিলো সেদিন তুমি কেঁদেছিলে, কিন্তু আমি ছিলাম না বাবা। আমার জানতে ইচ্ছা করে সেদিন তুমি কেন কেদেছ। শিশু একাডেমি থেকে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র সবখানেই পুরস্কার নেয়ার সময় আমি আর তুমি ছিলাম মা ছিল, কোনোদিন তুমি একবারও বুঝতে দিলে না, তবে সেদিন কেন আমার অনুপস্থিতিতে কাদলে সেটা আমার কাছে আজও রহস্যময়।
তোমার প্রতি আমার অভিযোগের শেষ নেই, হয়তো আমার প্রতি তোমার, কিন্তু তুমি সবসময় আমার জন্য আদর্শ হয়ে ছিলে, আমার জীবনের দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষ তুমি।
ভালোবাসি বাবা, তোমাকে সত্যিই অনেক অনেক ভালোবাসি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।