আমার নিজেকে আমি মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলি। তখন অন্যের চোখে নিজেকে খুজে ফিরি। কখনো পাই কখনো পাই না।
‘বৃক্ষের নিকটে গিয়ে বলি;
দয়াবান বৃক্ষ তুমি একটি কবিতা দিতে পারো?
বৃক্ষ বলে আমার বাকল ফুঁড়ে আমার মজ্জায়
যদি মিশে যেতে পারো, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা!’
জীর্ণ দেয়ালের কানে বলি;
দেয়াল আমাকে তুমি একটি কবিতা দিতে পারো?
পুরোনো দেয়াল বলে শ্যাওলা-ঢাকা স্বরে,
এই ইট সুরকির ভেতর যদি নিজেকে গুঁড়িয়ে দাও, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা!
একজন বৃদ্ধের নিকট গিয়ে বলি, নতজানু,
হে প্রাচীন দয়া ক`রে দেবেন কি একটি কবিতা?
স্তব্ধতার পর্দা ছিঁড়ে বেজে ওঠে প্রাজ্ঞ কণ্ঠে – যদি
আমার মুখের রেখাবলী
তুলে নিতে পারো
নিজের মুখাবয়বে, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা। (একটি কবিতার জন্য)
তিনি পেরেছিলেন।
বৃক্ষের বাকল ফুঁড়ে মজ্জায় মিশে যেতে। পেরেছিলেন ইট সুরকির ভেতরে নিজেকে গুঁড়িয়ে দিয়ে জীর্ণ দেয়াল থেকে কবিতা নিতে। নতজানু বৃদ্ধের মুখের বলীরেখা নিজের মুখাবয়বে তুলে নিয়েছিলেন বলেই আজও তিনি অমর।
কবি শামসুর রাহমান। যার নামের শুরুতে বিশেষণের প্রয়োজন হয় না।
বিশেষ্য যখন নিজেই বিশেষণ তখন কেন-ই বা প্রয়োজন আধ্যিকেতার? তবুও বলতে হয়,কবি জীবনানন্দ দাসের পর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি ছিলেন তিনি। আধুনিক বাংলা কবিতার বয়ে চলা নদীর নতুন বাঁক শামসুর রাহমান। সমকালীন সময়ে তাকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল বললে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবে না। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট পার্থিব্যজগত থেকে মহা প্রস্থান করেছিলেন তিনি। মাত্র ৭৭ বছর বয়সে সবাইকে কাঁদিয়ে কবি আজ না ফেরার দেশের বাসিন্দা।
কবি শামসুর রহমানের কবিতা মানেই ভাষা আন্দোলন,মুক্তিযুদ্ধ,স্বাধীনতার চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতার এক বলিষ্ঠ হুংকার। ১৯৫০এর দশকে কাব্যচর্চার পথে যাত্রা শুরু পর পিছু ফিরে তাকানো সময় ছিলো না তাঁর। নাগরিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই কবি সমকালীন বাংলা সাহিত্যে বাংলা ভাষার সবচেয়ে বেশি কবিতা রচনা করেছেন। দেশাত্মবোধ, প্রেম, ভালোবাসা, উত্থান-পতন, নিপীড়ন, নির্যাতন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, শোষণ, যাতনা, আনন্দ-বেদনা ও সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রামের বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার কলমের ছোঁয়ায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান,গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনসহ জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের ইতিহাস পরম্পরা তাঁর কবিতা আঁকড়ে রেখেছে।
ভাষার কারুকার্যে মন্ডিত করেছেন দেশাত্মবোধক কবিতাকে। লিখেছেন-
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল। (স্বাধীনতা তুমি)
তাঁর লেখা ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় অসাধারণ ভাষার মাধুর্য্যতা দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন গণতন্ত্রপূণরুদ্ধারে অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়া মমতাময়ী মায়ের বুকের মানিক, বোনের ভালবাসার ভাই আসাদের অমরদান। কবি লিখেছেন-
ডালীম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা। (আসাদের শার্ট)
শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ, আদিগনত্ম নগ্ন পদধ্বনি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, বন্দী শিবির থেকে, বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে, প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে, যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ প্রভৃতি। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও শিশুতোষ মিলে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। আর কবিতার সংখ্যা হাজারের বেশি।
শুধু রাজনীতি, সমাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাই নয়,পাঠক মননে কবি শামসুর রাহমান প্রেমিক সত্তা হিসেবেও স্বমহিমায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। প্রেম-ভালবাসা আছে বলেই যে পৃথিবী এতো সুন্দর তা বুঝিয়েছেন তিনি। ভালবাসার নিয়ে রচনা করেছেন অসাধারণ অনেক কবিতা।
তোমার বিবাহোত্তর রূপ নিয়ে নিজস্ব সংসারে
আগেকার মতো আজো আমাকে তোমার
মনে পড়ে কিনা,
জানি না কিছুই। আগেকার মানে কাবেকার? বলো
তুমি কি এখনো
আমাকে অত্যনত্ম ভেবে রাত্রির চিতায় জ্বলজ্বলে
যেৌবন পোড়াও হে সুচেতা? (তোমার কুশল)
নতুন লেখকদের প্রতি তিনি ছিলেন আশির্বাদ দেবতা।
তার উৎসাহ অনুপ্রেরণায় অনেক নতুন কুঁড়ি আজ বৃক্ষের রূপ পেয়েছে। শুধু বাংলাদেশই নয়। বিশ্ব পরিমণ্ডলেও মহান এ কবি আপন সৃষ্টিতে সমাদৃত। আমৃত্যু দেশ, মাটি ও মানুষকে বেঁধে রেখেছিলেন অদৃশ্য মায়াঢোরে। লিখে গেছেন-
আমার মৃত্যুর পরেও যদি সেই
সুনীল পাখি আসে আমার জানালায়,
আবার শিস দেয়, আমার বইখাতা
যদি সে ঠোকরায়, দিও না বাধা তাকে।
(আমার মৃত্যুর পরেও যদি)
পুরনো ঢাকার মাহুতটুলিতে ১৯২৯ সালের ২৪ অক্টোবর জন্ম নেয়া কবি শামসুর রাহমান জীবনভর অসামান্য কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার,একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, আদমজী পুরস্কার, জীবনানন্দ পুরস্কার, পদাবলী পুরস্কারসহ অনেক সম্মাণনা। এছাড়া রবীন্দ্রভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মান সূচক ডিলিট উপাধী প্রদান করে।
ছয় বছর পার হলো বাংলা সাহিত্যের মহান এ সেবককে হারিয়েছি আমরা। তবু যেন মনে হয়, তিনি আছেন। এই তো তিনি কথা বলছেন।
কথার সম্মোহনে মানুষকে কাছে ডাকছেন। হ্যাঁ, সত্যি তিনি আছেন। তিনি আছেন জলে স্থলে মিশে। আকাশের চন্দ্র, তারকার মাঝে। আছেন ভালবাসায়, পূর্ণতায়।
আছেন বিপ্লবী কণ্ঠস্বরেও। বলছেন-
কবিকে দিওনা দু:খ, স্বপ্নের আড়ালে তাকে তীব্র
আবৃত্তি করতে দাও পাথর, পাখির বুক, গাছ,
রমণীয় চোখ,
ত্বক, হেঁটে যেতে দাও ছায়াচ্ছন্ন পথে, দাও সাঁতার কাটতে বায়ুস্তরে একা,
অথবা থাকতে দাও ভিড়ে নিজের ভেতরে। রোজ
হোক সে রূপান্তরিত বার বার। নিজস্ব জীবন রেখেছে সে
গচ্ছিত সবার কাছে নানান ধরনে অকপট।
কবিকে দিও না দু:খ, একান্ত আপন দু:খ তাঁকে
খুঁজে নিতে দাও।
(কবিকে দিও না দুঃখ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।