আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভিনদেশী তারা(ছোট গল্প )

একজন সাদাসিদে মানুষ এরকম হওয়ার কথা ছিল না । কোন কিছুই এরকম হওয়ার কথা ছিল না । আজকে চাদ রাত টাও ফাহিমের ভালো লাগারই কথা ছিল । তার কাছে ঈদের চেয়ে চাদ রাতের মজাই বেশী ছিল । আর গত দুটা ঈদ তো তার জীবনের সেরা ঈদ ই ছিল ।

তার পাশে তখন অহনা ছিল । মেয়েটা শপিং এর এত্ত পাগল । ফাহিমকে নিয়ে মার্কেট এর পর মার্কেট ঘুরে ,শ খানেক পাঞ্জাবী ট্রায়াল দিয়ে তারপর নিজের পছন্দের সেরা টা ফাহিম কে গিফট করত । ফাহি ম এই ঈদে আর পাঞ্জাবী কিনে নি । অহনার দেয়া গতবারের পাঞ্জাবী দিয়েই কাজ চালিয়ে দিবে ।

মায়ের ফোন আসাতে বাস্তবে ফিরে আসে ফাহিম । ঈদানিং প্রায় সারাক্ষনই সে অন্যমনস্ক থাকে । গত দু মাস ধরে এই অবস্থা । অহনা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে দু মাস । -হ্যালো মা ,বল -তুই এখনো রওনা দিস নাই ? কয়টা বাজে?কখন পৌছাবি ? -এইত এখনি বের হব ।

-ব্যাগ গুছানো শেষ ? -হ্যা সব শেষ ,শেভ টা করেই বের হচ্ছি । -এখনো শেভ ও করস নাই । তাড়াতাড়ি কর । আমি রাখি । -আচ্ছা মা ।

খোদা হাফেজ । বাবা মা ছোট বোন সবাই বাড়ি চলে গিয়েছে তিন দিন আগেই । ফাহিম থেকে গিয়েছে পরীক্ষা ঈদের পর , পড়তে হবে এই কথা বলে । সবাই কথাটা বিস্বাস করে তাকে বাসায় একা রেখে চলে গিয়েছে । মেডিকেলে পড়ে ।

সারাবছরই পরীক্ষা লেগে থাকে । ঈদের পর পরই পরীক্ষা থাকাটা খুব স্বাভাবিক । কথা ছিল সে চাদ রাতে বাড়িতে রওনা দিবে । ফোন টা রেখে ফাহিম কম্পিউটারের সামনে বসে । গান ছেড়ে দেয় উচ্চ শব্দে ।

একটা গানই সিলেক্ট করা । রিপিট মুডে বারবার বাজতে থাকবে । "আমার ভিনদেশী তারা একা রাতেরই আকাশে তুমি বাজালে একতারা আমার চিলে কোঠার পাশে" এই গানটা কেন জানি তার খুবই প্রিয় ঈদানিং । হুয়ত অহনা এখন তার কাছে এক ভিনদেশী তারা বলেই । কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠে দাড়ায় ফাহিম ।

শেভ করতে হবে । যদিও বাড়ি যাবার কোন প্ল্যানই নেই তার । তবুও সে ধীরেসুস্থে শেভ করে নেয় । কোন তাড়াহুড়ো নেই তার ভেতর । প্রায় তিন সপ্তাহ বাদে শেভ করার পর তার ফর্সা চেহারায় কেমন একটা সবুজ আভা ভেসে উঠছে ।

তবে এই আভাও তার চোখের নিচের কালো কালি লুকাতে পারছে না । অনেকদিন ধরে নির্ঘুম রাত কাটানোর ফসল এই কালি । গোসল টাও সেরে নেয় । সারা শরীরে আশ্চর্য রকম এক প্রশান্তি । নিজের শরীরের প্রতি নিজেরই মায়া হয় তার ।

গত দু মাসে অনেক অত্যাচার করা হয়েছে বেচারার উপর । ড্রয়ার থেকে কড়া ইস্ত্রি করা অহনার গতবার দেয়া পাঞ্জাবীটা বের করে । পাঞ্জাবীটার বুকে ভারী কাজ করা । নিজের অজান্তেই হাত বুলিয়ে নিল একবার পাঞ্জাবীটার গায়ে । অহনার পছন্দের পাঞ্জাবী গায়ে দিয়েই ওর সাথে দেখা করবে ।

মেয়েটা কি পরিমান খুশী হবে চিন্তা করে এখনি হাসি পাচ্ছে ফাহিমের । হয়ত বলবে "কিপ্টা । আমি নাই দেখে আবার আগের মত কিপ্টামি শুরু করে দিছ ? ঈদের জন্যে একটা নতুন পাঞ্জাবীও কিনলা না ? "। পাঞ্জাবীর সাথে গতকালই কেনা হালকা কালো রঙ্গের জিন্স টা পরে নেয় ফাহিম । বাবা মায়ের রুমে গিয়ে মায়ের ড্রেসিং টেবিল টার সামনে দাড়ায় সে ।

নিজের আপাদমস্তক দেখে নেয় একবার । নিজেকে দেখে নিজেরই হাসি পাচ্ছে । এত রোগা হয়েছে গত দু মাসে । কি বকাটাই না দিবে অহনা তাকে যদি এই অবস্থা দেখে । মেয়েটা রেগে বকা দেয়া শুরু করলে তাকে আরো সুন্দর দেখায় ।

অহনা রেগে গেলেই ফাহিম হাসা শুরু করত । বলত "এই যে , চোখমুখ সব লাল করে ফেলছ । পুরা টমেটো । তাড়াতাড়ি টমেটো থেকে মানুষ হও । তারপর তোমার সব কথাই শুনছি " ।

যত রাগই থাকুক এরপর অহনা আর রাগ করে থাকতে পারত না । গানের শব্দ ভেসে আসছে পাশের রুম থেকে । "আমার বিচ্ছিরি একতারা তুমি নাওনা কথা কানে তোমার কিসের এত তাড়া? এ রাস্তা পার হবে সাবধানে..." আসলেই কিসের এত তাড়া ছিল অহনার সেদিন । রাস্তাটা একটু সাবধানে পার হলেই তো হত । ফাহিম বুঝতে পারে তার চোখ ভিজতে শুরু করেছে ।

নিজের রুমের দিকে যায় সে । যাবার সময় ডাইনিং থেকে আগে থেকে ভরে রাখা এক বোতল পানি নিয়ে নেয় । গান টা বেজেই চলছে । রুমে ঢুকতেই বিছানার উপর রাখা মোবাইল টা বেজে উঠল । বন্ধু জুয়েল ফোন দিয়েছে ।

-হ্যালো দোস্ত । বল । -তুই কই ? বাসায় রুমের কোণার মধ্যে বইসা আছস ? -হ । তোরে আমি ফোন দিতাম একটু পর । -*ল দিতি ।

বাড়িতে যাবি কখন ? -একটু পর । শোন আমার আম্মার নাম্বার টা আছে না তোর কাছে ? -হ আছে ? কেন? -ওই নাম্বার থেকে ফোন দিলে ধরিস । -আচ্ছা । ঠিকাছে । পরে কথা হবে ।

-ওকে । বাই । -বাই । ফোন রেখে দেয় ফাহিম । মুচকি একটা হাসি দেয় বন্ধুদের কথা চিন্তা করে ।

শালা গুলার কালকে ঈদটাই মাটি করে দিবে সে । এই যুগে এত ভাল বন্ধু পাওয়া কঠিন ব্যাপার । টেবিলের উপর থেকে ঘড়িটা নিয়ে হাতে পড়ে নেয় । ৮টা ১০ বাজে । টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ায় ফাহিম ।

পেয়ে যায় যা খুজছিল । অনেকদিন ধরে ২-৩ টা করে কিনে কিনে সে প্রায় ৫০ টা ঘুমের ট্যাবলেট জমিয়ে ফেলেছিল । খাটের উপর পা তুলে আয়েশ করে বসে সে । পানি দিয়ে একে একে সবগুলো ট্যাবলেট ই পেটে চালান করে দেয় । পানির বোতল টা পাশেই নামিয়ে রাখে ।

খাট থেকে নেমে দাড়ায় ফাহিম । মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করে উঠল । এভাবে সাথে সাথে তো কিছু হওয়ার কথা না । হয়ত অবচেতন মনের কোথাও এক অজানা ভয় কাজ করছে । হেটে হেটে বাসার সবগুলো লাইট নিভিয়ে দিয়ে নিজের রুমে ফেরত আসে ।

নিজের রুমের চারদিকে নজর বুলায় একবার । রুমের লাইট টাও নিভিয়ে দেয় । রুমের ভেতর শুধু কম্পিউটারের মনিটরের আলোটাই বোঝা যাচ্ছে এখন । গান টা বেজেই চলছে । খাটের দিকে এগিয়ে যায় ফাহিম ।

মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল । শুয়ে পড়ল খাটে । পাঞ্জাবীটা টেনে ঠিক করে দেয় । দুই হাত ভাজ করে বুকের উপর রাখে সে । প্রচন্ড ঘুম আসছে ।

ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । ঘুমানো দরকার । কতদিন ঘুমায়না ঠিক ভাবে ফাহিম । দু মাস আগে রোড এক্সিডেন্টে অহনা মারা যাবার পর থেকে তার চোখে ঘুম নেই এক বিন্দু ও । অহনা গুড নাইট বলে দেয়া ছাড়া কীভাবে ঘুমাবে সে ?চোখ বন্ধ করে ফাহিম ।

দুই চোখের পাতা জোড়া লাগতেই অহনার চেহারা ভেসে উঠে । একী মেয়েটা কাদছে কেন ? তার তো হাসার কথা । হয়ত অহনার কান্না দেখেই ফাহিমের বন্ধ চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে বালিশ ভিজিয়ে দিতে থাকে । গানটা তখনো বেজে চলছে । "তোমার কিসের এত তাড়া? এ রাস্তা পার হবে সাবধানে... তোমার গায় লাগেনা ধুলো আমার দু'মুঠো চাল-চুলো রাখো শরীরে হাত যদি আর জল মাখো দুই হাতে... প্লীজ ঘুম হয়ে যাও চোখে"।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।