রাত একটু গভীর হলে এগিয়ে যাই খালি পায়ে। ঠান্ডা বাতাস বইছে বেশ। ভূত নেই জানি-তবুও কিসের যেন সাড়া পাচ্ছি মনে মনে। ভরসা একটাই চোর ডাকাত নেই এখানে। বেশি বিপদ হলে ১১২ নম্বর তো আছেই।
সাথে সাথে পাওয়া যাবে অতিভদ্র পুলিশ বাহিনীকে। ওদেরকে কার্টুন মনে হয় আমার মাঝে মাঝে। কারন ওরা সন্দেহভাজন অপরাধীদের সাথেও এমনভাবে কথা বলে যেন নিজেরাই কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। যাই হোক, এত রাতে বাইরে বের হয়না কেউ সাধারনত, উইকেন্ড ছাড়া। ওদের রুটিনে ৭টায় ডিনার, ৮টায় ঘুম।
ভোরে ছুটবে কাজে। কেবল শুক্র আর শনিবার রাত এলেই ব্যতিক্রম। আজ শুক্র বা শনি কোনোটাই না। আমার বেরুনোর উদ্দেশ্য হলো আজ একুশে ফেব্রুয়ারী। রাত ১২ টা বাজার আগেই যে আমাকে পৌঁছাতে হবে শহীদ মিনারে।
এই অজপাড়া গাঁয়ে তো আর শহীদ মিনার নেই। তাই কমিউনকে আগেই বলে রেখেছিলাম ফুল দিব শহীদ মিনারে। কাঠ আর কাগজ দিয়ে নিজেই একটা শহীদ মিনার বানিয়ে রেখেছিলাম বিকেলে। শহীদ মিনার তো হয়নি; তবে শহীদ মিনারের মত কিছু একটা হয়েছে। এক ঘন্টা ওটা মূল চত্ত্বরে রাখার অনুমতিও দিয়েছে ওরা।
ভ্রাম্যমান শহীদ মিনার আর কি।
স্টকহোম থেকে ৩১৫ কিমি দূরে ছোট্ট এই গ্রামে হাজার দেড়েক লোকের বাস। সুইডিসদের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশীও বাস করে এখানে। বিশেষ করে ডেনমার্ক, জার্মানী, নেদারল্যান্ড থেকে আগত অনেক পর্যটকই এখানে এসে আর ফিরে যায়নি। কথিত আছে, মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষনে আর ঘরবাড়ি সস্তা হওয়ার কারণে সামারে বেড়াতে আসা এইসব বুড়োবুড়িরা ভিলা কিনে জীবনের শেষ আশ্রয়স্থল খুঁজে নিয়েছে ২.১৯ বর্গকিলোমিটারের এই গ্রামে।
মাসকয়েক আগে আমার আগমন তাই ওদের পরিসংখ্যান খাতায় নতুন একটা দেশের নাম যোগ করেছে। হ্যাঁ, আমিই একমাত্র বাংলাদেশী এখানে।
একুশে উদযাপন অনুষ্ঠানের অনুমতির আবেদনপত্রে তাই অংশগ্রহনকারী সংখ্যা মাত্র একজন দেখে মিসেস বিরগিটা জোহান্সন বেশ ঘাবড়ে গেলেন। ষাটোর্ধ এই মহিলাটি কমিউনে আমার কন্টাক্ট পারসন। হেসে বললেন, তুমি তো একা, চাইলে আমি কিছু পাকিস্তানীকে বলে দেখতে পারি তোমার অনুষ্ঠানে সাহায্য করার জন্য।
(উল্লেখ্য, মারিয়ানালুন্ডে একটা এসাইলাম ক্যাম্প আছে, যেখানে বেশ কিছু পাকিস্তানী বাস করে। ) আমি হাসব না কাঁদবো বুঝতে পারলাম না। শুধু বললাম, ওরা সাহায্য করলে তো আজ আমাদের এই দিন পালনেরই প্রয়োজন পড়ত না। সে কিছু বুঝল বলে মনে হল না। তবে তার অজ্ঞতায় বিষ্মিত হলাম না।
শুধু সুইডেনে কেন; আমি ইউরোপের অনেক দেশেই দেখেছি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস বলে যে একটা দিবস আছে তা তারা জানে না। তাই সুযোগ পেলেই গর্বভরে ওদের জানিয়ে দিই, আমরাই একমাত্র জাতি যারা নিজের মায়ের ভাষার জন্য প্রান দিয়েছে। শুনে হতবাক হয় তারা। বিরগিটাকে জোরগলায় বললাম, আমি একাই করবো। তুমি শুধু অনুমতিটা নিয়ে দাও।
আমার একগুঁয়েমি বেশ ভালই জানা আছে ওর। তাই আর কথা বাড়াল না।
আমার বাসভবন থেকে ২০ মিনিটের হাঁটাপথ মূল চত্ত্বরটা, যেখানে ফুল দিব। জানি কেউ নেই সেখানে এখন। রাত বারোটায় কে আর ঘুরবে জঙ্গলে? আমি বেশ উত্তেজনা অনুভব করছি।
ভয় নেই মনে এখন। বুকের ভেতর আর্শ্চয্য এক শুণ্যতা কেবল। এটাও নতুন অনুভূতি আমার জন্যে। বিদেশ বিভূঁইয়ে এসেও প্রতি বছরই তো পালন করেছি দিনটা। আজকের আর্শ্চয্য এই অনুভূতিটা শুধু আমি একা বলে? হবে হয়তবা।
গল্পের শেষটা নাটকীয় হবে ভাবিনি। মূল চত্ত্বরের কাছাকাছি পৌছে যা দেখলাম অভাবনীয়। বিরগিটা দাড়িয়ে আছে ফুল হাতে। ঠান্ডায় কাঁপছে কনকন করে। চারটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়ানো।
অভিবাদন জানালো বিরগিটা। বুড়ো পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে বলল, তুমিই তাহলে লিকুয়াট? (ওদের মুখে নিজের নাম শুনলে দুঃখ হয়) আমি বললাম, হ্যাঁ, আমিই লিকুয়াট। শুরু হলো মূলপর্ব। জনা আটেক পুলিশ, বিরগিটা আর আমি। বিরগিটা কি করবে বুঝতে পারছে না।
বারবার তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমি আইফোনে বাজিয়ে দিলাম সেই গান; যে গান শুনলে রক্ত গরম হয়ে যায় আজো, যে গান শুনলে '৫২ তে জন্ম না হওয়ায় দুঃখ হয়- সেই গান; আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভূলিতে পারি? ফুল নিয়ে এগিয়ে গেলাম শহীদ মিনারে। আমার পেছনে বিরগিটা। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, আমি কি ফুল দিত পারি এই বেদীতে? মাথা নেড়ে মৌন সম্মতি দিলাম আমি। ঠিক তখনই বাতাসে হেলে গেল আমার ৫ ফুট উঁচু শহীদ মিনার।
আর তখনই দু'জন ছোকরা বয়সী পুলিশ দৌড়ে এসে দু'দিক থেকে সামলে ধরে রাখল ওটাকে। আমি ফুল দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম নিরবে। দশ হাজার মাইল দূরের আমার দেশের গন্ধ পাচ্ছি যেন। বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করছে। কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে মারিয়ানা লুন্ডের আকাশে।
আমি অপলক তাকিয়ে আছি কাগজের লাল বৃত্তটার দিকে। কতক্ষণ হলো জানি না। সন্বিত ফিরল ঘাড়ে কারো হাতের ষ্পর্শে। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম বিরগিটার হাত ওটা। চোখে পানি ওর।
কাঁদছে কোথাকার কোন ভিনদেশী এই বুড়িটা। চোখ মুছতে মুছতে বলল, দেশের জন্যে এমন করে কাউকে কাঁদতে দেখিনি আমি আগে কাউকে। তাই সামলাতে পারলাম না। সত্যিই তোমরা অনেক ভালোবাস তোমাদের দেশকে। হাসার চেষ্টা করলাম আমি।
শুধু বললাম, নিজের দেশকে কে না ভালোবাসে বলো?
ফিরে চললাম শেষে। হেলে পড়া শহীদ মিনার আর দুই তোড়া ফুলকে পিছনে রেখে। তবে সাথে নিয়ে এলাম অনেক ভালোবাসা। আমার দেশের প্রতি, আমার মায়ের ভাষার প্রতি অনেক অনেক ভিনদেশী ভালোবাসা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।