জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।
বাসায় আর কেউ ছিল না, ছাত্রী আর ছাত্রীর কুকুর। রোবিনা আমাকে ঘরে ঢুকালো ফোন কানে রেখেই। ও স্যরি বলে ফোনে কথা বলা শেষ করতে গেল। কুকুরটা প্রতিদিন ছুটে এসে পা চাটে।
আজকে কাছে আসল না। কি হয়েছে কে জানে!
আমি ড্রইং রুমে ইত:স্তত ঘুরে বেড়ালাম একা একা। বাসার মহিলা, আমার ছাত্রীর মা খুবই সৌখিন মহিলা। ঘরের প্রতিটা দেয়ালে নানাবিধ 'পেইন্টিং'। পেশায় ডাক্তার, কিন্তু নিজেও ছবি আঁকেন।
দারুণ সে সব চিত্রকলা। এসেছেন চীন থেকে, কিন্তু ইন্টারেস্টিংলি--মুসলিম। যারা সাইমুম সিরিজ পড়েছেন কখনও, তারা জানবেন, 'সিংকিয়াং' সহ বেশ কিছু অঞ্চলে, পশ্চিম চীনে, বেশ ভালো রকমের মুসলিম জনসংখ্যা আছে। এখন জাতিগত ভাবে খুবই অত্যাচারিত সে সব মুসলিমেরা। ছোট্ট একটা উদাহরণ--রোবিনাই জানালো ওদের সন্তানদের 'কুরআন' পড়ানো নিষেধ, বাড়ির চার দেয়ালের ভিতরেও।
ওরা জাতিতে তুর্কী, অনেক কাল আগে পূর্ব পুরুষ চীনে গিয়েছে। নিজেদের ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে আছে, কিছু মিশ্র বিয়ে হলেও তুর্কী রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করে চলেছে মনে হয়। তাই চীনে থাকা সত্ত্বেও খাঁড়া নাক, পাতলা ঠোঁট। সংস্কৃতিতে তুর্কী প্রভাব স্পষ্ট। আমার ছাত্রীর মাকে একবার ইংরেজিতে সাহায্য করছিলাম, আর্টিকেলে নোট নিচ্ছিলেন দু'টো ভাষায়, একটার অক্ষরগুলো দেখতে চাইনীজ, আরেকটার আরবি।
বুঝাই যায় ওখানকার মুসলিমদের বেশ নিজেস্ব একটা স্বতন্ত্র ধারা আছে, সংস্কৃতি আছে।
অথচ এদের পরিবারকে কাছ থেকে দেখলে 'ইসলামিক' ব্যাপার স্যাপার তেমন পাওয়া যাবে না। রোবিনার এক বড় ভাই বিয়ে করেছে বটে এক মুসলিম মেয়েকে, অন্য জন লীভ টুগেদার করছে স্ক্যান্ডেনেভিয়ার এক মেয়ের সাথে। তৃতীয় ভাইয়েরও গার্ল ফ্রেন্ড আছে, অজি। ফ্যামিলি রিউনিওনে ওরা সবাই এক হয় একই ছাদের তলে।
আমি যে ড্রইং রুমে হাঁটছিলাম, খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল প্রতিটা পেইন্টিং। বুঝলাম, মোঘলদের প্রভাবিত পেইন্টিঙে ওরকম দেখা যায় বলে চেনা চেনা লাগছে, ওই যে মেয়েরা বসে আছে হাতে ফুল নিয়ে, পায়ের গোড়ালী ছোঁয়া চুল, মাথায় আলতো করে ঘোমটা দেয়া। পোশাকগুলোকে 'লেহেঙ্গা' বলে চালিয়ে দেয়া যায়, কিন্তু ঠিক লেহেঙ্গাও না। লেহেঙ্গায় ওরকম 'কলার' থাকে না। চাইনীজ কখনই না।
আবার ঠিক তুর্কীও না। এ এক মিশ্র কালচার। রোবিনাকে একদিনই দেখেছিলাম খোলা চুলে। গাঢ় বাদামী চুল প্রায় হাঁটু অব্দি। পাতলা ওড়নায় চুল ঢেকে দিলেই টিপু সুলতান থেকে উঠে আসা কেউ হয়ে যেত।
ঘরের এক পাশে পারসিয়ান কার্পেট। সেই অংশটুকু জলসার মত করে সাজানো। গীটারটাই চিনতে পারলাম কেবল। বেশ কয়েক প্রকারের বাদ্য যন্ত্র, 'স্ট্রিং ইন্সট্রুমেন্ট'। আরেকটা দেখে সেতারের মত লাগল।
রোবিনার তখনও হয় নি। আমি নিচু হয়ে গিটারের তারে হাত রাখলাম। ঝন ঝনকরে বাজালাম কিছুক্ষন। আরও কয়েকটা স্ট্রিং ইন্সট্রুমেন্টে আঙ্গুল বুলালাম আলতো করে। সামান্য ছোঁয়াতেই কি ঝংকার! ছোট্ট একটা ইন্সট্রুমেন্ট ছিল, দেখতে সেতারের মত, কিন্তু বেশ ছোট।
ওটার শব্দগুলো কি মিষ্টি! ব্রাজিলের বা পেরুর গানে ওরকম টুংটাং শোনা যায় অনেক, বড় ভালো লাগে। খুব হিংসা হচ্ছিল যারা হাতের ছোঁয়ায় অর্থপূর্ণ সুরের মালা বানাতে পারে, তাদের।
পড়ানো শুরু করার একটু পরে নিচ থেকে সেটাই কেউ একজন সেটা বাজানো শুরু করলো। কি করে বুঝল আমি মুগ্ধ হয়ে যাই সেটা শুনে? অস্থির হয়ে যাই? আমি ম্যাথস বুঝাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম, আমার কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, আমি কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না! মোহিত হয়ে শুনে যাচ্ছিলাম... এত্ত সুন্দর! কি যে সুন্দর! বুকের ভিতর উথাল পাথাল শুরু হয়ে যায় শুনতে থাকলে।
কেমন করুণ একটা সুর, করুণ কিন্তু বেদনাময় না, আনন্দময়। সুখ-বেদনাদের উস্কে দেয়, দু:খদের না। তির তিরে সুর কিছুক্ষন, যেন মাঠ ভরা সবুজ ধান একটু একটু করে দুলছে। একাকীত্বে। তারপরে হঠাৎই ঝটকা টানে তুলে ফেলে অনেক উপরে, তীব্র ঘূর্ণিতে ফেলে দেয়... সেখানেই অনেক্ষন আকাশে বাতাসে ভাসায়, নাচায়... তারপরে হঠাৎই হেঁচকা টানে নামিয়ে আনার আগে...
বাসায় আসলাম অনেক্ষন আগে, কিন্তু এখনও কান পাতলেই শুনতে পাচ্ছি সেই অসহ্য সুন্দর সুর... ভিনদেশী সুর, কিন্তু বিদেশী মনে হয় নি একবারও, যেন আমার ভাষাতেই আমাকে ডেকে নিয়ে ওলট পালট করে ছেড়ে দিল...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।