৫ বৈশাখ, ১৪২০
খিলগাঁও, ঢাকা।
প্রিয় ঝরনা বেগম,
সেদিন সংবাদপত্রে আপনার কির্তী দেখে আমার মনে হয়েছে এরকম একজন মানুষও যতদিন এদেশে আছে এদেশ নিয়ে হতাশ হবার কিছু নেই। আজ আবার আপনার ছবি দেখলাম সংবাদ পত্রে, আমার আরেকবার ইচ্ছে হলো মহৎ হবার। আপনার কথা প্রথম যেদিন জানলাম, দুএকজনকে আমি নিজেই পড়ে শুনিয়েছি, বেশ কয়েকজনকে বলেছিলাম নিউজটা পড়ার জন্য, আমার অফিসে, আমার বাসায়, আমার আড্ডায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া ছাড়া আর যে গুটি কয়েক গর্বের, আনন্দের, সুখের সংবাদে আমি এভাবে প্রচারমুখর ছিলাম তার মধ্যে একটা ছিল ব্রায়ান লারার অপরাজিত চারশত রানের ইনিংসর।
আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সে ইনিংস দেখেছিলাম। সোনালি অতীত এবং নিমজ্জিত বর্তমানের ওয়েস্টইন্ডিজ দলের সমর্থক হিসেবে আমার বলার কিছু থাকত না, না আড্ডায়, না বাসায়, না কোচিং-এ। হঠাৎ করেই লারা নতুন ইতিহাস লেখালেন। লারা আমাকেও গর্বিত করলেন, আমারও গ্রেট হবার ইচ্ছে হলো।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেদিন নোবেল পুরস্কার জিতলেন সম্ভবত রোযার দিন ছিল।
দুপুর বেলা বসে বসে আমি কম্পিউটারে গেম খেলছিলাম। পাশেই টিভিতে খবর চলছিল। গেমসে মগ্ন কানেই হঠাৎ আসে খবরটা। আমার মনে আছে আমি গেম ফেলে বেশ কিছুক্ষণ ঘরে একা একা লাফালাফি করেছিলাম। এরকম লাফালাফি করেছিলাম একবার আমার নানাবাড়িতে।
কয়েক বন্ধু মিলে জ্যোৎস্না রাতে গায়ের শার্ট ও লু্িঙ্গ খুলে, এ মাঠ থেকে সে মাঠে। সেবার অনেক আনন্দ হয়েছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাকে গর্বিত করেছিলেন, আনন্দিত করেছিলেন, মহৎ হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
প্রিয় ঝরনা বেগম, জানি আপনার নাম ভুলে যেতে আমাদের বেশী সময় লাগবে না। যেমন নাম ভুলে গেছি সেই শিক্ষকের যিনি শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষাসফরে যাবার পথে বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে পালিয়ে যাওয়া চালকের আসনে বসে বাস নিয়ন্ত্রণে এনে রক্ষা করেন শিক্ষার্থীদের জীবন; নাম ভুলে গেছি সেই রিক্সাচালকের, যিনি তার রিক্সায় পাঁচ লক্ষ টাকা পেয়ে তা তার মালিককে ফেরত দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন; ভুলে গেছি সেই হকারের নাম, যিনি জীবনের ঝুকি নিয়ে চলন্ত বাসে ধর্ষনের শিকার গার্মেন্টস কর্মীকে বাচাতে এগিয়ে এসেছিলেন; সেই সাহসি ভাইকে, যিনি সকাল বেলা সাইকেলে করে কর্মক্ষেত্রে যাবার সময় এক ছিনতাইকারীর কাজে বাধা হয়ে দাড়িয়ে ছিনতাইকারীর অস্ত্রে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
আমরা সবকিছুই ভুলে যাই। ভুলে যাই কোন রাজনৈতিক দল আমাদের কী প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল, আর তার কতটুকু বাস্তবায়িত করতে পেরেছিল। কার আমলে দ্রব্য মূল্যের দাম কত হয়েছিল, কার আমলে বিদ্যুতের কী হাল ছিল, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দুর্নীতি, কালো টাকা আমরা কিছুই মনে রাখতে পারিনা। সব ভুলে যেয়ে আমরা ভালো থাকার ভান করি। প্রিয় ঝরনা বেগম, তাই আমরা আপনাদের ভুলে যাই, আমারও মহৎ হবার সুযোগ ছিল ভুলে যাই, মহৎ হবার ইচ্ছে ছিল ভুলে যাই।
এ্যাডভেঞ্চার বই পড়ে পড়ে জলদস্যু হবার ইচ্ছে ছিল, হতে পারিনি। দেবদাস উপন্যাস পড়ে নষ্ট হয়ে যাবারও ইচ্ছে হয়েছিল। তাও হতে পারিনি। আইনস্টাইন হবার ইচ্ছে ছিল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সূনীল গঙ্গোপাধ্যায় হবার ইচ্ছে ছিল। কিছুই হওয়া হয়নি।
তবুও আশার কথা, এখনও আপনাদের দেখে মহৎ হবার ইচ্ছে হয়।
মহৎ হবার জন্য কী প্রয়োজন? কোন পুলিশ সদস্যের আহত হবার সময় উপস্থিত থাকা? আমার সামনে পাঁচ লক্ষ টাকা পড়ে থাকতে দেখা? চলন্ত বাসে ধর্ষণ চেষ্টার সামনে দৈব ক্রমে পড়ে যাওয়া? আমি জানি এগুলোই সব নয়। আপনাদের উদ্যোগ আরও অনেক বড়, আরও অনেক মহৎ। আমি শপথ করছি, এধরনের কোন ঘটনা যদি আমার সামনে আসে আমি পিছপা হব না।
আমি একজন আপাকে চিনি, আপার বয়স এখন চল্লিশের কোঠায়।
অভাবের সংসারে নিজে চাকরি করে ছোট ছোট ভাই বোনকে পড়ালেখা করিয়েছেন। ছোট ভাইটা এখন বিসিএস ডাক্তার, বোনটা ইঞ্জিনিয়ার। আপা এখনও বিয়ে করেননি। জিজ্ঞেস করলে বলে, দেখেন আপনারা, ছেলে দেখেন। আমার সব টার্গেট ফিল আপ হয়ে গেছে।
জানিনা মুখের কথাই বলেন কিনা। বাংলাদেশী সূর্য এখন পড়ন্ত বেলায়। মানুষের একটাই জীবন, সেই জীবনটা আপা উৎসর্গই করে দিলেন!
আপার কথা যখনই মনে পড়ে, আমার মহৎ হতে ইচ্ছে করে।
প্রিয় ঝরনা বেগম, আপনাদের কাছাকাছি একটা জীবন অনেকেই পায়। আপনাদের কী আছে যা আমাদের নেই?
আপনি দীর্ঘজীবী হোন, আপনারা দীর্ঘজীবী হোন।
আর দেখেন, একদিন আমরাও...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।