জানতে ভালোবাসি,...তাই প্রশ্ন করি...
সদ্য অনুষ্ঠিত বরিশাল, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী—এ চারটি সিটি করপোরেশনে বিএনপি-সমর্থিত চার প্রার্থীর বিপুল বিজয় এটা প্রমাণ করে না যে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা তাঁদের চেয়ে দুর্বল ছিলেন; বরং ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি, সাংগঠনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় তাঁরা এগিয়ে ছিলেন। বিদায়ী চার মেয়রের মধ্যে অন্তত তিনজন তাঁদের মেয়াদকালে সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে অনেক কাজ করেছেন। কিন্তু তার পরও তাঁদের পরাজয়ের গ্লানি বইতে হলো। এর প্রধান কারণ তাঁরা যে দলের প্রার্থী ছিলেন, সেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের হতাশা ও অনাস্থা। এই নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীরা জয়ী হলেও মূল পরাজয় প্রার্থীদের নয়; সরকারি দলের।
সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের ১০ কারণ চিহ্নিত করা যায় এভাবে:
১. অতিআত্মবিশ্বাস: ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে একদা যেমন সূর্য অস্ত যেত না, তেমনি আওয়ামী লীগের নেতারা ভাবেন কোনো নির্বাচনে তাঁদের কেউ পরাজিত করতে পারে না। যদি কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতারা পরাজিত হন, তখন ভাবেন, এটা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফল।
২. ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব: আওয়ামী লীগ বরাবর বন্ধুকে শত্রু এবং নিকটকে দূর করতে পছন্দ করে। কেউ সরকারের সমালোচনা করলে তাঁকে দেশ ও জাতির শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আবার সেই শত্রুরা যখন আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন, তখন তাঁর দেশপ্রেমিকের সনদ পেতে অসুবিধা হয় না।
৩. সাংগঠনিক দুর্বলতা: আওয়ামী লীগ পুরোনো রাজনৈতিক দল। এই দলের সাংগঠনিক দুর্বলতাও পুরোনো। চারটি সিটি করপোরেশনের অন্তত তিনটি আওয়ামী লীগের একটি অংশ দলের মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে তলে তলে কাজ করেছে। কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সেই বিরোধ মেটানোর চেষ্টা ছিল না।
৪. বিরোধী দলের শক্তিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা: ২০০৮-এর নির্বাচনে বিজয়ের পর থেকেই আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আসছে।
শীর্ষ নেতাদের কথায় চরম অবজ্ঞা ও অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পেয়েছে। মানুষ কখনোই এ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি।
৫. মিত্রদের সঙ্গে অসহযোগিতা: চার সিটি করপোরেশনে মেয়র প্রার্থীদের ১৪ দলের সমর্থক বলে দাবি করলেও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ১৪ দলের মতামতকে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি কাউন্সিলর পদেও শরিকদের মতামত নেওয়া হয়নি। জোটগতভাবে কোনো তৎপরতাও লক্ষ করা যায়নি।
৬. জাতীয় পার্টির অসহযোগিতা: মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির কমবেশি ভোট সব সিটি করপোরেশন এলাকায় আছে। তাদের মতামত নেওয়া বা সহযোগিতা চাওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি আওয়ামী লীগ। ভেবেছে, একক শক্তিতেই নির্বাচনে জিতে যাবে। কিন্তু ২০০৮ আর ২০১৩ যে এক নয়, এই উপলব্ধি আওয়ামী লীগের নেতাদের আসেনি।
৭. কাজের চেয়ে কথা বেশি: গত সাড়ে চার বছরে আওয়ামী লীগের নেতারা, তার মন্ত্রীরা কাজের চেয়ে কথাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
তাঁরা ভেবেছেন, বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের কথা বলেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যাবে। সিটি নির্বাচন প্রমাণ করল শুধু কথায় চিড়ে ভেজে না।
৮. বিএনপিকে মৌলবাদীদের দিকে ঠেলে দেওয়া: ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি অনেকটাই জামায়াত থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলত। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা সব সময় তাদের জামায়াতের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দী করার কৌশল নিয়েছেন। এর ফলে সব মৌলবাদী গোষ্ঠী জোটবদ্ধ হয়ে বিএনপিকে ভোট দিয়েছে।
৯. সবকিছুর দায় চাপানো: জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মানুষ পছন্দ না করলেও বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিকে সমর্থন করছে। সরকার এ দুটিকে পৃথক না করে সব দায় যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধী তৎপরতা বলে চালিয়ে দিয়েছে।
১০. শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, হল-মার্ক ইত্যাদি কেলেঙ্কারির জবাব না পাওয়া: সরকারের নেতারা বিএনপিকে দুর্নীতিবাজ ও দুঃশাসনের প্রতিভূ বলে দাবি করলেও নিজেদের তার চেয়ে উত্তম প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথম দিকে মন্ত্রীদের কিছুটা পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি থাকলেও ‘আবুল ঘটনায়’ সরকার ও দলের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটাররা সরকারের প্রতি হলুদ কার্ড জানিয়ে দিয়েছেন।
আগামী নির্বাচনে তাঁরা লাল কার্ড দেখাবেন, না সাদা কার্ড, তা নির্ভর করবে ক্ষমতাসীনদের পরবর্তী আচরণের ওপর।
সোহরাব হাসান -প্রথম আলো
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।