সবাইকে শুভেচ্ছা। এক জীবনের মোম শরীর আমার, গলে গলে যায় প্রতিদিন।
তবে মোমেরা গলে যায় আলো ছড়িয়ে, মাথা থেকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে
কত জীবনেরে আলো দান করে একদিন নিঃশেষ হয়ে যায়।
কিন্তু আমার আলো নেই, শিখা নেই, তাই হয়তো আমি ক্ষয়ে যাই পা থেকে। পা থেকে আমার আজন্ম ক্ষয়িষ্ণু জীবন।
আমার সৌভাগ্য যে আমার এই ক্ষয়ে যাওয়াটাকে আমি খুব দেখতে পাই। আমার পা'দুটো কেমন ক্ষয়ে
ছোট হয়ে যেতে দেখেছি প্রতিদিন,
প্রতি সকালে এ আমার দেখার নেশা। খুব ধীরে,
কাউকে বুঝতে না দেওয়ার সুক্ষ্ণ শিল্পিক এক প্রণালী।
কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারি। আসলে কোন এক চারুপোকা,
খুব ধীরে খেয়ে চলে আমাকে।
প্রথম প্রথম মনে হতো, খাক না...
কতটুকু আর খাবে! একদিন ঠিক চলে যাবে
ছেড়েছুড়ে, একই স্বাদের বিস্বাদে।
আমি ঠিক দাঁড়িয়ে যাবো আবার পৃথিবীর মাটিতে।
এই আশা একদিন আমার জেগেছিল যখন
কৈশরের দুয়ারে পা রেখেছিলাম। প্রান্তের লাল সূর্য্যটাকে ধরবো বলে
দৌড়ে সীমান্তে গিয়ে দাঁড়াবো। মেঘের ভেলাদের সংগে পা রেখে রেখে
হাঁটবো নয়তো ঘুড়ি ওড়াউড়ি করবো রোদের জলে ভিজে।
কাঁধে বইয়ের বোঝা নিয়ে স্কুলে যাবো রোজ সকালে আর সব বন্ধুদের সাথে। কিন্তু পোকাটা চলে গেল না! রয়েই গেল।
আমার পা খেলো, হাত খেলো। শৈশব সেই কবেই খেয়েছে। কৈশোর, তাও।
এখন সর্বস্ব খাবে।
মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানেন! মনে হয়
আমি বুঝি এক জীবন্ত ভাস্কর্য হয়ে উঠছি। ভাস্কর আমাকে খুউব যত্ন করে পায়ের তলা থেকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে। এত নিপুণ তার কাজ,
আমার পা'টুকু শেষ করতেই কত বছর লেগে গেল।
অবাক হয়ে দেখলাম ভাস্কর কত সুক্ষ্ণ আঁচরে আমার
পা দু'টোর প্রান খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নিঃশেষ করে দিল!
ভাস্করের প্রথম ধাপ খুব ভালভাবেই শেষ করলো।
আমার হাতের কাজটাও প্রায় শেষ। পা দু'টো নিঃসাড় এখন,
হাত দু'টো অনাত্মীয় হয়ে গেছে প্রায়।
ইদানীং আমার খুব ভয় হয়। এতদিন আমি আমার ভাস্কর্য হয়ে ওঠাকে
খুব দেখতে পেয়েছি। ভাস্কর যদি এখন মগজ-মস্তকের কাজ শুরু করে, অথবা এই বুক, বুকের খাঁচা, খাঁচার অভ্যন্তরে, তাহলে আমি
আমার এই ধ্রুপদী বেড়ে ওঠা, ভাস্কর্য হয়ে যাওয়াটা দেখবো কেমন করে! শেষ দেখতে পাবো না তবে?
এখন চোখের কাজ শুরু করেছে মনে হয়।
ভাস্কর এখন
আমার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে,
ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শুন্তে পাই আজকাল। শুরুর আগে
ঠোকাঠুকির কাজগুলো বুঝতে পারি।
...খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি এখন, দশটি বছর শুধু বসেই কাটিয়ে দিলাম।
আমার বাবার জন্য খুব কষ্ট হয়। বাবার কাছে আমি
দুই যুগের শিশুই রয়ে গেলাম।
ওর কাঁধের ওপর ভর করে আমি
নির্ভার থেকেছি আমার পুরোটা কৈশোর। পুরো শৈশব তো প্রায়
কোলেই কাটালাম। আমাকে খেয়েছে কোন পোকা
কিংবা ভাস্কর, কিন্তু আর সবাইকে খায় সময়।
সময়ের সংগে সবকিছু প্রাচীন হয়ে যাওয়ার মত আমার বাবাও
ধীরে ধীরে প্রাচীন হয়ে গেল। একদিন দেখলাম বাবা আর আমাকে
ওর কাঁধে ধরে রাখতে পারছে না।
ক্ষয়ে যাওয়া আমার এই বাড়ন্ত শরীর
সদা শংকাগ্রস্ত আমার বাবার এতদিনের নির্ভরশীল কাঁধকে
হার মানিয়ে দিল। আমার আশ্রয় হলো দুই চাকার হুইল চেয়ারে।
এক সময় বাবার পা আর কাঁধই ছিল আমার অবলম্বন নিত্যদিনের চলাচলে, এ ঘর ও ঘর। এখন আমি অর্ধেক জীবন নিয়ে দু'চাকার যন্ত্রমানব,
বসে বসেই এদিক ওদিক করি।
পায়ের সংগে যেদিন আমার হাত দু'টোও গেল, সেদিন
বাবার হাতই হলো আমার হাত।
ওর হাতেই আমার প্রতিদিনের অন্নপ্রাশন। আমার প্রতিদিনের বেঁচে থাকা।
এমন সৌভাগ্য ক'জনের হয়, বাবার অকৃপন ভালবাসা আর স্নেহের উষ্ণ চাদরে সারা জীবন জড়িয়ে রাখা! পিতৃস্নেহ এত কোমল, এত উষ্ণ হতে পারে! পাতায় পাতায় বৃষ্টি ফোঁটা স্পর্শের মত এত প্রশান্তির হয়!
মাত্র দু'পাতার এই জীবন কাহিনী
তবু যায় মুছে প্রতিদিন, একটু একটু করে।
একদিন ভোর রাতে তোমরা দেখবে আমি পরিপূর্ণ ভাস্কর্য্য হয়ে বসে আছি। তোমরা সবাই দেখবে, শুধু আমি দেখতে পাবো না।
আমি ততক্ষনে পাড়ি দেবো মধ্যরাতের অন্ধকারের ভিতর দিয়ে আরেক আলোর দেশে। আমি জন্ম নেবো আবার, হবো মহাকালের বাসিন্দা। আমি আবার ফিরে পাবো আমার শৈশব-কৈশোর। দিগন্তের লাল সূর্য্যটাকে আমি ধরবো বলে ছুটবো, নাটাইয়ের সুতোয় আমার ঘুড়িগুলোকে খুব ওড়াবো, বৃষ্টিতে ভিজে কাদা-জলে হবো মাখামাখি, ছুটবো খুব সবুজ মাঠ পেরিয়ে...দুরে অনেক দুরে, অন্য কোন লোকে...মহাকালে!
(এক সুদর্শন তরুনের আত্মকথা, যাকে দেখলেই চোখে জল আসে। এক অজানা অসুখ ওকে টেনে নিয়ে চলেছে মহাকালের দিকে) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।