Never argue with idiots. They bring you down to their level and then beat you with experience আসছে ৪ নভেম্বর বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম দিকপাল ঋত্বিক ঘটকের জন্মবার্ষিকী। বাংলা চলচিত্র জগতে পরিচালক হিসাবে সত্যজিৎ রায়ের পর-ই বোধহয় তার অবস্থান। বেঁচে থাকলে এই দিনে ৮৭ তম জন্মদিন পালন করতেন তিনি। কিন্তু এই গুনী পরিচালক না ফেরার দেশে চলে গেছেন অনেক আগেই। তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে আগাম শ্রদ্ধাঞ্জলী।
....................................................................................................
'আমি আজও মরে যাইনি। আমি আজও হার স্বীকার করিনি। আমি নীরবে সে সুযোগের অপেক্ষায় আছি। আজ না পারি কাল, কাল না পারি পরশু প্রমাণ করে দেব। আজ আমি সংগ্রামী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবার ক্ষমতা রাখি।
তাদের আমি ভুলে যাইনি। অভাব, অনটন, অপবাদ কিছুই আমাকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না তার জন্য যে মূল্যই দিতে হয় আমি প্রস্তুত। '
মহাকালের সঙ্গে কথোপকথনের সঙ্গতি রচনায় যারা স্বপ্নের ডালপালা মেলে দেয়, অভ্যস্ত চাঁচকে অস্বীকার করে কোনো সময় জীবনের কথা বলেন, নবজীবনের আকাক্সায় সক্ষম বীজরোপণ করে মৃত্তিকার গহন থেকে মহীরূহ জন্মাবে বলে অন্তহীন আমন্ত্রণের গান গায় তাদেরই একজন শ্রী ঋত্বিক কুমার ঘটক। তাঁর বৃত্ত রচনার বাস্তবতা ছিল সত্যকে জয় করার অদম্য প্রয়োজন থেকে, ধ্বংসের ভেতর, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, আশ্রয়হীনতা ও অনিশ্চয়তার ভেতর থেকে অবশ্যম্ভাবী আগামীর বিকাশের নিয়মকে পরবর্তী প্রজন্মসমূহের রক্তে, চেতনায় সঞ্চারিত করার প্রয়াস থেকে। তাই তো পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা, ইতিহাসের প্রেক্ষিত তুলে ধরার দায়ের সঙ্গে আগামী দিনের বীরের ও অবয়ব উদঘাটন করার দায়িত্ব পালন করেন।
যুগসচেতন চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক এভাবেই ভাবতেন এবং নিজ চলচ্চিত্রে তা প্রস্ফুটিত করতেন। তিনি ঐসব শিল্পীদের মধ্যে একজন যিনি স্বপ্ন দেখেন ও দেখান যে, চূড়ান্ত অবক্ষয়ের মধ্যেও কীভাবে একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার বীজ সুপ্ত থাকে যেখানে শোষক ও শোষিত সম্পর্ক থাকবে না, শ্রেণী বিভাজন থাকবে না, সাম্প্রদায়িকতা, কাড়াকাড়ি, সাংস্কৃতিহীনতা থাকবে না। এমন সমাজ ব্যবস্থাকেই জীবনযাপনের বাস্তব প্রতিশ্রুতি করে গড়ে উঠবে একটি সুস্থ পৃথিবী যেখানে উপনিবেশের পঙ্কিলতা থাকবে না, থাকবে না সাম্রাজ্যবাদী লালসা, প্রথম বিশ্ব তৃতীয় বিশ্ব অভিধাগুলো থাকবে না। এ আশা পোষা এবং রোপণ করার ভেতর কোনো মনগড়া, উটকো উচ্চারণ নেই। কেননা, সমাজবাদী, বাস্তবতাবোধসম্পন্ন শিল্পী মাত্রই জানেন, তাঁর পারিপার্শ্বিক মানুষের এ দুঃখ, হতাশা, দৈন্য, জুয়াড়িবাজির জন্য দায়ী প্রচলিত সমাজব্যবস্থা।
এমন ব্যবস্থাকে দুষতে পারার জন্য বাস্তবতাকেই শুধু চিনলে চলছে না, খুঁজে দেখতে হবে কি কি বিধি এ অবস্থার নাটেরগুরু। ঋত্বিক ঘটক অমন প্রত্যাশা থেকেই জীবনের মর্মমূলে ঢুকে ইতিহাসের গতিপ্রক্রিয়া, প্রেক্ষিত, নিয়মানুবর্তিতাকে আবিষ্কারের জন্য সচেষ্ট হন। সমাজবাদী শিল্পী তার জীবনের সার্থকতা এ প্রতিশ্রুতির বাইরে ব্যবহার হলে তাকে খামখেয়ালিই মনে করেন। ঋত্বিক ঘটক যে দেশ তথা পারিপার্শ্বিকতায় বসবাস করেন তার চিত্রটা, চিন্তাটা হচ্ছে অসংযত, বোগাজ, তোষামোদি, সুবিধাবাদী খাছিলতে ভরা। সমন্বিত, সর্বাঙ্গীণ মুক্ত সমাজের চিন্তা ও কর্মের ভেতর শুধুই সিলছাপ্পড়ের মশকারি।
গণমানুষের বিভ্রান্তি, অর্থনৈতিক কাড়াকাড়ি, শ্রেণী বিভাজন, সাংস্কৃতিক ফাটল, বিদেশি বেনিয়ার লোলুপদৃষ্টি, রাজনৈতিকভাবে ভুল আবর্তের হাতে পড়ে মানুষের বেহালদশা। বুর্জোয়া সংস্কৃতির এসব ছলকলাকেই উন্মোচন করেন ঋত্বিক ঘটক।
ঋত্বিক ঘটক প্রণীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা আটটি। ০১. সুবর্ণরেখা, ০২. মেঘে ঢাকা তারা, ০৩. কোমলগান্ধার, ০৪. যুক্তি তক্কো গপ্পো , ০৫. অযান্ত্রিক, ০৬. তিতাস একটি নদীর নাম , ০৭. বাড়ি থেকে পালিয়ে, ০৮. নাগরিক এই আটটি ছবিই তিনি বানাতে পেরেছিলেন। এবং আরো অনেক বানানোর স্বপ্ন চোখে হারিয়ে গিয়েছিলেন।
এছাড়া অসমাপ্ত রেখে গেছেন চারটি ছবি। তিনি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ছাড়াও এগারোটা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং প্রমাণ্যচিত্র তৈরি করেন। এবং একাধিক চিত্রনাট্য লিখেন। বিষয় ও আঙ্গিকের প্রেক্ষিতে তাঁর সিনেমাগুলো বহুরৈখিক প্রেক্ষাপটের হলেও সমস্ত ছবিই অন্তর্বয়ানে সমাজ সমগ্র বদলেরই সত্যদর্শন ইঙ্গিত করে। এ ক্ষেত্রে তিনি বিষয়বস্তুর অন্যতম উপাদান হিসাবে দ্বন্দ্বকেই মূর্ত করে তোলেন।
প্রচলিত সমাজ কাঠামোর সঙ্গে মানুষের যে দ্বন্দ্বময়তা তার মধ্য দিয়েই বিরাজমান জীব থেকে স্পষ্ট করে চিনেছেন এবং চেনানোর চেষ্টা করেছেন। দূর থেকে নয়, কৃত্রিমভাবে নয়, জনজীবনের প্রবাহিত ধারার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে থেকে। দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, নেতৃত্বহীন রাজনীতি, মধ্যবিত্ত বাঙালির ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের অবক্ষয়, নাগরিক জীবনের অনিশ্চয়তা, সাংস্কৃতিক দূরত্ব, দু'বাংলার বিয়োগবিধুর সম্পর্ক সব মিলেই তাঁর সৃষ্টিকর্ম গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। সিনেমা বাস্তবের ছলনায় নির্মিত হলেও ঋত্বিকের সিনেমা সে ছলনাকে ডিঙ্গিয়ে বাস্তবের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যকে চিহ্নিত করে। অর্থাৎ ছলচাতুরিপূর্ণ সমাজ বাস্তবতাকে উন্মোচন করে, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করে ঋত্বিক ইঙ্গিত করেন হামাগুড়ি দিয়ে চলা জীবনের পায়ের ওপর দাঁড়াবার শক্তি, পথের দিশা।
সোজাসাপটাভাবে যা আমাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায়।
ঋত্বিকের প্রথম চলচ্চিত্র 'নাগরিক। যা তাঁর জীবদ্দশায় মুক্তি লাভ করেনি। 'নাগরিক' চলচ্চিত্রটি মধ্যবিত্ত সমাজের জীবন জটিলতা, নগরযন্ত্রণা, উদ্বাস্তু জীবন, যুব প্রজন্মের বেকারত্ব, হতাশা-বিচ্ছিন্নতা বোধ, শ্রেণী বিভাজনের অসুখ-বিসুখ, রাষ্ট্রের হাতে মানুষের পুতুল হয়ে পড়ার আবহই মূল উপজীব্য। ঘটকের সব ছবিতেই শিশু চরিত্রের ভূমিকা, সদ্য শিশুর আগমনী বার্তা থাকে।
কেন? সুদূরপ্রসারী ব্যাপ্তি থেকে এটি আগামী দিনের দায়-দায়িত্ব সম্পন্ন জীবনের আশা, জন্মচক্রের ধারায় জীবনের জয়গান, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও প্রাণের প্রেরণা পাওয়া, সমাজ বদলের বীরের প্রত্যাশাকে ফুটিয়ে তোলে। শিশু চরিত্রের মাধ্যমে ঋত্বিক খুব স্পষ্ট করেই হুঁশ জ্ঞানসম্পন্ন পথিকের ইঙ্গিত করেন, দায়িত্ব নিতে, সিদ্ধান্ত নিতে আহ্বান জানান। দ্বিতীয় ছবি 'অযান্ত্রিক'। নিঃসঙ্গ বিমল যে কিনা যন্ত্রকে যে শুধু যন্ত্র নয়, তার সঙ্গেও একটা মানবিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে তা অপরিসীম মায়ায় প্রমাণ দিয়েছে। কিন্তু যতই অযান্ত্রিক হোক না কেন শেষ পর্যন্ত যন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে মানবিক মানুষের মতোই।
আশপাশ থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন বিমল ট্যাক্সি জগদ্দলকে হারানোর চোটে যখন কেঁদে উঠবে, কেঁদে উঠবে আমাদের মন তখনই হঠাৎ তার মুখে ফুটে উঠে নিষ্পাপ হাসির রেখা। কারণ, একটি শিশুর হাতে খেলার আনন্দে বেজে উঠে জগদ্দলের ভাঙা হর্নটি। যেন সভ্যতার, নির্মাণের শেষ নেই, মৃত্যু নেই মানুষের মানবিকতার। আমরা তখন দায়িত্ব অনুভব করি, প্রতীকী অর্থে আগামীর হর্ন বাজিয়ে হতাশা, বিচ্ছিন্নতা তথা মুক্তির দিশা খোঁজার প্রত্যয়ে মিলিত হবার প্রেরণা পাই। অর্থনৈতিক অস্বাচ্ছন্দ্যে থাকার ফলে মানুষের যে ব্যক্তিবাদী মনোভাব, সমাজ বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, কোনো নিছক অনুভবকে আঁকড়ে থাকা, স্বার্থপর ওয়ে ওঠা, মানসিকভাবে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া, নগরজীবনের প্রতি মোহ এসব কিছুই ঘুরে ফিরে ঋত্বিক বহু আঙ্গিকে বলার চেষ্টা করেছে।
কেননা, 'অর্থ বিনা ব্যর্থ এই সংসার সবারি। 'হরদম যাদের অর্থ নেই, অর্থহীনতা তাদের জীবনকেই নিঃশেষ করে দেয়। রাজনীতি হোক আর ধর্মীয় জাতীয়তা বা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদই বলি না কেন সব কিছুর অন্তরে অর্থনীতি আছে এবং থাকে। কিন্তু এ থাকাটা স্পষ্ট করা হয় না। যেহেতু ঋত্বিক কুমার ঘটকের জীবনে শ্রেণী শোষণহীন সমাজের প্রত্যাশা আছে তাই তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, বাংলা ভাগ হওয়ার দরুন যে অর্থনৈতিক চুরমার ঘটেছে তার ষোল আনাই সুবিধাভোগীদের স্বার্থে।
কোমলগান্ধার, মেঘে ঢাকা তারা, সুবর্ণ রেখা, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো এসব কথাবস্তু নিয়েই নির্মিত। তাঁর চলচ্চিত্রের অধিকাংশ পাত্র-পাত্রীই উদ্বাস্তু। দলবদ্ধভাবে, বা ব্যক্তিগতভাবে একটি সম্প্রদায় এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে গিয়ে কি ধরনের সমস্যার পাঁকে জড়ায় তার চলচ্চিত্র রূপ আমরা তাঁর কাজে পাই, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্বাস্তু জীবন কীভাবে মানব মনকেও উদ্বাস্তু করে তার চিত্রটি মেঘে ঢাকা তারায় যেভাবে বর্ণিত আছে; দরিদ্র সংসারটিকে কোনো ক্রমে দাঁড় করিয়ে রাখে নীতা। বাবা-মাকে সাহস দেয়, ভাই বোনকে সহায় দেয়। সঙ্গীত চর্চায় দাদাকে উৎসাহ দেয়।
কিন্তু ক্রমে ক্রমে ক্ষয়ে পড়াটাই যেন নিয়তি অথচ ক্ষতটা ঠিকই গোপন রাখে নীতা। প্রেমিক সনৎ তাকে প্রত্যাখ্যান করে বিয়ে করল তারই ছোটবোন গীতাকে, অসহ্য হতে শুরু করল সবকিছু। প্রতারণার এই সংসারে গীতা নিজেকে গুটিয়ে নেয়। যক্ষ্মায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে। অথচ এ মৃত্যু সে চায়নি।
মা চায় রোজগেরে মেয়ে আইবুড়ো থাকুক, সনৎ চায় গ্লামার, গীতা চায় স্বাচ্ছন্দ্য, সততা-ন্যায়-সমতা থেকে সকলে বিচ্ছিন্ন। সকলেই নিজ নিজ নীড়ের সন্ধানে ব্রত। শেষমেশ মৃত্যুর দিন আসে। কিন্তু বাঁচার আকুতি তার জেগে ওঠে যখন দাদা হাসপাতালে নীতাকে বাড়ির খবর জানায়, জানায় গীতার ছেলের অসীম প্রাণ চঞ্চলতার কথা। তখন যক্ষ্মা রোগগ্রস্তা গীতা দাদাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে, 'দাদা আমি বাঁচব, বাঁচতে আমার বড় ভালো লাগে।
' আমরা বুঝে যাই শিশুটির জীবনাবেগে গীতা মৃত্যুকে অস্বীকার করতে চায়। এ যেন মৃত্যু নয় জীবনের ঘোষণা। এ শিশু আত্মার দিক থেকে তার কিন্তু ঘটনার পাঁকে শারীরিকভাবে অন্যের তথা ছোটবোন গীতার। সামাজিক পটভূমিতে নারীর স্থূল ও ভঙ্গুর জীবনযাপন ঋত্বিক চলচ্চিত্রে অসাধারণ ভঙ্গিমায় ফুটে ওঠে। জীবন চক্রাবর্তে নাগরিকের রামুর মা বোন, প্রেমিকা।
অযান্ত্রিকের প্রেমিক পরিত্যক্তা নাম-ঠিকানাহীন মেয়েটি। বাড়ি থেকে পালিয়ে সিনেমায় কাঞ্চনের মা, ছেলে হারানো বুড়ি মা-টা। মেঘে ঢাকা তারার নীতা, গীতা ও তাদের মা। কোমলগান্ধারের অনূসয়া। সুবর্ণ রেখার হরপ্রসাদের স্ত্রী, ঈশ্বরের বোন সীতা।
তিতাস একটি নদীর নামের রাজার ঝি, বাসন্তী আর যুক্তিতক্কো গপ্পোর বঙ্গবালা, নীলকণ্ঠের বউ সকলেই পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় জীবনযাপনে তথা মানসিকভাবেও উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। কোমলগান্ধার ঋত্বিকের পঞ্চম ছবি। আজীবন দেশভাগের যে যন্ত্রণা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে তারই নৈবদ্য। এ ছবির মূলসুর দুই বাংলার মিলনের। সংস্কৃতি সচেতন ছেলেমেয়েদের নাটকের দলেও ভাগাভাগি, একদল বিখ্যাত ক্যাসিকের পক্ষে অন্যদল চায় বাস্তবের মঞ্চরূপ।
শেষমেশ যৌথ নাটকের মঞ্চরূপ কিছু অসৎ, ঈর্ষাপ্রবণ, সুবিধাবাদীর দরুন ভেস্তে যায়। ১৯৪৭-এ ষোলোআনা সুবিধা পাবার আশায় বাংলা যেভাবে ভাগ করা হয়েছে তারই প্রতীকী দিক বহন করে কোমলগান্ধার। বিভক্ত বাংলার মর্মবেদনা নায়ক ভৃগু আর নায়িকা অনসূয়ার ছিন্নমূল হওয়া, সাম্প্রদায়িকতার বীভৎসতার মাকে হারানোর কষ্ট বেজে ওঠে। তবু চারপাশের শত ঝড় ঝাপটার মাঝে বাংলাকে তাদের মিষ্টি সুরের একটি মেয়ে মনে হয়। ভাঙতে ভাঙতে সব ভেঙে পড়ার পরও ভৃগু অনসূয়া ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি খোঁজে।
অনসূয়া বলে, 'মা বলতেন, পিচাশের বর্বরতা বার বার হানা দিচ্ছে এদেশে। তাই বীর তৈরি করতে হবে। সে ক্ষমতা একমাত্র মেয়েদের আছে। ... তুমি আমার মায়ের ছেলে তোমায় আমি দেখেই চিনেছি। 'কোমলগান্ধারের পর ঋত্বিক সাতচল্লিশের দেশভাগে বাঙালির জীবনে যে চরম বিপর্যয় নেমে আসে তাকে আরও যথাযথ রূপ দেয় সুবর্ণ রেখায়।
কোমলগান্ধার যদি হয় সংস্কৃতির মিলনের ইঙ্গিত, দ্বিধাবিভক্ত মনের পিছুটান তবে 'সুবর্ণ রেখা' হলো এ দুর্গতির কুফল বর্ণনার আলেখ্য। দেশভাগের কারণে ঈশ্বর ও তার শিশুবোন সীতা ও অভিরাম সকলেই ছিন্নমূল হয়ে যায় এপার থেকে ওপারে। অভি শৈশবে তার মাকে হারিয়ে যৌবনে ফিরে পায় মায়ের মরণদশা। স্বামীহারা সীতা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হয় আর তার ওপর উপগত হয়ে আসে তারই সহোদর ভাই ঈশ্বর। স্বভাবতই আত্মহনের মাধ্যমে সীতার শেষ পরিণতি ঘটে।
সীতা যেন বিভক্ত বাংলা, পতিতার মতো অবস্থা তার। সবাই তাকে শুধু ব্যবহারই করেছে। তবু বেঁচে থাকারও নতুনের, নবপ্রাণের খোঁজ পাওয়া যায়। সীতার শিশুপুত্র যখন নতুন বাড়ি যাবার কথা বলে তখন এত বিপর্যয়ের মাঝেও নতুন আশার স্বপ্ন জাগে। একদিকে হরপ্রসাদ, ঈশ্বরদের প্রজন্ম ব্যর্থ হলেও সীতার ছেলে বিনু ইতিহাসের পথে নতুন পথিক।
স্বপ্ন দ্রষ্টা। আর ঋত্বিক আমাদের হুঁশ ফিরিয়ে দেন হর প্রসাদের মুখ দিয়ে যখন উচ্চারিত হয়, ''দেখেন আগের যুগে ক্ষুধিরাম শহীদ হয়েছে। শান্ত পায়ে গান করতে করতে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াইয়া নিজ হাতে নিজের গলায় দড়ি পরাই দিয়েছিল। তার জানা ছিল যে সে কি। সেই ছিল তার মেরুদন্ড।
আর আইজ আমরাই ক্ষুধিরামের দল, আমরা জানিই না যে আমরা কি? তাই লড়াই করারে মনে করি মাইর খাওয়া। আর শহীদ হওয়ারে বলি পথকুক্কুরের মৃত্যু। '' ঐক্যের অভাবেই আজ মানুষ উদ্বাস্তু থেকে বসতি, বসতি থেকে উদ্বাস্তু। এমনি অনৈক্যের ফলে তিতাস পাড়ের জনগোষ্ঠী একদিন বিলীন হয়ে যায়। তিতাসের তীরবর্তী গ্রামের জেলেদের ভাগ্য তিতাসের সঙ্গে জড়িত।
তিতাসকে কেন্দ্র করেই তার তীরে গড়ে উঠেছে একটা সভ্যতা, একটা সংস্কৃতি, ধীরে ধীরে সে তিতাস একদিন শীর্ণ হয়ে যায়। জেলেদের জীবনে নেমে আসে অর্থনৈতিক বিপর্যয়। নদী শুকায় চর জাগে, আর সে চরের প্রতি কুদৃষ্টি পড়ে সমান্তবাদী ভূস্বামীদের। তারা চক্রান্ত করে জেলেদের সেখান থেকে উৎখাত করে। জেলেদের ঐক্যে ফাটল ধরাবার জন্য তার নতুন ফন্দি আঁটে।
ঋণগ্রস্ত করে তোলা, সংস্কৃতির ভাঙন ধরিয়ে তারা জেলেদের গ্রাম ছাড়া করে। কিন্তু সব নিশ্চিহ্ন হওয়ার পরও আমরা আশা পোষণ করি সভ্যতার রূপান্তর, নতুন কারীর। ছবির শেষ মরা তিতাসের বুকে যে চর জেগেছে, তাতে সবুজ ঘাসের ক্ষেত এবং তার ভেতর দিয়ে উলঙ্গ শিশুর ভেঁপু বাজিয়ে হেঁটে যাওয়া আমাদের বেঁচে থাকার ইঙ্গিত বহন করে। এ হলো 'তিতাস একটি নদীর নাম। ' আমৃত্যু বিপ্লবী শ্রী ঋত্বিক কুমার ঘটকের জীবনও কর্মকে ব্যাখ্যা করতে হলে আমাদের নানান কৌণিকতার প্রতি আলো ফেলতে হবে।
সমাজ বদলের সংগ্রামের স্বার্থে এ বিশ্লেষণ আমাদের অবশ্যই জরুরি।
ঘটক প্রণীত শেষ চলচ্চিত্র 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো। ' একদিক থেকে এটি আত্মজৈবনিক চলচ্চিত্র। ঋত্বিকের জীবনযাপনের আপসহীন, সংগ্রামী চিন্তার চিহ্ন বহন করে এ চলচ্চিত্র। তিনি নিজেই এ ছবির মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।
নীলকণ্ঠ বাগচী, নচিকেতা, বঙ্গবলা, জগন্নাথ, মিলে কলকাতা শহরের অলিগলিতে উদ্বাস্তু, জীবন নিয়ে নিরুদ্দেশ ঘুরাফেরা শেষে নীলকণ্ঠে বাগচী কাঞ্চনপুরে বউ, ছেলের কাছে যাত্রা করে। কিন্তু তাদের নিরুদ্দেশ যাত্রার কাল যেন শেষ হবার নয়। আকণ্ঠ মাতাল, হতাশ স্বামীকে তার স্বাধীনতা মতো থাকতে দিয়ে স্ত্রী-শিশু সন্তানকে নিয়ে গ্রামে চলে যায়। নীলকণ্ঠ বাগচীর বাকি জীবনে যেন আর কিছুই করার নেই। সমস্তই ভাঙা বাংলার মতো।
রাজনৈতিক নেতৃত্বহীনতা, রাষ্ট্রের শত্রুভাবাপন্ন আচরণ, ইতিহাসকে ভুলে চোখে দেখা, সমাজতান্ত্রিক অব্যাখ্যা, শিল্পী চরিত্রের অসাধুতা এমন পারিপার্শ্বিকতার ভেতর নিজেকে অর্থহীন, একজন ভাঙা বুদ্ধিজীবীর মতন মনে হন। দেশভাগ জাতিগোষ্ঠী, রাজনৈতিক প্রত্যাশা, সমাজ বিপ্লব সব কিছুই ক্রমে ভেস্তে পড়ছে। এরি মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আসা বঙ্গবলাকে পেয়ে নীলকণ্ঠের মনে হয়েছে যেন বাংলাদেশকে ফিরে পাওয়া গেছে। যে বাংলাদেশ আশ্রয়ের সন্ধানে নীড়হারা পাখির মতো ছুটছে। লেখক নীলকণ্ঠ বাগচী আর তার বন্ধুরা একদিন আরম্ভ করেছিল সংগ্রামী সমাজ সচেতন শিল্পী হিসেবে, আর আজ তার বন্ধুরা পর্নোগ্রাফি বেচে খায়।
তবু নীলকণ্ঠ নিজেকে লাইনচ্যুত করে না। সে জানে, 'ভয়াল ভয়ানকভাবেই নিশ্চল' তবু আমরা সকল কনফিউজড, দিশেহারা হয়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছি আশ্রয়। কিন্তু 'সব মাতাল, ... আমাদের সমস্ত জেনারেশনটার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। প্রস্তুতি, একটা কিছু থাকতে হবে। অনেক পথ।
আমাদের বাংলাটার হিস্টোরি কন্ডিশনটা কেউ সাইয়েন্টেফিকলি রিয়েলাইজ করেনি। বিজ্ঞানের সূত্রে ইলাস্টিক গ্রোথ হয়নি এবং ইকোনমিক কাসগুলো গত ২০০ বছরের উত্থান-পতন বিশেষ করে এ যে '৪৭ সালের বিশাল বিশ্বাসঘাতকতা, জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, ন্যাশনাল লিবারেশনের পিঠে ছুরি মেরে বুর্জোয়াদের ১৫ আগস্টের বিরাট বিট্রেয়ার ইন্ডিপেনন্ডেস। থু...। ' বলে যখন নীলকণ্ঠ ক্ষোভ ঝাড়ে তখন আমাদের অন্তত ইতিহাসে এগিয়ে নেয়ার কথায়ই বলেন। নকশাল আন্দোলনের ও রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর সংঘর্ষের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে মৃত্যু দৃশ্য রচনার আগে নীলকণ্ঠ তার ছেলেকে একবার দেখতে চেয়েছিল যা আগামী জীবনে ও দায়িত্বের প্রত্যাশাই বটে।
আর মৃত্যুর ক্ষণে আমাদের জানিয়ে গেছেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মদন তাঁতির কথা যে ভুবন মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তাঁত চালায়নি, ঐক্যের সঙ্গে, তাঁতি গোষ্ঠীর সঙ্গে যে বেঈমানী করেনি। অথচ আজ আমাদের সমাজবাস্তবতার গালে চাবুকের দাগ পড়ে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্নতায় ক্রমশ অন্ধকারে পতিত হচ্ছি। অথচ অন্ধকারই শেষ কথা নয়, আলোর খোঁজে ঐক্যবদ্ধ, দায়িত্বসম্পন্ন হতে হয়। ঋত্বিক ঘটক সমাজকে তার ক্ষয়ক্ষতসহ আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন, দেখিয়েছেন প্রাণের, জীবনের বহির্প্রকাশ।
যুগযন্ত্রণাকে গর্ভে নিয়ে নতুন কচি জীবনের স্বপ্ন দেখেছেন, দেখিয়েছেন। বীরের প্রত্যাশা করেছেন। কালজয়ী এ স্রষ্টাকে নিয়ে বলতে গেল নানান কৌণিকতা এসে যায়। নানান দিক থেকেই বলতে হয়। তিনি যেমন অনন্ত সংগ্রামী তেমনই চেয়েছেন বহু সংগ্রামী, বিপ্লবী জীবন।
তাঁর শিল্পকর্মগুলো যেমন ঐক্যসূত্রে বাঁধা তেমনই বলকাওয়াটা বিক্ষিপ্ত হলে তাকে বোঝা ভার হয়ে দাঁড়ায়। আকণ্ঠ সচেতন শিল্পীর মৃত্যুর হয় না, ঋত্বিক কুমার ঘটক ইতিহাসের বাঁক ধরে নিরবধি বয়ে চলা সেই সুবর্ণ রেখার তীরে পুনরুজ্জীবনের আকাঙ্খায় বসে আছেন।
** লেখাটি লিখতে ব্লগ, বিভিন্ন সাইটের নানাবিধ লেখা ঘাঁটাঘাটি করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রভাব চলে আসতেই পারে। এজন্য আগাম ক্ষমাপ্রার্থী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।