ভাই সাহেব একটু আসবেন? কিছু কথা ছিল।
জামান সাহেবের ডাকে গাড়িতে উঠতে গিয়েও উঠা হল না। জামান সাহেব। আমার ব্যাংকের একজন ক্লায়েন্ট। কারেন্ট একাউন্ট হোল্ডার।
দোকানে ঢুকলাম। তিনি বসতে দিলেন। ডাবল বেনিফিট প্রডাক্টটি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। নড়েচড়ে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই কি ডিপোজিট করতে চাইছেন? বললেন, ব্যাপারটা প্রায় ঐ রকমই।
ব্যাংকে টাকা রাখলে নাকি ছয় বছরে ডাবল হয়ে যায়? আমি বললাম, হ্যা। তবে ভাইসাহেব, আমার ব্যাংকে তো এই প্রডাক্ট নাই। আপনি বরং এক কাজ করুন, তিন মাস মেয়াদে ফিক্সড করে রেখে দিন।
বললেন, না, আমাদের ইচ্ছে ডাবল টাকা পাওয়ার। তা বিভিন্ন ব্যাংক যে ডাবল টাকা দেবে বলে, আসলেই কি তা দেয়? মানে, এক কোটি রাখলে কি মেয়াদ শেষে দুই কোটি টাকা দেবে? নাকি, কেটে রাখবে কিছু?
এক কোটি! বলে কি?? আমার ব্রােঞ্চ্ যদি এই টাকাটা নেয়া যায় তবে তো কম্ম সাবাড়।
এ বছর একটা অতিরিক্ত বোনাস পাওয়া ঠেকায় কে? আর তাছাড়া আমার যে নড়বড়ে অবস্থা ব্যাংকে, তাতে কোনদিন আমাকে বান্দরবন না ট্রান্সফার করে দেয় ভাবছি! গত বছর আমার ব্রাঞ্চের পারফরম্যান্স খুব একটা ভাল না। ইয়ারলি কনফারেন্সে চ্যায়ারম্যান আমাকে প্রকাশ্যে যে ভাষায় বকা দিয়েছে তা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। আপনারা আমাদের কোট টাই পড়া সৌন্দর্য দেখে ভাবেন কত না সুখে আছি আমরা। আসলে আমরা ভয়াবহ টেনশনে থাকি সারাক্ষণ! অসহনীয় প্রেশারে থাকি। ব্যাংকের মালিকপক্ষ বেনিয়ার বাচ্চা, লাভ ছাড়া কিছু বুঝে না।
ব্রাঞ্চকে যদি প্রফিট করে দেন তবে আপনি খুব ভাল। রাইজিং স্টার অব দি ইয়ার পদকে ভূষিত করতে কার্পন্য করে না। মাসের শেষেও দেয় মোটা অংকের বেতন। আবার তা দেয়ার পর চিন্তায় থাকে কিভাবে আপনাকে শুষে নিতে পারে। আমি ভাবি পূর্বজন্মে নিশ্চয়ই কোন পাপ করেছিলাম যে কারনে আমাকে আজ ব্যাংকার হতে হয়েছে।
আমি আমার ছেলে মেয়েকে বলব ভিক্ষুক হও, তবু ব্যাংকার হয়ো না।
যাই হোক, জামান সাহেবের প্রশ্নের উত্তর দেয়া উচিত। ডাবল বেনিফিটের চিন্তা তাকে বাদ দেয়াতেই হবে। যে করে হোক এই এক কোটি ডিপোজিট আমার ব্রাঞ্চে আনতেই হবে। বাই হুক, অর বাই ক্রুক।
অবশ্যই কেটে রাখবে। সরকারের ইনকাম ট্যাক্স তো আর এড়াতে পারবেন না। দিতেই হবে। এক কোটি টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা তো কেটেই রাখবে। আপনি পাবেন অতিরিক্ত নব্বই লাখ।
তাকে এই তথ্যটি জানালাম। বেশ জোরেশোরেই জানালাম।
ও আচ্ছা। তবু মন্দ না ব্যাপারটা। কী বলেন?
হায় হায় বলে কি ব্যাটা! তবু মন্দ না।
তার মানে এখনো ডাবল বেনিফিটের সিদ্ধান্তই স্থির! কি করা যায় তবে? কি করে তবে ব্যাটাকে আটকানো যায়? বললাম, না, ব্যাপারটা মন্দ না। আপনি চাইলে তো অবশ্যই করবেন। তবে আমার মনে হয় আরো খানিকটা ভাবা উচিত। এতগুলা টাকা বলে কথা! একবার রেখে দিলে তো হাজারো দরকারে আর তুলতে পারবেন না!
না না এ নিয়ে কোন চিন্তা নাই। এ টাকাটা একদম ফেলে রেখে দেয়া হবে।
আর, প্রাইম ব্যাংকের ম্যানেজার তো বললেন, যে হঠাৎ টাকার দরকার হলে ডিপোজিটের এগেইন্সটে এসওডি না কি লোন জানি সাথে সাথে দিয়ে দেবে।
তা দেবে। কিন্তু এর জন্য তো মোটা অংকের সুদ গুনতে হবে আপনাকে। সব ঠকানোর ফন্দি!
এতো এতো যুক্তি দেখালাম, ব্যাটা তবু একাট্টা! ডাবল বেনিফিট নাকি ভাল। কচু ভাল।
আর আমাদের ব্যাংকের ম্যানেজম্যান্টও যা! মাত্র কয়েকটা প্রডাক্ট নিয়ে বসে আছে। যুগটা হল প্রডাক্টের যুগ। বিজ্ঞাপনের যুগ। যে যত বেশি নিজের ঢোল পেটাতে পারবে তাকেই মানুষ বাহবা দেবে। আর প্রডাক্ট বাড়ালে দোষই বা কি।
তোর যখন এতোই ডিপোজিট দরকার, মানুষকে দে না একটুখানি। তোর যত আছে কমবে না তো। বরং দ্বিগুন পাবি। আর জামান সাহেবও যা! এতো টাকা পয়সা। তবু সুদের টাকার হিসেব করে।
বলি মুসলমান হয়ে সুদের টাকার এভাবে হিসেব নিতে তোর ভয় করে না। দোজখের কথা ভুলে গেলি? প্রতিদিন তো দেখি মসজিদে নামাজ পড়ার সময় দোকান লাগিয়ে গিয়ে নামাজ পড়িস! এসব কি তবে দেখানেপনা? মানুষকে দেখাস? তবে তো তুই মানুষকে ভয় পাস, আল্লাহকে না। তুই যাই চিন্তা করিস। আজ আমি তোকে ছাড়ছি না। আমরা হচ্ছি ব্যাংকের মানুষ।
মানুষকে কনভিন্স করার মতা আর কে রাখে আমাদের থেকে বেশি? সাধে কি ব্যাংকে মাস্টার্স পাশ লোকজনের নিয়োগ দেয়? আরে বাবা, আমরা যে কাজ করি ব্যাংকে তা তো একজন এসএসসি পাশ ছেলেও করতে জানে। এসএসসি পাশ ছেলেদের না নিয়ে এতো টাকা খরচ করে কেন আমাদের বেছে নেয় ব্যাংক? তোর মতো গাধাদের কনভিন্স করার জন্য। বুঝলি ব্যাটা? আজ তোকে দেখাবো আমার মতা কতটুকু।
রিং টোনের শব্দে বাধা পড়লো চিন্তায়। শিউলি।
আমার বউ। ইম্পর্টেন্ট মুহুর্ত। জানি, ফোনটা না ধরাটাই উচিত হবে। তবু ধরতে হল। না হলে যে শিউলি খেপে যাবে।
তার উপর আজ আবার ছুটির দিন। তার শক্ত নিষেধ আছে ছুটির দিনে ব্যাংকের কোন কাজ করতে। ওকে কিছুতেই বুঝাতে পারি না আমরা যারা ব্যাংকার তাদের আসলে ছুটির দিন বলে কিছু নেই। সারাণ ব্যাংকের চিন্তা করতে হয়। ব্যাংকের মালিকপক্ষ বেশি বেশি প্রফিট গুনার ধান্দায় সারাক্ষণ এতো বিভোর থাকে যে আমরা যে মানুষ, আমাদেরও যে পরিবার পরিজন আছে, রোমান্টিকতা আছে, স্বপ্ন আছে তা ভুলে যায়।
ব্যাংকে যখন প্রথম ঢুকি, তখন ৯ টা থেকে ৫টা পর্যন্ত অফিস টাইম জেনেই ঢুকেছিলাম । ওমা, পরে আমার ম্যানেজার আমাকে শুনালেন, ব্যাংকে ঢুকার সময় আছে বেরুবার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই! বের হতে হতে রাত ৮ টা ৯টা বেজে যেতো। আপনারই বলুন এটা কি মানুষের জীবন?
শিউলির কলটা ধরতেই মনে পড়ল আমাদের বাবুটা অসুস্থ। আমি বের হয়েছিলাম ওর জন্য ওষুধ কিনতে। শিউলি বেশ ঝাঁঝের সাথেই জিজ্ঞেস করল, একট মাত্র ওষুধ কিনে আনতে আর কতণ লাগবে তোমার।
আমি বিস্তারিত না বলে বললাম, যসুকে দিয়ে আনিয়ে নাও। আমি একটা কাজে আটকা পড়ে গেছি। যসু আমাদের বাসার কাজের ছেলে। ওই এ ওষুধটা আনতে পারবে। জানি শিউলি রাগ করবে।
আমার দায়িত্বহীনতার কথা তুলে আমাকে খোঁচা দেবে। দিক। আগেতো নিজের চাকরি বাঁচাই। চাকরি যে কোন সময় আমাকে ছেড়ে দিবে, শিউলি, লক্ষ্মী বউটা আমার, জানি আমাকে ছেড়ে যাবে না কখনো। আমাকে সে ভীষণ ভালবাসে।
মাঝে মাঝে তাকে জিজ্ঞেস করি, এতো ভালবাস কেন আমায়? তোমার ভালবাসার প্রতিদান তো আমি কিছুই দিতে পারছি না। তুমি কতো রোমান্টিক একটা মেয়ে। বিবাহিত জীবন নিয়ে তোমার যেসব স্বপ্ন ছিল তা তো কিছুই পূরণ করতে পারছি না। তোমাকে একটু খানি সময়ও দিতে পারি না। তুমি তো জানতে ব্যাংকারদের কেমন করে সময় কাটাতে হয়।
ব্যাংকারদের নিয়ে যে কৌতুকগুলা বহুল পরিচিত তা তো তোমার কাছ থেকেই জেনেছিলাম প্রথম। তুমিই তো একদিন হাসতে হাসতে বলেছিলে আগেকার যুগে নাকি ঝগড়া হলে একটা মেয়ে আরেকটা মেয়েকে অভিশাপ দিত এই বলে যে, তোর বিয়ে যেন কোন এক ব্যাংকারের সাথে হয়! অথবা ঐ কৌতুকটা: একটা পিচ্চি ছেলেকে তার ব্যাংকার বাবা একদিন রেগে গিয়ে খুব পেটালেন। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে তার মার কাছে গিয়ে নালিশ দিল, মা, মা ঐ লোকটা আমাকে খুব মেরেছে। প্রতি রাতে ছেলে ঘুমিয়ে পড়লে তারপর বাবা বাড়ি ফেরেন বলে ছেলে কখনো তার বাবাকে দেখতে পায়নি বলেই নাকি এ অবস্থা! তুমি তো সবই জানতে। তবে কেন বিয়ের প্রস্তাবটাতে রাজী হলে শিউলি? শিউলি নিশ্চুপ থাকে।
আর মুচকি হাসে। তার এই হাসিটা কতদিন যে দেখিনা! জামান সাহেবের কুৎসিত হাসিতে শিউলির হাসিটা চোখে ভাসতে গিয়েও ভাসল না। কলটা কেটে দিয়ে বিনয়ের সাথে জামান সাহেবের দিকে তাকালাম। তখন জামান সাহেবের মোবাইলটাও বেজে উঠল। কার সাথে জানি কথা বললেন একটু দুরে সরে গিয়ে।
তারপর আমাকে বললেন, মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়েেছ নাকি হঠাৎ। মাফ করবেন ম্যানেজার সাহেব, আমাকে যেতে হবে। হুহ! চলে যাবার কথা বললেই হল নাকি। যদিও কবি বলেছেন, যদি বলি যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়..। নাহ! আমি হচ্ছি ব্যাংকার মানুষ।
এতো সহজে আমি যেতে দিতে পারি না তাকে। বললাম, চলেন, আমিও যাব। সাথে গাড়ি আছে। ডাক্তার টাক্তার লাগলে সুবিধে হবে। সুবিধের কথা শুনেই বোধহয় কিছু না বলে তিনি আমার গাড়িতে উঠলেন।
তাকে নিয়ে তার বাসায় গিয়ে দেখি মেয়েটি তার ভয়াবহ অসুস্থ। তাড়াতাড়ি তাকে গাড়িতে তুললাম। ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার বলল হাসপাতালে নিতে হবে। জামান সাহেব প্রায় ভেঙে পড়েছেন একমাত্র মেয়ের অবস্থা দেখে।
তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করালাম। জামান সাহেব নিশ্চয়ই এবার আমার উপর সন্তুষ্ট হয়ে ডিপোজিটটা আমাদের ব্যাংকে দিয়ে দিবেন। তার মেয়ের সেবা করার এমন একটা সময়োচিত সুযোগ পেয়ে আমি মনে মনে খুশিই হলাম। ব্যস্ততার কারনে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে রাত নেমে গেছে টেরই পাইনি। হঠাৎ ঘড়িতে চোখ গেলে ব্যাপারটা ধরতে পারলাম।
ততক্ষণে মেয়েটিও কিছুটা সুস্থ হয়ে পড়েছে। এখন আমি বিদায় নিতে পারি। জামান সাহেবকে ব্যাপারটা বলতেই তিনি বললেন, ডিপোজিটের প্রসঙ্গে কাল জানাবেন। আমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলেন। রাত দশটা।
আমি বাড়ির পথে। খেয়াল হল আমার ছেলেটার কথা। পকেটে রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি তা বন্ধ। চার্জ চলে গিয়ে কখন যে মোবাইলটা বন্ধ হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি করে বাড়ি পৌছে যখন জানতে পারলাম আমার ছেলেটাকে নাকি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কাজের মেয়েটির কাছ থেকে আরো জানতে পারলাম, শিউলি নাকি অনেক চেষ্টা করেছে আমাকে মোবাইলে পেতে।
মোবাইল বন্ধ থাকায় আমাকে না পেয়ে তার ভাইয়ের সাহয্যে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পাঠক, বলে বুঝাতে পারব না, খবরটা জেনে আমার কতটা খারাপ লেগেছিল। আমার ছেলেটা যখন হাসপাতালে তখন কিনা আমি আরেকজনের মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে যাই। চাকরি আমার!
পরদিন সকাল বেলা জামান সাহেব কল করে আমার প্রতি তার কৃতজ্ঞতা জানালেন আর বললেন, আমার কথাই তিনি রাখছেন। বগুড়ায় থাকা তার শ্যালককে অলরেডি নাকি বলে দিয়েছেন তার এক কোটি টাকার ডিপোজিটটা যেন আমার ব্যাংকের বগুড়া শাখায় করে।
হায় আমার মার্কেটিং! উলুবনে মুক্তা ছড়ানো!
প্রসঙ্গত: আমি সিলেট ব্রাঞ্চের ম্যানেজার। বগুড়া ব্রাঞ্চের না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।