ওই যে নদী যায়রে বইয়া... শিশুটিকে জন্ম দেওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মারা যায় মা। এখন কী হবে? কে দেখবে এই নবজাতককে? সদ্য প্রসূত শিশুটির দিকে তাঁকিয়ে দুচোখ ভিজে যায় নয়া সরদারের। শিশুটি যখন ওর মায়ের গর্ভে, তখন থেকেই ওর মা অসুস্থ ছিল। নিজের নাওয়া-খাওয়ার দিকে খেয়াল ছিল না নয়ার। সবটুকু শক্তি দিয়ে সেবা করেছিলেন সদ্য প্রসূত এই শিশুর মায়ের।
কিন্তু তার পরও যা হওয়ার তা-ই হল। নয়া সরদারের ডান পাশে সদ্যজাত শিশুটি পা নাচাচ্ছে। আর বাম পাশে নিথর হয়ে পড়ে আছে শিশুটির মায়ের প্রাণহীন নিথর দেহ। কোমড়ের লাল গামছাটি খুলে নিয়ে চোখের পানি মুছে নেন নয়া সরদার। পরম মমতায় দুহাতে ধরে কোলে তুলে নেন শিশুটিকে।
ঠিক ওই মুহূর্ত থেকেই বদলে যান মানুষ নয়া সরদার। তাঁর চিন্তা-চেতনা, দৈনন্দিন কাজকর্ম সবকিছুই ওই শিশুটিকে ঘিরে।
পরিচিতজনকে ডেকে কাছে এনে নয়া সরদার বলতেন, 'দ্যাহো (দেখ) দ্যাহো, পাগালার (শিশুটির) চাওনিডা (চাহনি) কত মায়াবী!'
অনেক ভেবে-চিন্তে শিশুটির জন্য একটা নাম বের করেন নয়া সরদার। নামটির সঙ্গেও যেন অনেক আদর মেশানো। তিনি নাম রাখেন কালাচান।
দিন যায়, মাস যায়, একে একে বছরও চলে যায়। এভাবে কেটে যায় ১২টি বছর। নয়া সরদারের আদরে লালিত হয়ে কালাচান এখন অনেক সবল। তবে আর যা-ই হোক, নয়া সরদারের চোখের আড়াল কখনোই হয় না কালাচান। এলাকার সবাই ওর নাম আবার একটু বাড়িয়ে দিয়েছে।
নয়া সরদার কালাচান বলে ডাকলেও এলাকার লোকজন ডাকে কালাচানবাদশা বলে।
২০০৪ সালের ১৪ মে শুক্রবার। বেলা তখন ১১টা। জোয়ারে ডুবে যাওয়া মাঠ থেকে একটি নালা দিয়ে পানি নামছে ভাটির টানে। নালার পাশেই রক্তাক্ত প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে নয়া সরদারের।
নালা দিয়ে বয়ে যাওয়া ভাটির পানির সঙ্গে নয়া সরদারের শরীরের রক্ত মিশে পুরো নালাটিই যেন লালচে রঙের হয়ে গেছে। রক্ত-পানির নালার মধ্যেই হাটুপানিতে নেমে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে নয়া সরদারের আদরের কালাচান। নিরাপদ দূরত্বে কয়েকশ গ্রামবাসী চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কেউ একজন খবর দিলেন থানা-পুলিশে।
সন্ধ্যার আগে পুলিশের একটি দল এসে নয়া সরদারের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পাঠায় ময়না তদন্তে।
সবাই ব্যস্ত থানা-পুলিশ আর মর্গে যাওয়া আসা নিয়ে। কালাচানের খবর কেউই রাখেনি।
পরের দিন শনিবার দুপুর ১২টা। এলাকার লোকজন দেখলো কালাচান সেই একই যায়গায় একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। সবাই বলাবলি করছেন, মহিষটি স্বজন হারানোর কষ্টে কাঁদছে।
আসলেই কালাচানের দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছিল।
১২ বছর আগে যে কালাচানকে নিজের সন্তান ভেবে মমতায় কোলে তুলে নিয়েছিলেন নয়া সরদার, সেটি একটি মহিষের বাচ্চা।
জনৈক হাজি আলী হোসেনের বাড়িতে গরু-মহিষের রাখাল হিসাবে কাজ করতেন নয়া সরদার। মহিষ কালাচানের ১২ বছর বয়সে আলী হোসেন এটিকে বিক্রি করে দেন পার্শ্ববর্তী এলাকার গেন্দু মাতব্বরের কাছে। বিক্রি করার সময় নয়া সরদার অনেক ওজোর-আপত্তি করেছিলেন।
আলী হোসেন তা শোনেননি। গেন্দু মাতব্বর কালাচানকে তাঁর বড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরের দিন দড়ি ছিঁড়ে কালাচান আবার চলে আসে নয়া সরদারের কাছে। এদিকে গেন্দু মাতব্বর আবার এসে হাজির। তিনি আলী হোসেনের কাছে কালাচানকে ফেরত চাইলেন। আলী হোসেন নয়া সরদারকে বললেন, কালাচানকে গেন্দু মাতব্বরের বাড়িতে পৌঁছে দিতে।
নয়া সরদার রাজি হলেন না। বললেন, দ্যাখেন ভাইজান, ও ক্যামন করে আমার ঘাও (শরীর) চেটে দিচ্ছে।
এক পর্যায় মালিকের কড়া আদেশ এবং গেন্দু মাতব্বরের দেওয়া নগদ ৫০০ টাকা বকশিস পেয়ে কালাচানের শিংয়ে দড়ি বেঁধে নয়া সরদার এগিয়ে চললেন কালাচানকে নিয়ে গেন্দু মাতব্বরের বাড়ির উদ্দেশে। কালাচানও শান্তভাবে এগুতে থাকে। কিন্তু গেন্দু মাতব্বরের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালে কালাচান ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে।
শুরু করে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি। নয়া সরদার শান্ত করতে গেলে মহিষটি তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শিং দিয়ে তাঁর বুক-পেট চিরে নাড়ি-ভুড়ি বের করে ফেলে। শিং দিয়ে তাঁকে উঁচিয়ে নিক্ষেপ করে মাঠের পাশে একটি নালার মধ্যে। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় নয়া সরদারের।
এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, ওই ঘটনার পর থেকে কালাচান টানা ২২ ঘণ্টা একই যায়গায়, একই ভঙ্গিতে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে ছিল।
এ সময়ে মহিষটি কোনো রকম নড়াচড়া করেনি, এমনকি একটি ঘাসও খায়নি।
উল্লেখ্য, এ ঘটনায় ২০০৪ সালের ১৬ মে প্রথম আলোর শেষের পাতায় 'কী ছিল মহিষের মনে?' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।