আমি স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে --
এক
- ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে খুলনা থেকে ঢাকায় বড়চাচার বাসায় এসেছিলাম বেড়াতে; ১৯৯৪ সালের এক সনধ্যায়, ধানমন্ডি ৭ নম্বর রোডের পাশে আমাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে চাচা একটা দোকানে ঢুকেছেন। আমি গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ আবিস্কার করলাম আমার পাশের সাদা গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন তিনি আমার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ! আমার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠলো, ভুল দেখছি না তো? কিছুক্ষণ ইতস্তত করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে তাঁর সামনে গিয়ে বললাম, “স্লামালিকুম, আপনি কি হুমায়ূন আহমেদ?”
- “হ্যাঁ। ”
- “আমি আপনার একজন ভক্ত। আমার নাম মিতুল। ”
- “ও, কেমন আছ, মিতুল?”
- “জ্বী, ভাল।
আপনার সামনে দাঁড়াতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমি কাঁপছি, হার্টবিট খুব বেড়ে গেছে। ”
- “দেখো, হার্টবিট বেশি বেড়ে গেলে কিন্তু হার্ট ফেইল হয়ে যেতে পারে। ”
- তাঁর রসিকতায় আমি হাসলাম; তিনি গম্ভীর। তিনি হাসাবেন, নিজে হাসবেন না। যতদূর মনে করতে পারি, আমি ঐ সময় তাঁর “পোকা” বইটা পড়ছিলাম (যেখানে তিনি চরিত্রগুলির নাম কোথাও কোথাও ভুল লিখেছিলেন)।
সে প্রসঙ্গে আমি তাঁকে বললাম, “আপনি একজনের নাম লিখতে গিয়ে কোথাও কোথাও আরেক জনের নাম লিখেছেন…”।
- “চাদেঁরও কলঙ্ক আছে, আমার ভুল হইতেই পারে” ময়মনসিংহের সেই টানে তিনি বললেন; এবারও হাসলেন না, আমি হাসলাম।
- “আপনার একটা অটোগ্রাফ দেবেন?”
- “দাও, কাগজ-কলম দাও”
- আমি পড়লাম বিপদে। আমি হঠাৎ করে বড়চাচার গাড়িতে উঠে চলে এসেছি, চাচা গেছেন দোকানে। আমি কাগজ কলম কোথায় পাই? গাড়ির ড্যাশবোর্ডে ঘাঁটাঘাঁটি করে একটা দোকানের স্লিপ পেলাম, কলম নেই।
স্যারের কাছে গিয়ে বললম, “চাচা, কাগজ পেয়েছি, কলম পাইনি। ”
- আমার চাচা ডাকটা হঠাৎ মুখে এসে গিয়েছিল, তবে তিনি কিছু মনে করেছেন বলে মনে হলো না। তিনি বললেন, “কলম তো আমার কাছেও নেই। ”
- আমি এবার দোকানে ছুটলাম; তিনি চলে যাবার আগেই আমাকে কলম নিয়ে যেতে হবে তাঁর কাছে। দ্রুত একটা কলম কিনে আবার ছুটলাম, তখনও আমার ভেতর দারুণ উত্তেজনা, যেন কল্পনার জগতের এক মহামানবের দেখা পেয়েছি বাস্তবে।
- তিনি নির্বিকারভাবে সেই টাকার রসিদের উল্টোপিঠে অটোগ্রাফ দিলেন: প্রিয় মিতুল, ভাল থেকো।
- আমার অনুরোধে তাঁর ১০/এ নম্বর রোডের ৩৪ নম্বর বাসার ঠিকানাটাও লিখে দিলেন। তারপর গাড়িতে ঢুকলেন তিনি। তিনি চলে যাবার পরও আমার বিস্ময় আর আনন্দের ঘোর কাটতে বেশ সময় লেগেছিল সেদিন।
-
দুই- ১৯৯৮ সালে আমি এইচ.এস.সি. পরীক্ষা দিয়ে বড়চাচার বাসায় উঠেছিলাম বুয়েট ভর্তি কোচিং এর জন্যে।
চাচা তখন বেঁচে নেই, চাচী আমার অভিভাবক। ১৩ নভেম্বর ছিল স্যারের ৫০তম জন্মদিন। আগের দিন প্রথম আলো-তে পড়েছি, এই দিন তাঁর বাসার দরজা সবার জন্যে খোলা থাকবে; এই সুযোগ আমি ছাড়ি কী করে?
- আগের দিন নিউমার্কেট থেকে বড় একটা লাল রঙের কার্ড পেপার কিনে সেটা কেটে বিশাল একটা হৃৎপিন্ডাকার কার্ড তৈরী করলাম। ভেতরে কী লিখেছিলাম এখন মনে করতে পারছি না। তাঁর সাথে দেখা করার জন্যে ১৩ নভেম্বর ঘুম থেকে উঠেই রওনা হলাম।
সাত মসজিদ রোডের ঐ পারে তাঁর বাস, এপারে আমার…। পথে দেখা হলো শিলা ও বিপাশার সাথে। ওদের সাথে পরিচিত হলাম, জেনে নিলাম বাসাটা কোথায় এবং স্যার আছেন কিনা।
- স্যারের বাসার দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে ঢুকে দেখি ড্রয়িং রুমের ওপারে এক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে ডাইনিং স্পেস, সেখানে খাবার টেবিলে বসে লিখছেন তিনি।
আমাকে দেখে তাঁর পাশের চেয়ারে ডেকে বসালেন। আমার কার্ড ও জন্মদিনের শুভেচ্ছা বাণী সাদরে গ্রহণ করলেন তিনি। পরিচয় পর্ব শেষে একটা অটোগ্রাফ চাইলাম আমার নিজের জন্যে ও খুলনায় আমার এক চাচাত বোন নাহিদের জন্যে (সে স্যারের পরম ভক্ত)। স্যারকে পান্ডুলিপি লিখতে দেখে জানতে চাইলাম, কী লিখছেন। "চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস" এর পান্ডুলিপি দেখালেন তিনি।
স্বনামে একটি প্যাডে ছোট ছোট অক্ষরে আমাদের জন্যে শব্দের নকশীকাঁথা বুনছিলেন তিনি, দেখে যেন চোখ ধন্য হলো।
- অটোগ্রাফ নিয়ে তখন উঠতে যাব, তিনি বললেন, “আমার বাসায় আসছ, কিছু না খেয়ে চলে যাবা?”
- আমি হাসলাম।
- “মিষ্টি খাবা?”
- আমি বললাম, “আপনার বাসায় বসে মিষ্টি না খেয়ে গেলে পরে খুব আফসোস হবে”
- গুলতেকিন আহমেদ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। স্যারের ইশারায় তিনি ভেতরে গেলেন, হাসিমুখ করে আমাকে দুই প্লেট সন্দেশ এনে দিলেন। আমি বিস্ময়ে, আনন্দে বিগলিত..।
খেতে খেতে একটু পর দেখা মিললো নূহাশ ও নোভা আপুর। শিলাও বাসায় ফিরে আমাকে দেখে স্নিগ্ধ হাসি উপহার দিলো।
- আমার মতো মফ:স্বল থেকে আসা এক অচেনা কিশোর (তখনও তরুণ হয়ে উঠিনি) যে আন্তরিকতা আর আপ্যায়নের স্বাদ পেলো, তার তুলনা হয়না। স্যারের বাসার সেই কয়েক মিনিট আমার জীবনের সেরা সকালগুলির একটি।
-
-তিন
- -
- ২৩ জুলাই, ২০১২ স্যার এসেছেন।
তাঁকে দেখতে যেতে খুব ইচ্ছে করছিল। ইচ্ছে করছিল তাঁর সাথে শেষবারের মতো কাটাই আরো কয়েকটি মিনিট…। কিন্তু তাঁর এই বিধ্বস্ত চেহারা আমি দেখতে যাইনি। জানি, তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে গেছেন, দেখতে চেয়েছেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ, শেষ সুযোগ দিতে চেয়েছেন বিজ্ঞানকে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধে জয়ী হবার। আমি চাই তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত সেই চেহারাটিই থাক আমার স্মৃতিতে।
পত্রিকায়, টিভিতে, ফেসবুকে – কোথাও আমি দেখতে চাইনা তাঁর ক্ষয়ে যাওয়া মুখ।
- আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, তখন রাজু ভাইয়ার কাছ থেকে না বলে নেয়া “নিষাদ” দিয়ে শুরু করেছিলাম স্যারের বই পড়া। এরপর ১২তম জন্মদিনে উপহার হাতে পাই “আমার ছেলেবেলা”, জানতে পারি এক অমর লেখকের শৈশবের রঙ্গীন গল্প। এমিলি ভাবী উপহার দিয়েছিলেন “সূর্যের দিন”, মহান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে সেটা ছিল আমার পড়া প্রথম উপন্যাস। কিশোর বয়স থেকে বাবু ভাইয়ার সংগ্রহ থেকে বলে, না বলে নিয়ে পড়েছি অসংখ্য মিসির আলী আর হিমুর বই।
মিসির আলীর লজিক আর হিমুর এন্টি-লজিক আমাকে বারবার হাতছানি দিয়ে নিয়ে যায় এক ভিন্ন জগতে। “পোকা” বইটা পড়ে আমি বড়চাচাকে উপহার দিয়েছিলাম, তাঁর মতো স্বভাবের একটি চরিত্র এখানে ছিল বলে। নাহিদকে আমি সুপ্রভা বলে ডাকতাম, ঠিক যেন ওর মতো করে সুপ্রভা চরিত্রকে (উপন্যাস: “অপেক্ষা”) স্যার সৃষ্টি করেছিলেন। “জোছনা ও জননীর গল্প” ভোরের কাগজ-এ যখন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, তখন কিছুটা পড়েছিলাম, পুরোটা পড়েছি বড়চাচীর কাছ থেকে নিয়ে, পড়ে হেসেছি, কেঁদেছি, কখনও বা আতঙ্কে, কখনও ঘৃণায় শিউরে উঠেছি; পড়া শেষ করে ভেবেছি, একজন মানুষ কী করে এমন একটা ইতিহাসকে এত গভীর আর হৃদয়স্পর্শী করে লিখতে পারেন? আমার স্ত্রী সুমীও তাঁর ভীষণ ভক্ত। চাকরীর ব্যস্ততার মাঝেও সে ডাউনলোড করে স্যারের উপন্যাস পড়ে।
গত বছরও বিশেষ এক দিনে আমি ওকে উপহার দিয়েছি “দীঘির জলে কার ছায়া গো” বইটি।
-
- গতবার দেশে এসে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, তিনি সুপারম্যান নন, তার ভেতরে আছে মানবীয় সব দোষ। আমিও তাই বলি, ব্যক্তি হুমায়ুন একজন সাধারন মানুষ, মহামানব নন। তবে লেখক হিসেবে তিনি অনন্যসাধারণ। আমরা সেই অনন্যসাধারন ব্যক্তিত্বকে অমর করে রাখব আমাদের ইতিহাসে, আমাদের চেতনায়।
যেখানেই সমাহিত হোক তাঁর শরীর, তিনি স্বমহিমায় চিরপ্রোজ্জ্বল আমাদের স্মৃতিতে, মননে। সেই মানুষটি, যিনি বদলে দিয়েছেন আমাদের পাঠাভ্যাস, নির্মান করেছিলেন আমাদের মনন ও রুচি, শিখিয়েছিলেন কষ্টের ভেতর বাস করেও কীভাবে হাসতে হয়, অশ্রুভেজা চোখে কীভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়, তিনি আর লিখবেন না। তিনি রয়ে যাবেন আমাদের মেধায়, আমাদের মননে, চেতনায়। যুগে যুগে তিনি নাড়া দিয়ে যাবেন আমাদের হৃদয়ে, আমাদেরকে রসবোধের শিক্ষা দেবেন, দেশপ্রেমের দীক্ষা দেবেন; শুধু সশরীরে আর দেখা দেবেন না। চাইলেও আর তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে পারবনা আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে আপনাকে দেখে; বরং শুধু মনে হবে, আমাদের হৃদয় জুড়ে তিনি… যেন “নয়ন সমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই”।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।