আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছাতা মাথা আমজনতা

বসে আছি পথ চেয়ে.... ছাতা এবং মাথা- একটির সঙ্গে অপরটির ঘনিষ্ট সম্পর্ক। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি ছাতার প্রসঙ্গ এলেও অনিবার্যভাবেই মাথা এসে যায়। বর্তমানে এই বর্ষা-বাদলের দিনে ছাতা ছাড়া মাথার কথা চিন্তাও করা যায় না। আসলে মাথা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথার অন্ত নেই। শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গই হচ্ছে মাথা।

সব কিছু বাদ দিলে হয়তো মাথা সচল থাকে; কিন্তু মাথা বাদ দিলে সমস্তই অচল। তাই এ মাথাকে রক্ষা করতে আমাদের সারাক্ষণই মাথা ঘামাতে হয়। আমরা বলতে পারি, সবার উপরে মাথা সত্য তাহার উপরে নাই। আর এ ‘হেড’-কে ‘শেড’ দিতে মানুষ আবিষ্কার করেছে ছাতা। মানুষের অনেক সুমহান সৃষ্টি, এমনকি অনেক সুমহান সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেলেও ছাতা আজও অক্ষয় কীর্তি হিসেবে টিকে আছে।

মাথাকে বাঁচাতে ছাতার এ ভূমিকা সত্যিই বিস্ময়কর। ছাতার সঙ্গে মাথার এ চমৎকার স¤পর্কের কারণে কবিও আনন্দে লিখেছেন: পেটের উপর বুকের বসতি,/বুকের উপর মাথা/তাহারও উপর মুখের বসতি,/তাহার ওপর ছাতা। সমাজে মাথার মূল্য যাদের যতো বেশি, তারাই ততো বেশি ছাতা ব্যবহার করেন। আমাদের সমাজে যারা আমজনতা হিসেবে চিহ্নিত অর্থাৎ নিম্নবিত্ত গরিব, কৃষক, মজুর, মুটেরা বড়ো বেশি ছাতা ব্যবহার করে না। কারণ তারা জানে, জীবনে তাদের মাথার মূল্য নেই, প্রয়োজনও নেই।

তাই তাদের মাথা রোদে-জলে খোলা থেকে ওয়াটার প্রুফ হয়ে যায়। কিন্তু মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদের বেলায় তা হয় না। এই শ্রেণীর লেকেরা মাথা খাটিয়ে এবং মাথা বেঁচেই খান। তাদের জীবনে মাথার মূল্যই বেশি। তাই তাদের মাথা বাঁচানোর জন্য ‘উপরে ছাতা’র দরকার হয়।

যার যতো মূল্যবান মাথা, তার ততো মূল্যবান ছাতা। প্রতিটি বস্তুর যেমন একটি ইতিহাস থাকে, ছাতারও তেমনি একটি ইতিহাস আছে। অন্য অনেক জিনিসের মতো ছাতার আইডিয়াটাও মানুষের মনে এসেছিলো প্রকৃতির গাছপালা থেকে। আজো তাই রোদ-বৃষ্টিতে গাছের তলায় আমরা আশ্রয় নিই। সম্ভবত আদি মানবেরা লতাপাতার তৈরি ছাতা দিয়েই প্রথম যাত্রা শুরু করে।

সভ্যতার বিবর্তনের পথ ধরে এসেছে কাপড়ের ছাতা, প্লাস্টিকের ছাতা। ছাতার আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে রেইনকোট। বর্তমানে নানা রঙের, নানা বর্ণের, নানা সাইজের ছাতায় বাজার ছেয়ে গেছে। ছাতা দেখে অনেক সময় আমরা মানুষ চিনতে পারি। যার ছাতাতে যতো বেশি তালি, জীবনে সে ততো বেশি হোঁচট ও ঠোক্কর খাওয়া লোক।

নতুন ছাতা যার, তিনি ছাতা হারাতে ওস্তাদ এবং অত্যন্ত ভাবপ্রবণ উদাসীন কবি প্রকৃতির মানুষ। আর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যাদের ছাতা নেই, তারা অত্যন্ত সুবিধাবাদী তথা মতলববাজ। দরকার মতো এর ওর ছাতার তলায় কাজ চালিয়ে নেন এবং নিজে কোনো দায় না নিয়ে অন্যের ঘারে চাপতে চান। রাজনীতিবিদদের মতো এই ছাতাহীন ব্যক্তিরাও অত্যন্ত ডেঞ্জারাস এবং এ ধরনের লোক সম্পর্কে সতর্ক থাকাই ভালো। আমাদের এই মধ্যবিত্ত জীবনে কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করার আগে জেনে নেয়া দরকার তিনি নিয়মিত ছাতা ব্যবহার করেন, না অন্যের ছাতা দিয়ে কাজ চালিয়ে নেন।

ছাতার প্রকারভেদ আছে। ব্ল্যাক ছাতা, কালার ছাতা, ট্রাডিশনাল ছাতা, অটোমেটিক ছাতা, অ্যানালগ ছাতা, ডিজিটাল ছাতা। এমনকি ছাতার জেন্ডার পর্যন্ত আছে। ছাতার আকার এবং চেহারা দেখলে এই ইকোফেমিনিজমের যুগেও লেডিস এবং জেন্টস ছাতা নির্ণয় করা যায়। ছাতা আজ আর শুধু মাথায় সীমাবদ্ধ নেই।

নির্বোধ বাঙালি জাতিকে প্রজনন-নিয়ন্ত্রণের উপায়-উপাত্ত জানাতে ‘সবুজ ছাতা’ কর্মসূচি চালু হয়েছে। এই ‘সবুজ ছাতা’ চিহ্নিত অফিসে আপনি গেলেই প্রয়োজনীয় ‘সেবা-পরামর্শ’ পেতে পারেন। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য ছাতা নামক ক্ষুদ্র বস্তুটির ভূমিকা সত্যিই অপরিসীম। ছাতাহীন অবস্থায় আমরা কেউই বুঝি ভালোভাবে বাঁচতে পারি না। এ দেশে মতলববাজ, চোর-গু-া-বদমাশ, খুনি-সন্ত্রাসী-লম্পট, চাঁদাবাজ সবাই আশ্রয় নেয় ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক ছাতার নিচে।

আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পর্যন্ত ছাতা আছে। কালো টাকার মালিকেরা হচ্ছে এই ছাতা। সরকারের ছাতা হচ্ছে আমলা, সেনা ও দাতাগোষ্ঠী। বিপদে পড়লে আমাদের দেশে কম-বেশি সবাই শক্তিমানের ছাতার নিচে আশ্রয় নেন। অনেক সময় মানুষের উপর থেকে ছাতা সরে যায়।

কারো বাবা মারা গেলে যেমন আমরা বলি, আহা! ছেলেটির মাথার উপর থেকে ছাতা সরে গেল। আবার অনেকে ছাতা থেকে ছিটকেও পড়েন। অর্থাৎ ছাতার নিচ থেকে বের করে দেয়া হয়। বর্তমান যুগে সাফল্যের অন্যতম শর্তই হচ্ছে যখন যার ছাতার তলায় লাভ বেশি, সেই ছাতার নিচে আশ্রয় নেয়া। এ ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা-আদর্শ হচ্ছে বাতিল জিনিস।

সুযোগ মতো ছাতা ধরতে পারলে বা যোগ্য ছাতার তলায় আশ্রয় নিতে পারলে অনেক কিছুই অর্জন করা যায়। খুনের মামলা থেকে রেহাই, শ’ শ’ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ, লাইসেন্স-পারমিট, মন্ত্রীত্ব-সবকিছুই বাগানো সম্ভব। এদেশের আমজনতা ছাড়া সবারই কম-বেশি ছাতা আছে। তবে আমজনতা নিজেরাই হচ্ছে ব্যাঙের ছাতা। অকারণে অবহেলায় জন্ম নেয়, অতঃপর দলিত-মথিত হয়ে মারা পড়ে।

ক্ষমতার পালাবদল হয়, সিংহাসনের ছাতা বদলে যায়। কিছু লোক আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে যায়। কিন্তু আমজনতার জীবনে ছাতার সন্ধান মেলে না। এমনকি এই বর্ষা-বাদলের দিনেও না। হায়, এই বর্ষাঋতুতে জলবৃষ্টি থেকে তাদের মাথা কে রক্ষা করবে? ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।