ইহা কঠোরভাবে একটি রাজনীতি মুক্ত ব্লগ । । হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো
লেখকঃ বিশ্বজিত সাহা, মুক্তধারা নিউইয়র্ক এর প্রতিষ্ঠাতা।
------------------------------------------------------------------------------
দূরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে দ্বিতীয় দফা অস্ত্রোপচারের ২৯ দিন পর গত ১৯ জুলাই নিউইয়র্ক সময় দুপুর ১টা ২৩ মিনিটে নিম্ন রক্তচাপের ফলে তাকে চিকিৎসকেরা বাঁচিয়ে রাখতে ব্যর্থ হন। প্রায় তিন সপ্তাহ লাইফ সাপোর্টে থাকার পর অনেকটা নীরবে-নিভৃতে কিছু না বলেই চলে গেলেন বাংলা ভাষার কিংবদন্তির লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
১২টি কেমোথেরাপি বা প্রথম অস্ত্রোপচারের পরও হুমায়ূন আহমেদকে কখনো বিমর্ষ দেখায়নি। সব সময় তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত। হাসপাতালের বিছানায়ও হাসতে হাসতে অবলীলায় বলতেন মৃত্যু নিয়ে রসাত্মবোধক গল্প। সেই মানুষটি কিছুই বলে যেতে পারেননি, কিছু লিখে যেতে পারেননি শেষ মুহূর্তে। জুনের শেষ সপ্তাহে মুখে বলতে পারেননি।
তবে লিখে জানতে চেয়েছিলেন, কবে তার শরীর থেকে এসব যন্ত্রপাতি খোলা হবে। কবে তিনি আরোগ্য লাভ করে বাসায় যাবেন? কখনোই তিনি ভাবতে পারেননি তিনি এভাবে চলে যাবেন।
আমার স্মৃতিতে এখনো জ্বল জ্বল করছে, প্রথম অস্ত্রোপচারের আগে সার্জন মিলারকে নিজেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, কত শতাংশ নিশ্চয়তা রয়েছে তার ভালো হবার। ডাক্তার বলেছিলেন, ‘‘আমি অস্ত্রোপচার করলে শতভাগ। ’’ উজ্বল হয়ে গিয়েছিল হুমায়ূন ভাইর দু’চোখ।
এবং তারপর অনেক আনন্দ নিয়ে, মা মাতৃভূমি আর অতি ভালোবাসার নুহাশপল্লী দেখতে গিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদ দেশ থেকে ফিরে এলেন যেন আনন্দ উৎসব করে। বললেন, অনেক ভালো লেগেছে দেশে গিয়ে। মাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাইর ভালোবাসার শেষ নেই। মা ছেলের চিকিৎসার জন্য দিয়েছেন সারা জীবনের সঞ্চয়।
ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল হুমায়ূন ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর পরপরই বেলভ্যু হাসপাতালে বললেন, ‘‘আমাদের পরিবারকে আবার একটি মৃত্যুকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু দাদাভাইয়ের মৃত্যু মা মেনে নিতে পারবেন না। ’’
দেশ থেকে আসার পর হুমায়ূন ভাইয়ের ভালো লাগার গল্প প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় হতো। বিশেষ করে সুস্বাদু বাঙালি খাবারের গল্প। আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম ফেব্রুয়ারির বইমেলায়।
এরপর আবার নিউইয়র্কের বইমেলার প্রয়োজনীয় কাজ করতে মার্চে। প্রতিবারই দু’সপ্তাহের জন্য ছিলাম। একবারও আমি হুমায়ূন ভাইকে আগে থেকে জানাইনি, ঢাকায় যাচ্ছি। যেদিন ফ্লাইট ছিল সেদিনই তিন ঘণ্টা আগে গিয়ে বলেছি, আমি ঢাকায় যাচ্ছি।
মাঝখানে একটি থেরাপির সময় আমি শুধু ছিলাম না।
আর একটি থেরাপির আগের দিন নিউইয়র্কে পৌঁছে গেছি। বলে গেছি, হুমায়ূন ভাই আমি নেই, রুমা (আমার স্ত্রী রুমা সাহা) আছে। আপনি চিন্তা করবেন না। একটি বিষয়ে গত ৯ মাসে তিনি নিশ্চিত ছিলেন, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে সে আমাদের গাড়ি দিয়ে হোক বা সাবওয়ে হোক বা অন্য কারো গাড়ি করে নিয়ে যাবার জন্যে বিশ্বজিত হাজির থাকবেই। তার এ বিশ্বাসের কখনো অমার্যাদা হয়নি।
এ নিয়ে অনেক সময় অনেক কথাও হয়েছে। দেখা গেছে, হুমায়ূন ভাইকে বাসা থেকে ঘুম থেকে উঠিয়েও হাসপাতালে নিতে হয়েছে।
২৬ জুন অনেক রাতে গিয়েছিলাম বেলভ্যু হাসপাতালে। রাত ১১টা বেজে গেছে। আমি আর আমার স্ত্রী।
প্রায় দেড় ঘণ্টা ছিলাম হুমায়ূন ভাইয়ের পাশে। ২৯ জুন নিউইয়র্কের বইমেলা শুরু, তাই নানা ঝামেলায় দিনে যেতে পারতাম না। যতবারই চলে আসতে চেয়েছি, হুমায়ূন ভাই হাত দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য। দেড় ঘণ্টায় তিনবার চাইলেন পানি, পানি পানি। আমরা পানি পান করালাম।
এরপর যতোবারই গিয়েছি, হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে আর কথা হয়নি। চিনতে পারেননি আমার উপস্থিতি। হুমায়ূন ভাই, আর কখনো বলবেন না আর কিছুক্ষণ থাকো।
অনেক স্মৃতি, অনেক কথা। ১৯৮৭ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘আনন্দপত্র’ ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত উপন্যাস ‘প্রিয়তমেষু’ নিতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা।
২০১২ সালের ১৯ জুন অপরাহ্নে ২৫ বছরের একটি সম্পর্কের ছেদ, একটি বন্ধনের সমাপন।
আমার এখনো মনে আছে, হুমায়ূন ভাইয়ের যখন দ্বিতীয় কেমোথেরাপি চলছে স্লোয়ান ক্যাটারিং হাসপাতালে। সেদিন সকালে হুমায়ূন ভাই আমাকে বললেন, ‘‘বিশ্বজিত ক্যান্সারের চিকিৎসা শেষে এবার হার্টেরও চেক-আপ করিয়ে যাবো। গতবার ২০০১ সালে তুমি বেলভ্যু হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি চিকিৎসা না করে চলে গেছি।
এবার চিকিৎসা করিয়ে যাবো।
তিন ঘন্টার মতো লাগতো সময়। এরপর পোটেবল থেরাপি সঙ্গে দিয়ে হুমায়ূন ভাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হতো। সেদিনই কেমো নেয়ার ফাঁকে আমি বেলভ্যু হাসপাতালে খোঁজ নিতে যাই। এসে বললাম, কাগজপত্র নিয়ে এসেছি, বাকিগুলো জমা দিয়ে আপনার হাসপাতাল কার্ড করবো।
তারপর এক এক করে সব চিকিৎসা শেষ করে ভালো হয়ে দেশে যাবেন।
কোনো কিছু অপছন্দ হলে স্যার সরাসরি বলে দেন। এর প্রয়োজন নেই বা অন্যকিছু। কোনো এক প্রসঙ্গে এরপরই কেমোথেরাপির খরচ জানার জন্য একদিন বেলভ্যু হাসপাতালে যাই। পুরো অ্যাকাউন্টস সেকশন ঘুরেও আমি জানতে পারিনি, সিটি হাসপাতালে এর খরচ কতো।
দু’জন বাঙালি কাজ করেন, এ ডিপার্টমেন্টে। তারা চেষ্টা করেও আমাকে জানাতে পারেননি। আমার শ্বাশুড়ি মায়ের রেফারেন্সে পরিচয় হলো বেলভ্যু হাসপাতালে কর্মরত রনি বড়ুয়ার সঙ্গে।
এরই মধ্যে হুমায়ূন ভাইরা বেড়াতে যাবেন লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসুর ডেনভারের বাড়িতে। মহা আয়োজন।
যাবার দিন কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে দিয়ে গেলেন। এসে পেলেন হাসপাতালের কার্ড। আমেরিকায় যারা থাকেন, তাদের সকলেই জানেন, কারো অনুপস্থিতিতে কখনো তার হাসপাতালের কার্ড হয় না। হুমায়ূন আহমেদের বেলায় সেটাই হয়েছিল। তারপর হুমায়ূন আহমেদ ডেনভার থেকে ফিরে এলেন।
এসেই পেলেন বেলভ্যুর অ্যাপয়েন্টমেন্ট। আগে থেকেই আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখেছি।
অঙ্কোলজিস্ট ডা. জেইনের অধীনে চিকিৎসা শুরু হলো। কাড়ি কাড়ি নগদ টাকা দিয়ে স্লোয়ান ক্যাটারিং হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হয়নি। এভাবেই স্লোয়ান ক্যাটারিং হাসপাতাল থেকে লেখক হুমায়ূন আহমেদের বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হয়।
এর পর আর্থিক অসঙ্গতির জন্যে কারো কাছে দ্বারস্ত হতে হয়নি তাকে। বিক্রি করতে হয়নি নিজের গড়া কোনো সম্পত্তি। ঋণ নিয়ে হুমায়ূন ভাই সব সময় চিন্তিত থাকতেন। পত্রিকায় সাক্ষাৎকারেও বলেছেন, চ্যানেল আইয়ের ঋণ তিনি দেশে গিয়ে শোধ করে দেবেন। স্লোয়ান ক্যাটারিং হাসপাতালের তিনটি থেরাপীর খরচ বহন করার পর চিকিৎসার জন্য আর কোনো খরচ বহন করতে হয়নি হুমায়ূন ভাইকে।
মুক্তধারা থেকে বেলভ্যু হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
হুমায়ূন আহমেদের দীর্ঘ ৯ মাসের শেষ দিনগুলোর অনেক কথা লেখার ইচ্ছে রয়েছে। এ বছর নিউইয়র্কের বইমেলা নিয়েও ছিল হুমায়ূন ভাইয়ের অনেক স্বপ্ন। একদিন নিজে থেকেই বললেন, বিশ্বজিত এবারের বইমেলায় একটি অনুষ্ঠান হবে ‘শতবর্ষের বাংলা গান’। টপ্পা থেকে শুরু করে হাল আমলের গান পর্যন্ত।
প্রতিটি গানের শুরুতে গানটির ইতিহাস হুমায়ূন ভাই বলবেন। তখন আলো পড়বে হুমায়ূন ভাইয়ের ওপর। এরপর গান করবেন মেহের আফরোজ শাওন। তখন আলো থাকবে তার ওপর। গান শেষে আলো পড়বে যন্ত্রীদের ওপর।
হুমায়ূন ভাইর স্বপ্নের অনুষ্ঠানটি হলো না, হলো না তাকে সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠানটিও। হয়েছিলো তাঁর আঁকা প্রথম চিত্র প্রদর্শনী। ২০টি ছবি স্থান পায় এ প্রদর্শনীতে। এটিই হলো হুমায়ূন ভাইয়ের জীবোদ্দশায় তার ছবির প্রথম ও শেষ প্রদর্শনী। সে সময় তিনি ছিলেন বেলভ্যু হাসপাতালের সিসিউতে।
আসতে পারলেন না হুমায়ূন ভাই সে প্রদর্শনীতেও।
গত ১৩ নভেম্বর জ্যাকসন হাইটসের মুক্তধারায় অনুষ্ঠিত হয় হুমায়ূন ভাইয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। স্কাইপিতে নিজের টুপি খুলে সবাইকে অবাক করে দেন, তেমনি গ্রহণ করেন জন্মদিনের সিক্ত ভালোবাসা। হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনকে ঘিরে নিউইয়র্কের মুক্তধারা যেভাবে সাজানো হয়েছে, তা ছিল দেখার মতো। ৭ দিনব্যাপী চলে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রদর্শনীও।
যদ্দুর মনে পড়ে, ২০০১ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘হুমায়ূন মেলা’ হুমায়ূন আহমেদের ওপর সেরা অনুষ্ঠান। সে সময়ে জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী প্রায়ই আমাকে ওই অনুষ্ঠানের জন্য অভিনন্দন জানাতেন।
দুই সপ্তাহের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের শতাধিক বইয়ের প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র প্রদর্শন, হুমায়ূন আহমেদের গানের অনুষ্ঠান, হুমায়ূন আহমেদের মঞ্চনাটক, হুমায়ূন আহমেদের গল্প বলা নিয়ে অনুষ্ঠিত ওই ‘হুমায়ূন মেলা’ নিউইয়র্কবাসী তথা বাংলাভাষাভাষী মানুষের কাছে অমলিন হয়ে থাকবে।
হুমায়ূন আহমেদ শারীরিকভাবে আমাদের কাছ থেকে চলে গেছেন। তার অনেক স্মৃতি আজ উঁকি মারছে।
বলেছেন, চিকিৎসা শেষ করে কলকাতায় যাবেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখতে। কলেজ স্ট্রিটের আদর্শ হিন্দু হোটেলের গল্প শুনে বলেছেন, সেই হোটেলে খেতে যাবেন। হুমায়ূন ভাই, সেই আদর্শ হিন্দু হোটেলে আমিও কি আর কখনো খেতে যেতে পারবো, আপনাকে ফেলে?
১৯৯৭ সালে আমেরিকায় বইমেলা উদ্বোধন করলেন হুমায়ূন আহমেদ। সারাদিন মুষলধারে বরফ পড়ছে। তখন বইমেলা হতো ফেব্রুয়ারির শেষদিকে।
প্রচণ্ড তুষারপাতের মধ্যে (১২ ইঞ্চির উপর তখন বরফ পড়েছিল) উদ্বোধনের সময় লোকজন থাকবে কিনা সন্দেহে ছিলাম।
সন্ধ্যা ৮টায় উদ্বোধন। হুমায়ূন আহমেদ পৌনে ৭টায় মিলনায়তনে এলেন। ৩০ মিনিটের মধ্যে শত শত হুমায়ূন ভক্ত ঘিরে ধরলেন তাদের প্রিয় লেখককে। অটোগ্রাফ শিকারীদের কবল থেকে উঠে ফিতা কেটে বইমেলার উদ্বোধন করলেন তিনি।
আবার অটোগ্রাফ দিতে বসলেন। একজন পাঠক গোটা ত্রিশেক বইয়ে স্বাক্ষর করালেন। অপেক্ষারতরা ছিলেন ভীষণ বিরক্ত। কিন্তু সেই লাইন আমি কখনো ভুলবো না।
সেদিন একজন কিশোরী এসে বলেছিল, ‘‘স্যার আপনাকে আমি একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি? আরেকজন মুখে বলতে পারেননি।
কিন্তু তার প্রিয় লেখককে স্পর্শ করতে গিয়ে লেখককে ফেলেছিলেন বেকায়দায়। সে যাত্রায় রক্ষা পাওয়ার জন্য হুমায়ূন আহমেদকে সিগারেটের অজুহাতে অটোগ্রাফ দেওয়া থেকে উঠে যেতে হয়।
হঠাৎ করে একদিন বিশেষ খামে একটি চিঠি এলো মুক্তধারায়। চিঠিটা খোলা হলো। আমেরিকার লস এঞ্জেলেসের একটি জেলখানা থেকে।
একজন বাঙালি জেলখানা থেকে মুক্তধারায় চিঠি লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদের ২০১০ সালে প্রকাশিত বই চেয়ে। মানে পাঠকের আগের বইগুলো পড়া। জেলখানা থেকেও হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ার আকুতির কথা কি কখনো ভোলার?
এরকম আরো অনেক ঘটনা। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ যাচ্ছেন, ইমিগ্রেশন পার হচ্ছেন। বাঙালি ইমিগ্রেশন অফিসার এসে সালাম করে হতবাক করে দিলেন বা প্লেনে ওঠার পর ককপিঠে প্লেন চালক সিগারেট খাওয়ার জন্য স্যারকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।
কতো রকম ঘটনা। এ রকম আরো উল্লেখ করার মতো মজার ঘটনা আছে যা পরবর্তীতে লেখার ইচ্ছে আছে।
স্যার আসলেন ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে আমেরিকায়। লেখা শুরু করলেন প্রথম আলো এবং কালের কন্ঠে। নিজের মৃত্যুর কথা নিয়ে এমন রসিকতা (রসবোধ) করলেন তাতে পাঠকরাই শিউরে উঠলেন।
অসুস্থতার মধ্যেও লেখা ও পাঠ করেই কাটছে তার সময়।
এক কলামে লিখলেন, নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক গাজী কাশেমের বইয়ের কথা। আমেরিকা প্রবাসী বাঙালি লেখককূল হুমায়ূন আহমেদের কাছে পাঠাচ্ছেন তাদের গ্রন্থ। শ’ পাঁচেক বই ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে তার হাতে। এটি এক অনন্য উদাহরণ।
শুধু সব বয়সী পাঠকদের কাছে নয়, নবাগত লেখকদের কাছেও তিনি সমান জনপ্রিয়।
গত ৪০ বছরের এ ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার সুগভীর রহস্য শুধু তিনিই জানেন। আমরা শুধু স্মরণ করতে পারি, তার হিরন্ময় কিছু কাজ্।
নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার লিখে সাড়া জাগিয়ে সত্তর দশকের শুরুতে বাংলা সাহিত্যকাশে তার যাত্রা। এরপর এক এক করে তার সুনিপুণ লেখনীতে সৃষ্টি করেছেন মিসির আলী, হিমুর মতো কালজয়ী সব চরিত্র।
আবার মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখেন বিশাল ক্যানভাসের ‘জোৎস্না ও জননীর গল্প’। ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস মধ্যাহ্ন ও বাদশাহ নামদার বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গে সমানভাবে সমাদৃত।
আত্মজৈবনিক লেখা আমার ছেলেবেলা, কিছু শৈশব, বলপয়েন্ট, ফাউন্টেন পেন, কাঠ পেন্সিল এবং সর্বশেষ রং পেন্সিল পাঠকদের আগ্রহের নতুন সংযোজন। ‘দেয়াল’ প্রকাশিত হবার আগেই তার লেখনীর যাদুকরী স্পর্শে তৈরি করেছে দেশব্যাপী বিশাল আবেদন।
হয়তো দেয়ালই তার লেখা শেষ বই।
আমার যতদূর মনে পড়ে, হুমায়ূন ভাই বলেছিলেন তার মৃত্যুর পর তাঁর অনূদিত কোরান শরীফ প্রকাশিত হবে। সেটি এখন কোথায় এবং কোন অবস্থায় রয়েছে সেটাও অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের আগ্রহের বিষয়।
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পে হুমায়ূন আহমেদ একটি প্রতিষ্ঠান। যে প্রকাশকই তার আশীর্বাদ পেয়েছেন, তিনিই হয়ে উঠেছেন সে সময়ের সফল প্রকাশক। যেমন এক সময় ছিলো খান ব্রাদার্স, তারপর অবসর প্রকাশনা, এরপর সময়।
সর্বশেষ অন্যপ্রকাশ। হুমায়ূন আহমেদের আশীর্বাদেই বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে গড়ে উঠেছে বড় বড় প্রকাশনা সংস্থা।
তাই তার অসুস্থতায় প্রকাশক ও প্রকাশনা শিল্পে নামে বিষাদের ছায়া। তার মৃত্যুতে প্রকাশনা শিল্প কোথায় পৌঁছে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এতো গেল বাংলাদেশের কথা।
এবার দেখা যাক, পশ্চিমবঙ্গের দিকে। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের গ্রন্থ প্রকাশ। বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা মিত্র অ্যান্ড ঘোষ প্রকাশ করেছে ‘এইসব দিনরাত্রি’র মতো গ্রন্থ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত শারদীয় দেশ পত্রিকায় পর পর ৩ বছর প্রকাশিত হয় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস। আমার জানা মতে, দেশ পত্রিকায় এ যাবৎ আর কোন লেখকের পর পর ৩ বছর কোনো উপন্যাস প্রকাশ হয়নি।
এটাও তার জনপ্রিয়তারই স্বীকৃতি।
শিল্প-সংস্কৃতির নানা শাখায় হুমায়ূন আহমেদের সাফল্য প্রবাদপ্রতিম। তার এই সব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, বহুব্রীহি, অয়োময়, আজ রবিবার এর মতো ধারাবাহিক নাটক যেমন মানুষের হৃদয়ে চির জাগরুক, তেমনি নিমফুল, অচিন বৃক্ষ, আজ আমাদের ছুটি এখনো মানুষ খুঁজে বেড়ায়। হুমায়ূন আহমেদের শঙ্খনীল কারাগার গ্রন্থের মতো চলচ্চিত্রও অমর সৃষ্টি। পরিচালনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র আগুণের পরশমণি, সৃষ্টি করেছেন নতুন ইতিহাস।
আবার গ্রামবাংলাকে উপজীব্য করে সৃষ্টি করেছেন শ্রাবণ মেঘের দিনের মত্ অসম্ভব জনপ্রিয় চলচ্চিত্র।
আসলে সাহিত্য-সংস্কৃতিরে যে শাখায় তার হাত পড়েছে সেখানেই তিনি সোনা ফলিয়েছেন।
সংগীতের ক্ষেত্রে তিনি হাছন রাজাকে করেছেন পুনরাবিস্কার। আবার যখন নিজে গান রচনা শুরু করলেন, সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ কিছু গান- এক যে আছে সোনার কন্যা, ও আমার উড়ালপঙ্খী, বরষার প্রথম দিন, আমার ভাঙা ঘরের ভাঙা চালা, চাঁদনি পসর রাতে আমার মরণ, যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো, কে পরাইল আমার চোখে কলঙ্ক কাজল ... নামক অমর গীতিকথা।
হুমায়ূন ভাই, আপনি ২২ জুলাই সোমবার দেশে যাচ্ছেন।
সারা দেশের মানুষ, আপনার মা, ভাই-বোন, আপনার সন্তান নোভা, শীলা, বিপাশা, নুহাশ এবং সন্তানগুলোর মা আপনার অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন। আপনি কি এবারো সরাসরি আপনার তৈরি করা নন্দন কানন নুহাশ চলচ্চিত্রে যাবেন। সেখানে খাসি জবাই হবে। আনন্দ হবে। আবার আপনি চিকিৎসা করাতে নিউইয়র্কে ফিরবেন, আপনাকে আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাবো।
আর হবে না এসব কিছুই। এটাই এখন সত্য।
লেখকঃ বিশ্বজিত সাহা: লেখক, সাংবাদিক ও মুক্তধারা নিউইয়র্ক এর প্রতিষ্ঠাতা
সুত্রঃ Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।