রহিম বাদশা। অফিসিয়াল নাম আবদুর রহিম। কিন্তু কবে কখন তার নামের সঙ্গে বাদশা শব্দটি জুড়ে গেছে দিনক্ষণ হিসেব করে কেউ বলতে পারবে না। তবে বাদশা অভিধাটি যে তার কাজের স্বীকৃতি এটা সবাই স্বীকার করে। আগেকার দিনে রাজা বাদশারা কোনও খায়েশ করলে যেমন অপূর্ণ থাকত না তেমনি রহিম বাদশার ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য।
অবশ্য এ ধারণা তার কাছের লোকদের। তার সম্পর্কে অফিসে অনেক চটকদার কল্পকথা বা সত্যকথা প্রচলিত। সে নাকি খুব চৌকস অফিসার। যে কোনও কাজ উপরের মর্জি মতো করতে পারে। আবার কেউ কেউ বলে লোক হিসেবে সে খুব ধুরন্ধর।
চারপাশ ম্যানেজ করে চলতে অভ্যস্ত। নইলে এলডিএ কাম টাইপিস্ট থেকে এতদূর আসতে পারত না। অফিসে তার পছন্দের লোকদের ধারণা গত চল্লিশ বছরে তার মতো অফিসার তারা দেখেনি। সে চলে গেলে হারে হাওে অফিস তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে।
আজ রহিম বাদশার অফিসে শেষ কর্ম দিবস।
তার রুমের চারপাশে শুভাকাঙ্খী ও সহকর্মীদের আনাগোনা। তারা যখন তার কাছে এসে শেষ বারের মতো বিদায় জানায়Ñ তখনই সে বলেÑ
বিদায় বলছো কেন? আমি তো তোমাদের সঙ্গেই আছি। আল্লাহ চাইলে আবার ফিরতেও পারি। আমার জন্য দোয়া করো। সব আল্লাহর ইচ্ছা।
এ কথা বলে সে সামনে বসা লোকগুলোর দিকে ফ্যালফ্যাল কওে তাকিয়ে থাকে। আগত সহকর্মীরা দৃঢ়কণ্ঠে তার ইচ্ছার প্রতি সমর্থন জানায়। কারণ তারা ধরেই নিয়েছে স্যার ফিরে আসবেন। এছাড়া সে নিজের মুখে কাছের লোকজনকে বলেছেÑ যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে এই সরকারের মেয়াদের বাকি সময়টা চাকুরি করবে। তাদের ধারণা স্যারের যে ক্যারিশমাটিক ক্ষমতা, ফিরে আসা তার পক্ষে কোনও ঘটনাই না।
বরং বলা চলে মামুলি একটা ব্যাপার।
রহিম বাদশা চলে যাওয়ার পরপরই তার ফাঁকা চেয়ার স্বাভাবিক নিয়মে পূরণ হয়ে যায়। কিন্তু তার উপস্থিতি যেন প্রতিদিন টের পাওয়া যায়। সে সশরীরে না থেকেও অফিসে আসে। খবর হয়ে আসে।
আলোচনা-সমালোচনায় আসে। আজ এই পক্ষ বলে যে স্যারের কন্ট্রাক্ট আগামীকাল সই হবে। সরকারের উপর মহলের লোকজনকে ম্যানেজ করে ফেলেছে। অন্যপক্ষ বলে এটা অসম্ভব। আর এই সরকারের আমলে তো প্রশ্নই আসে না।
এই রকম উড়ো খবর আর আলোচনা এক টেবিল থেকে ঘুরে অন্য টেবিলে ছড়ায়। মজার ব্যাপার হলো এ নিয়ে কথা-বার্তা যতটা না অফিসাররা করে তারচেয়ে বেশি করে কর্মচারিরা।
দিন পনেরো পরের কথা। রহিম বাদশা সত্যি সত্যি তার ক্যারিশমা দেখাল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নাকি তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র জারি করেছে।
এ সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে সে অফিসে হাজির। যারা তার ফিরে আসার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছিল তারা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিল না, এটা কি করে সম্ভব? চারদিকে ফিসফিসানি আর চাপা গুঞ্জন। কেউ কেউ তো নিজের চামড়ায় চিমটি কেটে দেখে, যা ঘটেছে তা বাস্তবে না কল্পনায়। যদিও রিটায়ার্টম্যান্টের আগ-পর থেকেই জল্পনা-কল্পনা চলছিল রহিম বাদশা ফিরছে। তাদের ধারণা হয় চুত্তিভিত্তিক না হয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সে ফিরবে।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চাকরিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা তার সমালোচকরা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। যদিও এলপিআরএ যাওয়ার সপ্তাহ দুয়েক আগে অফিসের লোকজন আবিষ্কার করল রহিম বাদশা মুক্তিযোদ্ধা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নামে গেজেট জারি করেছে। তারপরও তারা নিশ্চিত। কারণ কায়দা-কৌশল করে সার্টিফিকেট জোগাড় করা গেলেও তার নিজ হাতে সই করা চিঠি তো মিথ্যা না? প্রয়োজনে খবরের কাগজের লোকদের সঙ্গে খাতির করবে।
তারপরও এ খবর ছাপাতে হবে। আর এ খবর ছাপলে কি হবে এটা আন্দাজ করতে পেরে তারা মনে মনে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। এখানেই মুক্তিযোদ্ধা রহিম বাদশার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। রহিম বাদশার পক্ষের লোকেরা ভড়কে যায়। কি ছিল সে চিঠি? একদিন গোপন খবরের মতো এ খবরও বেরিয়ে আসে।
তারপর ঘটনা সবার চোখের সামনে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। তারা জানতে পারেÑ
সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর আগে অফিসে একটা চিঠি দিয়েছিল। কোন দপ্তরে কতজন মুক্তিযোদ্ধা আছে। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে সেই চিঠির জবাব দিয়েছে রহিম বাদশা। সে জানিয়েছে তার বিভাগে খন্দকার করম আলী নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা আছে।
তার পদবিÑ এলডিএ কাম টাইপিস্ট।
খন্দকার করম আলীর চোখের সামনে ভাসে সেই চিঠি। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে তার নাম। মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার করম আলী। সেদিন তার খুব ভালো লেগেছিল।
এই প্রথম অফিসে তার নামটি বিশেষভাবে উল্লেখ হলো। চাকরি জীবনে সে যে লাঞ্চনা বঞ্চণার শিকার হয়েছে তা ক্ষণিকের জন্য হলেও সেদিন ভুলে গিয়েছিল। আর মনে মনে আল্লাহর কাছে শোকর গুজার করেছে।
সরকারের এ সিদ্ধান্তে অফিসের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী হতাশা প্রকাশ করলো। খন্দকার করম আলীকে তারা সেদিন বিশেষ চোখে দেখলেও সে চোখ ঈর্ষার আগুনে জ্বলজ্বল করছিল।
তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে খন্দকার করম আলী আবিষ্কার করেছিল সেই আগুনের উত্তাপ। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম ইকবাল আহমেদ। তিনি নিজের রুম থেকে উঠে এসে তার সঙ্গে হাত নয়, বুক মিলিয়ে ছিলেন। আর যারা সরকারের এ সিদ্ধান্তে হতাশ, তারা বলতে লাগলোÑ সরকার এই কাজটি ভালো করেনি। সময় সুযোগ পেলে কাজে অকাজে সরকারের গোষ্ঠি উদ্ধারে নেমে পড়ে।
তারা বললোÑ এ সরকার মুক্তিযুদ্ধের ঢোল বাজিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করে দেখাতে চায়। যাতে লোকজন বিশ্বাস করে যে, আগামীতে ভোট দাও, অনেক কিছু করবো। ,কেউ কেই বলতে লাগলোÑ
বুঝলেন না রাজনীতি, ভোটের রাজনীতি! সেই সঙ্গে যুক্ত হলো নতুন তত্ত্ব। সরকার নাকি মুক্তিযোদ্ধা কর্মচারি আর অমুক্তিযোদ্ধা কর্মচারিদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার জন্য এ কাজটি করেছে।
আর এর পেছনে সরাসরি ভারতের হাত আছে। তারা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, আসুক ভোটের দিন।
খন্দকার করম আলী এ সব কথা কেবল শুনে। কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কারণ সে জানে এসবের মানে কি?
আজ রহিম বাদশা যখন বীরদর্পে ফিরে এলো খন্দকার করম আলীর মনে ভয় ঢুকে গেল।
চাকরির বয়সসীমা বাড়াতে সে যে পরিমাণ খুশি হয়েছিল ঠিক সেই পরিমাণ ভয় পেয়েছে। প্রতিদিনের মতো অফিসে এসে তার মধ্যে যে প্রাণ চাঞ্চল্য থাকে আজ তা মিলিয়ে গেল। ফুটো হওয়া বেলুনের মতো যেন চুপসে আছে। কিন্তু কেন? সে কথা একমাত্র নিজেই জানে। মনে মনে আল্লাহরে ডাকে।
আল্লাহ জানে কি হয়। কারণ রহিম বাদশা নিশ্চিত ফিরতে পারবে না ভেবে সেদিন মনের জ্বালা মিটিয়ে ছিল। ঘটনার সময় এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে নিজেদের মধ্যে অফিসিয়াল পার্থক্যটাও ভুলে গিয়েছিল। আজকে মনে হচ্ছে কেন এ কাজটি করতে গেল? না করলে এমন কি ক্ষতি হতো? চুপ করে তো চাকরি জীবনটা প্রায় পার করেই দিয়েছিল? এখন যদি রহিম বাদশা সেদিনের অপমানের প্রতিশোধ নেয়, তাহলে তার কি এমন করণীয় আছে? খন্দকার করম আলী এসব ভাবে আর নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে। শত প্রশ্ন আর ভয় তাকে পলাতক আসামির মতো তাড়িয়ে বেড়ায়।
তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারের প্রতি সে খুব বেশি আস্থা রেখেছিল? তার কি একবারও মনে হয়নি যে, রাজনীতির মাঠে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছাড়া ভোটও হয় না। তবে একটা বিষয়ে সে নিশ্চিত যে, অন্তত ঘটনার সময়টাতে এ সরকারের প্রতি তার গভীর আস্থা ছিল। তার বিশ্বাস ছিল অন্তত এ সরকারের আমলে তার মতো রাজাকার গোছের লোকের ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। আজ মনে হচ্ছে সবই সম্ভব। মনের ভেতর ভয়টা আকাশের সাঁঝের মতো বাড়তে থাকে।
কি হবে কিংবা কি করবে। কারণ অন্য কেউ রহিম বাদশাকে না চিনুক সে চিনে। এবং হারে হারে চিনে। রহিম বাদশা সুযোগ কাজে লাগাবে না এটা ভাবাও অপরাধ। খন্দকার করম আলীর শরীর বেয়ে ঘাম পড়তে থাকে।
মুখ তোলে আকাশের দিকে তাকায় যেন উপরওয়ালার হাতে সবকিছু সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। যা হওয়ার হবে। আল্লাহ তুমি তো আছো? তার মনে পড়ে সেদিনের কথা। দিনটি ছিল বৃহস্প্রতিবার। অফিসে লোকজন কম।
কেউ কেউ অফিসে এসে খাতায় সই করে চলে গেছে। বাড়িতে যাবে। দূরের রাস্তা। তাই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া। সপ্তাহের এ দিনটিতে অফিস তেমন কড়াকড়ি থাকে না।
এটা বহুদিনের নিয়ম। বলা যায় অঘোষিত রেওয়াজ হয়ে গেছে। ভরদুপুরের ফাঁকা অফিসে টেবিলে বসে পত্রিকা পড়ছে খন্দকার করম আলী। সাধারণত অফিসে পত্রিকা পড়ার সুযোগ কম। আজ কাজ একটু তুলনামূলক কম বলে পড়ার সুযোগ হলো।
পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে তার মন খারাপ হয়ে যায়। একটা খবরও নেই যা দেখে সে আনন্দিত হতে পারে। সবখানে কেবল খুন আর দখলের খবর। এ সব দেখতে-শুনতে তার ভালো লাগে না। দু চোখের পাতা এক হয়ে আসে।
সাধারণত পত্রিকা পড়ার সময় প্রায়ই সে এমন করে। এমন অনেক দিন গেছে যে পত্রিকা হাতে নিয়ে মন খারাপ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কোনোদিন পত্রিকা পড়বে না। কিন্তু কথা রাখতে পারেনি। দেখা গেল পরের দিনই বাসে জ্যামে আটকা পড়ে বসে আছে। সময় কাটানোর জন্য গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ রাখে।
যদি হকার আসে একটা পত্রিকা কিনবে। যদিও শেষ পর্যন্ত পড়া হয় না। গরম থেকে বাঁচার জন্য পত্রিকা হাত পাখা হয়ে যায়। আজও পত্রিকা পড়তে ইচ্ছে করছে না। সে উঠে দাঁড়ায়।
বাইরের দিকে চোখ পড়তেই অবাক। চারদিকে গুমোট অন্ধকার। আকাশে মেঘ করেছে। সে মনে করতে চাইলো এখন বাংলা কোন মাস চলছে? কিন্তু পারল না। টেবিলের নিচে রাখা ক্যালেন্ডারে চোখ রেখে দেখে আষাঢ় মাস।
নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। কেমন মানুষ সে? এখন বাংলা কোন মাস বলতে পারে না। পরক্ষণেই সেই অপরাধবোধটা দূর হয়ে যায়। কেমন করে জানবে? দিনকাল যা পড়েছে? অথচ একটা সময় ছিল ক্যালেন্ডারে চোখ রাখার দরকার পড়তো না। প্রকৃতিই বলে দিত এখন কোন মাস? কোন ঋতু? সেদিন কি আর আছে? সব উজাড় হয়ে যাচ্ছে ছেলেবেলার মতো।
কেবল স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নেই। এমন সময় ঝপ্ঝপ্ করে বৃষ্টি শুরু হলো। টেবিলের কাছ থেকে কয়েক পা এগিয়ে সে জানালার পাশে দাঁড়াল। বৃষ্টি আর নদী তার বড় প্রিয়। জীবনে যতবার সে নদীর কাছে গেছে শরীর না ভিজিয়ে ফিরেনি।
আর বৃষ্টি আসলে ভিজেনি এমন দিন খুব কমই মনে করতে পারে। অনেক বছর হলো সে বৃষ্টিতে ভিজে না। শরীর কুলোয় না। কিন্তু আজ ভিজতে ইচ্ছে হলো। একবার ভাবলো অফিসে তো এমন কোনও কাজ নেই।
বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাসায় ফিরলে কেমন হয়। এমন সময় পিএ এনায়েত এসে পাশে দাঁড়ালো।
কী করছেন?
বৃষ্টি দেখছি।
স্যার আপনাকে সালাম দিছে।
তুমি যাও আমি আসছি।
এনায়েত চলে যাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ সে বৃষ্টি দেখলো। ইচ্ছে করছিল না স্যারের রুমে যেতে। কিন্তু অফিসের অর্ডার তো আর ইচ্ছে অনিচ্ছার মধ্যে চলে না। তাই এক রকম বাধ্য হয়েই স্যারের রুমের দিকে গেল।
স্যার আমাকে ডেকেছেন?
হ্যাঁ।
ভিতরে আসো। ভাবলাম তোমার সঙ্গে গল্প করি।
খন্দকার করম আলী স্কুল ছাত্রের মতো স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
দাঁড়িয়ে কেন বসো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে বসলো।
রহিম বাদশার সামনে সে সাধারণত আসতে চায় না। বড় ধরনের কোনও সমস্যা না হলে নানা অজুহাতে একে ওকে পাঠিয়ে ছোটখাটো কাজ সেরে নেয়। লোকটা তার দুচোখের বিষ। গত ২৭ বছর ধরে তাকে সে চিনে। অনেকে বলে সে নাকি পানিরঙা মানুষ।
কিন্তু আজ হঠাৎ কেন গল্প করার খায়েশ হলো সে বুঝতে পারছে না।
কোনও রকমের ভূমিকা ছাড়াই রহিম বাদশা কথা শুরু করে।
আপনি তো জানেন কয়েকদিন পরেই আমি এলপিআরএ যাচ্ছি। এতবছর একসঙ্গে কাজ করলাম। খুব মিস করবো সবাইকে।
মিস করার কি আছে স্যার। আল্লাহ চাইলে আপনি তো অল্পদিনের মধ্যে ফিরে আসবেন।
রহিম বাদশা খন্দকার করম আলীর চোখের দিকে তাকায়। কে কি বলছে। এ তো ভূতের মুখে রাম রাম! কারণ সে জানে তার ফিরে আসা সবাই মেনে নিলেও করম আলীর পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব না।
তবে কি বিদায়বেলা আমার প্রতি তার কোনও ক্ষোভ নেই? খন্দকার করম আলীকে বুঝার জন্য সে চেয়ার টেনে আরেকটু সোজা হয়ে বসে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না।
একটা কথা বলি আলী সাহেব
কি কথা স্যার?
রহিম বাদশা একটু সোজা হয়ে বসে। অফিসের চারদিকটা ভালো করে দেখে নেয়। চোখেমুখে একটু সিরিয়াস ভাব আনার চেষ্টা করে।
খন্দকার করম আলীও শরীর টান করে বসে। কি এমন কথা সে বলতে চায় যার জন্য তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। রহিম বাদশা মুখ খোলেÑ
আমি জানি আপনি ব্যক্তি হিসেবে খুব ভালো এবং সৎ। কিন্তু আপনার যে সমস্যা এর জন্য আপনি নিজেই দায়ি।
ঠিক বুঝলাম না স্যার?
বুঝবেন না।
আগেও বুঝেননি এখনও বুঝবেন না। যদি পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝতেন, তাহলে আজকে কোথায় থাকতেন জানেন? আমাকে দেখুন, কোথা থেকে কোথায় এসেছি। খন্দকার করম আলী কোনও কথা বলে না। চুপ করে তাকিয়ে আছে। কারণ সে জানে এই পরিবেশ পরিস্থিতিটা কি? খন্দকার করম আলীর নীরবতা দেখে রহিম বাদশা চেয়ারটা টেবিলের দিকে আরেকটু এগিয়ে আনে।
তার ধারণা বৃষ্টির অঝর ধারার মতো করম আলীর মনও পোড়খাওয়া জীবনের কথা ভেবে নিশ্চয় আফসোসের সাগরে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। সে নিশ্চয় বুঝতে পারছে সবকিছু অন্যের মতো চললে আজকে সে কোথায় থাকত। কি নেই রহিম বাদশার? গাড়ি বাড়ি অর্থ-কড়ি। এবার রহিম বাদশা সরাসরি বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে। আপনি সারাজীবন মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।
এই শেষ বয়সে এসেও কি আপনার মনে হয় না পুরনো গীত গেয়ে দেশটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি আমরা? দেশে আজ স্পষ্ট একটা বিভাজন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি আর বিপক্ষ শক্তি। আরে বাবা একটা দুধের শিশুও জানে এ বিভাজনের রাজনীতিটা শুরু করেছে ভারত। দেশে ঐক্য না থাকলে ভারতের জন্য সুবিধা। খন্দকার করম আলী আর বসে থাকতে পারছে না।
সে উঠে দাঁড়ায়। আর কিছু বলবেন?
উঠছেন কেন?
আপনার ফালতু কথা শুনে আমার কোনও লাভ নেই।
কি বলছেন বুঝতে পারছেন?
বুঝার দরকার নেই। আপনি রাজাকার মানসিকতার লোক। খন্দকার করম আলীর মুখে রাজাকার শব্দটি শুনে আঁতকে উঠে রহিম বাদশা।
মেজাজ বিগড়ে যায় তার। করম আলীর এত বড় স্পর্ধা। রাগে ক্ষোভে তার গলার স্বর উচু হয়ে আসে। রীতিমতো চিৎকার করে বলেÑ বস্। খন্দকার করম আলী খানিকটা ঘাবড়ে যায় কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়।
সেও জোড় গলায় বলে অফিসিয়াল কোনও কাজ থাকলে বলেন। নইলে আমি উঠে যাচ্ছি বলে সে হন্হন্ করে বেড়িয়ে গেল।
রহিম বাদশার রুম থেকে বের হয়ে খন্দকার করম আলী তার চেয়ারের দিকে গেল না। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। এমন কি দুর্বলতা সে জাহির করেছিল যে, শেষ পর্যন্ত তাকে এমন কথা শুনতে হলো।
সংসারের ঘানি টানতে তার কষ্ট হচ্ছে এ কথা সত্য। কিন্তু কোনোদিন তো মুখ ফুটে কাউকে বলেনি। তবে কি রহিম বাদশা বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিল? মনে হয় পেরেছিল। নইলে আজ এ কথা তুলবে কেন? খন্দকার করম আলী তারপরও বিষয়টি মানতে পারছে না। তার মনে পড়ে যায় বছর তিনেক আগের কথা।
তখন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। চারদিকে ধরপাকড় চলছে। ঠিক এমন সময়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের বিচার নিয়ে সবাই সোচ্চার। অফিসপাড়া থেকে শুরু করে খবরের কাগজ সবখানে দুর্নীতি আর যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তুমুল আলোচনা। এই যখন পরিস্থিতি তখনই ঘটনাটা ঘটে।
সেদিনও ছিল সম্ভবত বৃহস্প্রতিবার। অফিসে নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছেন খন্দকার করম আলী। হঠাৎ দেখে তার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছেন ইকবাল আহমেদ। বয়স খুব বেশি হবে না। বড়জোড় ২৭ কি ২৮ হবে।
তাকে দেখে সে দাঁড়িয়ে যায়।
স্যার আপনি?
না এমনিতেই আসলাম। হাতে কোনও কাজ নেই তো। ভাবলাম আপনার সঙ্গে গল্প করি। ইকবাল সাহেবের এমন আগমন সেদিন তার খুব ভালো লেগেছিল।
মনে মনে এক ধরনের আনন্দও পেয়েছিল। যাক এতদিন যে অফিসে সে কাজ করেছে সে অফিসটা বোধ হয় পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে। কোনও অফিসার একজন কেরানিমার্কা লোকের টেবিলে আসবে গল্প করতে ভাবা যায়? অফিসাররা তো নিচে চায়ের দোকানেই যায় না। পাছে যদি কর্মচারিদের সঙ্গে বসে এককাপ চা খেতে হয়। সেই অফিসেই কিনা এমন অফিসার চাকরি করতে এসেছে।
অবশ্য ইকবাল সাহেব আজই যে প্রথম এসেছে তা নয়। তিনি প্রায়ই এর ওর টেবিলে যান। গল্প করেন। এ নিয়ে অন্য অফিসার বিশেষ করে পুরনো অফিসারদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন আছে। কেউ কেউ অবশ্য বিষয়টিকে তার অভ্যাসের দোষ বলে মেনে নিয়েছেন।
তারা মনে করেন ইকবাল সাহেব খবরের কাগজের লোক ছিলেন। আর ঐ ধরনের লোকেরা সাধারণত এমনই হয়। কেউ কেউ অবশ্য বিষয়টি মেনে নিতে না পেরে তাকে সরাসরিই বলেছেনÑ এভাবে ওদের পাত্তা দিবেন না। মাথায় উঠবে। কিন্তু তিনি যে কথাটা গায়ে খুব একটা মেখেছেন এমন নয়।
আজ ইকবাল সাহেব গল্প করতে এসেছেন শুনে খন্দকার করম আলী হাতের কাজ রেখে আড়মোড়া ভেঙ্গে সোজা হয়ে বসলো।
স্যার বসেন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
ইকবাল সাহেব সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়েন। কোনও রকমের ভণিতা ছাড়াই বলতে শুরু করেনÑ আজ আমি আপনার কাছে গল্প শুনতে এসেছি। এটা আমার কাজে লাগবে।
কি গল্প শুনবেন?
মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধের গল্প?
একটি পত্রিকা বিশেষ সংখ্যা করবে। মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধকালীন সময়ের বিশেষ স্মৃতি নিয়ে। আমি ভাবলাম, আপনার একটি ঘটনার কথাই লিখি না কেন? তাই আসা। আপনার কাজ থাকলে আমি অন্য সময় এসে শুনবো।
না, স্যার। কোনও কাজ নেই। আপনি চাইলে আমি আপনাকে একটি ঘটনার কথা শুনাতে পারি। শুনবেন?
অবশ্যই।
খন্দকার করম আলী ইকবাল সাহেবের চোখের উপর চোখ রাখে।
আর বলতে শুরু করে সেদিনের সেই না বলা গল্প।
১৯৭১ সাল। শেখ মুজিবের ডাকে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কি রকম ছিল সে যুদ্ধ যারা করেছে বা দেখেছে তারাই জানে। বলে বুঝানো যাবে না।
বাড়ি ঘর ছেড়ে হাজারে বিজারে মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। আমার বাজান বুড়ো মানুষ। মা মারা গেছে সংগ্রামের আগের বছর। কি করবো বুঝতে পারছি না? আমার বন্ধুদের অনেকেই আগরতলা চলে গেছে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। আমার মন আনচান করছে কখন যাব? কিভাবে যাব? কিন্তু বাড়িতে বুড়ো বাপ।
সঙ্গে বড় বোনটাও এসেছে। বিয়ের পর প্রথম বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চাটার বয়স ৭ কি ৮ মাস হবে। এদিকে যুদ্ধের দাবানল দিনকে দিন বাড়ছে। আমি বাজানরে কইলাম যুদ্ধে যেতে চাই।
বাজান বললোÑ
আমি কই থাকুম। তার কথা শুনে চুপসে যাই। কিছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকি। এরপর বাজান বললোÑ
এক কাজ করোÑ আম্রারে সইতাইন্যা ঘাটের কাছে রাইখ্যা আস। ওহানে পাঞ্জাবিরা যাইব না।
আরও অনেকেই এই আশায় ওহানে গেছে। বাজানের কথা মতো পরদিন সন্ধ্যার দিকে রওয়ানা দিলাম। তখন বর্ষাকাল। সাথে বড় বোন ও তার দুধের শিশু। আমরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে হাঁটা ধরলাম।
রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে আছে। বাড়ি ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। বাহির থেকে দেখে বুঝার কোনও জো নেই যে, বাড়িতে লোকজন আছে। সবাই ভয়ে বাইরের দিকে তালা ঝুলিয়ে রেখেছে। কেউ বা সত্যি সত্যি বাড়িঘর আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে চলে গেছে।
আমাদের গ্রাম চিনাইর থেকে খেওয়াই খুব বেশি দূরে না। আর খেওয়াই গ্রাম পেরুলেই সইতাইন্যা ঘাট। এ ঘাটটি হচ্ছে তিতাস নদীতে। কিন্তু খুব বেশি দূরে না হলে কি হবে? সেদিনের এতটুকু রাস্তাকে মনে হচ্ছিল কেয়ামতের মাঠে পুলসেরাত পারের মতো কঠিন পরীক্ষা। কোমর সমান পানিতে আমরা হেঁটে চলেছি।
এমনভাবে হাঁটছি যেন কেউ টের না পায়। কারণ পাঞ্জাবিরা নৌকা করে টহল দিচ্ছে। পানি ভেঙে খেওয়াই গ্রামে ডাঙায় উঠেই আমার বোন অজ্ঞান হয়ে পড়লো। আমি ছিলাম সবার পেছেনে, বুঝতে আর বাকি রইল না। অতিমাত্রিক সর্তকতা অবলম্বন করতে গিয়ে ছেলের মুখের উপর হাত চেপে রেখেছিল।
দুধের শিশু। সেকি আর বিপদ আপদ কিংবা যুদ্ধ বোঝে? পাছে কখন চিৎকার করে উঠে এই ভয়ে হাত দেয়া। ফলে যা হবার তাই হলো। দম বন্ধ হয়ে মারা গেল। খন্দকার করম আলী এর বেশি আর বলতে পারল না।
দু’চোখ বেয়ে বানের জলের মতো চোখের জল গাল বেয়ে নামতে শুরু করল। এমন সময় এসে হাজির হলো রহিম বাদশা।
কি কাঁদছো কেন? কোনও সমস্যা?
না স্যার। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গল্প বলছিলাম।
এসব বলে কান্নাকাটি করে আর কি লাভ।
সামনে অনেক দিন পরে আছে। সেদিকে চোখ রাখো।
এরপর একদিন ইকবাল সাহেব হেড অফিস থেকে বদলি হয়ে চলে গেলেন সাতক্ষীরায়। খন্দকার করম আলী জানে এ বদলির উদ্দেশ্য কি? কে করেছে এই বদলি। কিন্তু জানলে কি হবে? তার কিছুই করার নেই।
সব আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়ে তিনি দিন গুনেন।
আজ যখন রহিম বাদশা অফিসে এসে পুনরায় নিজের চেয়ারে বসলো খন্দকার করম আলী ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। কারণ সে জানে সেদিনের ঘটনার কথা কোনোদিনই সে ভুলবে না। সুযোগ পেলেই মরণকামড় দেবে। আচ্ছা, এমন যদি হয় মিথ্যা অভিযোগে ওকে চাকরি থেকে বরখাস্তের চেষ্টা করে? তাহলে সে কি করতে পারে? তার মনে পড়ে গ্রামের বাড়ির দুঃসম্পর্কের এক ভাতিজার কথা।
নাম নাজমুল। সে নাকি এখন সরকারের কোন এক মন্ত্রীর পিএস। তার সঙ্গে একবার কথা হয়েছিল। খুব খাতির করেছিল। ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিলÑ কোন দরকার হলে চাচা ফোন কইরেন।
আমি আপনার ছেলের মতো। খন্দকার করম আলী পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে নাম্বারটা খোঁজে। হ্যাঁ পাওয়া গেছে। মনে মনে একটু সাহস ও ভরসা পায়। কিন্তু তারপরও মনের ভেতর এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে।
টেবিল থেকে উঠে বাইরে বেরোয়। অফিসে আজ উৎসব উৎসব আমেজ। মন্ত্রী মহোদয় এসেছেন। সঙ্গে রহিম বাদশাও। তিনি হাঁটতে হাঁটতে হল রুমের দিকে যান।
হলভর্তি মানুষ। একবার ইচ্ছে হলো ভেতরে ঢুকে বক্তৃতা শুনবে কিন্তু পরক্ষণেই তা উবে গেল। কারণ হলের ভেতর থেকে মাইকে যে কণ্ঠটি ভেসে আসছে এটি রহিম বাদশার। তিনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেনÑ এ সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করা। আমরা আশা করি, নির্ধারিত মেয়াদেই এটি সম্পন্ন হবে।
সত্যিই কি রহিম বাদশার কণ্ঠ না অন্য কেউ? বিশ্বাস করতে পারছে না খন্দকার করম আলী। ঠিক যেমন রহিম বাদশার ফিরে আসাটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না এটিও তেমনি। সে দরজার ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। সত্যি রহিম বাদশা! খন্দকার করম আলী ভেবেছিল বক্তৃতা না শুনে নিচে গিয়ে এককাপ চা খাবে এখন সেই রুচিটাও নষ্ট হয়ে গেল। হাত পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে।
নিচে নামার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। ঘামে ভিজে যাচ্ছে সারা শরীর। মনে হচ্ছে প্রাণ বুঝি বের হয়ে আসবে। সে ধপাস করে দু’পা ছড়িয়ে দরজার পাশেই বসে পড়ে। তার এ অবস্থা দেখে সহকর্মীরা দৌঁড়ে আসে।
বাথরুমের পাশে নিয়ে মাথায় পানি ঢালে। তারা জানতে চায় কি হয়েছে খন্দকার করম আলীর? সে কোনও কথা বলে না। নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে।
মন্ত্রী মহোদয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলেই রহিম বাদশার রুমে ডাক পড়ে খন্দকার করম আলীর। তার পিএ অবশ্য বলেছিল সে অসুস্থ।
কিন্তু রহিম বাদশা এসব শুনতে নারাজ। জরুরি তলব। খন্দকার করম আলী দুর্বল শরীর নিয়ে রহিম বাদশার রুমে প্রবেশ করে।
স্যার আমাকে ডেকেছেন?
হ্যাঁ। খন্দকার করম আলী কোনও কথা না বলে সামনের ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়ে।
অন্য সময় হলে সে পারমিশনের জন্য অপেক্ষা করতো। কিন্তু আজ শরীরটা এত খারাপ লাগছে যে অপেক্ষার সময় নেই। রহিম বাদশা তার রুমের ভেতর আগত সবাইকে বের হয়ে যেতে বললো। এ আদেশ শুনে খন্দকার করম আলী ভয় পেয়ে যায়। আঁচ করতে পারলো অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে।
সবাই বেরিয়ে গেলে শুরু হয় আসল খেলা।
তোমাকে বসতে কে বলেছে? নাকি এ ক’দিনে আদব কায়দাও ভুলে গেছ?
স্যার আমার শরীরটা হঠাৎ খারাপ লাগছে।
শরীর খারাপ না ছাই। তুমি এতদিন হেড অফিসে কি করে আছো? কোনও কাজ জানো না। শুধু শুধু দল ভারি করা।
অফিস সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোমাকে ঢাকার বাইরে পাঠাবে।
এমন আকস্মিক খবরে দিশেহারা হয়ে পড়লো খন্দকার করম আলী। সে জানতো রহিম বাদশা প্রতিশোধ নেবে কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এমনটা সে ভাবেনি।
স্যার আর কিছু বলবেন?
না, যাও। আ্যডমিন থেকে অফিস আদেশটা নিয়ে নিবে।
আর এক্ষুণি একটা রিলিজ অর্ডারের আবেদন করো। আমি সই করে দেব।
খন্দকার করম আলী একটি কথাও বলেনি। বাধ্য ছেলের মতো কথা শুনে বের হয়ে আসে। বদলির খবর শুনে সে বিচলিত না।
কারণ এটা চাকরির অংশ। আল্লাহ জানে এই দুবছরে সে কার উপর কি ঝাল ঝাড়ে। এদিকে রহিম বাদশার রুমের আশপাশে সহকর্মীরা কৌতুহল নিয়ে খন্দকার করম আলীর জন্য অপেক্ষা করছে। তারা জানতে চায় প্রথম দিন অফিসে এসেই কি এমন দরকার পড়লো যে, খন্দকার করম আলীর সঙ্গে সবাইকে বের করে বৈঠক করতে হবে? কিন্তু যখন শুনে খন্দকার করম আলীকে বদলি করা হয়েছে কেউ কথা বাড়ায় না। সবার চেহারার মধ্যে করম আলীর মতো কেমন যেন আতঙ্ক আর ভয়ের বলিরেখা ভেসে উঠে।
বিকেলে অফিস ত্যাগ করার আগে বদলির অর্ডারটা হাতে নিয়ে মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। কি এমন অপরাধ ছিল তার? যে কারণে তাকে এমন অপমানজনক বদলি করা হবে? তাও সপদে বদলি নয়। এলডিএ কাম টাইপিস্ট পদে থেকে কাজ করবে নাইটগার্ড হিসেবে। খন্দকার করম আলীর চোখের সামনে সন্তানের চেহেরা ভেসে উঠে । একজন দারোয়ানের মেয়েকে কি কেউ বিয়ে করবে? কোনও উত্তর পায় না সে।
নিজের পরিচিতজনের কাছে তার অবস্থানটা কোথায় দাঁড়াবে? তারপরও বদলিটা নিজ জেলা না হলে সে মেনে নিতে পারতো। নিজের জন্য না হলেও অন্তত সন্তানদের জন্য। কারণ চাকরিটাই তার একমাত্র সম্বল। এর উপর ভর করেই তিন তিনটে মেয়ে পড়ালেখা করছে। সেই সঙ্গে ঘরে অসুস্থ স্ত্রী।
প্রতিমাসে ওষুধ কেনা আর নিজের কথাতো বাদই। কি করবে সে বুঝতে পারছে না। অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দেখে রাস্তাঘাট ফাঁকা। আকাশে প্রচণ্ড মেঘ। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে।
মনে হচ্ছে প্রকৃতিও তার ব্যথায় ব্যথিত। অফিসের স্টাফ বাসে উঠতে ইচ্ছে করছে না। শরীরে শক্তি না থাকা সত্ত্বেও পায়ে হেঁটে মগবাজারের দিকে হাঁটা দিল। কিছুক্ষণ হাঁটার পরই অঝর ধারায় বৃষ্টি নামলো। চোখের জল আর বৃষ্টির জল মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
কে কাঁদছে? খন্দকার করম আলী না গোটাদেশ? বুঝা মুশকিল!
রাতে বাসায় ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়লো খন্দকার করম আলী। কপালে হাত রেখে টের পায় জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ওষুধ খেল না। তার মাথায় এখন আর অন্য কিছু নেই। আবার নাজমুলের কথা মনে পড়ে।
সেই পারে এখন তাকে রক্ষা করতে। মোবাইলটা হাতের কাছে এনে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর ব্যর্থ হয় খন্দকার করম আলী। চোখেমুখে অন্ধকার দেখে। সে রাতে খন্দকার করম আলীর গায়ে যেমন করে জ্বরের মাত্রা বেড়েছে তেমনি বেড়েছে হতাশাও। ঘুমের ঘোরে জ্বরের মাথায় সে তার মরা বাপের সঙ্গে নিজের দুঃখের কথা বলেছে।
এ কথা সে না বলতে পারলেও রুমমেটরা ঠিকই শুনেছে। সকালের দিকে শরীরের অবস্থা আরো অবনতি হয়। পাশের সিটের রফিক সাহেব লোকজন ডেকে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। করম আলীর যেন কী হয়েছে? লোকজন এসে ধরাধরি করে তাকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তার নার্স আর রুমমেটদের পদভারে মুখরিত হয় হাসপাতাল প্রাঙ্গণ।
খন্দকার করম আলী এসব দেখে না। কারণ সে তখন আইসিওতে। ডাক্তার জানিয়েছে স্ট্রোক করেছে। বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে। বিকাল নাগাদ সবাই এসেছে।
স্ত্রীর চোখে জল। সন্তান তিনটে কেবল কাঁদছে।
বিকেলের দিকে খবর পেয়ে দলবল নিয়ে ছুটে আসে রহিম বাদশা। তার আফসোসের সীমা নেই। এমন ভালো মানুষ হঠাৎ করে কিভাবে এত অসুস্থ হয়ে পড়ে।
সে একে ওকে ফোন করে খবরটা জানায়। রাত বাড়তে থাকে। তার অধনস্তরা তাকে তাড়া দেয়Ñ স্যার রাত হয়ে যাচ্ছে। বাসায় যাবেন না?
যাব। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে সর্বশেষ অবস্থাটা জেনে নিই।
এমন সময় নার্স এসে জানালোÑ তার পরিবারের লোকজন কে আছে? এগিয়ে যায় রহিম বাদশা। নিজের পরিচয় দিয়ে সে করম আলীর খবর জানতে চায়। নার্স জানালোÑ অবস্থা খুব ভালো না। শরীর দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। এ খবরে কান্নার রোল পড়ে হাসপাতাল জুড়ে।
রহিম বাদশা সান্ত্বনা দিচ্ছে করম আলীর সন্তানদেরÑ
আল্লাহরে ডাকো। সব তার ইচ্ছায় হয়। সাহস হারাও কেন? আমরা আছি না?
০৪.০৭.১২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।