https://www.facebook.com/blogger.sadril মূসা ইব্রাহিমের এভারেস্ট জয়ের কিছুদিন পরের ঘটনা। ঢাবির কলা ভবনের নিচ তলায় লিফটের জন্য সাগর কলার মতো লম্বা লাইনে দেখি বন্ধু শওকত দাড়িয়ে লম্বা লম্বা হাই তুলছে। আমি আগে থেকেই জানি, তার ডিপার্টমেন্ট লোক-প্রশাসন তিন তলায়। শাসন করার উদ্দ্যেশ্যে তাকে বলি “মুসা ইব্রাহিম পায়ে উঠে এভারেস্ট উইঠা গেলো আর তুমি তিন তলায় সিড়ি বেয়ে উঠতে পারবা না??” তার সার্ফ-এক্সেলে ধোয়া সাফ জবাব “মুসা তো একদিন এভারেস্ট বাইছে আমারে তো প্রতিদিন বাইতে হয়”। কথাটা ফেলে দিতে পারলাম না।
সবকিছুকে যদি আপেক্ষিকভাবে দেখি তাহলে এভারেস্টে ওঠাটাও হয়ে যেতে পারে তিন তলায় ওঠার কষ্টের সমান। কিছুদিন আগেই আমদের ৯তলা এপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর লিফট একজন চরিত্রহীনের মতো নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তখন চলছিলো আমার আম-কাঠালের ভ্যাকেশন মানে সামার ভ্যাকেশন। । প্রযুক্তির আরও উতকর্ষ সাধিত হলে আম গাছে লিফট ফিট করে সেটায় করে গাছে চড়ে আম পেড়ে খেয়ে আম-কাঠালের ভ্যাকেশনটাকে সার্থক করা যেত।
কিন্তু সেরকম করার সুযোগ নেই। তাই সামার ভ্যাকেশন কাটাচ্ছিলাম চামার হয়ে ঘরে বসে বসে। ঘরের জন্য টুকিটাকি কিনতে দোকানে যেতে হলেই কেবল লাল টুকটুকে বউ-এর বেশ ছেড়ে বের হতাম। নিচ থেকে ৯তলা বিল্ডিং-এর ৮ তলা ফ্ল্যাটে(আমার বাসা) যখন হাড়ে হাড়ে ব্যাথা তুলে সিড়ি দিয়ে হেটে উঠতে হচ্ছিলো তখন শওকতের সেই আপেক্ষিক কষ্টের মতবাদ হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। আর নিয়তির পরিহাসে নিয়মিত এভারেস্ট উঠা-নামার সময়েই হতে লাগলো নানান অভিজ্ঞতা।
দড়ির গিট হলো না ফিট
মা যখন বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিলো আমি তখন পড়ে আছি দড়িওয়ালা প্যান্ট। দড়ি কোমরে গিট দিয়ে প্যান্টটা পড়তে হয় অনেকটা মশারির মতো টাঙ্গিয়ে। সেটা পড়েই এভারেস্ট থেকে নামলাম,দুই ব্যাগ ভর্তি বাজার করলাম। দুহাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে এভারেস্টে উঠের মাঝ পথেই টের পেলাম প্যান্টের দড়ি নিজে নিজেই খুলে গিয়ে স্রেফ আমাকে দয়া দেখিয়ে সেটা কোমরে জড়ানো মালার মতো ঝুলে আছে। প্যাণ্টের ভেতর দড়ি ঝুলছে, কোমরে প্যান্ট ঝুলছে, হাতে ঝুলছে বাজারের ব্যাগ।
গায়ে দেয়া হাটু পর্যন্ত লম্বা গেঞ্জি উঠিয়ে দড়ি-টরি ঠিক করে আবার যে গিট লাগাব সেটার উপায় নেই, এভারেস্টের উন্মুক্ত সিড়িতে যে কেউ চলে আসতে পারে। ইচ্ছে হলো প্যান্টের দড়ি খুলে সেই দড়ি দিয়ে গলায় ফাস নেই,কিন্তু তা করলে আমার ঝুলন্ত লাশের দেহে যে প্যান্টটাও ঝুলে থাকবে তার গ্যারান্টি কি?জান যাবে, ইজ্জতটাও যাবে। তার চেয়ে একটু একটু করে এভারেস্টের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। আমি উঠছি, প্যান্ট নিচে নামছে, দুহাতের বাজারের ব্যাগ নিচে নামাচ্ছি,তারপর প্যান্টটা টেনেটুনে আবার উঠাচ্ছি।
মিল্কিওয়ে
ইন্টারকম থেকে দারোয়ান ফোন দিয়ে জানালো এভারেস্টে লিফট না থাকায় দুধওয়ালা উপরে উঠতে পারবে না,আমাকে নিচে গিয়ে দুধ নিয়ে আসতে হবে।
দুধওয়ালাকে দুধভাত অভিশাপ দিতে দিতে সাপের মতো পিছলিয়ে পিছলিয়ে পাতিল হাতে নেমে এলাম এভারেস্ট বেয়ে। দুধওয়ালাকে বলি,
“ আপনার দুধ বাইর করেন?”
-“জ্বে”?
-“আপমার দুধের বালতি বাইর করেন”?
দুধওয়ালা ভ্যানগাড়ি থেকে বালতি নামিয়ে আমার পাতিলে দুধ ঢালতে ঢালতে বলেন
-“অতোদূর সিড়ি বাওনের শক্তি আমার নাই। আপনারে নামায় আইনা কষ্ট দিলাম,কিছু মনে কইরেন না ভাই”।
-“আপনার উচিত নিজের দুধ নিজে খাওয়া। শক্তি হবে”।
-“জ্বে”?
-আপনার উচিত নিজের গরুর দুধ নিজে খাওয়া। শক্তি হবে”।
দুধওয়ালা গরুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো,আমি কানায় কানায় পরিপূর্ণ দুগ্ধ-পাতিল নিয়ে এভারেস্ট বেয়ে উঠতে লাগলাম। তখন আবার ময়লাওয়ালা আসারও সময়। এভারেস্টের প্রত্যেক তলার সিড়ির গোড়ায় ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের ময়লার ডিব্বা আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে লাগলো।
একেকটার দূর্গন্ধ একেক ফ্লেভারের। গলায় চলে আসলো থুতু, আরেকটু হলেই সেটা মুখ থেকে বের হয়ে দুধের পাতিলে পড়তে যাচ্ছিলো। অঘটন ঘটার আগেই দ্রুত গিলে নিলাম। থুতুর সাথে দূর্গন্ধগুলোকেও গিলতে হচ্ছে গ্লাসে দুধ খাওয়ার মতো ঢগডগ করে। নাক চেপে উঠার উপায় নেই, দু হাতেই যে পাতিল ধরে আছি।
এক হাতে নাক চাপতে গেলে দুধের পাতিল পড়ে গিয়ে এভারেস্টের সিড়িপথ দুধে ভেসে গিয়ে হয়ে যেতে পারে মিল্কিওয়ে। তখন নাক চাপা বন্ধ করে কপাল চাপড়াতে হবে। এইসব ভাবনা চলাকালীন সময়েই হঠাত সামনে থেকে দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজা দিলেন এক নারী। ইনি সম্ভবত অপ্রস্তুত অবস্থায় ময়লা দিতে এসেছিলেন সিড়িতে, আমাকে আশা করেন নাই। আরে, আমি তো সেদিনের বালক, আমার সামনে এতো সিরিয়াস হবারই বা কি দরকার ছিলো?নাকি আমকেও বিবেচনা করা হচ্ছে বিল্ডিং-এর অন্যান্য আঙ্কেল-ভাইয়াদের সাথে একই পুরুষ-মানদন্ডে?বাংলা সিনেমায় দেখেছি বালক গ্লাসে দুধ খেতে খেতে বড় হয়ে নায়ক যায়, আর বাস্তবে আমি দুধের পাতিল নিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বড় হয়ে ভিলেন হয়ে গেলাম!!!
পিতৃত্ব
এক টাকার নোটের বিলুপ্তির পথে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো এক টাকার ভাংতি লজেন্স।
দোকান থেকে ফিরছি এভারেস্ট বেয়ে বেয়ে, পকেটে এক টাকার ভাংতি লজেন্স। সিড়ির গোরায় দেখি বুয়ার কোলে একটা কিউট বেবী। আগেই শুনেছি এই আধো আধো বোলে কথা বলতে শেখা বাচ্চা ছেলেটির বাবা-মা সকাল হলেই অফিস চলে যায়, বাচ্চার ঘরে থাকার আগ্রহ নেই, সে সারাদিন সিড়ির গোড়ায় বুয়ার কোলে বসে বাবা-মার অপেক্ষায় থাকে। বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা বুয়ার কোলে। আমি সেই ভাংতি লজেন্স ধরিয়ে দিলাম বাচ্চার হাতে, আর বাচ্চা আমাকে স্তম্ভিত করে বলে উঠলো “বাবা, বাবা”।
বুয়া হেসে জানালো, এই বাচ্চাকে যে কেউ আদর করলে বাচ্চা তাকে বাবা-মা ডাকতে শুরু করে। বিল্ডিং-এর অনেক আন্টিকে ইতিমধ্যে তার মা ডাকা হয়ে গিয়েছে,এখন সে পড়েছে ব্যাটাছেলেদের ‘বাবা’ ডাকার নিয়ে। আমি ভাবি এই নিষ্পাপ শিশুটি তো আর জানে না অন্য নারীকে মা ডাকা যতটা পবিত্র, অন্য লোককে বাবা ডাকাটা ততটাই অপবিত্র। সেদিনের মতো দ্রুত এভারেস্টে বেয়ে উঠে গিয়ে নিজের বেসক্যাম্পে (আমার ফ্ল্যাটে) ঢুকে আরেক দফা বাবা হওয়া থেকে বাচলাম।
পানি সমস্যা
ওয়াসা এভারেস্টে ওয়াসাধারন (অসাধারন) পানি সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছে।
ফুটিয়ে, ফিটকিরি দিয়ে,ফিল্টার করে এবং পরশপাথার চবিয়ে্ও পানির গন্ধ দূর হচ্ছে না। বাসা থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হল পানি কিনে খাওয়া হবে। আমি দোকান থেকে পানি কিনে দুই হাতে দুই-দুইটা দুই লিটারের বোতল নিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠছি, দেখি সিড়িতে সেই বাবা ডাকাওয়ালা পিচ্চি বসে আছে। তার পরপ্নে প্যান্ট নেই আর তাতেই কিনা সে উতসাহীত হয়ে নিজের পানির কল ছেড়ে দিয়েছে। কুল কুল শব্দে সেই পানিস্রোত সিড়িময় ছড়িয়ে আমার যাবার পথ রুদ্ধ করেছে।
ওয়াসা পানি দিতে পারছে না, দেশের নদ নদী পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে,মেঘ বৃষতি ছড়াতে অপরাগ, পানি নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ বির্তক চলছে আর এই পিচ্চি এতো পানি কই পেলো সেটাই রহস্য। তবে আশার কথা বিল্ডিং-এ কোনদিন আগুন লাগলে এই পিচ্চিকে দিয়ে দমকলের কাজ করিয়ে নেয়া যাবে। পিচ্চির পালনকারী বুয়া একটু দূরে পাশের ফ্ল্যাটের বুয়ার সাথে আড্ডায় মশগুল। আমাকে ওখান থেকেই সে জানালো, “আফনে পাশ দিয়া চইলা যান। আমি পরে মুইছা নিমু নে”।
যাবো কীভাবে?যাবার সব পথই তো বানের জোয়ারে ভেসে গেছে। আমি নিচ থেকে উঠতে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, আর উপর থেকে তীব্র গতিতে নামতে থাকা বিল্ডিং-এর ফজল ভাই শিশুপুত্রের শিশুমূত্র দেখে থমকে দাড়ালো। তিনিও আর আগে ‘বাবা’ ডাক খেয়েছেন। পিচ্চি একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার ফজল ভাই-এর দিকে তাকাচ্ছে। যেন ভাবছে কাকে বাবা ডাকাটা এপ্রোপ্রিয়েট হবে।
ফজল ভাই যখন বুঝলেন এই নদী পাড় করিয়ে দেবার জন্য সিড়ি ঘাটে কোন নৌকা ভিড়বে না তখনই এক লাফে মূত্রনদ পার হয়ে আমার সামনে দিয়ে সাই করে নেমে গেলো। আমার দিকে তাকিয়ে পিচ্চি বাবা বলার টারগেট লক করলো। চার লিটার পানি নিয়ে আমি ফজল ভাই-এর মতো লং জাম্প দিয়ে পার হতে পারবো না। সাতরে (মাড়িয়ে) পার হবার প্রস্তুতি নিচ্ছি আর মনে মনে বলছি “ছেড়ে দে পিচ্চি, লজেন্স পাবি কিন্তু পিতৃত্ব পাবি না’।
পরিশেষে
লিফট এখন ঠিক হয়ে গিয়েছে।
। আরামের নেশায় একটি বদ্ধ কক্ষে কিছু মানুষ্য মূর্তির সাথে উপরে ওঠার সুযোগের কাছে গুম হয়েছে সিড়ি বেয়ে এ্যাডভেঞ্চার করার নেশা। তবে নিজের বেস ক্যাম্প থেকে সিড়ি বেয়ে এভারেস্টের চূড়ায় (বিল্ডিং-এর ছাদে)ওঠা হয় প্রতিদিন। এপার্টমেন্টের বদ্ধ মুরগীর খুপরীতে থাকতে থাকতে আকাশটাকেও মনে হয় মেঘের চিকা মারা নিরেট দেয়াল। শহুরে জীবন তো এমনই দেয়ালময়,দেয়ালের হেয়ালে মুক্তির খেয়ালগুলো গরুর গোয়ালে পরিণত হয়েছে।
তবে সেটা সমস্যা নয়। সমস্যা হলো ওয়াসফিয়া আর নিশাতের এভারেস্ট জইয়ের কারনেই কিনা আশেপাশের ছাদে নারীদের বিচরনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্টি থেকে আপু,কচি থেকে পিচ্চি সব বয়সী। ছাদের প্রিয় স্থান টাঙ্কির ধারে আর যাই না। দীর্ঘক্ষণ টাঙ্কিতে হেলান দিয়ে দাড়াতে দেখলে তারা ভাবতে পারে আমার উদ্যেশ্য টাঙ্কি মারা।
নারী সংখ্যাগরিষ্ঠতার এই ছাদ যুগে কতৃপক্ষের নিকট (কতৃপক্ষ কে তা জানা নেই)পুরুষ সংরক্ষিত ছাদের দাবি জানিয়ে আমার এভারেস্ট বিজয়ের কাহীনি শেষ করছি।
(লেখায় সংযুক্ত ছবিটি ওয়াসফিয়া নাজনীন-এর ফেসবুকের প্রোফাইল থেকে নেয়া)
ব্লগে আমার আগের কিছু পোস্টঃ
দীগম্বরী ১৮+
রেসলিং রম্য ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।