আমরা হেরে যাইনি। এশিয়া কাপ না জিতলেও তোমরা আমাদের হৃদয় জয় করেছ। আমরা গর্বিত রোববার নববর্ষ সংখ্যায় ‘টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি’ শিরোনামের একটি ছোট গল্প ছাপে পত্রিকাটি, যা লিখেছেন বাংলা একাডেমি ও একুশে পদকজয়ী লেখক সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হাসনাত আবদুল হাই। তুমুল প্রতিক্রিয়ার মধ্যে বিরল এক ঘটনায় লেখক নিজেই লেখাটির জন্য ক্ষমা চেয়েছেন এবং গল্পটি অন্য কোথাও অন্তর্ভুক্ত করবেন না বলে কথা দিয়েছেন। গল্পটিতে শাহবাগ আন্দোলনকারী নারীদের ‘অমর্যাদাকরভাবে উপস্থাপন’ করা হয়েছে--এমন সমালোচনায় রোববার থেকেই সরগরম হয়ে উঠে ফেইসবুকসহ অন্যান্য কমিউনিটি ব্লগ।
শাহবাগের আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে এই লেখার সমালোচনা উঠছে, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি নারীবিরোধী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার। সোমবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী টিএসসিতে প্রথম আলোর কপিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ জানায়।
কিছুদিন আগেও পত্রিকাটির বিরুদ্ধে ‘অবমাননাকর’ গল্প ছাপানোর অভিযোগ ওঠে। পরে গল্পটি প্রত্যাহার ও ক্ষমা চেয়ে দায়িত্বরত সম্পাদককে অব্যাহতি দেয়া হয়।
এর আগে ২০০৭ সালে একটি কার্টুন নিয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠলে কার্টুনটি প্রত্যাহার করা হয় এবং চাকরিচ্যুত করা হয় কার্টুনিস্ট ও বিভাগীয় সম্পাদককে।
জ্যেষ্ঠ সম্পাদকদের চোখ গলে বিষয়বস্তু প্রকাশের পর পত্রিকাটির সম্পাদকীয় প্রক্রিয়া ও নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন গণমাধ্যম ব্যবস্থাপকদের কেউ কেউ।
মতিউর রহমানের নেতৃত্বে আব্দুল কাইয়ুম, সাজ্জাদ শরীফ, আনিসুল হক, মিজানুর রহমান, উৎপল শুভ্র পত্রিকাটির জ্যেষ্ঠ সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন।
প্রচার সংখ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনের পরের অবস্থানে থাকা দৈনিকটিতে গল্পে বলা না হলেও মূল চরিত্র ‘স্লোগান দেয়া নারী’টি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকারী নারীদের দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত করে দাবি করে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলোতে এ নিয়ে সমালোচনা ওঠে।
গল্পটি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ বলেছে, ওই লেখাটি ‘অসাবধানতাবশত’ প্রকাশ হয়েছিল।
হাসনাত আবদুল হাইয়ের গল্পের মূল চরিত্র এক নারী, যিনি মফস্বল থেকে ঢাকায় পড়তে এসে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
স্লোগান দিয়ে জনপ্রিয়তা পেলেও তিনি এই সঙ্কটে পড়েন যে, মঞ্চে স্লোগান অব্যাহত রাখতে তাকে ছাত্রনেতাদের ‘খাদ্য’ হতে হবে। শুধু তাই নয়, যে রাজনীতিক তাকে রাজনীতিতে এনেছে, সে এখন তারও ‘খাদ্য’। নারীটি এখন রাজনীতি ছাড়তে চান।
সোমবার প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে বলেছে, “অসাবধানতাবশত লেখাটি মুদ্রণের জন্য প্রথম আলো আন্তরিকভাবে দুঃখিত এবং পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমরা এ লেখাটি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।
”
লেখাটি এখন আর অনলাইন সংস্করণ ও ই-পেপারে পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রথম আলোর সহযোগী আব্দুল কাইয়ুম বলেছেন, “এটা শুধু আমরা প্রত্যাহারই করছি না, আর্কাইভ থেকেও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ”
বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে কয়েকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এরপর কথা বলা হয় আব্দুল কাইয়ুমের সঙ্গে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রকাশিত গল্পটি তাদের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে ‘একেবারে বেমানান’, তবে ‘অসাবধানতাবশত’ ছাপা হয়ে গেছে।
এই অসাবধানতার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা অনুসন্ধান করে দেখছি যে কোন জায়গায়, কার কতটুকু ভুল হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এটা আর না হয়, তার প্রতিকারের বিষয়ে আমরা পদক্ষেপ নেব। ”
পাঁচ বছর আগে প্রকাশিত একটি কার্টুন নিয়ে সমালোচনার মুখে কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমান এবং বিভাগীয় সম্পাদক সুমন্ত আসলামকে বরখাস্ত করে প্রথম আলো। আরিফকে তখন গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল।
ওই কার্টুনে মহানবী (সা.) কে কটাক্ষ করা হয়েছে বলে ইসলামী বিভিন্ন সংগঠন অভিযোগ তুললে ২০০৭ সালে প্রথম আলো একইভাবে ক্ষমা চেয়ে ব্যঙ্গচিত্রটি প্রত্যাহার করে নেয়।
শুধু তাই নয়, বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিবের হাত ধরে ‘মাফ চেয়ে’ নিষ্কৃতি পান প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান।
প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ওই সময় আন্দোলনরত মাওলানাদের সমঝোতায় ভূমিকা রাখেন তখনকার সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মইনুল হোসেন।
লেখার জন্য ক্ষমা চেয়ে হাসনাত আবদুল হাই বলেছেন, “দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু পাঠক গল্পটি পড়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের ক্ষুব্ধ করার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। ”
নিজের কোনো গল্পগ্রন্থে এটিকে রাখবেন না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
১৯৯৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন হাসনাত আবদুল হাই। লেখালেখির জন্য ১৯৯৪ সালে একুশে পদক এবং ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
তবে এই লেখা প্রকাশের পর এই পদকগুলো ফিরিয়ে নেয়ার দাবি উঠেছে। সোমবার এই দাবি জানানোর সঙ্গেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আলোর কপি পোড়ানো হয়।
১৯৩৩ সালে জন্ম নেয়া হাসনাত আবদুল হাই ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন।
অবসরের আগে শিল্প ও ভূমি সচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
হাসনাত আবদুল হাই ও প্রথম আলো ক্ষমা চাইলেও তা ‘যথেষ্ট’ নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন জন।
গণজাগরণ আন্দোলনের সমর্থক ব্লগার পিনাকী ভট্টাচার্য তার ফেইসবুক পাতায় স্ট্যাটাসে লিখেছেন, একটি চড় মেরে ‘স্যরি’ বললেই কি তা মেনে নেয়া যায়?
এক্ষেত্রে প্রথম আলোকে দায়ী করে তিনি লিখেছেন, “এই লেখাটি কোন ভুলে সম্পাদকের ডেস্ক থেকে ছাপাখানায় গেল? কে কে দায়ী ছিল? তাদের শাস্তি কী হয়েছে?”
পিনাকীর মতো অনেকেই এই লেখার সমালোচনা করেছেন, সেই সঙ্গে প্রথম আলোরও সমালোচনা করেছেন তারা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।