আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিকই জন্ম সূত্রে কিছু অধিকার অর্জন করে , যা থেকে কেউ তাকে বঞ্চিত করতে পারে না। এই অধিকার সমূহের নিশ্চয়তা বিধান করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তা করতে ব্যর্থ হলে বা অবহেলা করলে নাগরিকগণ ঐ অধিকার সমূহ বলবৎ করার জন্য আইনের আশ্রয় নিতে পারে । এই অধিকার সমূহকেই বলা হয় মৌলিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে এই অধিকার সমূহ সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের ৩ উপ-অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে , ' কেবল ধর্ম , গোষ্ঠি , বর্ণ , নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা বাধ্যবাধকতা বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না। ' সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বর্নিত হয়েছে। এই ভাগে ১৫ অনুচ্ছেদে ঘোষিত হয়েছে , ' রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন , যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয় সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়ঃ (ক) অন্ন , বস্ত্র , আশ্রয় , শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারনের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা ; (খ) কর্মের অধিকার , অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তি সংগত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার ;(গ) যুক্তি সংগত বিশ্রাম , বিনোদন ও অবকাশের অধিকার ; এবং (ঘ) সামজিক নিরাপত্তার অধিকার , অর্থাৎ বেকারত্ব , ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য , মাতা পিতৃহীনতা বা বার্ধক্য জনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতি জনিত আয়ত্বাধীন কারণে অভাবগ্রস্থতার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য লাভের অধিকার। '
এ থেকে সুস্পষ্টভাবেই প্রতিভাত হয় যে শিক্ষা অর্জনের অধিকার প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে। শিক্ষার সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কর্মসহ অন্যান্য অধিকার ।
এই সব বিষয়গুলো সংবিধানে থাকলেও আজ পর্যন্ত সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়নি। এই শুণ্যতা থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেতনার সৃষ্টি হয় । রাজধানীর কোলাহল ও যানজটমুক্ত পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম 'গণ বিশ্ববিদ্যালয়'। 'পাবলিক' ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের
কার্যক্রমের কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে ভর্তির পর পরই শপথ গ্রহণ করতে হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে 'জাতীয় স্মৃতিসৌধে' নবীন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষক মন্ডলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ সমবেত হন। উপাচার্য মহোদয় নবীন ছাত্রছাত্রীদের শপথ বাক্য পাঠ করান। শপথ গ্রহণ করার পর নবীন ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যেককে লিখিত শপথ বাক্যে দস্তখত দিতে হয় এবং তা বিশ্ববিদ্যালয় দফতরে সংরক্ষণ করা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে বাংলা পঞ্জিকা অনুসরন করা হয় । গত ২৪ শে বৈশাখ ১৪১৯ বঙ্গাব্দ ( ৭ই মে ২০১২ খ্রিঃ ) তারিখ রোজ সোমবার পূর্বাহ্নে নবীন ছাত্রছাত্রীদের শপথ গ্রহণের পর পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয় ।
শপথ বাক্য নিম্নরূপ ,' ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অদ্য ... তারিখে সাভারস্থ জাতীয় স্মৃতিসৌধে দাঁড়িয়ে আমি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ... শপথ করছি যেঃ
১. আমি নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত হব, সেমিনার ও ফিল্ড ট্রিপে যোগ দেব এবং সময় মত নির্ধারিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করব এবং ছাত্র অবস্থায় আমি কোন দলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত হব না।
২. আমি গণবিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-শৃংখলা বিরোধী কোন আচরণ করব না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থবিরোধী কোন কাজে লিপ্ত হব না। শিক্ষকদের প্রতি সদা সর্বদা শ্রদ্ধাশীল থাকব এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করব।
৩. আমার অধ্যয়ন ও সকল কর্মকে আমি দেশের জনগণের সার্বিক অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের কাজে নিবেদিত করব । আমি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলোর বাস্তব উপলব্ধি এবং তার সৃজনশীল সমাধানের প্রক্রিয়ার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করব।
৪. আমি শিক্ষিত হব সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার জন্য । শরীরের সকল রক্ত মুখে জমা হলে তা যেমন সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয় , তেমনি দেশের সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থা যদি মুষ্ঠিমেয় বিত্তবানের কুক্ষিগত থাকে তাকেও সুষম সমাজ বলা যায় না । আমি একটি গণতান্ত্রিক বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে নিবেদিত হব।
৫. নারীর প্রতি সহিংসতা ও অবিচার সহ বাংলাদেশে সকল ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদী হব এবং নারী-পুরুষ সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সচেষ্ট হব।
৬. দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠি ও তাঁদের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হব এবং তা বিকাশের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করব।
৭. জীবনে অবশ্যই অর্থের প্রয়োজন আছে । তবে দরিদ্র মানুষের শ্রম ও শরীরের উপর দিয়ে আমি অর্থ উপার্জন করব না। দরিদ্র মানুষকে আমার জ্ঞান ও সেবা থেকে কখনও বঞ্চিত করব না। দেশের জন্য সাধারণ মানুষের অবদানের কথা আমি সবসময় স্মরণ রাখব। '
শিক্ষাঙ্গনকে বলা হয় মানুষ গড়ার আঙ্গিনা।
শিক্ষার্থীদেরকে প্রথম থেকেই দেশপ্রেম ও জনহিতকর মানসিকতায় সম্পৃক্ত করে গড়ে তোলার মাধ্যমেই প্রকৃত মানুষ গড়া যায়। তা না হলে শিক্ষিত মানুষ তৈরী হয় বটে কিন্তু দেশ ও জনগণের হিত সাধন হয় না। এই বাস্তবতা উপলদ্ধি করেই গণবিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে চলেছে। এটা অন্যদের জন্য অনুসরনীয় এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।