ভবের খেয়া এবার বাওয়া হইল আমার শেষ; এবার তরী ভাসিয়ে দিলাম পরপারের দেশ । । নিলুফার ইয়াসমিন (১৯৪৮ - ২০০৩) জন্ম ও পারিবারিক পরিচয় নিলুফার ইয়াসমিনের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতায়। পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বড় বোন ফরিদা ইয়াসমিন ও মেজো বোন ফওজিয়া খান প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীতশিল্পী।

সেজো বোন শিক্ষা বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রীধারী নাজমা ইয়াসমিন হক। তিনি রেডিয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ (ইংলিশ মিডিয়াম)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। ছোট বোন সাবিনা ইয়াসমিন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী। নিলুফার ইয়াসমিনের পিতা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার। সরকারী কাজে ব্যাস্ত থাকা সত্ত্বেও সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল প্রবল।

পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি গান গাইতেন। আর নিলুফার ইয়াসমিনের মা হারমোনিয়াম বাজাতেন। তাঁর পিতার বাড়ি সাতক্ষীরার মুকুন্দপুর গ্রামে। মুকুন্দপুরের 'পণ্ডিত বাড়ি' বললে ঐতিহ্যবাহী এ পরিবারটিকে সবাই চেনেন। বহু আগে থেকেই এ বাড়ির লোকজন শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল অগ্রগামী।

নিলুফার ইয়াসমিনের মা মুর্শিদাবাদের স্বনামধন্য ওস্তাদ কাদের বক্সের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ভাল গান গাওয়া ছাড়াও ভাল হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন। শৈশব নিলুফার ইয়াসমিনের শৈশব কেটেছে মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী এবং ঢাকায়। মায়ের কাছে নিলুফার ইয়াসমিনের সঙ্গীতে হাতেখড়ি। বাসায় গ্রামোফোন রেকর্ড প্লেয়ার ছিল।

পিতা নতুন নতুন রেকর্ড কিনে আনতেন আর বোনেরা সবাই মিলে সেসব রেকর্ডের গান বার বার বাজিয়ে শুনে শিখে ফেলতেন। আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কমলাঝরিয়া, হরিমতী, কে মল্লিক, জ্ঞান গোস্বামী, শচীনদেব বর্মণ, মৃণালকান্তি ঘোষ, কমল দাশগুপ্ত, আব্বাসউদ্দীনসহ আরও বিখ্যাত সব শিল্পীর গাওয়া রেকর্ড থেকে তাঁর মা গান তুলে গাইতেন এবং তাঁর গাওয়া থেকেই নিলুফার ইয়াসমিন গান শিখে ফেলতেন। তাঁর মা-ই তাঁকে বলতেন যে এ-সব গানগুলোর রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলাম। তখন থেকেই নজরুল সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ জন্মে। শিক্ষাজীবন সঙ্গীত শিক্ষার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায়ও তাঁর ছিল সমান মনোযোগ।

তিনি আদমজী কটন মিলস্ স্কুল, বাংলাবাজার গার্লস স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ ও সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। তিনি ১৯৬৩ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৬৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে বি.এ. (অনার্স) এবং ১৯৭০ সালে ২য় শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এ. পাস করেন। পারিবারিক জীবন প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও অভিনেতা খান আতাউর রহমানের সঙ্গে ১৯৬৯ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরের বছর তাঁর একমাত্র পুত্র কণ্ঠশিল্পী আগুনের জন্ম হয়। সঙ্গীতের তালিম নিলুফার ইয়াসমিনের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখা শুরু হয় ওস্তাদ পি সি গোমেজের কাছে ১৯৬৪ সালে।

একাধারে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখেন। তারপর উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ-র সুযোগ্যা ছাত্রী মীরা ব্যানার্জীর কাছে তালিম নেন। এরপর প্রখ্যাত সারেঙ্গী বাদক ওস্তাদ সগীরউদ্দীন খাঁ ও মুর্শিদাবাদের স্বনামধন্য ওস্তাদ এ দাউদ সাহেব ও প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দীর্ঘকাল তালিম গ্রহণ করেন। তিনি নজরুল সঙ্গীতের প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছেন স্বরলিপিগ্রন্থ থেকে। স্বরলিপি অনুসরণ করেই প্রথম দিকে বেতার-টেলিভিশনে নজরুল-সঙ্গীত গেয়েছেন।

তিনি প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী, নজরুল-সঙ্গীতস্বরলিপিকার ও বিশেষজ্ঞ শেখ লুৎফর রহমান ও সুধীন দাশের কাছে নজরুল-সঙ্গীত শিখেছেন। কর্মক্ষেত্র নিলুফার ইয়াসমিন বাংলাদেশ বেতারের ছোটদের অনুষ্ঠান খেলাঘরের মাধ্যমে শিল্পী জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ টেলিভিশনের শুরু থেকে আমৃত্যু একজন নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গেয়েছেন। নিলুফার ইয়াসমিন উচ্চাঙ্গ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, টপ্পা, ঠুমরি, কীর্তন, রাগপ্রধান, আধুনিক গানসহ গানের ভুবনের প্রায় সব শাখাতেই অবাধ বিচরণ করেছেন। রাগপ্রধান গানে অসাধারণ দখল থাকলেও তিনি নজরুল-সঙ্গীতশিল্পী হিসেবেই বেশি পরিচিত।

নিলুফার ইয়াসমিন বেশ কয়েকটি ছায়াছবিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। যেমন- শুভদা, অরুণ-বরুণ-কিরণমালা, জোয়ার ভাটা, আবার তোরা মানুষ হ, সুজন সখী, যে আগুনে পুড়ি, জীবন-তৃষ্ণা, জলছবি ইত্যাদি। ১৯৯৫ সাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের নজরুল সঙ্গীত বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন। সন্মাননা, স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা শিল্পী হিসেবে নীলুফার ইয়াসমিনের জনপ্রিয়তা শুধু দেশের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বিদেশেও ছিল ব্যাপক। ১৯৮৪ সালে কলকাতার 'অগ্নিবীণা'-র আমন্ত্রণে ঢাকাস্থ নজরুল একাডেমীর সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে কলকাতা গমন করেন।

বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের আমন্ত্রণে দিল্লী ও কলকাতায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এছাড়াও তিনি পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ফ্রান্স, পাকিস্তান ভ্রমণ করেন এবং সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেন। 'সুজন সুখী' চলচ্চিত্রে কণ্ঠপ্রদানের জন্য ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থার পুরস্কার, 'শুভদা' চলচ্চিত্রে কণ্ঠপ্রদানের জন্য ১৯৮৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থার পুরস্কার, সঙ্গীত বিষয়ে অনন্য অবদানের জন্য ২০০৪ সালে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় 'একুশে পদক' এবং নজরুল সঙ্গীতে তাঁর অবদানের জন্য ১৪১০ বাংলা সালে 'নজরুল পদক'সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন নিলুফার ইয়াসমিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে নজরুল সঙ্গীতে তাঁর অবদানের কথা চিরস্মরণীয় করে রাখতে তাঁর নামে নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। প্রকাশনা নিলুফার ইয়াসমিন শ্রোতার আসর প্রযোজিত ও খান আতাউর রহমান পরিচালিত 'বেলা শেষের রাগিনী'তে 'আবার ভালবাসার সাধ জাগে' শিরোনামের নজরুল-সঙ্গীতটি রেকর্ড করেন।

বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্ব কার্যক্রম থেকে 'এ কোন সোনার গাঁয়' রেকর্ডে একটি ও নজরুল ইনস্টিটিউট প্রকাশিত 'পাষাণের ভাঙালে ঘুম' ও 'বাজলো কি রে ভোরের সানাই' রেকর্ড দু'টিতে দু'টি নজরুল-সঙ্গীত গেয়েছেন। এছাড়াও তাঁর কণ্ঠে নজরুল-সঙ্গীত, কীর্তন ও পুরনো দিনের গানের বেশ কয়েকটি অডিও ক্যাসেট ও সিডি বেরিয়েছে। পুরনো দিনের গানের গীতিকাররা হলেন চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল ও কাজী নজরুল ইসলাম। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এই গুণী শিল্পীর কণ্ঠে ধারণকৃত ৫টি সিডি ও ক্যাসেট প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ৩টি নজরুল সঙ্গীতের, ১টি পুরনো দিনের গানের এবং অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান নিয়ে ১টি সিডি।

এছাড়া ইমপ্রেসের ব্যানারে তাঁর একটি একক অডিও এ্যালবাম 'পথের শেষে' প্রকাশিত হয়েছে। এই এ্যালবামে তাঁর একমাত্র পুত্র আগুন শিল্পীর পুরো জীবনী নিজ কণ্ঠে উপস্থাপন করেছেন। মৃত্যু ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে নিলুফার ইয়াসমিনের টিউমার ধরা পড়ে। অপারেশনের পর তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন সঙ্গীত ভুবনে। কিন্তু ২০০৩ সালের ১০ মার্চ বারডেম হাসপাতালে তিনি সকলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

নিলুফার ইয়াসমিন - বাংলা কীর্তন - বাজে মঞ্জুল মঞ্জীর ১। কুঞ্জ সাজায়ে দে লো ২। বাজে মঞ্জুল মঞ্জীর ৩। আমি সখী লো গৃহে রবো ৪। না মিটিতে মন সাধ ৫।

আজো শ্রীধাম বৃন্দাবনে ৬। ওগো যামিনী ৭। ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা বধূ ৮। সখী লোকে বলে কালো কোয়ালিটি - ১২৮ কেবিপিএস এমপি৩ ফাইল সাইজ - ৫২ মেগাবাইটস ডাউনলোড - নিলুফার ইয়াসমিন - বাজে মঞ্জুল মঞ্জীর  ।