আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গার্ল পাওয়ার

১. তিনবন্ধু মুমু, কৌশিক ও আরাফ অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে একটা সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করার। একটা সিএনজি চালকও ওদের গন্তব্যে যেতে রাজি হচ্ছে না। কৌশিক ও আরাফই মূলত সিএনজির ভাড়া নিয়ে চালকদের সাথে কথা বলছিল এতক্ষণ। একটা সিএনজি চালককেও রাজি করাতে পারলো না ওরা। ‘’নারে, বাদ দে।

হেঁটেই যেতে হবে মনে হচ্ছে। ‘’ আরাফের গলায় ক্লান্তি ঝরে পড়ে। ‘’এই দ্যাখ, আরেকটা সিএনজি আসছে। ‘’, ওদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকা একটা সিএনজির দিকে লক্ষ্য করে বলে মুমু। ‘’এইবার তুই তোর গার্ল পাওয়ার দিয়ে সিএনজিওয়ালাটাকে রাজি কর।

‘’ ফোঁড়ন কাটে কৌশিক। --কী? কী বললি তুই? তুই গার্ল পাওয়ার মানে বুঝিস?’’ ওদের কথার খুনসুঁটি চলতে থাকে, সিএনজি আর ভাড়া করা হয় না। ২. ‘’আমরা কী আর ফার্স্ট ক্লাস পামু? আমাগো লগে কথা কইয়া কী স্যারের মজা লাগবো, ক?’’—কিবরিয়ার কণ্ঠে স্পষ্ট বিদ্রুপ। যে সহপাঠির সাফল্য নিয়ে এমন নোংরা ও বাঁকা মন্তব্য করতে পারে তার সাথে আর কোনদিন কথা নয়, শায়মা সাথে সাথে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এমন মন্তব্য অবশ্য আজকেই প্রথম নয়।

শায়মা দেখেছে, ওর সাফল্যে সবাই ঈর্ষান্বিত। ক্লাসে প্রথম স্থানটি নিয়ে ঠাণ্ডা লড়াই বন্ধুদের মধ্যে চলে, সাফল্য নিয়ে ঈর্ষাও করে অনেকেই অনেককে। তবু মেয়েদের সাফল্য, মেয়েদের প্রথম হওয়াটা যেন কেউ মন থেকে মেনে নিতে পারে না। এর মধ্যে অন্য একটা মানে কীভাবে যেন সবাই খুঁজে বের করে ফেলে। শায়মা মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে আজ হয়ত এমন রুচিহীন ইংগিতপূর্ণ কথা ওকে শুনতে হতো না।

৩. ‘’ইশিতা যাও, আবারও ডাক পড়ল তোমার’’— জুঁই চোখ টিপে বলে। --আমাকে বস ডাকলে তুমি যে কেন এত আনন্দ পাও, বুঝি না। -- আর তুমি বুঝি আনন্দ পাও না? -- বস ডেকেছেন মানে একগাদা কাজ ধরিয়ে দেবেন। এতে আমার আনন্দ পাওয়ার কী আছে বলো তো? আমাকে ঝামেলায় দেখলে তো তোমার খুব আনন্দ হয় -- আরে, স্যার তোমাকে শুধু কাজের জন্যই ডাকেন বুঝি? আমাদেরকে তো কাজ ধরিয়ে দেবার জন্যও ডাকেন না রঙ ফর্সা করা ক্রিম কত মাখলাম, তবু তোমার মত সুন্দর হতে পারলাম না। --এত ফালতু চিন্তা তোমার মাথায় যে কী করে আসে জুঁই মেজাজটা একটু খারাপ করেই ইশিতা স্যারের রুমে চলে গেল।

এটা ঠিক, ইশিতাকে ওর বস অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই পছন্দ করেন। সেটা ওর দায়িত্বশীলতার জন্য তো বটে, তবে আরেকটা বাড়তি কারণও আছে। ইশিতা মাঝে মাঝে বসের দেওয়া ইংগিতগুলো বেশ ভালভাবেই টের পায়, কিন্তু গায়ে মাখে না। কিন্তু কতক্ষণ এড়িয়ে চলতে পারবে, এ প্রশ্নের উত্তর ওর নিজেরও জানা নেই। কাজের ব্যাপারে ইশিতা যথেষ্ট সৎ, দায়িত্বশীল, দক্ষ ও যোগ্য।

তবু সব সময় শুধু মেধার জোরে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না। চাকরি ছেড়ে দেবার কথাও ইশিতা ভেবেছে, কিন্তু নতুন আরেকটা চাকরি বললেই কী আর পাওয়া যাবে? তাই, অকারণেই বসের কথায় ওকে মিষ্টি হেসে সায় জানিয়ে যেতে হয়। কাজের কথা বাদ দিয়ে বস যখন ওর সৌন্দর্য্য নিয়ে অহেতুক প্রশংসা করেন, অসহ্য লাগলেও হাসিমুখে শুনে যেতে হয় ওকে। এভাবেই মুমু, শায়মা ও ইশিতাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে নোংরা ইংগিতের। কখনো ঠাট্টার ছলে, কখনো সিরিয়াসলি।

এমনিতে নারীর সাফল্যে অনেকেই মুখে সাধুবাদ জানান, কিন্তু আড়ালে এই নিয়ে কটু কথা বলতে ছাড়েন না। শুধু পুরুষই নয়, নারী হয়েও আরেক নারীর সাফল্য নিয়ে রুচিহীন মন্তব্য করে বসেন অনেকে। যেন নারীর সাফল্য থাকতে নেই। আর যদি সফলতা আসেও তার কৃতিত্ব শুধুই নারীর শারীরিক সৌন্দর্য্যের অথবা কোন গোপন অবৈধ সম্পর্কের প্রতিদান। এ ধরনের মন্তব্য তো শুধু নারীর জন্য অপমানজনকই নয়, বরং তার মেধার অবমূল্যায়ন।

এখন ‘’গার্ল পাওয়ার’’ মানে আর নারীর ক্ষমতায়ন নয়। এর নতুন নেতিবাচক মানে হলো নিজের রূপ,সৌন্দর্য ব্যবহারের মাধ্যমে অন্যকে প্রলুব্ধ করে নিজের কার্য হাসিল করা। আর তাই, নিজের মেধা খাটিয়েও যারা প্রত্যাশা অনুযায়ী সফলতার মুখ দেখতে পারছেন না, তারা সফল নারীর প্রতি বিরাগ হয়ে কটু মন্তব্য করছেন। শুধু পেশাগত সাফল্যের বেলাতেই নয়, এমন কি ফেসবুকের স্ট্যাটাস ও ছবিতে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি লাইক বা কমেন্ট পেলেও নানারকম মন্তব্যের ঝড় উঠে। সুন্দরী মেয়ে বলেই বেশি মনোযোগ পাচ্ছে সবার কাছে, এমন অভিযোগও করে থাকেন অনেকে।

তাদের অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যেও নয় হয়ত। নাটক, সিনেমা, বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে গনমাধ্যমগুলো থেকে শৈশব থেকেই নারী শিখে আসছে কীভাবে নিজেকে সবার সামনে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে হয়। মেধার থেকে যেখানে নারীর সৌন্দর্য্যকেই বেশি মূল্যায়ন করা হয়, সেখানে বাহ্যিক সৌন্দর্য্য নিয়ে নারীর নিজের মাথাব্যথা থাকবে না কেন? এ সমাজ নারীকে একজন মানুষ হিসেবে পূর্ণ মর্যাদা দিতে পারে নি এখনো। প্রতিনিয়ত তাকে কখনো মোহনীয়, রমনীয়, কমনীয়, কখনো লাস্যময়ী, যৌন আবেদনময়ী হিসেবে যারা দেখতে চায়, তাদের কাছে ‘’গার্ল পাওয়ার’’ প্রয়োগ করে যদি সে নিজের কাজ উদ্ধার করতে চায়, সেক্ষেত্রে দোষটা আসলে কার? ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।