আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রতিশোধ

মিথ্যেবাদী নই, প্রেমিক আমি ! আমার নাম সোহান। আমি একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের ভদ্র ছেলে। এই মুহূর্তে আমাকে দেখে কেউ ভাবতেও পারবেনা যে আমি একটা ধারাল চাকু নিয়ে ঘুরছি। একটা কাগজে মুরিয়ে প্যান্টের পকেটে রেখেছি। চাকুটা এতই ধারাল যে সামান্য আঁচড়ে গভীরভাবে কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

এটা আনার কারন একটাই, আজ আমি একটা রক্তপাতের ঘটনা ঘটাতে চলেছি। নাহ! ভয় পাওয়ার কোনও কারন নেই! কাউকে খুন বা জঘম করার উদ্দেশ্য নেই আমার। নিজেকেই ক্ষত বিক্ষত করব আজ। আপনাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে হঠাৎ এমন একটা সিদ্ধান্ত কেন নিলাম? আমি একটি মেয়েকে ভালবাসার প্রস্তাব দিয়েছি। প্রায় এক মাস হয়ে গেল মেয়েটা হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি।

ওর জন্যই অপেক্ষা করছি এখন। চাকুটা এনেছি ওর মুখ থেকে কথা আদায় করার জন্য। যতক্ষণ পর্যন্ত সে উত্তর না দেবে আমি নিজের শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়েই যাবো। আমার কথা শুনে আপনাদের মনে হতে পারে যে আমি কোনও টিন এজ ছেলে। সদ্য প্রেমে পড়েছি।

মনের মানুষের ভালোবাসা আদায়ের জন্য তাই এমন পাগলামি শুরু করেছি। ব্যাপারটি আসলে সেরকম কিছু নয়। আমি যথেষ্ট ম্যাচিউরড্ একটা ছেলে। আমার বয়স সাতাস। এবছর লন্ডন থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে ফিরেছি।

এটি আমার কোনও ক্রেজি লাভ নয়। আমি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে এগচ্ছি। আজকের ঘটনাটা সেই পরিকল্পনারই একটা অংশ। অনেকে হয়ত ভাবছেন আমি যে মেয়েটির জন্য এসব করছি সে আমাকে পছন্দ করেনা। তাই এরকম আক্রমণাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

ধারনাটা ভুল! গত এক মাস আমি মেয়েটির পেছনে ছায়ার মত লেগে আছি। সে যেখানে যায় আমি তাকে ফলো করি। অনেকবার অনেকভাবে ভালবাসার কথা জানিয়েছি। আমি ছেলে হিসেবে খারাপ না। মেয়েটি ইতিমধ্যে আমাকে পছন্দ করে ফেলেছে।

কিন্তু কোনও একটা অদ্ভুত কারনে সে সেটা স্বীকার করতে চাইছে না। তাই আজ তার মুখ থেকে কথা আদায় করে ছাড়ব। আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই। ইদানিং ধৈর্য শক্তিও কমে গেছে। যত দ্রুত সম্ভব ওকে দিয়ে “ভালবাসি” বলাতে হবে।

তাই বেঁছে নিয়েছি এই পথ। *** যে মেয়েটির কথা বলছি তার নাম দিনা। মেয়েটি অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ইডেন কলেজে পড়ে। এই মুহূর্তে তার রুপের বর্ণনা দিতে মন চাইছে না।

শুধু এতটুকুই বলব যে মেয়েটি যদি নাটক সিনেমার নায়িকা হয় তবে অন্যান্য নায়িকাদের না খেয়ে মরতে হবে! তাই বলে আপনারা এই ভেবে বসবেন না যে আমি তার রুপ সৌন্দর্যে পাগল হয়ে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অধির হয়ে উঠেছি। আগেই বলেছি যে আমি একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেছি। আমার প্রতিটি কাজ সেই পরিকল্পনারই অংশ। এবার আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগছে যে তাহলে কি আমি মেয়েটিকে ভাল বাসিনা? ছোট একটা ঘটনার বিবরন দিলেই আপনারা ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। আজ সকালের ঘটনা।

খাবার টেবিলে আম্মার সাথে কথা হচ্ছিল। “কি ব্যাপার সোহান? তোর বাবা বলল মাস খানেক যাবত তুই ঠিকমত অফিসে যাচ্ছিস না! কোথায় নাকি যাস?” “তেমন কিছুনা আম্মু। একটু বন্ধু বান্ধবদের সাথে দেখা করি, আড্ডা দেই”। “দেখিস বাবা! আবার কোনও ঝামেলায় জড়িয়ে যাস না যেন!” “না মা। তুমি কিচ্ছু ভেবনা”।

এবার মা একটু নিচু গলায় বলল, “একটা কথা বলব সোহান?” “কি কথা? বল”। “তোর বাবা আর আমি তোর বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছি”। আমি একটু হাসলাম। “তোর কি কোনও পছন্দের মেয়ে আছে?” “না!” দৃঢ় কণ্ঠে বললাম আমি । কিন্তু মা কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

“ঠিক বলছিস তো?” “ঠিক বলছি মা”। “তাহলে আমি মেয়ে দেখতে শুরু করি?” “দেখো... আমার আপত্তি নেই”। এবার নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পারছেন যে দিনাকে আমি ভালবাসি না। যদি ভালবাসতাম তবে মায়ের কাছে কেন বলব যে আমার কোনও পছন্দের মেয়ে নেই! আমি আসলে ভালবাসার ভান করছি। এটাও আমার পরিকল্পনার একটা অংশ।

*** আমি দাড়িয়ে আছি শান্তিনগর মোড়ের কাছে, একটা গলির মুখে। দিনা এসেছে তার খালার বাসায়। তাকে ফলো করে এসে দাড়িয়ে আছি। দিনা জানে আমি দাড়িয়ে আছি এখানে। প্রায় ৪ টা বাজে।

মনে হয় ওর বের হতে আরও একটু দেরি হবে। এই ফাকে আপনাদের কে আমার পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে একটু আভাস দেই। এখানে আসার আগে মালিবাগ মোড়ে আমার বন্ধু পলাশের সাথে দেখা করেছি। পলাশ আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার যত সুখ- দুঃখ, হাসি- আনন্দ, ভাল- মন্দ সবই আমি পলাশের সাথে শেয়ার করি।

আমার পরিকল্পনার একটা বড় অংশ ওর উপর নির্ভর করছে। “তোর কেসটা কতদুর?” পলাশ প্রশ্ন করল। আমি হেসে বললাম, “আজকেই কেস খতম হবে। তুই তোর ফ্ল্যাট খালি কর”। “তুই শিওর?” “হা... আমি শিওর”।

“ওকে, আমি তোর ভাবিকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি”। “ভাবিকে কি বলবি?” “বলব, তোমার বাবা মাকে অনেক দিন দেখিনা। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। চল ওনাদের কাছ থেকে দু একদিনের জন্য বেরিয়ে আসি”। “ভাবি সন্দেহ করবে নাতো?” “মাথা খারাপ? বরং খুশিই হবে”।

আমি হাসলাম। পলাশ আমার একটা হাত ধরল। নিচু গলায় বলল, “মেয়েটিকে ফ্ল্যাটে আনতে পারবি তো?” আমি আলতো করে পকেটে রাখা চাকুটা স্পর্শ করলাম। “সে দায়িত্ব আমার! তোকে ভাবতে হবেনা”। “আচ্ছা! ফ্ল্যাটে না হয় আনলি।

কিন্তু শেষ মুহূর্তে যদি মেয়েটা রাজি না হয়?” “এমন সিচুয়েসনে ফেলব যে রাজি না হয়ে উপায় থাকবেনা?” আমি অনিশ্চিত কণ্ঠে বললাম। “আর একান্তই যদি রাজি না হয় তবে গায়ের জোর খাটাবো”। “ঠিক বলছিস? পারবি তো?” “পারতে আমাকে হবেই!” আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললাম। পলাশ আমার কাঁধে হাত রাখল। “দেখিস বন্ধু।

বিবেক বড় ভয়ানক জিনিস! একবার বিবেকের দংশনে পড়ে গেলে আর রক্ষা নাই”। “আমার জীবন থেকে ১০ টি বছর নষ্ট হয়েছে পলাশ। বিবেক বলতে আমার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন আমার শুধু একটাই চিন্তা! প্রতিশোধ নিতে হবে! ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ!” পলাশ সহানুভুতির সুরে বলল, “আমি জানি দোস্ত! ১০ টি বছর তুই যন্ত্রণা বুকে চেপে বসে আছিস। তোর কষ্ট আমি বুঝি।

তাইতো তোকে এই পরিকল্পনায় সাহায্য করছি। এতে করে যদি তোর মনে একটু শান্তি আসে তাহলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবেনা”। পলাশ আমার হাতে তার ফ্ল্যাটের একটা ডুপ্লিকেট চাবি দিল। “আমি যা যা করতে বলেছি সব মনে আছে তো?” “আছে” আমি ছোট করে জবাব দিলাম। “তারপরও আবার বলছি, শোন” পলাশ বলছে, “ফ্ল্যাট থেকে ফেরার সময় ভুলেও এমন কোনও ব্যবহার করবি না যা দেখে মেয়েটার সন্দেহ হয়।

মেয়েটাকে বোঝাবি যে তুই তাকে বিয়ে করবি। খুব তারাতাড়ি তোর বাসা থেকে প্রস্তাব নিয়ে যাবে। তারপর বাসায় ফিরেই তুই মোবাইল টা অফ করে সিম টা পাল্টে ফেলবি। কালই দু-এক মাসের জন্য ঢাকার বাইরে হাওয়া হয়ে যাবি। মনে রাখবি, নিজের সম্পর্কে এমন কোনও কথা বলবি না যা থেকে মেয়েটা তোর খোঁজ বের করতে পারে।

ঠিক আছে?” “আমার ব্যাপার তো ঠিকই আছে। কিন্তু তুই কি সেইফ থাকতে পারবি?” “আমার ব্যাপার তোকে ভাবতে হবেনা। আমি অস্বীকার করব পুরো বিষয়টা। মেয়েটা লোক লজ্জার ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও পারবে না। দু একদিন একা একা চেষ্টা করবে ।

শেষে কিছু করতে না পেরে সব চেপে যাবে”। আমি বললাম, “তোকে অনেক ধন্যবাদ দোস্ত, এই সাহায্যটা করার জন্য”। পলাশ একটু হাসল। তারপর বলল, “তুই কি পুরো বিষয়টা আর একবার ভেবে দেখবি?” “ভাবা ভাবির কাজটা অনেক আগেই শেষ করে ফেলেছি”। পলাশ আমার চোখে মুখে কি যেন খুঁজল।

তারপর আনমনে আবার একটু হাসল। এবার নিশ্চয়ই আমার পরিকল্পনাটা আপনাদের কাছে পরিস্কার হয়েছে? নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে যে কি এমন ঘটনা ঘটেছে আমার জীবনে? কেন এমন ভয়ংকর প্রতিশোধ নেয়ার চিন্তা করছি আমি? নাহ! আপনাদের আর আধারে রাখতে মন চাইছে না। পুরো বিষয়টা এবার খুলেই বলি। ঘটনার শুরু হয়েছিল এভাবে... *** আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট এর ছাত্র। ঢাকার একটা নাম করা কলেজে পড়ি।

কম্বাইন্ড কলেজ ছিল। উঠতি বয়স, চোখে রঙ্গিন স্বপ্ন। সহপাঠি একটা মেয়েকে ভালবেসে ফেললাম। মেয়েটির নাম মিনা। দেখতে ছিল হুরপরি গোছের।

আর একটু দেমাগও ছিল। আমার প্রেমের প্রস্তাব পেয়ে ভীষণ হাসল। বলল, পরে জানাবে। কিন্তু পরে আর জানানোর নাম নাই। আমি প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যায়।

আমি ভীষণ রেগে গেলাম। একদিন ক্লাসের সবাইকে বলে বেরালাম, “মিনা আমার গার্ল ফ্রেন্ড” ব্যাস! আর যায় কই? আমি ক্লাসে না আসলেই সবাই মিনাকে ধরত, “কিরে তোর বয় ফ্রেন্ড আসেনি কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি...” মিনা কয়জন কে বলবে যে আমি মিথ্যে বলেছি? মিনা রেগে গিয়ে একদিন আমাকে শাসাল, “আমি তোমাকে উচিত শিক্ষা দেব!" আমি একটু হাসলাম। ভাবতেও পারিনি মিনা আমাকে কত ভয়ংকর শিক্ষা দেয়ার কথা ভাবছে! এ ধরনের সুন্দরি মেয়েদের অনেক শুভাকাঙ্খি থাকে। এদের মধ্যে অন্যতম হল পাড়ার বড় ভাইরা। মিনাদের এলাকায় এমন একজন ভাই ছিল- গনি ভাই।

তার কাজ ছিল সারাদিন ৫-৬ জন ষণ্ডা মত ছেলেকে সাথে নিয়ে ঘোরা আর চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়া। মিনার সাথে দেখা হলেই বলত, “কি অবস্থা আপু? কেমন চলতেসে?” মিনা মিষ্টি হেসে বলত, “এইত ভাইয়া ভাল। আপনি কেমন আছেন?” মিনা এবার সেই গনি ভাই কে কাজে লাগানর সিদ্ধান্ত নিল। গনি ভাই আর তার সহকারিরা আড্ডা দিচ্ছিল আর সিগারেট ফুকছিল। এসময় মিনা সেখানে গিয়ে উপস্থিত।

“গনি ভাই। আমার একটু হেল্প দরকার”। গনি ভাই তো আকাশ থেকে পড়ল। “কি হেল্প? বল বল!” “না মানে... আমার ক্লাসের এক ছেলে আমাকে খুব ডিস্টার্ব করতেছে”। “কি নাম পোলার? কই থাকে?” “নাম সোহান।

কই থাকে জানিনা”। গনি ভাই বলল, “সমস্যা নাই। তোমার কলেজে গিয়াই ঐ পোলারে ধরমু। এমন মাইর দিমুনা!” “না ভাইয়া...মার দেয়ার দরকার নেই। একটু ধমক ধামক দিলেই চলবে।

যেন আমাকে আর ডিস্টার্ব না করে”। “ঠিক আছে। তোমার ছুটি কখন হয়?” “বিকেল ৫ টায়”। “ওকে, ছুটির সময় আমি আমি থাকমু বাইরে। তুমি খালি পোলাটা বাইর হইলে আমারে দেখায় দিবা”।

পরদিন ছুটির পর আমি অবশ্য আগে ভাগেই কলেজের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। পলাশ আমার সাথে ছিল। সে আমাকে যাওয়ার জন্য টানল। আমি বললাম, “একটু দাড়া না! একবার মিনাকে একটু দেখে নেই। তারপর যাবো”।

আমাদের কাছাকাছি গনি আর তার সাঙ্গ পাঙ্গরা দাড়িয়ে ছিল। আমি যদি ঘুনাক্ষরেও টের পেতাম ওদেরকে মিনা টেনে এনেছে আমাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য তাহলে কি আর সেখানে দারাতাম? মিনা বের হতেই আমার সাথে চোখা চোখি হল। আমি হাসলাম। মিনা আসলে গনি ভাইকে খুজছিল। মিনাকে দেখে গনি ভাই হাত নাড়ল।

মিনা তার দিকে এগিয়ে গেল। আমি তখনও ব্যাপারটা বুঝি নাই। মিনা গনি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিল। এইবার আমি বুঝলাম। কিন্তু ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে।

গনি ভাই আর তার সাঙ্গ পাঙ্গ রা আমাকে ঘিরে ধরল। “তোর নাম সোহান?” “জি”। “কাধ থেকে ব্যাগ নামা”। “মানে?” “যা বলছি কর। কথা বাড়ালে বাপের দশা লাগায় দিব”।

আমি কাধ থেকে ব্যাগ নামালাম। গনি ভাই এবার বলল, "এবার শার্ট খুল। খালি গায় হ"। "কি বলছেন এসব? কি করেছি আমি?" "আবার কথা বারায়! শার্ট খুলবি নাকি ছিঁড়া ফালামু?" আমি লজ্জায় অপমানে লাল হয়ে গেলাম। ততক্ষনে কলেজের আশে পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে।

কেউ সাহস করে এগিয়ে আসছে না। আমি শার্ট খুললাম। “এইবার কান ধর”। পলাশ আর শান্ত হয়ে থাকতে পারল না। আমার সামনে এসে দাঁড়াল।

“কি ব্যাপার? কি সমস্যা আপনাদের? ওর কি দোষ?” “তুই সামনে থেকে সর”। পলাশ বলল, “সরব না। কি করবেন না সরলে?” গনি ভাই হাতের মুথি শক্ত করে পলাশের নাকের ওপর একটা ঘুষি মারল। পলাশ তাল হারিয়ে পড়ে গেল। তার নাক ফেটে গেছে।

ঠোঁটও কেটে গেছে। সারা মুখ রক্তাক্ত! কয়েকটা মেয়ে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। ছেলেরাও ভয় পেয়ে একটু পিছিয়ে গেল। এবার মিনাও বোধহয় বুঝতে পারল যে ব্যাপার টা বাড়া বাড়ি হয়ে গেছে। সে বলল, “গনি ভাই থাক।

ছেড়ে দেন”। “তুমি দূরে থাক মিনা। আমি দেখতেসি’। আমার দিকে ফিরে গনি ভাই বলল, “কি ব্যাপার এখনও কানে ধরিস নাই?” আমি বিনা বাক্য বায়ে কানে ধরলাম। “আমার সাথে বল, মিনা আমার বোন”।

আমি যন্ত্রের মত বললাম, “মিনা আমার বোন”। “আর জীবনেও তাকে ডিস্টার্ব করবমু না”। আমি বললাম। “করলে আমি কুত্তার গু খাই”। আমি দাঁতে দাঁত চেপে এই কথাটাও বললাম।

আমার শিক্ষা গ্রহন শেষ হল। গনি তার দল বল নিয়ে চলে গেল। অন্যান্য স্টুডেন্ট রাও একে একে চলে যেতে লাগল। শুধু মিনা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে ছিল। আমি শার্ট গায়ে দিলাম।

পলাশ কে ধরে দার করালাম। তার রক্তাক্ত মুখ দেখে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। আমি মিনার সামনে গিয়ে দারালাম। “আমার দিকে তাকাও মিনা”! মিনা তাকাল। শরিরের সমস্ত শক্তি এক করে মিনার গালে প্রচণ্ড একটা চর বসালাম।

মিনা এক পাক ঘুরে গিয়ে পার্ক করা একটা গাড়ির ওপর পড়ল। এদিকে ঝামেলার কথা শুনে কলেজের বেশ কিছু স্যার ম্যাডামরা চলে এসেছেন। তারা আমাকে চর মারার দৃশ্যটি দেখে ফেললেন। উভয় পক্ষের গার্জিয়ান দের ডাকা হল। এদিকে খবরের গন্ধ পেয়ে দু- একজন সাংবাদিকও আশে পাশে ঘোরা ঘুরি করছে আর একে তাকে জিজ্ঞেস করছে ।

প্রিন্সিপাল দুই পক্ষের গার্জিয়ানদের কঠিন কঠিন কথা শুনালেন এবং দু জনকেই টি সি দিয়ে দেবেন বলে শাসালেন। পত্রিকাতে আন্দাজের ওপর লেখা একটা খবর বেরিয়ে গেল। “অমুক কলেজে যৌন কেলঙ্কারি” এই টাইপের কিছু। মিনার ফ্যামিলিতে চলছিল অন্য নাটক। ব্যাপারটা অনেক দূর গরিয়েছে।

পত্রিকাতে খবর বেরিয়ে গেছে। তারা চিন্তায় পড়ে গেল যে তাদের মেয়ের নামে কলঙ্ক রটে যাবে। মিনার এক মামা ছিলেন পুলিশের বড় কর্মকর্তা। তিনি বুদ্ধি দিলেন সমস্ত দোষটা আমার কাঁধে চাপাবেন। তারা আমার বিরুদ্ধে ইভ টিজিং ও যৌন হয়রানির মামলা করলেন।

পরদিন আমি গ্রেফতার হলাম। আমার বাবার টাকা পয়সা ছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা তদবির করেও কোনও কাজ হল না। স্বয়ং পুলিশ কমিশনার কেসটা হ্যান্ডেল করছিলেন মিনার মামার অনুরোধে। এদিকে রিমান্ডে অমানুষিক টর্চার করে আমার মুখ থেকে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী নেয়া হল।

আমার দু বছরের জেল হয়ে গেল। পত্রিকায় খবর ছাপা হলঃ “ইভ টিজিং কারির দৃষ্টান্ত মুলক শাস্তি!” আসল ঘটনাটা চাঁপা পড়ে গেল। জেলখানায় কয়েদীর জীবন কাটালাম ২ বছর। ছোট বেলা থেকে মায়ের আঁচল তলে বড় হয়েছি। কষ্ট কি জিনিস তা বুঝি নি।

এবার বুঝলাম। শারিরিক কষ্ট যা পেয়েছি তার চেয়ে শতগুন বেশি ছিল মানুষিক কষ্ট! মুক্তি পাওয়ার পর বাবা আর আমাকে দেশে রাখলেন না। আমার এই ঘটনা যাতে চাঁপা পড়ে যায় সেজন্য আমাকে লন্ডনে ছোট চাচার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে কাটালাম ৮ টি বছর। এভাবে আমার জীবন থেকে ১০টি বছর নষ্ট হয়ে গেল।

আমার যত সুখ- যত স্বপ্ন- যত আনন্দ সব ধংস হয়ে গেল। জেলখানায় থাকা কালিন সময় থেকেই একটা শব্দ শুধু কানে বাজত। “প্রতিশোধ! প্রতিশোধ নিতে হবে! ভয়ংকর প্রতিশোধ!” দেশে ফিরেই মিনার খোঁজ নিলাম। জানলাম যে মিনার বিয়ে হয়ে গেছে আমেরিকা প্রবাসী এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এর সাথে। বিয়ের পর দু জন পাড়ি জমিয়েছে আমেরিকায়।

তখন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় জ্বলছিলাম। রাতে ঘুম আসত না একদমই। বুকের ভেতর কি যে কষ্ট! তখন পলাশ খবর আনল মিনার একটা ছোট বোন আছে। নাম দিনা। ইডেন কলেজে পরছে।

পলাশের সাথে একদিন গেলাম মেয়েটাকে দেখতে। দিনাকে দেখে তো তাজ্জব বনে গেলাম! অবিকল সেই চোখ, সেই নাক, সেই হাসি! যেন মিনার কার্বন কপি! মিনার ওপর আমার যত ক্রোধ ছিল সব এসে পড়ল এই মেয়েটির ওপর। “হ্যাঁ... মিনার প্রতিশোধ আমি দিনার ওপর নেব”। এরপর ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা সাজালাম। *** এইমাত্র দিনা বের হল।

আজ লাল রঙের সালোয়ার- কামিজ পরেছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। আমার সাথে চোখা চোখি হল। ওর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল। তারপর না দেখার ভান করে পাশ দিয়ে হেটে চলে গেল।

ও জানে আমি ডাক দেব। “একটু দাড়াও দিনা”। “আপনি তো দেখছি আজব লোক! ফলো করতে করতে এখানেও এসে হাজির হয়েছেন?” দিনার মুখে প্রশ্রয়ের হাসি। “হ্যাঁ... আমি জবাব চাই”। “আমিতো বলেছি, আমাকে একটু ভাবার সময় দিন”।

“আর ভাবাভাবির সময় নেই। আমি এই মুহূর্তে জবাব চাই। তুমি আমাকে ভালবাস কিনা?” দিনা নিরবে হাসতে লাগল। আমি পকেট থেকে কাগজে মোড়ানো চাকুটা বের করলাম। ধীরে ধীরে কাগজের ভাজ খুলে হাতে নিলাম।

দিনা আতকে উঠে পিছিয়ে গেল। “একি?” “তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত আমার প্রশ্নের উত্তর না দেবে আমি আমার শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়ে যাবো”। “কি পাগলামি করছেন?” দিনা ভয় পেয়ে গেছে। “বল- ভালবাস কিনা?” আমি ডান হাতে হাতলটা ধরে চাকুর আগাটা বাম হাতের উপর ধরলাম। রক্ত ঝরাতে প্রস্তুত।

“দেখুন, প্লিজ ছেলেমানুষি করবেন না!” দিনা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলছে। প্লিজ থামুন। আমি বা হাতের কব্জি থেকে কনুই বরাবর একটা পোঁচ দিলাম। গভির ভাবে কেটে গেল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল।

দিনা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। প্রায় দৌড়ে এসে কাঁটা অংশটা তার দুহাতে চেপে ধরল। “ইয়া আল্লাহ! আপনি এটা কি করলেন? আপনি কি মানুষ”? দিনা রক্ত আটকানোর ব্যার্থ চেষ্টা করতে লাগল। আমি তখন চাকুটা আমার বুকে ধরেছি। “বল- আমাকে ভালবাস?” মেয়েটি এবার হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল।

হড়বড় করে বলতে লাগল, “তোমার দোহাই লাগে, অমন করোনা প্লিজ..... আ....আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি.... তুমি এত বোকা কেন?.... সব কিছু কি বলে দিতে হয়? ....তুমি বোঝনা”? আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। আমি হাত থেকে চাকুটা ফেলে দিলাম। দিনা তার ওড়না, রুমাল, হাত সব কিছু দিয়েই রক্ত পড়া আটকানোর আপ্রান চেষ্টা করছে। কিন্তু রক্ত যেন আজ কোনও বাধাই মানবে না। দিনার হাত আর কাপর চোপর রক্তে ভিজে একাকার! আমার পরিকল্পনায় একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে! ঠিক কতটা কাটা দরকার তা আমি বুঝিনি।

খুব বেশি কেটে গেছে । প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে শরীর থেকে। দুর্বল লাগছে খুব! হাঁটু ভাজ হয়ে যাচ্ছে! আমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম। *** মাথার ভেতর একটা ভোঁতা ব্যাথা। আমি আস্তে আস্তে চোখ মেললাম।

সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা দেখছি। বুঝতে পারলাম হাসপাতালের কেবিনের ভেতর আছি । উঠে বসার চেষ্টা করলাম। দুটো হাত আমাকে সাহায্য করল বসতে। আমি ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম আমার বেডের পাশে পলাশ দাড়িয়ে আছে।

“কি ব্যাপার পলাশ? আমি দুর্বল কণ্ঠে বললাম। আমি এখানে কেন?” “তুই একটা গাধা! এমন ভাবে হাত কাটে কেউ? জানিস কত বড় ক্ষত হয়েছে? ১০টা সেলাই পড়েছে”! আমি বাম হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম হাতটা কনুই এর উপর থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো। নাড়ানোর চেষ্টা করতেই বাথা পেয়ে গুঙিয়ে উঠলাম। “আমাকে এখানে এনেছে কে?” “কে আর আনবে? তুই জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর দিনা কেঁদে কেটে মানুষ জড়ো করেছে। তারপর লোক জনের সাহায্যে তোকে এখানে এনেছে! যে পরিমান রক্ত গেছে, আর ঘণ্টা খানেক দেরি হলে তোকে বাঁচানোই মুশকিল হয়ে যেত!” “তুই খবর পেলি কিভাবে?” “তোর কাজ কতদুর এগোল জানার জন্য ফোন দিয়েছেলাম।

রিসিভ করল দিনা। তার মুখে সব শুনে দৌড়ে এসেছি”। “এখন কটা বাজে?” “রাত ৯ টা। পাক্কা ৫ ঘণ্টা অজ্ঞান ছিলি তুই! রক্ত দেয়া হয়েছে, স্যালাইন দেয়া হয়েছে- জমে মানুষে টানা টানি”! “মেয়েটা কই?” “এতক্ষন তো তোর পাশে বসে কাঁদছিল। কিছুতেই তাকে শান্ত করা যায় না! বলছে, তোর এই অবস্থার জন্য সেই দায়ি! তার ভুলেই তোর এই হাল হয়েছে।

এখন মনে হয় ডাক্তারের রুমে গেছে তোর জ্ঞান ফিরতে দেরি হচ্ছে কেন জানার জন্য!” আমি চুপ করে থাকলাম। “তুই কি একটা জিনিস বুঝতে পারছিস সোহান?” পলাশ নিচু কণ্ঠে প্রশ্ন করল। “কি?” “তুই আসলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য হাত কাটিস নি!” “কেন বলছিস একথা?” “তুই যদি প্রতিশোধ নেয়ার কথা মাথায় রেখে হাতে পোঁচ দিতি তাহলে তোর খেয়াল থাকত কতটা কাটতে হবে, কতটুকু রক্ত ঝরাতে হবে, জাতে নিজের ক্ষতি না হয়! তুই আসলে সত্যিকার অর্থেই দিনার ভালবাসা চাইছিলি। তাই এভাবে নিজের ক্ষতি করতে তোর দ্বিধা হয়নি”। “তোর ধারনা ভুল”।

“না আমার ধারনা ভুল না! আমি তোকে চিনি সোহান। মিনাকে ভালবাসার পর তোর চোখে আমি যে দৃষ্টি দেখেছিলাম, অনেক বছর পর দিনাকে দেখার পর আমি সেই দৃষ্টি আবার তোর চোখে দেখেছি। আমি তোকে এই পরিকল্পনায় সাহায্য করেছি যাতে তুই ব্যাপারটা নিজেই বুঝতে পারিস”। “না...পলাশ...” “চুপ কর তুই” আমাকে থামিয়ে দিল পলাশ। “তোর কি মনে হয় তুই মিথ্যে ভালবাসার ভান করবি আর দিনা তা বুঝতে পারবেনা? মেয়েটা কি এতই বোকা? আরে... বোকা তো তুই! তোর যে ভালবাসা মিনা গলা টিপে মেরেছিল সেই ভালবাসা শতগুন হয়ে দিনার হাত ধরে তোর কাছে ধরা দিয়েছে”! পলাশ হয়ত আরও কিছু বলত কিন্তু দিনাকে কেবিনে ঢুকতে দেখে থেমে গেল।

মেয়েটাকে চেনাই যাচ্ছে না! কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলে গেছে! আমাকে বসে থাকতে দেখে মুখে হাসি ফুটল। প্রায় ছুটে এসে আমার পাশে বসল। পলাশ আমাদের রেখে কেবিনের বাইরে গেল। দিনা আমার ডান হাতটা দু হাতে ধরে নিজের কোলে নিল। তার দু চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু বেরিয়ে এল।

ধরা গলায় বলল, “আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি সোহান। তুমি আর কখনো এমন পাগলামি করবে না প্লিজ! তোমার কিছু হলে আমি বাঁচব না”। আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম। হাত বাড়িয়ে দিনার গাল স্পর্শ করলাম। তাকিয়ে থাকলাম ওর মায়াময় দুটি চোখের দিকে।

ঐ চোখের গভিরে আছে অসীম সুখের হাতছানি। ও দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে ১০ বছর কেন, ১ শতাব্দির কষ্ট ভুলে যাওয়া যায়! মিনার প্রতি আমার প্রতিশোধ স্পৃহা চলে গিয়ে যায়গা দখল করল কৃতজ্ঞতাবোধ। সে হয়ত কেড়ে নিয়েছে আমার ১০টি বছর কিন্তু খুলে দিয়েছে অনন্ত জীবনের দুয়ার! মা ঝড়ের বেগে কেবিনে ঢুকলেন। ঢুকেই এ দৃশ্য দেখে বিব্রত হয়ে গেলেন। দিনা লজ্জা পেয়ে দ্রুত সরে গেল।

তারপর মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকল। আমি বললাম, “আম্মু! তুমি না সকালে প্রশ্ন করেছিলে আমি কোনও মেয়েকে পছন্দ করি কিনা?” মায়ের মুখে হাসি ফুটল। তিনি দিনার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “করেছিলাম তো! তুই ‘না’ বলেছিলি”। “মিথ্যে বলেছিলাম মা। এই মেয়েটিকে আমি গভির ভাবে ভালবাসি!” মা আমার অবস্থার কথা ভুলে দিনার দিকে এগিয়ে গেলেন।

দিনার কাঁধে একটা হাত রাখলেন। অন্য হতে থুতনি ধরে ওর মুখটা উচু করে দেখলেন। দিনার ঠোঁটে লাজুক হাসি। মা মুগ্ধ হয়ে হাসলেন। আমার দিকে ফিরে বললেন, “আমি জানতাম তুই মিথ্যে বলছিস।

তুই মিথ্যে বললেও তোর চোখ কিন্তু মিথ্যে বলেনি!” কি আশ্চর্য! মাও বুঝতে পেরেছিলেন! শুধু আমিই বুঝতে পারলাম না? আমি আসলেই বোকা! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।