আমার চোখে ঠোটে গালে তুমি লেগে আছো !! আমার কেবল মনে হল যে ছেলেটার পেছন পেছন দৌড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই । সিমুকে বাঁচাতে হলে কেবল এই কাজটাই করতে হবে ।
দৌড়াতে হবে ।
এই কঠিন জ্যামের মধ্যে গাড়িটা সেই কখন থেকে নিশ্চল হয়ে দাড়িয়ে আছে । অথচ আমাদের হাতে সময় নেই একদম ।
ছেলেটা ততক্ষনে দৌড়াতে শুরু করেছে । বাবা প্রথমে বাঁধা দিতে চেয়েছিল কিন্তু ছেলেটা শুনলোই না । সিমুকে কাধে তুলে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল । আমি নিজেও ছেলেটির পেছন পেছন দৌড়াতে শুরু করলাম ।
অন্য সময় হলে আমি হয়তো নিজেই এই দৃশ্যটা বিশ্বাস করতাম না ।
কিন্তু আমি এখন নিজেই এর ভিতরে ঢুকে গেছে । আমি জানি, সচরাচর এই শহরে এই দৃশ্য দেখা যায় না ।
প্রচন্ত জ্যামে পুরো শহর থেমে আছে । তার মধ্যে সাদা শার্ট পরা একটা ছেলে, ২৪ বা ২৫ বছর বয়স হবে, একটা ১০ বছরের মেয়েকে কাঁধে তুলে দৌড়াচ্ছে ।
ছোট্ট মেয়েটার নাক, মুখ আর কান দিয়ে অনবরত রক্ত পরছে ।
সেই রক্তে ছেলেটার সাদা শার্ট ভেসে চলে যাচ্চে কিন্তু ছেলেটার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ।
যেকোন ভাবেই হোক হাসপাতালে যেন তাকে পৌছাতে হবে । ঐ ছেলেটার পেছন পেছন আর একটা মেয়েও দৌড়াচ্ছে প্রানপনে । আর তার পেছন একজন মাঝ বয়সী লোক ।
এই দৃশ্য কি বাস্তবে সহজে চোখে পড়বে ?
ছেলেটি রাস্তার ওপারে পৌছে গেছে ।
এখনই বোধহয় রিক্সায় চড়বে ! ওখান থেকে রাস্তা মোটামুটি ফাকাই বলা চলে ।
আমি দাড়াও বলে কোন মতে চিত্কার দিলাম ।
আমার দম ফুরিয়ে এসেছে । একটা মেয়ে হয়ে এতো দুর দৌড়ে এসেছি ভাবতেই অবাক লাগছে । অন্য সময় হলে হয়তো এতোদুর আমি হেটেও আসতে পারতাম না ।
আসলে পরিস্থিতি মানুষকে কি না করতে বাধ্য করে ।
আমি দেখলাম ছেলেটা লাফ দিয়ে রিক্সায় উঠল । কিন্তু রিক্সা ছেড়ে দিল না । তারমানে ছেলেটা আমার চিৎকার শুনতে পেরেছে । আমার জন্য অপেক্ষা করছে ।
আমি আরো জোরে পা চালালাম । পৌছে গেলাম রিক্সার কাছে যা ভেবেছিলাম তারও আগে ।
আমি জানতামই না এতো জোরে দৌড়াতে পারি আমি?
রিক্সায় উঠতেই বুঝলাম আমার বুকটা কি পরিমান হাপাচ্ছে । আমি রিক্সার পেছনে তাকিয়ে দেখলাম বাবা তখনও অনেকটা পেছনে ।
আসতে আরো সময় লাগবে ।
রিক্সা চলতে আরাম্ভ করল । হাসপাতালে পৌছাতে আর বড় জোর পনের বিশ মিনিট সময় লাগবে !
আমার বোনটা বাঁচবে তো ? ওকে বাঁচাতে পারবো তো ?
ছেলেটা সিমুকে আমার কোলে দিয়ে মোবাইল বের করে কাকে যেন ফোন দিল ।
-কোথায় তোরা ?
খানিক নিরবতা ।
-হ্যা । জলদি মেডিক্যালে পৌছা ।
ইমার্জেন্সি !
তারপর ছেলেটা আর এক জায়গায় ফোন দিল
-হ্যা তুহিন কই ? ওকে! ডাক্তার শফিকের কাছে যা । ইমার্জেন্সির সামনে রেডি থাকতে বল । জলদি জলদি ।
ফোন কেটে দিয়ে তৃতীয় বারের মত ফোন দিল ছেলেটা ।
-রাফি ?
-
-কোথায় তোরা ?
-
-একটু মেডিক্যালে আয় জলদি ।
-
-হ্যা রক্ত লাগবে ।
-
-কোন গ্রুপ ?
ছেলেটা এবার আমার দিকে ফিরল । জিজ্ঞেস করল
-আপনার বোনের রক্তের গুপ কি ?
-আমি জানি না ।
-আচ্ছা । ব্যাপার না ।
ছেলেটা আবার ফোনে ফিরে গেল ।
-যতজনকে পারিস রেডি রাখ । আমি আধঘন্টার মধ্যে জানাচ্ছি ।
রিক্সা হাসপাতালের সামনে থামতেই ছেলেটি সিমুকে নিয়ে আবার দৌড় মারল । আমিও পেছন পেছন দৌড় দিলাম ।
দেখলাম জরুরী বিভাগের সামনে আগে থেকেই কয়েক জন দাড়িয়ে আছে স্ট্রেচার নিয়ে । আরো চারপাচ জন ছেলে দুতিন জন নার্স আর একজন ডাক্তার গোছের লোক । তবে তার বয়স কম । ছেলেটার থেকে কিছু বেশি হবে ।
ছেলেটা স্ট্রেচারের উপর সিমুকে সাবধানে শোয়াল ।
তারপর দ্রুত ভিতরের দিকে চলে গেল ।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম চারিদিকে কেমন একটা হুলস্থুল বেধে গেল সিমুকে নিয়ে । ডাক্তারা ছোটাছুটি করছে । কিছু ছেলে চলে এসেছে রক্ত দেবার জন্য । আরো কত কি ? এরই মধ্যে বাবা চলে এসেছে ।
খুব হাপাচ্ছে !
ছেলেটি বাবাকে ধরে বেঞ্চের উপর বসালো । বলল
-আঙ্কেল আপনি শান্ত হয়ে বসুন । আর আল্লাহকে ডাকুন । এখন সব ওনার হাতে ।
এমন সময় একজন ডাক্তার এসে পেছনে দাড়াল ।
-প্রতিক ?
ডাক্তার ডাক দিল ।
-জি শফিক ভাই !
-অপারেশন করা লাগবে এখনই । এখনই যদি ইন্টার্নাল ব্লিডিং থামানো না যায় অবস্থা আরো সিরিয়াস হয়ে যাবে । রোগীর রিলেটিভ কোথায় ?
-এই তো ।
ডাক্তার শফিক একটা কাগজ এগিয়ে দিল বাবার দিকে ।
-এখানে সাইন করুন ।
সাইন নিয়ে ডাক্তার চলে গেল ।
আমি বাবার পাশে বসে রইলাম চুপ করে ।
কেন জানি আর ভয় করছে না । এতো গুলো মানুষ সিমুর জন্য এসেছে ! সিমুকে বাঁবানোর এতো চেষ্টা বৃথা যেতে পারে না ।
কিছুক্ষন আগে যখন রাস্তায় জ্যামের মধ্যে বসে ছিলাম তখন খুব ভয় লাগছিল । বারবার মনে হচ্ছিল আমার ছোট্ট বোনটাকে বুঝি আর বাঁচাতে পারলাম না ।
কিন্তু কোথা থেকে ফেরেস্তার মত প্রতিক নামের ছেলেটা এসে হাজির হল । এখন দেশের মানুষ আর অন্যের সমস্যা নিজের সমস্যা বলে মনে করে না ।
কিন্তু ছেলেটা করল ।
যখন গাড়ির মধ্যে সিমুকে দেখল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
-কি হয়েছে ?
চোখ দিয়ে কেবল পানিই বের হচ্ছিল তখন । কোন মতে বললাম যে
-সিড়ি থেকে পড়ে গেছে ।
ছেলেটার আরো কাছে এসে বলল
-আরে এর অবস্তা তো খুব খারাপ । এখাবে বসে থাকলে তো বাঁচানো যাবে না । দেখি বের হন গাড়ি থেকে ।
ছেলেটা এক প্রকার জোর করেই সিমুকে গাড়ি থেকে বের করে আনল । ছেলেটার হাতে একটা পপকর্ণের প্যাকেট ছিল । ভরাই বলতে গেল । সবে মাত্র মুখ খোলা হয়েছে ।
প্যাকেটটা গাড়ির ব্যাগ সিটে পরে রইল ।
সত্যি প্রতীক না থাকলে আজ হয়তো এখনও এপর্যন্ত আসতেই পারতাম না ।
একটা সময় হাসপাতালের কোলাহল কমে যায় । একটু আগে যেমন কত লোক ছিল আসেপাশে কিন্তু এখন পুরো করিডোরটা জুরে কেবল আমি আর বাবা ! মাঝে সাঝে দুএক জন নার্সকে দেখা যাচ্ছে ।
আশ্চার্য নিরব সব কিছু । অপারেশন থিয়েটারের লাল লাইটটা বন্ধ হতেই একজন ডাক্তার বেড়িয়ে এল ।
বেশ বয়স্ক ।
বাবা আর আমি কাছে গেলাম । ডাক্তার মুখের মাস্ক খুলতে খুলতে বলল
-অবস্থা এখনও সিরিয়াস তবে আশংকা কেটে গেছে অনেকটা । ভয় পাবেন না ।
বাবা হু হু করে কেঁদে দিলেন ।
আমিও আর কান্না আটকিয়ে রাখতে পারল না । তবে এ কান্না আনন্দের কান্না । প্রিয় জনকে না হারানোর আনন্দ ।
আমার প্রথমেই মনে হল প্রতীক নামের ছেলেটাকে আগে ধন্যবাদ দিতে হবে । ও না থাকলে আজ আমার বোন বাঁচতো না ।
কিছুতেই বাঁচতো না ।
আমি মানছি আল্লাহ সবাইকে বাঁচান । কিন্তু উছিলারতো দরকার হয় । প্রতীক সেই উছিলা হয়েই আমার বোনকে বাচিয়েছে ।
কিন্তু আসেপাশে কোথাও প্রতীক অথবা তার কোন বন্ধুবান্ধবকে দেখতে পেলাম না ।
একেবারে পুরোপুরি হাওয়া । পরবর্তী এক ঘন্টা আমি কেবল প্রতীক কেই খুজলাম । কিন্তু কোথাও তাকে পেলাম না ।
তারা কোথায় গেল সবাই ?
ফেবু লিংক ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।