গত ১৬ জুন পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধনী-২০১৩ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা। বিলটি উপস্থাপনের আগে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য জাফরুল ইসলাম চৌধুরী বিলের উপর আপত্তি দিয়ে বিলটি সংসদে উপস্থাপন না করার জন্য স্পিকারকে অনুরোধ করেন। তার আপত্তির মুখে স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী বিলটি কণ্ঠ ভোটে দেন। সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা হ্যাঁ ভোট ও বিরোধীদলীয় সদস্যরা না ভোট দিলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতায় হ্যাঁ ভোট জয়যুক্ত হলে বিলটি সংসদে উপস্থাপন করেন ভূমিমন্ত্রী।
উপস্থাপনের পর বিলটি পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে ৭ দিন পর সংসদে উপস্থাপনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রেরণের জন্য স্পিকার কণ্ঠভোটে দেন।
বিরোধীদলীয় সদস্যরা না-ভোট দিলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিলটি ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতে প্রেরিত হয়। সে হিসেবে আগামী ২৩ জুন সংসদে বিলটি চুড়ান্তভাবে পাসের জন্য উপস্থাপিত হওয়ার কথা। ১৭৫৭ সালের এই ২৩ জুনে পলাশীর আ¤্রকাননে বাংলার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছিল। ২৫৫ বছর পর আরেক ২৩ জুনে পার্বত্য বাঙালির ভাগ্য নির্ধারিত হতে পারে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে। শুধু বাঙালির নয় বাংলাদেশের ভাগ্যও এর সঙ্গে অনেকটাই জড়িত।
কারণ এই সংশোধনীতে এমন কিছু ধারা রয়েছে যা দেশের সার্বভৌমত্বের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
পার্বত্য চুক্তির ঘ-খ-ের ৪নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল চলিবে না’। অন্যদিকে ভূমি কমিশন আইনের ১৬নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আদালত বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের নিকট আপিল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না। ’ এখানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও এখতিয়ারকে খর্ব করা হয়েছে সংবিধান বিরোধী। বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার খ-ের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।
’ কিন্তু পার্বত্য চুক্তি ও ভূমি কমিশন আইনের ফলে সেখানকার অধিবাসীরা কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করতে পারবে না। কমিশন ও এর আইন উপজাতি ঘেঁষা হওয়ায় সেখানে বৈষম্যের শিকার হবে পার্বত্য বাঙালিরা।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী ও পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না। ’ কিন্তু কমিশনে সদস্য, সচিব ও কর্মচারী নিয়োগের বেলায় এই বৈষম্য প্রকটাকারে পরিদৃষ্ট। এখানে কেউ কেউ হয়তো সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদ, ২৯(৩-ক) ধারা উল্লেখ করে ‘নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের’ জন্য সংবিধানের উল্লিখিত ধারার বিশেষ রেয়াতের সুবিধা নিতে চাইবেন।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের’ মধ্যে ৮৭% শিক্ষিত চাকমারা পড়ে কিনা তা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখতে হবে। একই সাথে যুগ যুগ ধরে বৈষম্যের শিকার পার্বত্য বাঙালিরা কোন বিবেচনায় ‘অগ্রসর’ জনগোষ্ঠীভুক্ত হলেন তাও রাষ্ট্রকে তদন্ত করে দেখতে হবে। কারণ, শিক্ষাদীক্ষা, চাকরি ও অবস্থানগত সুবিধার কারণে শুধু বাঙালি নয় উপজাতীয় অন্যসব গোত্র শোষিত হচ্ছে চাকমাদের দ্বারা। পার্বত্যাঞ্চলের জন্য রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বরাদ্দকৃত কোটাসহ সকল প্রদত্ত সুবিধা ভোগ করছে চাকমা জনগোষ্ঠী। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, চাকমা সমাজের কয়েকটি গোত্র মাত্র।
অন্যসব উপজাতি এ সুবিধার সামান্যই ভোগ করতে পারে। একইভাবে পার্বত্য চুক্তি ও ভূমি কমিশনের উল্লিখিত ধারা বাংলাদেশ হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারকে খর্ব করে। সংবিধানের ১০১, ১০২(২)-এর উপধারা (অ), (আ), ও ১০৯ ধারার সাথে তা সরাসরি সাংঘর্ষিক।
শান্তিচুক্তির ঘ খ-ের ৪নং ধারায় কেবলমাত্র ‘পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমিজমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি’র কথা বলা হয়েছে। একইভাবে ভূমি কমিশন আইনের ৬(ক) ধারায়ও ‘পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা’র কথা বলা হয়েছে।
অর্থাৎ আইন অনুযায়ী কেবল পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করাই এ কমিশনের দায়িত্ব। এখানে পার্বত্য অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালিদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ নেই। কাজেই বাঙালিদের কোনো কোনো সংগঠন তাদের দাবিতে ভূমি কমিশনে সমানুপাতিক হারে বাঙালি সদস্য রাখার যে দাবি তুলছে তা, হয় আইন না জানা কিংবা না বোঝার ফল অথবা আপসকামিতার দৃষ্টান্ত। ভূমি কমিশনে সমানুপাতিক হারে কেন, সকল সদস্য বাঙালি হলেও তাতে বাঙালিদের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই যদি বিদ্যমান আইন বহাল থাকে। অর্থাৎ কমিশন সদস্যরা বিচার করবেন যে আইনে, সে আইন যতক্ষণ পর্যন্ত বাঙালি ও দেশের স্বার্থের অনুকূল না হবে, সে পর্যন্ত এই কমিশন বাঙালির স্বার্থ বিরোধী হয়েই থাকবে।
অন্য কথায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন’ উপজাতীয়দের ‘ঐতিহ্য’, ‘রীতি’ ও ‘পদ্ধতি’ অনুযায়ী বিচার পরিচালিত হলে কমিশনের সদস্য বাঙালি হলেও তাদের কিছুই করার থাকবে না।
চুক্তির ৬(খ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশন ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন’, ‘রীতি’ ও ‘পদ্ধতি’ অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করিবেন’। আবার কমিশন আইনের ৬(গ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন বহির্ভূতভাবে কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং উক্ত বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল। ’ সংশোধনীর ধারা ৬(১-গ)-তে বলা হয়েছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভূতভাবে ফ্রিঞ্জল্যান্ড (জলেভাসা জমি)সহ কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান এবং বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল শব্দাবলী প্রতিস্থাপন করা’।
অর্থাৎ এই ভূমি কমিশন কাজ করবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন অনুযায়ী।
বাংলাদেশর আইন অনুযায়ী নয়। এর সাথে স্থানীয় ‘রীতি’ ও ‘পদ্ধতি’ শব্দটিও যুক্ত করা হয়েছে। এখানে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন’, ‘রীতি’ ও ‘পদ্ধতি’ শব্দগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের অখ-তা, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, সংবিধান, সরকারের কৃতিত্ব ও বাঙালির অস্তিত্বের স্বার্থে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন বলতে পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের ২(ছ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রচলিত আইন বলিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে এই আইন বলবৎ হইবার পূর্বে যে সমস্ত আইন, ঐতিহ্য, বিধি, প্রজ্ঞাপন প্রচলিত ছিল কেবলমাত্র সেইগুলিকে বুঝাইবে। ’ অর্থাৎ ২০০১ সালের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন বুঝাবে।
এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন বলতে আমরা কয়েকটি আইনের অস্তিত্ব দেখতে পাই। এর মধ্যে ১৯০০ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বপ্রথম আইন। দুটি বিশেষ কারণে ব্রিটিশ সরকার এই আইন করেছিল বলে মনে করা হয়। ১. পার্বত্য জনগোষ্ঠীর বিশেষ প্রবণতার প্রতি লক্ষ্য করে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও ২. কর আদায়।
প্রথম কারণে ব্রিটিশ সরকার এ আইনে বিপুল ক্ষমতা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সুপারিন্টেন্ডেট নামে একটি পদ সৃষ্টি করে, যা পরে ডেপুটি কমিশনার নামে পরিচিত হয়।
দ্বিতীয় কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি সার্কেল প্রধান বা রাজার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়। যদিও সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদটি এসেছে ১৮৬০ সালের আইন থেকে, ১৮৮১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত পুলিশ বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে পাহাড়িদের মধ্য থেকে একটি পুলিশ বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দেয়া হয়।
এসব মিলেই ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি প্রণয়ন করা হয। মূলত কর আদায়ের সুবিধার্থে সেখানে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে কারবারী আদালত, হেডম্যান আদালত ও সার্কেল চিফ আদালত গঠন করা হয়। কর, ভূমি ও সামাজিক সমস্যা নিরসনে পার্বত্য বাসিন্দারা প্রথম কারবারী আদালতে বিচার প্রার্থনা করবে, কারবারী আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হেডম্যান আদালতে এবং হেডম্যান আদালতের বিরুদ্ধে সার্কেল চিফের আদালতে আপিল করবে।
আবার সার্কেল চিফের রায়ের বিরুদ্ধে ডেপুটি কমিশনারের কাছে আপিল করা যাবে। তবে ডেপুটি কমিশনারকে পার্বত্য রীতি, ঐতিহ্য ও পদ্ধতি সম্পর্কে সার্কেল চিফের পরামর্শ গ্রহণ করার বিধান রাখা হয়। ব্রিটিশদের এই আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামে হেডম্যানের অনুমতি ছাড়া অস্থানীয় কাউকে ভূমি বরাদ্দ বা ভূমি অধিগ্রহণ করার সুযোগ রাখা হয়নি।
ব্রিটিশদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল একটি বহির্ভূত রাজ্য এলাকা। কর আদায়ই ছিল তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য।
ফলে ১৯০০ সালে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবিধানে তার প্রভাব পড়ে। ব্রিটিশ আইনটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো অনুকূল আইন ছিল না। কারণ এই আইনের মাধ্যমেই পাহাড়ের ভূমি পাহাড়িদের হাত থেকে দলিল ও বন্দোবস্তির নামে সরকারের হাতে চলে যায়। অর্থাৎ পাহাড়ের মালিকানা পাহাড়িদের পরিবর্তে সরকারের হাতে চলে যায়। কিন্তু রাজা হিসেবে সার্কেল চিফরা বহাল থাকায় তারা এই আইনের প্রতিবাদ করেনি।
এটি ছিল ব্রিটিশের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির অংশবিশেষ। প্রতিকূল আইন হওয়া সত্ত্বেও আজ পাহাড়িরা ১৯০০ সালের ব্রিটিশ প্রবিধানকে ধন্য ধন্য করছেন তার একমাত্র কারণ এই আইনে পাহাড়ের বাইরের লোকদের পাহাড়ে পুনর্বাসন ও জমির বন্দোবস্তি পাহাড়িদের হাতে ছিল বলে। এছাড়া এই আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে নেয়া হয়।
অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এটি যখন তার অন্তর্ভুক্ত হয় তখন এই আইন তাদের পক্ষে আত্মিকরণ করা সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট যখন ভারত ভাগ হয় এবং পার্বত্য প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী রাঙামাটিতে ভারতীয় পতাকা ও বান্দরবানে বার্মার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
সে পতাকা বেশ কিছুদিন যাবত পাকিস্তানে উড়েছিল। ১৭ আগস্ট র্যাডক্লিফ রায় প্রকাশিত হবার পর ২১ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেই পতাকা নামিয়ে ফেলে। ১৭ আগস্ট রায়ের পরও পাহাড়িরা প্রতিবাদ জানিয়েছিল রায়ের বিরুদ্ধে। এ প্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার ১৯০০ সালে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবিধানমালাÑ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অনুমোদন দেয়নি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসনকে মেনে নেয়নি। বরং ১৯৫৮ সালে ভূমি অধিগ্রহণের নিমিত্তে আরেকটি নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে।
এই প্রজ্ঞাপনের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণ করে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করা হয়। কাজেই এটিও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন।
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানেও পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি-১৯০০-কে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। তবে এরশাদ সরকারের শাসনামলে ১৯৮৯ সালে ব্রিটিশ বিধি অনুসরণে জেলা পরিষদ আইন সৃষ্টি করা হয়। এ আইনে জমি বন্দোবস্তি হেডম্যানদের হাত থেকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের হাতে অর্পণ করা হয়।
আইন অনুযায়ী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অবশ্যই একজন উপজাতীয় হবেন।
তবে অনেকেই এখন ১৯০০ সালে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন বলে প্রচার করতে চাইছেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোতে এই বিধি গ্রহণের সুযোগ নেই। প্রথমত, এই বিধি একটি উপনিবেশিক ধারণাসঞ্জাত। দ্বিতীয়ত, এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসনকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।
সে কারণে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোতে এই বিধিকে গ্রহণ করা হয়নি। এখন যদি এই বিধি অনুসরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান করা হয় তাহলে আইনগতভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বায়ত্বশাসনের পথে এগিয়ে যাবে। কারণ এ বিধির উৎস ও পরিণতি সন্ধান করলেই এ কথা পরিষ্কার বোঝা যাবে। এ বিষয়ে তথ্য প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে। তবে এ লেখায় সেই দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ নেই।
এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত ‘রীতি’, ‘পদ্ধতি’ ও ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত ‘রীতি’, ‘পদ্ধতি’ ও ‘ঐতিহ্য’ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও লিখিত কোনো দলিল পাওয়া যায় না। মূলত এসব কতকগুলো ধারণা ও আচারের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত রীতি, পদ্ধতি ও ঐতিহ্য বলতে উপজাতীয়দের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতি, পদ্ধতি ও ঐতিহ্যকে বোঝায়। ভূমির ক্ষেত্রে এই রীতি, ঐতিহ্য ও পদ্ধতি হচ্ছে : পাহাড়িরা ভূমির ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানা, দলিল-দস্তাবেজে বিশ্বাসী নয়।
তাদের কাছে ভূমি সামষ্টিক অধিকার। পাহাড়ের জমি হচ্ছে সর্বসাধারণের সম্পত্তি। যার মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠী, জ্ঞাতিগোষ্ঠী এমনকি প্রেতলোকের সদস্যরাও। একক পরিবারগুলো জমি ব্যবহারের অধিকার ভোগ করে থাকে মাত্র। ফলে পাহাড়িরা মনে করে জমি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এর মালিক তারাই।
জুম চাষের জন্য তারা প্রত্যেক বছর এক স্থান থেকে অন্য স্থনে বসতি স্থানান্তর করে থাকে। কাজেই বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে যেখানে তারা জুম চাষ করেছে, বসতি গড়েছে সে জমি তাদের, আগামীতেও যে সকল জমি তাদের চাষের আওতায় আসতে পারে সে সকল জমিও তাদের। পাহাড়ের রীতি অনুযায়ী যে জমিতে তারা চাষাবাদ করেছে/করবে, যে জমি/পাহাড়/বন থেকে তারা আহার সংগ্রহ করেছে, করে বা করবে। যে জমিতে তারা বসতি স্থাপন করেছিল/করেছে/করতে পারে, যে জমির উপর দিয়ে তারা চলাচলের জন্য ব্যবহার করে থাকে, যে জমি থেকে তাদের পোষা প্রাণী খাবার সংগ্রহ করে থাকে, যে জমি তার দৃষ্টিসীমায়, স্বপ্ন ও কল্পনায় তা তাদের সকলের। এখানে নির্দিষ্ট মালিকানা বা দলিলের অস্তিত্ব নেই।
কাজেই এই রীতি বা ঐতিহ্য বা পদ্ধতি অনুযায়ী যদি ভূমি কমিশন বিচার করে সে ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালির অস্তিত্ব, জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে বাধ্য।
আইনের ১৬নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘বর্ণিত কোন বিষয়ে দাখিলকৃত আবেদনের উপর কমিশন প্রদত্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রি বলিয়া গণ্য হইবে। ’ দেওয়ানী আদালত একটি সাংবিধানিক আদালত। এর বিচারপতিগণ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান রক্ষায় শপথবদ্ধ থাকেন। অন্যদিকে কমিশনের প্রধান ও অন্যান্য সদস্যরা কেউই শপথবদ্ধ নন।
চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হওয়ায় তিনিও শপথবদ্ধ নন, আবার বাকি সদস্যরা সাধারণ উপজাতীয়, যারা হয়তো চুক্তির আগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এমন কেউ হতে পারে। বিশেষ করে জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ থেকে যাদের নাম আসবে তাদের ক্ষেত্রে সাবেক শান্তিবাহিনীর সদস্য আসা স্বাভাবিক অথচ তারা শপথবদ্ধ নন। হতে পারে তারা জেএসএস, ইউপিভিএফ এর সামরিক শাখার গোপন সদস্য। এছাড়াও অতীতে কোনো মামলা যদি দেওয়ানী আদালতে নিষ্পত্তি হয়ে থাকে, বা দেওয়ানী আদালতে চলমান কোনো মামলা যদি এই কমিশনের দৃষ্টিগোচর হয় তাহলে কমিশনের ভূমিকা কি হবে তা স্পষ্ট নয়। কিম্বা একই মামলা একপক্ষ কমিশনে এবং অন্যপক্ষ দেওয়ানী আদালতে বিচার প্রার্থনা করলে কমিশনের ভূমিকা কি হবে তাও স্পষ্ট নয়।
দেওয়ানী আদালত ও কমিশনের মধ্যে কার অবস্থান ঊর্ধ্বে তাও পরিষ্কার নয়। সাংবিধানিক আদালতকে অসাংবিধানিক চুক্তির আওতায় গঠিত কমিশনের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া যায় কিনা সে প্রশ্নটিও বিশাল।
তাহলে সরকার কি করবে? শান্তিচুক্তির মধ্যে কিছু অসাংবিধানিক ধারা যে বিদ্যমান তা উচ্চ আদালতের রায় দ্বারা প্রমাণিত। যদিও সে রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত অবস্থায় রয়েছে। তবে উপরিউক্ত আলোচনায় এ কথা প্রমাণিত যে, ভূমি কমিশন তেমনি একটি ধারা বা আইন।
বিষয়টি উচ্চ আদালতের দৃষ্টিতে নিলে তা বাতিল হতে বাধ্য বলে অনেক আইনজ্ঞ মনে করেন। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা মোকাবেলায় সরকারের করণীয়, শান্তিচুক্তির ভূমি কমিশন সংক্রান্ত ধারা ও ভূমি কমিশন আইন বাতিল করে দেশের প্রচলিত দেওয়ানী আদালতে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা। মামলা দ্রুততর করা ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে দরকার হলে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ঘোষণা করা। তবে তার আগে অবশ্যই ভূমি জরিপের মাধ্যমে ভূমির সীমানা ও মালিকানা নির্ধারণ করতে হবে। নিরাপত্তার অজুহাতে যদি ভূমি জরিপ না করা হয়, বা করা সম্ভব না হয় তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তার জন্য বিশাল আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
মনে রাখা প্রয়োজন পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অংশ। এখানে যা কিছু করা হবে তা দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন মেনেই করতে হবে।
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।