আমি একজন পর্যটন কর্মী। বেড়াতে, বেড়ানোর উৎসাহ দিতে এবং বেড়ানোর আয়োজন করতে ভালোবাসি।
লিখেছেন গোলাপ মুনীর, সূত্র নয়া দিগন্ত অনলাইন।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের ১৩,২৯৫ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে রয়েছে ভারত ও মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সীমান্ত।
১৯৮৪ সালের আগে পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম একটিমাত্র জেলার আওতায় ছিল। তা পরিচিত ছিল ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা’ নামে। ১৯৮৪ সালে তা ভেঙে করা হয় তিনটি জেলা : খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান।
জনসংখ্যা : ১৯৫১ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা বেড়ে চলা ও বণ্টন চিত্র থেকে দেখা যায়Ñ ১৯৫১ সালে সেখানকার জনসংখ্যা ছিল ২,৯০,০০০ (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫৭) জন), ১৯৬১ সালে ৩,৮৫,০০০ (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৭৫ জন); ১৯৭৪ সালে ৫,০৮,০০০ (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০০ জন), ১৯৮১ সালে ৭,০৮,৪৫২ (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৪৭ জন) এবং ১৯৯১ সালে ৯,৬৭,৪২০ জন (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৯০ জন)। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একমাত্র অঞ্চল, যেখানে মোট জনসংখ্যার মোটামুটি অর্ধেকই অবাঙালি ও অমুসলিম।
মূলত এ অঞ্চলটি মিশ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত বিভিন্ন জাতি-উপজাতি, নানা ভাষাভাষী এবং নানা ধর্মাবলম্বী ও বহু সংস্কৃতির ধারক-বাহক জনগণের একটি এলাকা। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা ও জনসংখ্যার বণ্টন দেখানো হয়েছে এভাবেÑ বাঙালি ৫ লাখ (৫০ শতাংশ), চাকমা ২ লাখ ৪০ হাজার (২৪ শতাংশ), মারমা ১ লাখ ৪৩ হাজার (১৪ শতাংশ), টিপরা বা ত্রিপুরা ৬১ হাজার (৬ শতাংশ), তনচঙ্গা বা ত্যগনাক ১ হাজার ৯০০ (১.৯ শতাংশ), কোম ৭ হাজার (০.৭ শতাংশ), পাঙ্গো ৪ হাজার ৫০০ (০.৩৫ শতাংশ, চাক ২ হাজার (০.২ শতাংশ), খ্যাং ২ হাজার (০.২০ শতাংশ), খুমি ১ হাজার ২০০ (০.১২ শতাংশ), লুসাই ৬২২ জন (০.৫ শতাংশ) এবং ম্রো বা কোকি ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার (?)।
ইতিহাস বলে
ব্রিটিশদের উপমহাদেশে আসার পর থেকে ব্রিটিশরাজের মধ্যভাগ (১৭৬২-১৮৯২) পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংখ্যা মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। ১৭৬০ সালে এ জেলায় জনসংখ্যা ছিল এক লাখ ৭ হাজার। ১৮৯২ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা আর না বাড়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় অধিক মৃত্যুহার এবং অভিগমন আইনের কড়াকড়ির বিষয়টিকে (Shelley, ১৯9২)।
বিগত শতকের প্রথম ভাগ থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৯৬১ সালে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার। ১৯৯১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৪২০ জনে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই অবাঙালি বা উপজাতীয় জনগোষ্ঠীভুক্ত। উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিয়ানমার বা বার্মা থেকে এসেছে চাকমারাÑ এরা সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতি গোষ্ঠী।
এদের ভাষা স্থানীয় ‘চাটগাঁইয়া’ ও বাংলা ভাষার মিশ্ররূপ। মারমা জনগোষ্ঠী এসেছে আরাকান থেকে, এরা মগ উপজাতি গোষ্ঠীভুক্ত। এরা পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। ভাষা ও জীবনাচরনের দিক দিয়ে এরা চামকাদের থেকে পুরোপুরি আলাদা। এদের ভাষা আরাকানি বর্মী ভাষা (আহমেদ, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ৬৩)।
টিপরা জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের তৃতীয় বৃহত্তম উপজাতি জনগোষ্ঠী। এদের প্রায় সবাই হিন্দু। এ ছাড়া আরো ছোট ছোট কয়েকটি উপজাতি নৃ-গোষ্ঠী আছে। তাই এটুকু এখন স্পষ্ট, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার অর্ধেকই বাঙালি। আর বাকি অর্ধেক বিভিন্ন মঙ্গোলীয় উপজাতি শ্রেণিভুক্ত।
বাঙালিদের একটা বড় অংশ বাংলাদেশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস শুরু করে। এর আগেও এ এলাকায় বাঙালি বসতি ছিল। অপর দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি জাতিবহির্ভূত অন্য সব উপজাতি জনগোষ্ঠীই এখানে তুলনামূলক সবার পরে এ এলাকায় আসে। ম্রো, খ্যাং, পাঙ্খো ও কুকিরাই মূলত এ এলাকায় প্রথমে আসে। ইতিহাসবিদদের ধারণা, এরা ২০০ থেকে ৫০০ বছর আগে স্থানান্তরিত হয়ে এ এলাকায় আসে।
অথচ চামকারা আসে মোগল আমলের শেষ দিকে ও ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকেÑ মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল থেকে (খবরিহ ১৮৬৯)। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ও ব্রিটিশ প্রশাসক টি এইচ লে উইনের মতে, ÔA greater portion of the hill tribes at presets living in the Chittagong Hill Tracts undoubtedly came about two generations ago from Arakn. This is asserted both by their own traditions and by seacoast in Chittagong Collect orate (Lewis, 1৮৬9, P-28).
পার্বত্য অঞ্চলের মারমা বা মগ জনগোষ্ঠী ১৭৮৪ সালে এ অঞ্চলে দলে দলে অনুপ্রবেশ করে এবং আধিপত্য বিস্তার করে (Shelley ১৯9২ and lewen 1৮৬9).
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজতীয়দের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এসব জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই যুদ্ধবিগ্রহ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামায় পারস্পরিকভাবে লিপ্ত ছিল। ফলে কোনো উপজাতি গোষ্ঠীকে তাদের পুরনো বসতি থেকে নতুন জায়গায় গিয়ে বসতি স্থাপন করতে হয়েছে। আবার কোনো উপজাতি দখল করা নতুন জায়গায় বসতি গড়ে তুলেছে। (Hutchenigon 1909, Bernot 1960 and Resley, 1991)।
হয়তো এ জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজাতিকে দেখা যায় বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করতে। এখানে এসব উপজাতির মধ্যে আন্তঃদ্বন্দ্ব ও রেষারেষি প্রবল। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সামরিক শক্তিচুক্তি কোনো উপজাতি গোষ্ঠী মানছে, আবার কোনো কোনো উপজাতি মানছে না। পরস্পরের বিরুদ্ধে তাদের সশস্ত্র হিংসাত্মক লড়াই এখনো চলছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। সম্প্রতি দৈনিক ইনকিলাবের একটি খবরে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে বিবদমান দুই পাহাড়ি সংগঠন ইউপিডিএফ ও জেএসএসের সঙ্ঘাতে গত দুই বছরে উপজাতি সম্প্রদায়ের ৭৫ জন নিহত হয়েছে।
তা ছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৮৬টি সেনাক্যাম্প থেকেও শান্তিচুক্তির পর দুই শতাধিক সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের পর উপজাতি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের ব্যাপক চাঁদাবাজির শিকার সেখানকার বাঙালিরা। এ পর্যন্ত উপজাতি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে পাঁচ শতাধিক বাঙালি নিহত হয়েছে। সরকার কোনোমতেই সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি ও বাঙালি হত্যা বন্ধ করতে পারছে না। তেমনি পারছে না উপজাতিদের আন্তঃসংঘর্ষ ও মানুষ হত্যা বন্ধ করতে।
উপজাতি বনাম আদিবাসী বিতর্ক
‘উপজাতি বনাম আদিবাসী’ কিংবা ‘ুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বনাম আদিবাস’ নামে একটি অহেতুক বিতর্ক আমাদের এই বাংলাদেশে বেশ জোরেশোরেই চালানো হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি বা ুদ্র নৃ-গোষ্ঠী যে এখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী নয়, তা ইতিহাসই বলে দেয়। তার পরও এরা নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। সুখের কথা, বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে শত দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে এই প্রধান দুই দলসহ বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল একমত : পার্বত্য চট্টগ্রামের অবাঙালি বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ুদ্র ুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতি গোষ্ঠীভুক্ত। এরা কখনোই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নয়।
কারণ, ইতিহাস কোনো মতেই তাদের আদিবাসী হওয়ার দাবিকে সমর্থন করে না। তার পরও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীর নেতারা সাংবিধানিকভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃত আদায়ের বিভ্রান্তিকর দাবি নিয়ে তৎপর। আমাদের দেশের গুটিকয়েক পত্রপত্রিকা ও কিছু এনজিও না বুঝে ইতিহাসের সত্যকে উপেক্ষা করে উপজাতিদের অযৌক্তিক ‘আদিবাসী’ হওয়ার দাবির প্রতি নানাভাবে সমর্থন-সহযোগিতা জানাচ্ছে। সেই সাথে জন্ম দিচ্ছে একটি অহেতুক বিতর্কের। আর এ বিতর্ক পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি বিনষ্টে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে চলেছে।
তা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের উল্লিখিত ভাষাগত জনজাতিগুলো তাদের ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি আদায়ের জন্য নানা ধরনের প্রচারণা ও লবিং চালাচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। তাদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে জাতিসঙ্ঘ চায় এরা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাক। এ জন্য মাঝেমধ্যে জাতিসঙ্ঘও বাংলাদেশের ওপর নানাধর্মী চাপও প্রয়োগ করছে। গত বছর ১৬ মে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থার আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের বৈঠক। এই ফোরামের জন্য উপস্থাপনের জন্য যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয় তাতে জাতিসঙ্ঘ পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি উপজাতিকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে উল্লেখ করে।
তা ছাড়া প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সেখানে আগের মতো এক সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই প্রতিবেদনে তাগিদ দেয়া হয়, বর্তমান সরকারের আমলেই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।
সুখের কথা, বর্তমান সরকার এ ফোরামে আদিবাসী প্রশ্নে বাংলাদেশের সঠিক অবস্থানটিই তুলে ধরেছে। সরকার বলেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাষাগত সংখ্যালঘুরা ুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠী। এরা আদিবাসী নয়।
লক্ষণীয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিগুলোর প্রশ্নে সরকারের সঠিক অবস্থান থাকলেও সরকারের দুুই মন্ত্রী ও কয়েকজন উপজাতি এমপি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি চাইছে সংবিধানে ও জাতিসঙ্ঘে। সরকারের বর্তমান সঠিক অবস্থান ধরে না রাখলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে। গত বছর ১৬ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিল, ‘উপজাতিরা আদিবাসী হিসেবে নয়, ুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি পাবে। জাতিসঙ্ঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, আদিবাসী বলতে যাদের বোঝায় আমাদের উপজাতিরা ‘আদিবাসী’ নয়। বর্তমান ও অতীতের প্রতিটি সরকার যখন উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার অযৌক্তিক দাবি স্বীকার করছে না, তখন উপজাতিরা বলছে, ব্র্যাকেটে হলেও সংবিধানে উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে উল্লেখ করা হোক।
এটা উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের একটি চতুর কৌশল। এ দাবি আদায়ে সক্ষম হলে পরবর্তী সময়ে দাবি তুলবে সেই ‘ব্র্যাকেট’ সংবিধান থেকে তুলে দিয়ে তাদের পুরোপুরি ‘আদিবাসী’ হিসেবে পূর্ণ স্বীকৃতি আদায়ে।
শাক্তিচুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর চাকমা রাজনীতিবিদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করে। সেখানে লারমা অভিযোগ করেন, সংবিধানে বাংলাদেশের সব নাগরিককে বাঙালি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু উপজাতিরা বাঙালি নয়।
এরা অবাঙালি। তা ছাড়া সংবিধানে শুধু বাঙালি সংস্কৃতির স্বীকৃতি আছে, অবাঙালি উপজাতি সংস্কৃতির নেই। অতএব সংবিধানে উপজাতিদের জাতিগত সত্তা ও সংস্কৃতির স্বীকৃতি দিতে হবে। তা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বায়ত্তশাসনও দিতে হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদেরকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে কথা চালু রয়েছে।
এতে লারমা ও অন্যান্য উপজাতির প্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুর জবাবে খুশি হতে পারেননি। তারা ১৯৭৩ সালে গঠন করে রাজনৈতিক সংগঠন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। এর সশস্ত্র শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ নামে পরিচিত। এই শান্তিবাহিনী শুরু করে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন।
একপর্যায়ে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু একদলীয় বাকশাল গঠন করলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পরবর্তী সামরিক সরকারগুলোর আমলেও অবস্থা একইভাবে চলতে থাকে। ১৯৭৭ সালে শান্তিবাহিনী প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কনভয়ের ওপর হামলা চালায়। সরকার এ অবস্থার পেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা মোতায়েন করে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনা ও সেখানকার মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য গঠন করেন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড’।
সেনাবাহিনীর একজন জেনারেলকে এ বোর্ডের প্রধান করা হয়, কিন্তু তাতেও অবস্থার উন্নতি ঘটেনি। উপজাতিদের আস্থা-অনাস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। এদিকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পাকিস্তান আমলে বাস্তুচ্যুত উপজাতিদের মধ্যে বিদ্যমান অসন্তোষও কাটেনি। এরশাদ সরকারের আমলে নানাভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আনায়নের চেষ্টা চলে আলাদা ‘জেলা পরিষদ আইন’ পাস করে। উপজাতিদের প্রতিনিধিত্ব স্থানীয় সরকারে বাড়ানো হয়।
কিন্তু পিসিজেএসএস এর প্রতি সমর্থন জানায়নি।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিসিজেএসএসের সাথে স্বাক্ষর করেন পার্বত্য শান্তিচুক্তি। আশা করা হয়েছিল, এই চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের অবসান ঘটাবে। কিন্তু কার্যত হয়নি। সব উপজাতি এ শান্তিচুক্তি মেনে নেয়নি।
তা ছাড়া পিসিজেএসএসও শান্তিচুক্তির বাইরে নানা দাবি নিয়ে সময়ে সময়ে হাজির হতে থাকে। শান্তিচুক্তির এক বছরের মাথায় ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে উপজাতিদের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট’ গঠিত হয়, যা শান্তিচুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এদের সশস্ত্র হামলা ও মানুষ হত্যা এখনো অব্যাহত।
১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি নতুন করে কিছু সমস্যার সৃষ্টি করে। এ শান্তিচুক্তিতে ‘বাংলাদেশে সকল নাগরিক সমান’Ñ এ সাংবিধানিক স্বীকৃতি অস্বীকার করে ভূমি, চাকরি, সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে উপজাতিদের অগ্রাধিকার দিয়ে সেখানকার বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়।
তাদের ভাবটা এমনÑ উপজাতিরাই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির মালিক। এ দাবি পাকাপোক্ত করার জন্য এদের সর্বশেষ কৌশল তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন আইনের অধিকতর সংশোধনী। সরকার চাপের মুখে পড়ে এদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে গত ২৯ জুলাই এক বৈঠকে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইনের ১৩টি সংশোধনীর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। শান্তিচুক্তির পর ২০১১ সালে জাতীয় সংসদে পাস হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন। জেসিএসএস বলছে, এই আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির মধ্যে ২৩টি অসঙ্গতি রয়েছে।
বলা হচ্ছে, সেসব অসঙ্গতি দূর করতেই সম্প্রতি ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইনে ১৩টি সংশোধনী চূড়ান্ত করা হয়েছে।
জনমনে আশঙ্কা
জেসিএসএস এদিকে সরকারের ওপর নানাধর্মী চাপ সৃষ্টি করে সরকারের কাছ থেকে নানা দাবিদাওয়া আদায় করে নিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন, উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইনের অধিকতর সংশোধনীর মাধ্যমে পার্বত্য ‘চট্টগ্রামের ভূমি ও প্রশাসনের ওপর একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করার চেষ্টায় লিপ্ত। অপর দিকে মাঝে মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে হুমকি দিচ্ছে আবার অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার। সরকারও মনে হয় থেকে থেকে উপজাতিদের এ ধরনের অযৌক্তিক হুমকির কাছে বারবার নতিস্বীকার করছে।
ফলে সেখানকার অর্ধেক জনগোষ্ঠী তথা বাঙালি ভূমি, চাকরি, অধিকারহারা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে পড়ছে। এর সাথে বিদেশী ষড়যন্ত্র কাজ করছে সমান্তরালভাবে। কোনো কোনো দেশ বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সব বাঙালিকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসনের যত খরচ হবে, তার পুরোটাই তারা বহন করবে। অতএব সরকার কেন তা করতে দেরি করছে। আমরা জানি না, বাইরের একটি দেশ কী করে একটি দেশের নাগরিকদের তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদের এ ধরনের অবৈধ প্রস্তাব দিতে পারে!
আসলে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপজাতি, আদিবাসী ও ুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের কথা বলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো কার্যত এক ধরনের ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক, ভূ-অর্থনৈতিক ও সর্বোপরি আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্র নিয়ে কাজ করছে, আশঙ্কা করা হচ্ছে, অদূরভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিলিস্তিনি ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের মতো একটি খ্রিষ্টবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
সে জন্য সেখানে খ্রিষ্টবাদী এনজিওগুলো উপজাতিদের খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে নানা ধরনের কর্মসংস্থান ও আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে। তারা অবাধে বিদেশে যাওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষকে সজাগ থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।