১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী বাহিনী নতজানু হয়ে আত্মসমর্পন করার পরে আমরা মনে করেছিলাম চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে যখন মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষ আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে উঠেছে, সে সময় সীমান্তের ওপারে পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট শহরের অদূরে ডাঙ্গা বিজয়শ্রী গ্রামে কমিউনিস্ট নেতা সিদ্ধেশ্বর ঘোষের বাড়িতে একটি বিদায় ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। বিজয়শ্রী ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও প্রায় নয় মাস ধরে যাঁরা আমাদের নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা দিয়েছিলেন গ্রামের সেইসব অকৃত্রিম বন্ধুদের অনেকেই সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেই বিদায় অনুষ্ঠানে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। হিলি-পাঁচবিবি-জয়পুরহাট স্বাধীন হয়ে গেছে আরও দু তিনদিন আগে।
কাজেই আমাদের সবার মধ্যেই তখন ঘরে ফেরার তাড়া। বিদায়ের আবেগঘন মুহূর্তে একজন বয়োবৃদ্ধ কমিউনিষ্ট নেতা আমাদের কয়েকজনের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ কিন্তু শেষ হয়নি কমরেড, তোমাদের সামনে এখনও অনেক কাজ। ’
কথাটি সে সময় গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার বয়স আমাদের নয়। ফলে কথাটি কে বলেছিলেন তাও এখন আর মনে পড়ে না। তবে স্পষ্ট মনে পড়ে জয়পুরহাটে ফিরে এসে ৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখ রাতে আমাদের পাকিস্তানপন্থী এক বন্ধুর পরিত্যক্ত বাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কয়েকজন একত্রিত হয়েছিলাম।
আমাদের মাংস পোলাওয়ের ভূরিভোজনে যোগ না দিয়েও নিরামিষাশী এক বন্ধু সর্বোচ্চ পনের টাকা চাঁদা দিয়েছিল। এরপর এলাকার খ্যাতনামা রাজাকার এবং পাকিস্তানী দালালদের খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়ে অস্ত্রশস্ত্র জমা দিয়ে জানুয়ারির শেষ দিকে আমরা যে যার মতো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়েছিলাম।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্য অগাস্টের হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরের কিছু বেশি সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্য নেহায়েত কম নয়। এর একদিকে ছিল একটি সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা, ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার, নব্বই লক্ষ শরণার্থীর পুনর্বাসন এবং সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করে আইন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার মতো তাৎক্ষণিক করণীয়। অন্যদিকে মাত্র ১০ মাসের মধ্যে একটি আধুনিক ও গ্রহণযোগ্য বিশ্বমানের সংবিধান প্রণয়ন, স্বল্পতম সময়ে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর প্রত্যাবর্তন, ১৪০টি দেশের স্বীকৃতি অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান নিশ্চিত করার মতো সুদূর প্রসারী অর্জন।
এ ছাড়াও শিক্ষা, কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ বাংলাদেশের অগ্রগতির লক্ষ্যে অপরিমেয় সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এই সকল ইতিবাচক অর্জন ছাপিয়ে ১৯৭৪ সালের খাদ্য ঘাটতি ও এর ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, রক্ষী বাহিনীর সন্ত্রাস ও সরকারের দুর্নীতি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করে জনমত সৃষ্টিসহ সরকার পতনের একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। সরকারের প্রচারযন্ত্র সে সময়েও ভীষণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এর কারণ হতে পারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ছিলেন তৎকালীণ তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী।
১৯৭৫ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ এবং তার কার্য-কারণ সম্পর্ক সকলেরই জানা।
জেনারেল জিয়াউর রহমান শাহ আবদুল আজিজ এবং আবদুল আলিমের মতো চিহ্নিত পাকিস্তানপন্থীদের নিয়ে তাঁর মন্ত্রী সভা গঠন করেছিলেন, বাংলাদেশে গণহত্যা পরিকল্পনার অন্যতম রূপকার জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযমের প্রত্যাবর্তন ও পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং জামায়াতে ইসলামীসহ নিষিদ্ধ ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে এনেছিলেন। জিয়ার শাসন অবসান এবং এরশাদের মতো স্বৈরশাসকের পতনের পরে দেশের গণতন্ত্রায়নের যুগেও ক্ষমতাসীনরা তাদের ভোটের রাজনীতির স্বার্থে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে যুদ্ধাপরাধীদের শক্তি সঞ্চয়ে সহায়তা দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এই মৌলবাদী অপশক্তি ব্যাংক বীমা, স্কুল কলেজ, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারি বেসরকারি চাকুরি ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করে তাদের অবস্থান সংহত করেছে। এমন কি জামায়াতকে ভোটযুদ্ধে সহযোদ্ধা হিসাবে গ্রহণ করে তাদের বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভায় স্থান করে দিয়েছে। এ ভাবেই একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা তাদের কৃতর্মের জন্যে কোনো ভুল স্বীকার বা ক্ষমা প্রার্থনা না করে বাংলাদেশের বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে, বাংলাদেশের মাটিতে উৎপাদিত খাদ্য খেয়ে, বাংলার পানিতে তৃষ্ণা নিবারণ করে এখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে, হরতালের নামে এবং বিক্ষোভের নামে জামায়াত শিবিরের এই অঘোষিত যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেলে, যোগযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হলে, একর পর এক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় ধ্বস নামলে তাদের কিছুই আসে যায় না। কারণ, প্রকৃতপক্ষে তারা তো বাংলাদেশের অস্তিত্বেই যারা বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাসীরা কখনও লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা করতে পারে না, ভাষা শহীদদের স্মৃতিধন্য শহীদ মিনার ভাঙতে পারে না।
যারা তাদের যুদ্ধাপরাধী পূর্বসূরীদের বাঁচাবার লক্ষ্যে সারা বাংলাদেশকে তাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়ে মরণ পণ লড়াইয়ে নেমেছে, যে কোনো মূল্যে তাদের প্রতিহত করাই এখন আমাদের প্রধান কাজ। আমরা যে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম তা শেষ করিনি, আমরা সাপ মেরে তার লেজ জিইয়ে রেখেছি, আমরা বিষবৃক্ষের গোড়া কেটে দিলেও তার অঙ্কুরোদ্গম বন্ধ করিনি।
সেই কারণে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সকল সাফল্য নস্যাৎ করে দিয়ে, সকল অর্জন ভূলুন্ঠিত করে যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদী অপশক্তি নামে বেনামে দেশকে অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার পাঁয়তারা করতে সাহসী হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার ৪২ বছরের পরেও তাই এ বছর নববর্ষে চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করতে হয়েছে ‘রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ/মুক্তিযুদ্ধ অনিঃশেষ’।
স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা লগ্নে কে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ কিন্তু শেষ হয়নি কমরেড’ তা এখন আর মনে নেই। তাঁর উদ্দেশে সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে বলতে চাই, ‘এতোদিন আগে কি করে এই ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন জানি না, তবে আপনার এই আশঙ্কা আজ বহুগুণ বর্দ্ধিত আকারে সত্যি হয়ে উঠেছে!’ বিজয়ের আত্মতৃপ্তিতে সেদিন আমরা যারা ভবিষ্যত মানে শুধু রঙিন স্বপ্নের অন্তহীন সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলাম তাদের জন্যেও কিছু কথা আছে। এখন আরও একবার একাত্তরের চেতনায় উজ্জীবীত হয়ে অসমাপ্ত যুদ্ধকে শেষবারের মতো শেষ করতে হবে।
শেকড় শুদ্ধ উপড়ে ফেলতে হবে বিষবৃক্ষ। আর তা না হলে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল, উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, সুখি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন বাদ দিয়ে পশ্চাদপদ তালেবানী রাষ্ট্রের দুঃসহ জীবন বেছে নেবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।