আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে
৩১ মে , ১৯৮১ । করাচীগামী সন্ধ্যার ফ্লাইটে বাবা দেশ ছাড়ার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ । হঠাৎ করেই ভর করে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ । ৩০ শে মে রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বিপথগামী কিছু অফিসার কর্তৃক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হলেন । বিদেশগামী যাত্রীদের দেশত্যাগে আরোপ করা হল ভীষণ কড়াকড়ি ।
বাবা ভীষণ দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন, ঠিক এমন সময় বাবাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন বাবার স্কুলের বন্ধু আর্মির একজন মেজর ।
২ বছর আগে ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করে আব্বু তখন ঢাকা মেডিকেলের সার্জারি ওয়ার্ডের রেজিস্টারার এবং সিও । বাংলাদেশী
ডাক্তারদের মাঝে তখন মধ্যপ্রাচ্যে যাবার ধুম । ঢাকা মেডিকেলের সার্জারি ওয়ার্ডের ইনচার্জ সিনিয়র প্রফেসর আব্বুকে ভীষণ স্নেহ করতেন । তার হস্তক্ষেপের কারণে সৌদি আরব সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধায়নে
সৌদি যাবার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায় বেশ কয়েকবার ।
দাদার সংসারের কথা ভেবে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন স্যারকে না জানিয়েই সৌদি আরবের চেয়ে অনেক কম সুবিধা সম্বলিত ইরান যাবেন । এ যাত্রায় বাবার সঙ্গী , বাবার এক বন্ধু ।
করাচী থেকে বাইরোডে পৌছুলেন পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে । সেখান থেকে বর্ডার পার হয়ে প্রবেশ করলেন ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে । জাহেদান শহর থেকে দীর্ঘ বাসযাত্রা শেষে তেহরান পৌছুতে লেগে গেল পুরো তিনদিন।
ইরান-ইরাক যুদ্ধের অষ্টম কি নবম মাস চলছে তখন । পারস্য উপসাগরে কয়েকটি দ্বীপের মালিকানা এবং শাতিল-আরব মোহনার দখলদারিত্ব নিয়ে ৮ বছর ব্যাপি ইরাক-ইরানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা ১৯৮০ সালে ।
১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর রেজা শাহ পাহলভীপন্থি আর্মি
অফিসারদের অনেকেই পাশ্চাত্যে পালিয়ে গেছেন , যারা যেতে পারেননি , তাদের অনেককেই বরখাস্ত করা হয়েছে , বা বিভিন্ন মেয়াদে কারাগারে
প্রেরণ করা হয়েছে। শাহের একান্ত অনুগত অনেক জেনারেলকে ফাঁসিকাষ্ঠও ঝুলানো হয়। ১৯৮০ সালে ইরাকের করা আকস্মিক আক্রমণে হতভম্ব ইরান তখনও গুছিয়ে উঠতে পারেনি ।
সে কারণে , শক্তিশালী ইরাকী
বাহিনীর মোকাবেলায় এলোমেলো ইরানী বাহিনী প্রাথমিকভাবে বিপর্যস্ত
হয়ে পড়ে ।
এরকম পরিস্থিতির মাঝে ৮১ সালের মে মাসের যেদিন আব্বু তেহরান পৌছুলেন , সেদিনও তেহরান দফায় দফায় ইরাকী বোমারু বিমানগুলোর হামলার শিকার হয় ।
দেশে আত্মীয়-স্বজনকে বিপুল উৎকন্ঠার মাঝে রেখে গেছেন আব্বু । কোথায় পোস্টিং হবে সেটা নিয়েও অনেক উৎকন্ঠার মাঝে পড়ে গেলেন । আব্বুর আশংকাই সত্য হল , পোস্টিং দেয়া হল ইরাক ঘেঁষে থাকা , ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ কেরমানশাহের সর্বপশ্চিমের জেলা পাভেহতে ।
ইরাক সীমান্ত থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরে দামাভান্দ পর্বতমালার একটি পাহাড়ে গা বেয়ে নেমে আসা শহর পাভেহ । ইরাক সীমান্ত থেকে মাত্র ১৭ কিমি দূরে হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধের এক বছরে পাভেহর একবারও আক্রান্ত না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল । ইরাক-ইরান যুদ্ধ তখন পরিচিত হয়ে উঠছে "ব্যাটল অব সিটিজ" হিসেবে । সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ক্ষয়ক্ষতি সাধনের জন্য দু' দেশই পরস্পরের বৃহত্তম শহরগুলোকে টার্গেট করতে শুরু করে , ফলে পাভেহ এর মত ছোট শহরগুলো প্রাথমিক আক্রমণের লক্ষবস্তু হয়নি । ইরাক সীমান্ত থেকে দূরত্ব মাত্র ১৭ কিমি হলেও এর পুরোটাই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল , ফলে স্থল আক্রমণ থেকেও পাভেহ তখনও অক্ষত রয়ে যায় ।
১৯৮২ সালের শুরুর দিকে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় । ইরাকী স্থলবাহিনী ইরানী ভূ-খন্ড দখলের লক্ষ্য নিয়ে ইরানের পশ্চিম সীমান্তে তীব্র আক্রমণ চালায়। আক্রান্ত হয় ইরাক সীমান্তবর্তী পাভেহ জেলার সীমান্ত সংলগ্ন শহর নওসুদ এবং নোদশেহ এবং ক্বাসর-এ-শিরিন।
প্রথমেই ইরাকী বাহিনীর হাতে পদানত হয় মরুদ্যান ক্বাসর-এ-শিরিন । ক্বাসর-এ-শিরিনের পতনের পর ইরাকী বাহিনী তখন নউসুদ এবং নদশা অভিমুখে উদ্যত ।
বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশী কোন ডাক্তারকে ফ্রন্টে পাঠানোর কথা নয় । নউসুদ এবং নোদশেহ এর আকস্মিক ভাবে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা সে চুক্তিতে কয়েকদিনের জন্য ছেদ টানল ইরাকী মর্টারশেল নিক্ষেপে ইরানি ডাক্তারদের অধিকাংশ তখন নিহত হন , ধ্বংস হয়ে যায় নৌসুদ হাসপাতাল। শয়ে শয়ে আহত সৈন্যে ভরে যায় নোদশেহ হাসপাতাল । প্রাদেশিক রাজধানী কেরমানশাহ থেকে ইরানী ডাক্তার এসে পৌছুতে সময় লেগে যাবে দু'তিনদিন । জরুরী ডাকে নদশেহ পাঠানো হল আব্বুকে ।
ইরাক সীমান্তের মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে নোদশেহ শহর দখল করতে এগিয়ে আসছে
ইরাকী ট্যাংকবাহিনী । জীবন-মরণের দোলাচলে , নদশা হাসপাতালে
বাবা অতিবাহিত করেন জীবনের দুঃসহতম তিনটি দিন ।
১৯৮২ এর শেষদিকে মাস দুয়েকের জন্য দেশে ফেরেন বাবা । সদ্য বিয়ে করে ইরান ফেরার পর বাবার নতুন কর্মস্থল পাভেহ এর দক্ষিণের শহর জাভানরুদে । চারটা বড় পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায় অবস্থিত জাভানরুদ তুলনামূলক ভাবে অনেক ছোট শহর , পাভেহ এর মত পুরো শহরটা পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নেই ।
শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট পাহাড়ি নদীটির নামও জাভানরূদ । পাভেহ এর তুলনায় জাভানরুদ অনেক বেশি সুরক্ষিত । ইরাকি বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হবার সুযোগটা অনেক কম , এ কথা ভেবে বাবা অনেকটাই আস্বস্ত । ১৯৮৩ এর মাঝামাঝি আম্মু জাভানরুদ যান ।
১৯৮৪ এর শুরুর দিকে যুদ্ধের গতিপথে বড় ধরণের পরিবর্তন আসল ।
প্রাথমিক বিপর্যয় অবস্থা কাটিয়ে উঠে ইরানিরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়তে শুরু করে । বড় শহর গুলোর সীমা ডিঙিয়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে ছোট শহরগুলোতে ।
১৯৮৪ এর শেষদিকে এক রাতে জাভানরুদের আকাশ ভেঙ্গে প্রথম উড়ে যায় কয়েকটি ইরাকী জঙ্গী বিমান । শহরের উত্তর প্রান্তের পাহাড়ের উপর অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট কামানগুলো গর্জে ওঠে । পরের দিন আতঙ্কে শহরের অনেকটাই খালি হয়ে যায় ।
শহরের উপকন্ঠের শান্ত পাহাড়ী গ্রামগুলো জাভানরুদবাসীর প্রাথমিক আশ্রয়স্থল । আম্মাকে
নিয়ে অন্য অনেক জাভানরুদবাসীর মত আব্বু আশ্রয় নেন জাভানরুদের উপকন্ঠে শান্ত , ছায়াঘেরা গ্রাম সাফিদবার্গে । আমার বয়েস তখন কয়েকমাস ....
ঘোরতর দুঃশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তার মাঝে আব্বু সিদ্ধান্ত নেন আরও দুর্গম এলাকায় পোস্টিং নেয়ার । হেড-অফিসে দরখাস্ত করার পর নতুন অফার আসে ... গন্তব্যের নাম শারভিনাহ। ১৯৮৬ এর একদম প্রারম্ভে আমরা জাভানরুদ ছেড়ে যাই , নতুন ঠিকানা শারভিনাহ ।
মোটামুটি প্রত্যন্ত অঞ্চল বলতে যা বোঝায় শারভিনাহের সাথে তা মোটামুটি মানিয়ে যায় । শারভিনাহ যাবার রাস্তা তখনও পুরো পাকা হয়নি , পাহাড় কেটে বানানো কাঁচা রাস্তা ধরে শারভিনাহ যাবার পথটাও ভীষণ বিপদসঙ্কুল , বেশ কিছু জায়গায় রাস্তার পাশে হাজার ফুটের বেশি গভীর খাদ । জাভানরুদের পূর্ব দিকে অবস্থিত শারভিনাহ ইরাকী ভু-খন্ড থেকে মাত্র ৩৫ কি। মি দূরে । তবে এ ৩৫ কি.মি এর প্রায় পুরোটাই বিপদশঙ্কুল পর্বতাকীর্ণ , সে কারণে স্থলবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ শারভিনাহতে নেই ।
আর কৌশলগত কারণে শারভিনাহতে বিমান হামলা হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় ইরাকের অনেক কাছাকাছি থেকেও শারভিনাহ ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি নিরাপদ ...
(এ পর্বের পুরোটাই আমার বাবা মায়ের কাছ থেকে শোনা , অল্প বয়েসের কারণে তখনকার কোন স্মৃতিই আমার মনে নেই । শারভিনাহ থেকে আমার স্মতিগুলো জমাট বাঁধতে শুরু করে , সেসব কথা থাকছে পরের পর্বে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।