লিবিয়ার ৪২ বছরের একনায়ক ও সরকারের বিরুদ্ধে সেদেশের গণবিদ্রোহ জটিল পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। লিবিয়ার বেসামরিক জনগণকে রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে পশ্চিমা সরকারগুলো ন্যাটো জোটের কাঁধে সওয়ার হয়ে সামরিক হস্তক্ষেপে মেতে ওঠায় উত্তর আফ্রিকার এই দেশে সংঘটিত গণবিদ্রোহ জটিল রূপ নিয়েছে। লিবিয়ার জনগণ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিলের মধ্যদিয়ে শুরু করেছিল ওই গণবিদ্রোহ। স্বৈরশাসক গাদ্দাফি ও তার স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটানোর শ্লোগান উচ্চারিত হয়েছে লিবিয়ার প্রায় সব ক’টি শহরে। গাদ্দাফি ও তার প্রশাসন প্রথম থেকেই বেসামরিক জনগণের গণবিক্ষোভ দমনের জন্য নৃশংস সামরিক দমন অভিযানের পথ বেছে নেয়।
গাদ্দাফি নিজে প্রতিবাদীদের নিকৃষ্ট বা নোংরা জানোয়ার হিসেবে অভিহিত করেন এবং তাদের হত্যা করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন। গাদ্দাফি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার দাবিতে সংগ্রামরত লিবিয়দের ওপর গুলি চালিয়ে তাদের স্তব্ধ করার পন্থা বেছে নেয়ায়, দেশটিতে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ এবং পাশ্চাত্যের সামরিক হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
লিবিয়ার বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তা, বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তা ও বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তা গাদ্দাফি সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। এ ছাড়াও তারা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে একটি অন্তর্বতী পরিষদ বা অস্থায়ী সরকার গঠন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
গাদ্দাফি আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে ভাড়াটে সেনা এনে ঘোষণা করেন, তাকে সহায়তা করার জন্য যারা প্রস্তুত তাদের সবার জন্য তিনি অস্ত্রের গুদাম খুলে দিয়েছেন।
এরপর গাদ্দাফির সেনারা বিপ্লবীদের দখলে থাকা বেশ কয়েকটি শহর পুণর্দখল করে। এমনকি তারা বিপ্লবীদের প্রধান ঘাঁটি বেনগাজির প্রায় ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যায়। এ অবস্থায় গাদ্দাফি এক ভাষণে বলেন, আমি আমার সেনাবাহিনীর জন্য বেনগাজি শহরের সমস্ত জানোয়ার বা প্রাণীগুলোকে হত্যা করা এবং তাদের পরিবার-পরিজনকে বন্দি হিসেবে গোলাম বানিয়ে নেয়াকে বৈধ ঘোষণা করলাম।
গাদ্দাফি সরকারের সাথে বৃটিশ ও ফরাসি সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠায় তারা দেশটির এই গণবিদ্রোহের মুখে ত্রিপোলির সাথে ওই ঘনিষ্ঠতার নীতি পরিবর্তনের চেষ্টা করে। লন্ডন ও প্যারিস লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করতে থাকে।
তবে এই হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তারা আরববিশ্বের সাম্প্রতিক গণজাগরণের প্রেক্ষাপটে একঢিলে বহু পাখি মারার লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয়। লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য বিশ্বজনমতের সমর্থন দরকার ছিলো। আর এ জন্য মানবদরদি শ্লোগান ব্যবহার করে পাশ্চাত্য। আফগানিস্তানে পাশ্চাত্যের সামরিক হস্তক্ষেপ বিশ্বজনমত কখনও সুনজরে দেখেনি। ইউরোপের জনগণ আফগানিস্তান থেকে তাদের সেনা সরিয়ে আনার দাবি করছে।
গাদ্দাফির নৃশংস গণহত্যা লিবিয়ায় তাকে এতোটা ঘৃণ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে, বল বা শক্তি প্রয়োগ করে তার পতন ঘটানোর চেষ্টায় দেশটির খুব কম নাগরিকের আপত্তি রয়েছে বলে মনে করা হয়। এ অবস্থায় নিরস্ত্র জনগণের ওপর গাদ্দাফি সেনাদের বিমান হামলা বন্ধ এবং বেসামরিক লিবিয় নাগরিকদের রক্ষার অজুহাতে দেশটিতে নো ফ্লাই জোন বা বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ অঞ্চল গঠন সংক্রান্ত ইঙ্গ-ফরাসি প্রস্তাব ১৭ মার্চ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাশ হয়।
১৯৯৯ সালে সার্বিয়ার ওপর এবং ২০০৩ সালে ইরাকের ওপর ন্যাটোর বিমান হামলার অভিজ্ঞতা থেকে এটা স্পষ্ট, নো ফ্লাই জোন গঠন লিবিয়ায় পাশ্চাত্যের সামরিক হস্তক্ষেপের একটা অজুহাত মাত্র। পাশ্চাত্য গাদ্দাফির দানবীয় চরিত্র সম্পর্কে ঠিকই সচেতন ছিলো। তারা জানতো, যে লোকটি নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য স্বদেশবাসীর ওপর গণহত্যা চালাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত নয়, সে লোকটি আন্তর্জাতিক আইনকেও সম্মান করবে না।
তাই পাশ্চাত্য কেবল নো ফ্লাই জোন গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করে জাতিসংঘে। আর গাদ্দাফির সেনারা ওই প্রস্তাব লঙ্ঘন করায় লিবিয়ায় ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপের পথ পরিস্কার হয়ে যায়। ন্যাটো জোটের ব্যানারে লিবিয়ায় ওই হস্তক্ষেপের সুবিধা হলো, এর রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামরিক ব্যয়ভার কেবল একটি বা অল্প কয়েকটি দেশের মধ্যেই সীমিত থাকবে না।
মার্কিন সরকারও লিবিয়ায় ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপকে সমর্থন করেছে। আফগানিস্তানে ন্যাটোর ব্যর্থতার পটভূমিতে লিবিয়ায় এ জোটের সাফল্য এটা প্রচারের সুযোগ এনে দিয়েছে, ন্যাটো ইউরোপের বাইরেও মার্কিন সরকার ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্য পূরণে সক্ষম।
লিবিয়ায় গাদ্দাফির বাহিনী ও বিদ্রোহিদের মধ্যে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় এবং গাদ্দাফি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য পাশ্চাত্যের তেমন আগ্রহ না থাকায় দেশটিতে পাশ্চাত্যের সামরিক হস্তক্ষেপের দীর্ঘ, মধ্য ও স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যগুলো নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল মনে করেন, লিবিয়ায় ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য জনগণকে মুক্ত করা নয়, বরং তাদের রয়েছে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ও স্বার্থ। তার মতে, যারা বহু বছর ধরে গাদ্দাফি সরকারকে সহায়তা দিয়ে এসেছে, তারা এখন নো ফ্লাই জোন গঠন করে রাতারাতি নীতি পরিবর্তন করেছে। আবদুল্লাহ গুল বলেন, পাশ্চাত্য কোথাও যুদ্ধের আগুন জ্বালালে আমাদেরকেও তাদের অনুসারী হতে হবে এমন ধারণা ঠিক নয় এবং দুঃখজনকভাবে এমন প্রত্যাশাও করা হয়েছে, তুরস্কও পশ্চিমা দেশগুলোর মতো লিবিয়ায় পাশ্চাত্যের হামলায় অংশ নেবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল আরো বলেছেন, আমার ভয় হচ্ছে, ইরাকে যা ঘটেছিলো, লিবিয়ায়ও তার পুণরাবৃত্তি ঘটবে।
ইরাকের সম্পদ লুট করা হয়েছে এবং এখন লিবিয়ার সম্পদও লুট করা হবে বলে আমি আশঙ্কা করছি। তুরস্ক ন্যাটো জোটের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও দেশটির প্রেসিডেন্টের এই বিশ্লেষণ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
মার্কিন সরকার ও ন্যাটো লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ চালিয়ে দেশটিতে গাদ্দাফির সেনা এবং বিদ্রোহীদের সামরিক শক্তিকে প্রায় সমান রাখতে চায়। বিদ্রোহীদের মোকাবেলায় গাদ্দাফি সেনাদের মূলশক্তি ছিলো যুদ্ধ বিমান। নো ফ্লাই জোন গঠন ও গাদ্দাফির কোনো কোনো সেনা-অবস্থানের ওপর ন্যাটোর হামলার ফলে ওই বিমানশক্তি অচল হয়েছে।
ন্যাটো এখন গাদ্দাফির সেনাদের মূল কাঠামোর ওপর হামলা চালাচ্ছে না, বরং ছোটখাট টার্গেটগুলোর ওপর হামলা চালাচ্ছে। এইসব সীমিত হামলার মাধ্যমে ন্যাটো গাদ্দাফি সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে চায়। ন্যাটো ইচ্ছে করলেই কয়েক দিনের মধ্যেই গাদ্দাফির গোটা বাহিনীকে অচল করে দিতে পারতো। আসলে ন্যাটো লিবিয়ার উভয় পক্ষকেই ক্লান্ত ও দুর্বল করার কৌশল প্রয়োগ করেছে। উভয় পক্ষই যখন যথেষ্ট মাত্রায় দুর্বল হবে, ন্যাটো তখন শান্তিরক্ষীর ভূমিকা নিয়ে উভয়পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে দেশটিতে তার পছন্দের সরকার গঠন করবে।
একজন আলকায়েদা থিঙ্কট্যাঙ্কার এসবে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, লিবিয়ার একজন কারজাই পাওয়া গেলেই তারা তড়িঘড়ি আলোচনার টেবিলে বসবে।
লিবিয়ায় মার্কিন সরকার ও ন্যাটোর আরেকটি বড় লক্ষ্য হলো, গাদ্দাফি রাশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা বিভিন্ন মডেলের অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমানসহ যেসব বড় বড় সামরিক এবং সুসজ্জিত বিমান ঘাঁটি গড়ে তুলে লিবিয়াকে ওই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বিমানশক্তিকে পরিণত করেছিলেন, তা ধ্বংস করে দেয়া। গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ায় যে সরকারই ক্ষমতাসীন হোক না কেন, তারা লিবিয়ার পুনর্গঠনের জন্য অস্ত্র কেনা বাবদ পাশ্চাত্যের অস্ত্র কোম্পানিগুলোর পকেট ভরে তোলবেন তেলের অর্থে। বিধ্বস্ত অর্থনীতি ও সশস্ত্রবাহিনীকে পুনর্গঠনের জন্য লিবিয়ার ভবিষ্যত সরকার পাশ্চাত্যের অর্থ এবং সামরিক সাহায্যের আশায় পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ পূরণে নিবেদিত থাকতে বাধ্য হবে। আর এভাবেই লিবিয়ার তেল সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য দেশটিতে পাশ্চাত্যের তেল কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি এবং প্রভাব অব্যাহত থাকবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।