সামান্য কারণেই শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে এই বিশাল শিল্প ধ্বংসের চক্রান্তে জড়িত দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে অতীতে কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একশ্রেণীর নামধারী রাজনৈতিক নেতা, এনজিও এবং শ্রমিক সংগঠনের মদদে এই ধ্বংস চলছেই।
টানা ৩ দিন আশুলিয়া এলাকায় শ্রমিকদের তাণ্ডব চলার পর শ্রমমন্ত্রীর উদ্যোগে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে সমঝোতা হয়। শ্রমিকরা শুক্রবার কাজে যোগদানও করেন। কিন্তু শনিবারই আশুলিয়া ও কাঁচপুরে একযোগে তাণ্ডব চালায় শ্রমিকরা।
কাদের ইন্ধনে শিল্প এলাকায় পরিস্থিতি এভাবে অশান্ত করে তোলা হলো তা পর্যালোচনা করলেই অনেক প্রশ্নের উত্তর বের হয়ে আসবে। আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছে তাদের বেশিরভাগই বাইরের লোক। এদের ব্যবহার করা হয়েছে। বাইরে থেকে যোগ দেয়া আন্দোলনকারীদের পুলিশ বাহিনীর কিছু জামায়াত ও বিএনপিপন্থী কর্মকর্তার সহযোগিতা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথম দিকে আশুলিয়ায় শ্রমিক আন্দোলনে বেতন বৃদ্ধির কোন দাবি ছিল না।
কৌশলে বেতন-ভাতার বিষয়টি আন্দোলনকারীরা সামনে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গার্মেন্টস শিল্পকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এর পেছনে জামায়াতের ইন্ধন রয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থা খবর দিয়েছে।
২০০৭ সালের পরে এটাই সবচেয়ে বড় শ্রমিক আন্দোলন। কেন এমন আন্দোলন দানা বেঁধেছে তা নিয়ে অনেক বিষয় জড়িত রয়েছে।
বাংলাদেশে একজন শ্রমিক প্রতিমাসে সর্বনিম্ন বেতন পান ৫৫ মার্কিন ডলার। চীনে প্রতিমাসে একজন শ্রমিক ২০৬ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১০৭ ডলার, পাকিস্তানে ৮৫ ডলার, ভারতে ৬৫ ডলার বেতন পান। দেশে শ্রমের মূল্য কম হলেও এ সেক্টর থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। এ বাজারটি অন্য কোথাও চলে যাক এর জন্য দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র চলছে দীর্ঘদিন ধরে। তারই বহির্প্রকাশ গত কয়েকদিনের শ্রমিক অসন্তোষ।
এক হিসাবে বলা হয়েছে, বেসরকারী খাতে সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী একটি খাত হচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্প। মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৭৮ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। উদ্যোক্তারা আশা করছেন, আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। এ উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়েই কাজ করছেন উদ্যোক্তারা। তবে এ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চূড়া স্পর্শ করতে হলে উদ্যোক্তাদের একার চেষ্টাই যথেষ্ট নয়।
এর জন্য দরকার তৈরি পোশাকশিল্পের স্থিতিশীল কর্মপরিবেশ এবং এ খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকারের নীতি-সহায়তা অব্যাহত রাখা।
চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের রফতানি খাতের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ হাজার ৫শ’ মিলিয়ন ডলার। এ লক্ষ্যমাত্রার হিসাব মেলাতে অর্থবছরের বাকি আছে আর মাত্র এক মাস। অথচ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেয়া তথ্য অনুযায়ী ৭৮ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণকারী তৈরি পোশাক খাতের রফতানি প্রবৃদ্ধি মোটেও সন্তোষজনক নয়। বিশেষ করে নিটওয়্যারে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় সাড়ে ১১ শতাংশ, ফুটওয়্যারে ১৩ দশমিক ০৯ শতাংশ, হোমটেক্সটাইলে ১০ দশমিক ১৪ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে রফতানি আয় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ১৮শ’ মিলিয়ন ডলার পিছিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ সময়ে ২৩ হাজার ৭৬২ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন ডলারের রফতানির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এর থেকে আয় হয়েছে মাত্র ২১ হাজার ৯৭৬ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
সূত্র জানিয়েছে, দেড় বছর আগে সরকার-মালিক-শ্রমিক ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে গার্মেন্টসের সর্বনিম্ন বেতন ঠিক করা হয় ৩ হাজার টাকা। ওই বৈঠকে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছিল আগামী দুই বছরের মধ্যে আর কোন বেতন বৃদ্ধির দাবি তোলা হবে না।
তখন শ্রমিকরাও বিষয়টি মেনে নেয়। দুই বছর পার হতে আরও ৬ মাস বাকি রয়েছে। এখন কেন বেতন-ভাতা বৃদ্ধির নামে তৈরি পোশাকশিল্পে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হলো। আশুলিয়া বা অন্য যেখানেই শ্রমিক আন্দোলন হচ্ছে সেখানেই পিছন থেকে ইন্ধন দেয়া হচ্ছে। আন্দোলনে প্রকৃত শ্রমিকের সংখ্যা হাতেগোনা।
বাইরে থেকে ভাড়াটে লোকজন এনে গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে।
গার্মেন্টস শ্রমিকনেতা আমিনুলের হত্যাকান্ডের বিষয়টি সম্প্রতি হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিরোধী নেত্রীর কাছে তুলে ধরেন। হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশের শ্রম অবস্থা নিয়ে প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি বলেন, এএফএল-সিআইও বাংলাদেশের জিএসপি অধিকার বাতিলের জন্য আবেদন করেছে, যা এখনও নির্ধারিত হয়নি। যদিও এর ফলে তৈরি পোশাকশিল্প সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না তবে এ অধিকার বাতিল হলে এর ফলে আমেরিকাজুড়ে একটি নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে যাবে যে বাংলাদেশ শ্রমবান্ধব নয়, এ বার্তাটি তৈরি পোশাক ক্রেতা ও ভোক্তার কাছেও পৌঁছে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) সম্পাদনে দেরি হওয়াটা ওয়াশিংটনে দেখা হয়েছে বাংলাদেশ তার আন্তর্জাতিক শ্রমআইনগত বাধ্যবাধকতা থেকে পিছু হটছে, যা তারা আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন ঘোষণায় অঙ্গীকার করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে এটি গ্রহণ করেছিল, তবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অঙ্গীকার থেকে পিছু হটতে পারবে না এবং হটবে না। টিকফা খুবই সরল এবং এটিতে একটি মাত্র কার্যকর বিষয় রয়েছে দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বাধা দূর করতে একটি ফোরাম গঠন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, সম্প্রতি ঢাকায় এক নৈশভোজে আমেরিকার প্রধান ব্র্যান্ডের ছয় ক্রেতা আমাকে পাশে ডেকে নেন এবং তাদের প্রধান কার্যালয় থেকে পাওয়া উদ্বেগের বিষয়গুলো আমাকে জানান। দি নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, এবিসি নিউজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্র্কে নেতিবাচক প্রতিবেদনসমূহ আমেরিকার জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
এছাড়া তারা বাংলাদেশে উন্নয়নের নেতিবাচক ধারণার কারণে তাদের কোম্পানির সুনাম ক্ষুণ্ণ ওয়ার ব্যাপারে তাদের উদ্বেগের কথা জানান।
সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী মালিক-শ্রমিক বৈঠকে বসেছিলেন। ওই বৈঠকে শ্রমিক নেতৃবৃন্দের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন বাবুল আকতার, শামীমা নাসরিন ও রুহুল আমীন। তাঁরা ওই বৈঠকে বলেন, আমরা এ মুহূর্তে বেতন ভাতা বাড়ানোর কোন আন্দোলন করছি না। কারা এ আন্দোলন করছেন এ বিষয়টি সরকারকে খুঁজে বের করার আহ্বান জানান তাঁরা।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের কোন এলাকাতেই শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন নামে কোন সংগঠন নেই। এটা শুধু আশুলিয়াতেই রয়েছে। এ সংগঠনের সভাপতির নাম গোলাম আজম। সংগঠনটির উপদেষ্টারা ও সদস্যরা হচ্ছে জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আশুলিয়ায় যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানোর জন্য এ সংগঠনটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
আর্থিকভাবে শক্তিশালী এ সংগঠনের সঙ্গে সেখানকার কয়েক উচ্চপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে। ওই সব পুলিশ কর্মকর্তার একটি তালিকা ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। একজন ডিআইজি যিনি বিএনপির এক সাবেক এমপির মেয়ের জামাই। আরেক কর্মকর্তার বাড়ি সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে। তিনি মনেপ্রাণে জামায়াতকে সমর্থন করেন।
ওই সংগঠনের সভাপতি গোলাম আজম বাইরে থেকে লোক সরবরাহ দিয়ে শিল্প এলাকা অশান্ত করে তোলে। এ গোলাম আজম বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছে।
পরিশেষে, বিশেষ মহলের সেই চক্রান্ত রূখে দিয়ে দেশের প্রধান রপ্তানি এই খাতকে বাঁচাতে সবার সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রয়োজন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।