আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পল্লীকবি জসীম উদদীন এর নকশী কাঁথার মাঠই--যারা এখন পড়েন নি ,তারা পড়ে দেখতে পারেন

নকশী কাঁথার মাঠ – জসীম উদদীন এক বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে ক্ষীর নদী, উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল, পাঙ্খা দেয় নাই বিধি | — রাখালী গান এই এক গাঁও, ওই এক গাঁও — মধ্যে ধু ধু মাঠ, ধান কাউনের লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ | এ-গাঁও যেন ফাঁকা ফাঁকা, হেথায় হোথায় গাছ ; গেঁয়ো চাষীর ঘরগুলি সব দাঁড়ায় তারি পাছ | ও-গাঁয় যেন জমাট বেঁধে বনের কাজল কায়া, ঘরগুলিরে জড়িয়ে ধরে বাড়ায় বনের মায়া | এ-গাঁও চেয়ে ও-গাঁর দিকে, ও-গাঁও এ-গাঁর পানে, কতদিন যে কাটবে এমন, কেইবা তাহা জানে! মাঝখানেতে জলীর বিলে জ্বলে কাজল-জল, বক্ষে তাহার জল-কুমুদী মেলছে শতদল | এ-গাঁর ও-গাঁর দুধার হতে পথ দুখানি এসে, জলীর বিলের জলে তারা পদ্ম ভাসায় হেসে! কেউবা বলে — আদ্যিকালের এই গাঁর এক চাষী, ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমে গলায় পরে ফাঁসি ; এ-পথ দিয়ে একলা মনে চলছিল ওই গাঁয়ে, ও-গাঁর মেয়ে আসছিল সে নূপুর-পরা পায়ে! এইখানেতে এসে তারা পথ হারায়ে হায়, জলীর বিলে ঘুমিয়ে আছে জল-কুমুদীর গায়ে | কেইবা জানে হয়তো তাদের মাল্য হতেই খসি, শাপলা-লতা মেলছে পরাগ জলের উপর বসি | মাঠের মাঝের জলীর বিলের জোলো রঙের টিপ, জ্বলছে যেন এ-গাঁর ও-গাঁর বিরহেরি দীপ ! বুকে তাহার এ-গাঁর ও-গাঁর হরেক রঙের পাখি, মিলায় সেথা নতুন জগৎ নানান সুরে ডাকি | সন্ধ্যা হলে এ-গাঁর পাখি ও-গাঁর পানে ধায়, ও-গাঁর পাখি এ-গাঁয় আসে বনের কাজল ছায় | এ-গাঁর লোকে নাইতে আসে, ও-গাঁর লোকেও আসে জলীর বিলের জলে তারা জলের খেলায় ভাসে | এ-গাঁও ও-গাঁও মধ্যে ত দূর — শুধুই জলের ডাক, তবু যেন এ-গাঁয় ও-গাঁয় নেইকো কোন ফাঁক | ও-গাঁর বধু ঘট ভরিতে যে ঢেউ জলে জাগে, কখন কখন দোলা তাহার এ-গাঁয় এসে লাগে | এ-গাঁর চাষী নিঘুম রাতে বাঁশের বাঁশীর সুরে, ওইনা গাঁয়ের মেয়ের সাথে গহন ব্যথায় ঝুরে! এ-গাঁও হতে ভাটীর সুরে কাঁদে যখন গান, ও-গাঁর মেয়ে বেড়ার ফাঁকে বাড়ায় তখন কান | এ-গাঁও ও-গাঁও মেশামেশি কেবল সুরে সুরে ; অনেক কাজে এরা ওরা অনেকখানি দূরে | এ-গাঁর লোকে দল বাঁধিয়া ও-গাঁর লোকের সনে, কাইজা ফ্যাসাদ্ করেছে যা জানেই জনে জনে | এ-গাঁর লোকেও করতে পরখ্ ও-গাঁর লোকের বল, অনেকবারই লাল করেছে জলীর বিলের জল | তবুও ভাল, এ-গাঁও ও-গাঁও, আর যে সবুজ মাঠ, মাঝখানে তার ধূলায় দোলে দুখান দীঘল বাট ; দুই পাশে তার ধান-কাউনের অথই রঙের মেলা, এ-গাঁর হাওয়ায় দোলে দেখি ও-গাঁয় যাওয়ার ভেলা | দুই এক কালা দতের কালি যা দ্যা কলম লেখি, আর এক কালা চক্ষের মণি, যা দ্যা দৈনা দেখি, —ও কালা, ঘরে রইতে দিলি না আমারে | — মুর্শিদা গান এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল, কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল! কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া, তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া | জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু, গা-খানি তার শাঙন মাসের যেমন তমাল তরু | বাদল-ধোয়া মেঘে কে গো মাখিয়ে দেছে তেল, বিজলী মেয়ে পিছলে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল | কচি ধানের তুলতে চারা হয়ত কোনো চাষী, মুখে তাহার ছড়িয়ে গেছে কতকটা তার হাসি | কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি, কালো দতের কালি দিয়েই কেতাব কোরাণ লেখি | জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভূবনময় ; চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয় | সোনায় যে জন সোনা বানায়, কিসের গরব তার’ রঙ পেলে ভাই গড়তে পারি রামধণুকের হার | কালোয় যে-জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন, তারি পদ-রজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন | সোনা নহে, পিতল নহে, নহে সোনার মুখ, কালো-বরণ চাষীর ছেলে জুড়ায় যেন বুক | যে কালো তার মাঠেরি ধান, যে কালো তার গাঁও! সেই কালোতে সিনান করি উজল তাহার গাও | আখড়াতে তার বাঁশের লাঠি অনেক মানে মানী, খেলার দলে তারে নিয়েই সবার টানাটানি | জারীর গানে তাহার গলা উঠে সবার আগে, “শাল-সুন্দী-বেত” যেন ও, সকল কাজেই লাগে | বুড়োরা কয়, ছেলে নয় ও, পাগাল লোহা যেন, রূপাই যেমন বাপের বেটা, কেউ দেখেছ হেন? যদিও রূপা নয়কো রূপাই, রূপার চেয়ে দামী, এক কালেতে ওরই নামে সব গাঁ হবে নামী | তিন চন্দনের বিন্দু বিন্দু কাজলের ফোঁটা কালিয়া মেঘের আড়ে বিজলীর ছটা — মুর্শিদা গান ওই গাঁখানি কালো কালো, তারি হেলান দিয়ে, ঘরখানি যে দাঁড়িয়ে হাসে ছোনের ছানি নিয়ে ; সেইখানে এক চাষীর মেয়ে নামটি তাহার সোনা, সাজু বলেই ডাকে সবে, নাম নিতে যে গোনা | লাল মোরগের পাখার মত ওড়ে তাহার শাড়ী, ভোরের হাওয়া যায় যেন গো প্রভাতী মেঘ নাড়ি | মুখখানি তার ঢলঢল ঢলেই যেত পড়ে, রাঙা ঠোঁটের লাল বাঁধনে না রাখলে তায় ধরে | ফুল-ঝর-ঝর জন্তি গাছে জড়িয়ে কেবা শাড়ী, আদর করে রেখেছে আজ চাষীদের ওই বাড়ি | যে ফুল ফোটে সোণের খেতে, ফোটে কদম গাছে, সকল ফুলের ঝলমল গা-ভরি তার নাচে | কচি কচি হাত পা সাজুর, সোনায় সোনার খেলা, তুলসী-তলায় প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঁঝের বেলা | গাঁদাফুলের রঙ দেখেছি, আর যে চাঁপার কলি, চাষী মেয়ের রূপ দেখে আজ তাই কেমনে বলি ? রামধনুকে না দেখিলে কি-ই বা ছিল ক্ষোভ, পাটের বনের বউ টুবাণী, নাইক দেখার লোভ | দেখেছি এই চাষী মেয়ের সহজ গেঁয়ো রূপ, তুলসী-ফুলের মঞ্জরী কি দেব-দেউলের ধূপ! দু একখানা গয়না গায়ে, সোনার দেবালয়ে, জ্বলছে সোনার পঞ্চ প্রদীপ কার বা পূজা বয়ে! পড়শীরা কয়—মেয়ে ত নয়, হলদে পাখির ছা, ডানা পেলেই পালিয়ে যেত ছেড়ে তাদের গাঁ | এমন মেয়ে—বাবা ত নেই, কেবল আছেন মা ; গাঁওবাসীরা তাই বলে তায় কম জানিত না | তাহার মতন চেরন “সেওই” কে কাটিতে পারে, নক্সী করা পাকান পিঠায় সবাই তারে হারে | হাঁড়ির উপর চিত্র করা শিকেয় তোলা ফুল, এই গাঁয়েতে তাহার মত নাইক সমতুল | বিয়ের গানে ওরই সুরে সবারই সুর কাঁদে, “সাজু গাঁয়ের লক্ষ্মী মেয়ে” — বলে কি লোক সাধে? চার কানা দেয়ারে, তুই না আমার ভাই, আরও ফুটিক ডলক দে, চিনার ভাত খাই — মেঘরাজার গান চৈত্র গেল ভীষণ খরায়, বোশেখ রোদে ফাটে, এক ফোঁটা জল মেঘ চোঁয়ায়ে নামল না গাঁর বাটে | ডোলের বেছন ডোলে চাষীর, বয় না গরু হালে, লাঙল জোয়াল ধূলায় লুটায় মরচা ধরে ফালে | কাঠ-ফাটা রোদ মাঠ বাটা বাট আগুন লয়ে খেলে, বাউকুড়াণী উড়ছে তারি ঘূর্ণী ধূলী মেলে | মাঠখানি আজ শূণ্য খাঁ খাঁ, পথ যেতে দম আঁটে, জন্-মানবের নাইক সাড়া কোথাও মাঠের বাটে : শুকনো চেলা কাঠের মত শুকনো মাঠের ঢেলা, আগুন পেলেই জ্বলবে সেথায় জাহান্নামের খেলা | দরগা তলা দুগ্ধে ভাসে, সিন্নি আসে ভারে : নৈলা গানের ঝঙ্কারে গাঁও কানছে বারে বারে | তবুও গাঁয়ে নামল না জল, গগনখানা ফাঁকা ; নিঠুর নীলের বক্ষে আগুন করছে যেনে খাঁ খাঁ | উচ্চে ডাকে বাজপক্ষি “আজরাইলে”র ডাক, “খর দরজাল” আসছে বুঝি শিঙায় দিয়ে হাঁক! এমন সময় ওই গাঁ হতে বদনা-বিয়ের গানে, গুটি কয়েক আসলো মেয়ে এই না গাঁয়ের পানে | আগে পিছে পাঁচটি মেয়ে—পাঁচটি রঙে ফুল, মাঝের মেয়ে সোনার বরণ, নাই কোথা তার তুল | মাথায় তাহার কুলোর উপর বদনা-ভরা জল, তেল হলুদে কানায় কানায় করছে ছলাৎ ছল | মেয়ের দলে বেড়িয়ে তারে চিকন সুরের গানে, গাঁয়ের পথে যায় যে বলে বদনা-বিয়ের মানে | ছেলের দলে পড়ল সাড়া, বউরা মিঠে হাসে, বদনা বিয়ের গান শুনিতে সবাই ছুটে আসে | পাঁচটি মেয়ের মাঝের মেয়ে লাজে যে যায় মরি, বদনা হাতে ছলাৎ ছলাৎ জল যেতে চায় পড়ি | এ-বাড়ি যায় ও-বাড়ি যায়, গানে মুখর গাঁ, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে যেন-রাম-শালিকের ছা | কালো মেঘা নামো নামো, ফুল তোলা মেঘ নামো, ধূলট মেঘা, তুলট মেঘা, তোমরা সবে ঘামো! কানা মেঘা, টলমল বারো মেঘার ভাই, আরও ফুটিক ডলক দিলে চিনার ভাত খাই! কাজল মেঘা নামো নামো চোখের কাজল দিয়া, তোমার ভালে টিপ আঁকিব মোদের হলে বিয়া! আড়িয়া মেঘা, হাড়িয়া মেঘা, কুড়িয়া মেঘার নাতি, নাকের নোলক বেচিয়া দিব তোমার মাথার ছাতি | কৌটা ভরা সিঁদুর দিব, সিঁদুর মেঘের গায়, আজকে যেন দেয়ার ডাকে মাঠ ডুবিয়া যায়! দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো | দেয়ারে তুমি নিষালে নিষালে নামো | ঘরের লাঙল ঘরে রইল, হাইলা চাষা রইদি মইল ; দেয়ারে তুমি অরিশাল বদনে ঢলিয়া পড় | ঘরের গরু ঘরে রইল, ডোলের বেছন ডোলে রইল ; দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো | বারো মেঘের নামে নামে এমনি ডাকি ডাকি, বাড়ি বাড়ি চলল তারা মাঙন হাঁকি হাঁকি কেউবা দিল এক পোয়া চাল, কেউবা ছটাকখানি, কেউ দিল নুন, কেউ দিল ডাল, কেউ বা দিল আনি | এমনি ভাবে সবার ঘরে মাঙন করি সারা, রূপাই মিয়ার রুশাই-ঘরের সামনে এল তারা | রূপাই ছিল ঘর বাঁধিতে, পিছন ফিরে চায়, পাঁটি মেয়ের রূপ বুঝি ওই একটি মেয়ের গায়! পাঁচটি মেয়ে, গান যে গায়, গানের মতই লাগে, একটি মেয়ের সুর ত নয় ও বাঁশী বাজায় আগে | ওই মেয়েটির গঠন-গাঠন চলন-চালন ভালো, পাঁচটি মেয়ের রূপ হয়েছে ওরই রূপে আলো | রূপাইর মা দিলেন এনে সেরেক খানেক ধান, রূপাই বলে, “এই দিলে মা থাকবে না আর মান |” ঘর হতে সে এনে দিল সেরেক পাঁচেক চাল, সেরেক খানেক দিল মেপে সোনা মুগের ডাল | মাঙন সেরে মেয়ের দল চলল এখন বাড়ি, মাঝের মেয়ের মাথার ঝোলা লাগছে যেন ভারি | বোঝার ভারে চলতে নারে, পিছন ফিরে চায় ; রূপার দুচোখ বিঁধিল গিয়ে সোনার চোখে হায়! পাঁচ লাজ-রক্ত হইল কন্যার পরথম যৌবন — ময়মনসিংহ গীতিকা আশ্বিনেতে ঝড় হাঁকিল, বাও ডাকিল জোরে, গ্রামভরা-ভর ছুটল ঝপট লট্ পটা সব করে | রূপার বাড়ির রুশাই-ঘরের ছুটল চালের ছানি, গোয়াল ঘরের খাম থুয়ে তার চাল যে নিল টানি | ওগাঁর বাঁশ দশটা টাকায়, সে-গাঁয় টাকায় তেরো, মধ্যে আছে জলীর বিল কিইবা তাহে গেরো | বাঁশ কাটিতে চলল রূপাই কোঁচায় বেঁধে চিঁড়া, দুপুর বেলায় খায় যেন সে—মায় দিয়াছে কিরা | মাজায় গোঁজা রাম-কাটারী চক্ চকাচক্ ধার, কাঁধে রঙিন গামছাখানি দুলছে যেন হার | মোল্লা-বাড়ির বাঁশ ভাল, তার ফাঁপগুলি নয় বড় ; খাঁ-বাড়ির বাঁশ ঢোলা ঢোলা, করছে কড়মড় | সর্ব্বশেষে পছন্দ হয় খাঁ-বাড়ির বাঁশ : ফাঁপগুলি তার কাঠের মত, চেকন-চোকন আঁশ | বাঁশ কাটিতে যেয়ে রূপাই মারল বাঁশে দা, তল দিয়ে যায় কাদের মেয়ে—হলদে পাখির ছা! বাঁশ কাটিতে বাঁশের আগায় লাগল বাঁশের বাড়ি, চাষী মেয়ের দেখে তার প্রাণ বুঝি যায় ছাড়ি | লম্বা বাঁশের লম্বা যে ফাঁপ, আগায় বসে টিয়া, চাষীদের ওই সোনার মেয়ে কে করিবে বিয়া! বাঁশ কাটিতে এসে রূপাই কাটল বুকের চাম, বাঁশের গায়ে বসে রূপাই ভুলল নিজের কাম | ওই মেয়ে ত তাদের গ্রামে বদনা-বিয়ের গানে, নিয়েছিল প্রাণ কেড়ে তার চিকন সুরের দানে | “খড়ি কুড়াও সোনার মেয়ে! শুকনো গাছের ডাল, শুকনো আমার প্রাণ নিয়ে যাও, দিও আখার জ্বাল | শুকনো খড়ি কুড়াও মেয়ে! কোমল হাতে লাগে, তোমায় যারা পাঠায় বনে বোঝেনি কেন আগে?” এমনিতর কত কথাই উঠে রূপার মনে, লজ্জাতে সে হয় যে রঙিন পাছে বা কেউ শোনে | মেয়েটিও ডাগর চোখে চেয়ে তাহার পানে, কি কথা সে ভাবল মনে সেই জানে তার মানে! এমন সময় পিছন হতে তাহার মায়ে ডাকে, “ওলো সাজু! আয় দেখি তোর নথ বেঁধে দেই নাকে! ওমা! ও কে বেগান মানুষ বসে বাঁশের ঝাড়ে!” মাথায় দিয়ে ঘোমটা টানি দেখছে বারে বারে | খানিক পরে ঘোমটা খুলে হাসিয়া এক গাল, বলল, “ও কে, রূপাই নাকি? বাঁচবি বহকাল! আমি যে তোর হইযে খালা, জানিসনে তুই বুঝি? মোল্লা বাড়ির বড়ুরে তোর মার কাছে নিস্ খুঁজি | তোর মা আমার খেলার দোসর—যাকগে ও সব কথা, এই দুপুরে বাঁশ কাটিয়া খাবি এখন কোথা?” রূপাই বলে, “মা দিয়েছেন কোঁচায় বেঁধে চিঁড়া” “ওমা! ও তুই বলিস কিরে? মুখখানা তোর ফিরা! আমি হেথা থাকতে খালা, তুই থাকবি ভুখে, শুনলে পরে তোর মা মোরে দুষবে কত রুখে! ও সাজু, তুই বড় মোরগ ধরগে যেয়ে বাড়ি, ওই গাঁ হতে আমি এদিক দুধ আনি এক হাঁড়ি |” চলল সাজু বাড়ির দিকে, মা গেল ওই পাড়া | বাঁশ কাটতে রূপাই এদিক মারল বাঁশে নাড়া | বাঁশ কাটিতে রূপার বুকে ফেটে বেরোয় গান, নলী বাঁশের বাঁশীতে কে মারছে যেন টান! বেছে বেছে কাটল রূপাই ওড়া-বাঁশের গোড়া, তল্লা বাঁশের কাটল আগা, কালধোয়ানির জোড়া ; বাল্ কে কাটে আল্ কে কাটে কঞ্চি কাটে শত, ওদিক বসে রূপার খালা রান্ধে মনের মত | সাজু ডাকে তলা থেকে, “রূপা-ভাইগো এসো,” —এই কথাটি বলতে তাহার লজ্জারো নাই শেষও! লাজের ভারে হয়তো মেয়ে যেতেই পারে পড়ে, রূপাই ভাবে হাত দুখানি হঠাৎ যেয়ে ধরে | যাহোক রূপা বাঁশ কাটিয়া এল খালার বাড়ি, বসতে তারে দিলেন খালা শীতল পাটি পাড়ি | বদনা ভরে জল দিল আর খড়ম দিল মেলে, পাও দুখানি ধুয়ে রূপাই বসল বামে হেলে | খেতে খেতে রূপাই কেবল খালার তারীফ করে, “অনেক দিনই এমন ছালুন খাইনি কারো ঘরে |” খালায় বলে “আমি ত নয়, রেঁধেছে তোর বোনে,” লাজে সাজুর ইচ্ছা করে লুকায় আঁচল কোণে | এমনি নানা কথায় রূপার আহার হল সারা, সন্ধ্যা বেলায় চলল ঘরে মাথায় বাঁশের ভারা | খালার বাড়ির এত খাওয়া, তবুও তার মুখ, দেখলে মনে হয় যে সেথা অনেক লেখা দুখ | ঘরে যখন ফিরল রূপা লাগল তাহার মনে, কি যেন তার হয়েছে আজ বাঁশ কাটিতে বনে | মা বলিল, “বাছারে, কেন মলিন মুখে চাও?” রূপাই কহে, “বাঁশ কাটিতে হারিয়ে এলেম দাও |” ছয় ও তুই ঘরে রইতে দিলি না আমারে | . — রাখালী গান ঘরেতে রূপার মন টেকে না যে, তরলা বাঁশীর পারা, কোন বাতাসেতে ভেসে যেতে চায় হইয়া আপন হারা | কে যেন তার মনের তরীরে ভাটির করুণ তানে, ভাটিয়াল সোঁতে ভাসাইয়া নেয় কোন্ সে ভাটার পানে | সেই চিরকেলে গান আজও গাহে, সুরখানি তার ধরি, বিগানা গাঁয়ের বিরহিয়া মেয়ে আসে যেন তরি! আপনার গানে আপনার প্রাণ ছিঁড়িয়া যাইতে চায়, তবু সেই ব্যথা ভাল লাগে যেন, একই গান পুনঃ গায় | খেত-খামারেতে মন বসেনাকো ; কাজে কামে নাই ছিরি, মনের তাহার কি যে হল আজ ভাবে তাই ফিরি ফিরি | গানের আসরে যায় না রূপাই সাথীরা অবাক মানে, সারাদিন বসি কি যে ভাবে তার অর্থ সে নিজে জানে! সময়ের খাওয়া অসময় খায়, উপোসীও কভু থাকে, “দিন দিন তোর কি হল রূপাই” বার বার মায় ডাকে | গেলে কোনখানে হয়তো সেথাই কেটে যায় সারা দিন, বসিলে উঠেনা উঠিলে বসেনা, ভেবে ভেবে তনু ক্ষীণ | সবে হাটে যায় পথ বরাবর রূপা যায় ঘুরে বাঁকা, খালার বাড়ির কাছ দিয়ে পথ, বাঁশ-পাতা দিয়ে ঢাকা | পায়ে-পায় ছাই বাঁশ-পাতাগুলো মচ্ মচ্ করে বাজে ; কেউ সাথে নেই, তবু যে রূপাই মরে যায় যেন লাজে | চোরের মতন পথে যেতে যেতে এদিক ওদিক চায়, যদিবা হঠাৎ সেই মেয়েটির দুটি চোখে চোখ যায় | ফিরিবার পথে খালার বাড়ির নিকটে আসিয়া তার, কত কাজ পড়ে, কি করে রূপাই দেরি না করিয়া আর | কোনদিন কহে, “খালামা, তোমার জ্বর নাকি হইয়াছে, ও-বাড়ির ওই কানাই আজিকে বলেছে আমার কাছে | বাজার হইতে আনিয়াছি তাই আধসেরখানি গজা |” “বালাই! বালাই! জ্বর হবে কেন? রূপাই, করিলি মজা ; জ্বর হলে কিরে গজা খায় কেহ?” হেসে কয় তার খালা, “গজা খায়নাক, যা হোক এখন কিনে ত হইল জ্বালা ; আচ্ছা না হয় সাজুই খাইবে |” ঠেকে ঠেকে রূপা কহে, সাজু যে তখন লাজে মরে যায়, মাথা নিচু করে রহে | কোন দিন কহে, “সাজু কই ওরে, শোনো কিবা মজা, খালা! আজকের হাটে কুড়ায়ে পেয়েছি দুগাছি পুঁতির মালা ; এক ছোঁড়া কয়, “রাঙা সূতো” নেবে? লাগিবে না কোন দাম ; নিলে কিবা ক্ষতি, এই ভেবে আমি হাত পেতে রইলাম | এখন ভাবছি, এসব লইয়া কিবা হবে মোর কাজ, ঘরেতে থাকিলে ছোট বোনটি সে ইহাতে করিত সাজ | সাজু ত আমার বোনেরই মতন, তারেই না দিয়ে যাই, ঘরে ফিরে যেতে একটু ঘুরিয়া এ-পথে আইনু তাই |” এমনি করিয়া দিনে দিনে যেতে দুইটি তরুণ হিয়া, এ উহারে নিল বরণ করিয়া বিনে-সূতী মালা দিয়া | এর প্রাণ হতে ওর প্রাণে যেয়ে লাগিল কিসের ঢেউ, বিভোর কুমার, বিভোর কুমারী, তারা বুঝিল না কেউ |—তারা বুঝিল না, পাড়ার লোকেরা বুঝিল অনেকখানি, এখানে ওখানে ছেলে বুড়ো মিলে শুরু হল কানাকানি | সেদিন রূপাই হাট-ফেরা পথে আসিল খালার বাড়ি, খালা তার আজ কথা কয়নাক, মুখখানি যেন হাঁড়ি | “রূপা ভাই এলে?” এই বলে সাজু কাছে আসছিল তাই, মায় কয়, “ওরে ধাড়ী মেয়ে, তোর লজ্জা শরম নাই?” চুল ধরে তারে গুড়ুম গুড়ুম মারিল দু’তিন কিল, বুঝিল রূপাই এই পথে কোন হইয়াছে গরমিল | মাথার বোঝাটি না-নামায়ে রূপা যেতেছিল পথ ধরি, সাজুর মায়ে যে ডাকিল তাহারে হাতের ইশারা করি ; “শোন বাছা কই, লোকের মুখেতে এমন তেমন শুনি, ঘরে আছে মোর বাড়ন্ত মেয়ে জ্বলন্ত এ আগুনি | তুমি বাপু আর এ-বাড়ি এসো না |” খালা বলে রোষে রোষে, “কে কি বলে? তার ঘাড় ভেঙে দেব!” রূপা কহে দম কসে | “ও-সবে আমার কাজ নাই বাপু, সোজা কথা ভালবাসি, সারা গাঁয়ে আজ ঢিঢি পড়ে গেছে,মেয়ে হল কুল-নাশী |” সাজুর মায়ের কথাগুলি যেন বঁরশীর মত বাঁকা, ঘুরিয়া ঘুরিয়া মনে দিয়ে যায় তীব্র বিষের ধাকা | কে যেন বাঁশের জোড়-কঞ্চিতে তাহার কোমল পিঠে, মহারোষ-ভরে সপাং সপাং বাড়ি দিল গিঠে গিঠে | টলিতে টলিতে চলিল রূপাই একা গাঁর পথ ধরি, সম্মুখ হতে জোনাকীর আলো দুই পাশে যায় সরি | রাতের আঁধারে গালি-ভরা বিষে জমাট বেঁধেছে বুঝি, দুই হাতে তাহা ঠেলিয়া ঠেলিয়া চলে রূপা পথ খুঁজি | মাথার ধামায় এখনও রয়েছে দুজোড়া রেশমী চুরী, দুপায়ে তাহারে দলিয়া রূপাই ভাঙিয়া করিল গুঁড়ি | টের সদাই জলীর বিলেতে দুহাতে ছুঁড়িয়া ফেলি, পথ থুয়ে রূপা বেপথে চলিল, ইটা খেতে পাও মেলি | চলিয়া চলিয়া মধ্য মাঠেতে বসিয়া কাঁদিল কত, অষ্টমী চাঁদ হেলিয়া হেলিয়া ওপারে হইল গত | প্রভাতে রূপাই উঠিল যখন মায়ের বিছানা হতে, চেহারা তাহার আধা হয়ে গেছে, চেনা যায় কোন মতে | মা বলে, “রূপাই কি হলরে তোর?” রূপাই কহে না কথা দুখিনী মায়ের পরাণে আজিকে উঠিল দ্বিগুণ ব্যথা | সাত নয় মার পাঁচ নয় এক রুপাই নয়ন তারা, এমনি তাহার দশা দেখে মায় ভাবিয়া হইল সারা | শানাল পীরের সিন্নি মানিল খেতে দিল পড়া-পানি, হেদের দৈন্য দেখিল জননী, দেখিলনা প্রাণখানি | সারা গায়ে মাতা হাত বুলাইল চোখে মুখে দিল জল, বুঝিল না মাতা বুকের ব্যথার বাড়ে যে ইহাতে বল | আজকে রূপার সকলি আঁধার, বাড়া-ভাতে ওড়ে ছাই, কলঙ্ক কথা সবে জানিয়াছে, কেহ বুঝি বাকি নাই | জেনেছে আকাশ, জেনেছে বাতাস, জেনেছে বনের তরু ; উদাস-দৃষ্টি য়ত দিকে চাহে সব যেন শূনো মরু | চারিদিক হতে উঠিতেছে সুর, ধিক্কার! ধিক্কার!! শাঁখের করাত কাটিতেছে তারে লয়ে কলঙ্ক ধার | ব্যথায় ব্যথায় দিন কেটে গেল, আসিল ব্যথার সাঁজ, পূবে কলঙ্কী কালো রাত এল, চরণে ঝিঁঝির ঝাঁজ! অনেক সুখের দুখের সাক্ষী বাঁশের বাঁশীটি নিয়ে, বসিল রূপাই বাড়ির সামনে মধ্য মাঠেতে গিয়ে | মাঠের রাখাল, বেদনা তাহার আমরা কি অত বুঝি ; মিছেই মোদের সুখ-দুখ দিয়ে তার সুখ-দুখ খুঁজি | আমাদের ব্যথা কেতাবেতে লেখা, পড়িলেই বোঝা যায় ; যে লেখে বেদনা বে-বুঝ বাঁশীতে কেমন দেখাব তায়? অনন্তকাল যাদের বেদনা রহিয়াছে শুধু বুকে, এ দেশের কবি রাখে নাই যাহা মুখের ভাষায় টুকে ; সে ব্যথাকে আমি কেমনে জানাব? তবুও মাটিতে কান ; পেতে রহি কভু শোনা যায় কি কহে মাটির প্রাণ! মোরা জানি খোঁজ বৃন্দাবনেতে ভগবান করে খেলা, রাজা-বাদশার সুখ-দুখ দিয়ে গড়েছি কথার মালা | পল্লীর কোলে নির্ব্বাসিত এ ভাইবোনগুলো হায়, যাহাদের কথা আধ বোঝা যায়, আধ নাহি বোঝা যায় ; তাহাদেরই এক বিরহিয়া বুকে কি ব্যথা দিতেছে দোল, কি করিয়া আ দেখাইব তাহা, কোথা পাব সেই বোল? —সে বন-বিহগ কাঁদিতে জানে না, বেদনার ভাষা নাই, ব্যাধের শায়ক বুকে বিঁধিয়াছে জানে তার বেদনাই | বাজায় রূপাই বাঁশীটি বাজায় মনের মতন করে, যে ব্যথা সে বুকে ধরিতে পারেনি সে ব্যথা বাঁশীতে ঝরে “আমি কেনে বা পিরীতিরে করলাম | ( আমার ভাবতে জনম গেলরে, আমার কানতে জনম গেলরে | ) সে ত সিন্তার সিন্দুর নয় তারে আমি কপালে পরিব, সে ত ধান নয় চাউল নয় তারে আমি ডোলেতে ভরিবরে, আমি কেনেবা পিরীতিরে করলাম | আগে যদি জানতাম আমি প্রেমের এত জ্বালা, ঘর করতাম কদম্বতলা, রহিতাম একেলারে ; আমি কেনেবা পিরীতিরে করলাম |” — মুর্শিদা গান বাজে বাঁশী বাজে, তারি সাথে সাথে দুলিছে সাঁজের আলো ; নাচে তালে তালে জোনাকীর হারে কালো মেঘে রাত-কালো | বাজাইল বাঁশী ভাটিয়ালী সুরে বাজাল উদাস সুরে, সুর হতে সুর ব্যথা তার চলে যায় কোন দূরে! আপনার ভাবে বিভোল পরাণ, অনন্ত মেঘ-লোকে, বাঁশী হতে সুরে ভেসে যায় যেন, দেখে রূপা দুই চোখে | সেই সুর বয়ে চলেছে তরুণী, আউলা মাথার চুল, শিথিল দুখান বাহু বাড়াইয়াছিঁড়িছে মালার ফুল | রাঙা ভাল হতে যতই মুছিছে ততই সিঁদুর জ্বলে ; কখনও সে মেয়ে আগে আগে চলে, কখনও বা পাছে চলে | খানিক চলিয়া থামিল করুণী আঁচলে ঢাকিয়া চোখ, মুছিতে মুছিতে মুছিতে পারে না, কি যেন অসহ শোক! করুণ তাহার করুণ কান্না আকাশ ছাইয়া যায়, কি যে মোহের রঙ ভাসে মেঘে তাহার বেদনা-ঘায় | পুনরায় যেন খিল খিল করে একগাল হাসি হাসে, তারি ঢেউ লাগি গগনে গগনে তড়িতের রেখা ভাসে | কখনও আকাশ ভীষণ আঁধার, সব গ্রাসিয়াছে রাহু, মহাশূণ্যের মাঝে ভেসে উঠে যেন দুইখানি বাহু! দোলে-দোলে-বাহু তারি সাথে যেন দোলে-দোলে কত কথা, “ঘরে ফিরে যাও, মোর তরে তুমি সহিও না আর ব্যথা |” মুহূর্ত পরে সেই বাহু যেন শূণ্যে মিলায় হায়— রামধনু বেয়ে কে আসে ও মেয়ে, দেখে যেন চেনা যায়! হাসি হাসি মুখ গলিয়া গলিয়া হাসি যায় যেন পড়ে, সার গায়ে তার রূপ ধরেনাক, পড়িছে আঁচল ঝরে | কণ্ঠে তাহার মালার গন্ধে বাতাস পাগল পারা, পায়ে রিনি ঝিনি সোনার নূপুর বাজিয়া হইছে সারা ; হঠাৎ কে এল ভীষণ দস্যু—ধরি তার চুল মুঠি, কোন্ আন্ধার গ্রহপথ বেয়ে শূণ্যে সে গেল উঠি | বাঁশী ফেলে দিয়ে ডাক ছেড়ে রূপা আকাশের পানে চায়, আধা চাঁদখানি পড়িছে হেলিয়া সাজুদের ওই গাঁয় | শুনো মাঠে রূপা গড়াগড়ি যায়, সারা গায়ে ধূলো মাখে, দেহেরে ঢাকিছে ধূলো মাটি দিয়ে, ব্যথারে কি দিয়ে ঢাকে! সাত “ঘটক চলিল চলিল সূর্য সিংহের বাড়িরে” | — আসমান সিংহের গান কান্-কানা-কান্ ছুটল কথা গুন্-গুনা-গুন তানে, শোন্-শোনা-শোন সবাই শোনে, কিন্তু কানে কানে | “কি করগো রূপার মাতা? খাইছ কানের মাথা? ও-দিক যে তোর রূপার নামে রটছে গাঁয়ে যা তা! আমরা বলি রূপাই এমন সোনার কলি ছেলে, তার নামে হয় এমন কথা দেখব কি কাল গেলে?” এই বলিয়া বড়াই বুড়ি বসল বেড়ি দোর, রূপার মা কয়, “বুঝিনে বোন কি তোর কথার ঘোর!” বুড়ি যেন আচমকা হায় আকাশ হতে পড়ে, “সবাই জানে তুই না জানিস যে কথা তোর ঘরে?” ও-পাড়ার ও ডাগর ছুঁড়ী, সেখের বাড়ির “সাজু” তারে নাকি তোর ছেলে সে গড়িয়ে দেছে বাজু | ঢাকাই শাড়ী কিন্যা দিছে, হাঁসলী দিছে নাকি, এত করে এখন কেন শাদীর রাখিস বাকি?” রূপার মা কয়, “রূপা আমার এক-রত্তি ছেলে, আজও তাহার মুখ শুঁকিলে দুধের ঘিরাণ মেলে | তার নামে যে এমন কথা রটায় গাঁয়ে গাঁয়ে, সে যেন তার বেটার মাথা চিবায় বাড়ি যায় |” রূপার মায়ের রুঠা কথায় উঠল বুড়ীর কাশ, একটু দিলে তামাক পাতা, নিলেন বুড়ী শ্বাস | এমন সময় ওই গাঁ হতে আসল খেঁদির মাতা, টুনির ফুপু আসল হাতে ডলতে তামাক পাতা | ক’জনকে আর থামিয়ে রাখে? বুঝল রূপার মা ; রূপা তাহার সত্যি করেই এতটুকুন না | বুঝল মায়ে কেন ছেলে এমন উদাস পারা, হেথায় হোথায় কেবল ঘোরে হয়ে আপন হারা | ও পাড়ার ও দুখাই মিয়া ঘটকালিতে পাকা, সাজুর সাথেই জুড়ুর বিয়ে যতকে লাগুক টাকা | শেখ বাড়িতে যেয়ে ঘটক বেকী-বেড়ার কাছে, দাঁড়িয়ে বলে, “সাজুর মাগো, একটু কথা আছে |” সাজুর মায়ে বসতে তারে এনে দিলেন পিঁড়ে, ডাব্বা হুঁকা লাগিয়ে বলে, “আস্তে টান ধীরে |” ঘটক বলে, “সাজুর মাগো মেয়ে তোমার বড়, বিয়ের বয়স হল এখন ভাবনা কিছু কর |” সাজুর মা কয় “তোমরা আছ ময়-মুরুব্বি ভাই, মেয়ে মানুষ অত শত বুঝি কি আর ছাই! তোমরা যা কও ঠেলতে কি আর সাধ্য আছে মোর?” ঘটক বলে, “এই ত কথা, লাগবে না আর ঘোর | ও-পাড়ার ও রূপারে ত চেনই তুমি বোন্, তার সাথে দাও মেয়ের বিয়ে ঠিক করিয়ে মন |” সাজুর মা কয়, “জান ত ভাই! রটছে গাঁয়ে যাতা, রূপার সাথে বিয়ে দিলে থাকবে না আর মাথা |” ঘটক বলে, “কাঁটা দিয়েই তুলতে হবে কাঁটা, নিন্দা যারা করে তাদের পড়বে মুখে ঝাঁটা | রূপা ত আর নয় এ গাঁয়ে যেমন তেমন ছেলে, লক্ষ্মীরে দেই বউ বানায়ে অমন জামাই পেলে!” ঠাটে ঘটক কয় গো কথা ঠোঁট-ভরাভর হাসে ; সাজুর মায়ের পরাণ তারি জোয়ার-জলে ভাসে | “দশ খান্দা জমি রূপার, তিনটি গরু হালে, ধানের-বেড়ী ঠেকে তাহার বড় ঘরের চালে |” সাজু তোমার মেয়ে যেমন, রূপাও ছেলে তেমন, সাত গেরামের ঘটক আমি জোড় দেখিনি এমন |” তার পরেতে পাড়ল ঘটক রূপার কুলের কথা, রূপার দাদার নাম গুনে লোক কাঁপত যথা তথা | রূপার নানা সোয়েদ-ঘেঁষা, মিঞাই বলা যায়— কাজী বাড়ির প্যায়দা ছিল কাজল-তলার গাঁয় | রূপার বাপের রাখত খাতির গাঁয়ের চৌকিদারে, আসেন বসেন মুখের কথা—গান বজিত তারে | রূপার চাচা অছিমদ্দী, নাম শোন নি তার? ইংরেজী তার বোল শুনিলে সব মানিত হার | কথা ঘটক বলল এঁটে, বলল কখন ঢিলে, সাজুর মায়ে সবগুলি তার ফেলল যেন গিলে | মুখ দেখে বুঝল ঘটক—লাগছে অষুধ হাড়ে, বলল, “তোমার সাজুর বিয়া ঠিক কর এই বারে |” সাজুর মা কয়, ” যা বোঝ ভাই, তোমরা গ্যা তাই কর, দেখ যেন কথার আবার হয় না নড়চড় |” “আউ ছি ছি!” ঘটক বলে, “শোনই কথা বোন, তোমার সাজুর বিয়া দিতে লাগবে কত পণ? পোণে দিব কুড়ি দেড়েক বায়না দেব তেরো, চিনি সন্দেশ আগোড়-বাগোড় এই গে ধর বারো | সবদ্যা হল দুই কুড়ি এ নিতেই হবে বোন, চাইলে বেশী জামাইর তোমার বেজার হবে মন!” সাজুর মা কয়, “ও-সব কথার কি-ইবা আমি জানি, তোমরা যা কও তাইত খোদার গুকুর বলে মানি |” সাধে বলে দুখাই ঘটক ঘটকালিতে পাকা, আদ্য মধ্য বিয়ের কথা সব করিল ফাঁকা | চল্-চলা-চল্ চলল দুখাই পথ বরাবর ধরি, তাগ্-ধিনা-ধিন্ নাচে যেন গুন্ গুনা গান করি | দুখাই ঘটক নেচে চলে নাচে তাহার দাড়ি, বুড়োর বটের শিকড় যেন চলছে নাড়ি নাড়ি ; লম্ফে লম্ফে চলে ঘটক দম্ভ করে চায়, লুটের মহল দখল করে চলছে যেন গাঁয়! ঘটকালিরই টাকা যেন ঝন্-ঝনা-ঝন্ বাজে, হন্-হানা-হন্ চলল ঘটক একলা পথের মাঝে | ধানের জমি বাঁয় ফেলিয়া ফেলিয়া, ডাইনে ঘন পাট, জলীর বিলে নাও বাঁধিয়া ধরল গাঁয়ের বাট | “কি কর গো রূপার মাতা, ভবছ বসি কিবা, সাজুর সাথেই ঠিক কইরাছি তোমার ছেলের বিবা | সহজে কি হয় সে রাজি, একশ টাকা পণ, এর কমেতে বসেইনাক সাজুর মায়ের মন | আমিও আবার কুড়ি তিনেক উঠিনে তার পরে, সাজুর মায়ও নাছোড়-বান্দা, দিলাম তখন ধরে ; আরেক কুড়ি, তয় সে কথা কইল হাসি হাসি, আমি ভাবি, বিয়ার বুঝি বাজল সানাই বাঁশী | এখন বলি রূপার মাতা, আড়াই কুড়ি টাকা, মোর কাছেতে দিবা, কথা হয় না যেন ফাঁকা! আসব দিয়ে গোপনে তায়, নইলে গাঁয়ের লোকে, মেজবানী দাও বলে তারে ধরবে চীনে জোঁকে | বিয়ের দিনে নিবে সে তাই তিরিশ টাকা যেচে, যারে তারে বলতে পার এই কথাটি নেচে | চিনি সন্দেশ আগোড়-বাগোড় তার লাগিবে ষোলো, এই ধরগ্যা রূপার বিয়া আজই যেন হল |” রূপার মায়ের আহ্লাদে প্রাণ ধরেইনাক আর, ইচ্ছে করে নেচে নেচে বেড়ায় বারে বার | “ও রূপা তুই কোথায় গেলি? ভাবিসনাক মোটে, কপাল গুণি বিয়ে যে তোর সাজুর সাথেই জোটে!” এই বলিয়া রূপার মাতা ছুটল গাঁয়ের পানে, ঘটক গেল নিজের বাড়ি গুন্-গুনা-গুন্ গানে | আট “কি কর দুল্যাপের মালো ; বিভাবনায় বসিয়া, আসত্যাছে বেটির দামান ফুল পাগড়ি উড়ায়া নারে |” “আসুক আসুক বেটির দামান কিছু চিন্তা নাইরে, আমার দরজায় বিছায়া থুইছি কামরাঙা পাটি মারে | সেই ঘরেতে নাগায়া খুইছি মোমের সস্র বাতি, বাইর বাড়ি বান্দিয়া থুইছি গজমতি হাতি নারে |” . — মুসলমান মেয়েদের বিবাহের গান বিয়ের কুটুম এসেছে আজ সাজুর মায়ের বাড়ি, কাছারী ঘর গুম্-গুমা-গুম্ , লোক হয়েছে ভারি | গোয়াল-ঘরে ঝেড়ে পুছে বিছান দিল পাতি ; বসল গাঁয়ের মোল্লা মোড়ল গল্প-গানে মাতি | কেতাব পড়ার উঠল তুফান ; —চম্পা কালু গাজী, মামুদ হানিফ সোনবান ও জয়গুন বিবি আজি ; সবাই মিলে ফিরছে যেন হাত ধরাধর করি | কেতাব পড়ার সুরে সুরে চরণ ধরি ধরি | পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোড়ল নাচিয়ে ঘন দাড়ি, পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোল্লা মাঠ-ফাটা ডাক ছাড়ি | কৌতুহলী গাঁয়ের লোকে শুনছে পেতে কান, জুমজুমেরি পানি যেন করছে তারা পান! দেখছে কখন মনের সুখে মামুদ হানিফ যায়, লাল ঘোড়া তার উড়ছে যেন লাল পাখিটির প্রায় | কাতার কাতার সৈন্য কাটে যেমন কলার বাগ, মেষের পালে পড়ছে যেন সুন্দর-বুনো বাঘ ! স্বপ্ন দেখে, জয়গুন বিবি পালঙ্কেতে শুয়ে ; মেঘের বরণ চুলগুলি তার পড়ছে এসে ভূঁয়ে ; আকাশেরি চাঁদ সূরুজে মুখ দেখে পায় লাজ, সেই কনেরে চোখের কাছে দেখছে চাষী আজ | দেখছে চোখে কারবালাতে ইমাম হোসেন মরে, রক্ত যাহার জমছে আজো সন্ধ্যা মেঘের গোরে ; কারবালারি ময়দানে সে ব্যথার উপাখ্যান ; সারা গাঁয়ের চোখের জলে করিয়া গেল সান | উঠান পরে হল্লা-করে পাড়ার ছেলে মেয়ে, রঙিন বসন উড়ছে তাদের নধর তনু ছেয়ে | কানা-ঘুষা করত যারা রূপার স্বভাব নিয়ে, ঘোর কলিকাল দেখে যাদের কানত সদা হিয়ে ; তারাই এখন বিয়ের কাজে ফিরছে সবার আগে, ভাভা গড়ার সকল কাজেই তাদের সমান লাগে | বউ-ঝিরা সব রান্না-বাড়ায় ব্যস্ত সকল ক্ষণ ; সারা বাড়ি আনন্দ আজ খুশী সবার মন | বাহিরে আজ এই যে আমোদ দেখছে জনে জনে ; ইহার চেয়ে দ্বিগুণ আমোদ উঠছে রূপার মনে | ফুল পাগড়ী মাথায় তাহার “জোড়া জামা” গায়, তেল-কুচ্-কাচ্ কালো রঙে ঝলক্ দিয়ে যায় | বউ-ঝিরা সব ঘরের বেড়ার খানিক করে ফাঁক, নতুন দুলার রূপ দেখি আজ চক্ষে মারে তাক | এমন সময় শোর উঠিল— “বিয়ের যোগাড় কর, জলদী করে দুলার মুখে পান শরবত ধর |” সাজুর মামা খটকা লাগায়, “বিয়ের কিছু গৌণ, সাদার পাতা আনেনি তাই বেজার সবার মন |” রূপার মামা লম্ফে দাঁড়ায় দম্ভে চলে বাড়ি ; সেরেক পাঁচেক সাদার পাতা আনল তাড়াতাড়ি | কনের খালু উঠিয়া বলে “সিঁদুর হল ঊনা!” রূপার খালু আনিয়া দিল যা লাগে তার দুনা! কনের চাচার মন উঠে না, “খাটো হয়েছে শাড়ী |” রূপার চাচা দিল তখন “ইংরাজী বোল ছাড়ি”| “কিরে বেটা বকিস নাকি?” কনের চাচা হাঁকে, জালির কলার পাতার মত গা কাঁপে তার রাগে | “কোথায় গেলি ছদন চাচা, ছমির শেখের নাতি, দেখিয়ে দেই দুলার চাচার কতই বুকের ছাতি! বেরো বেটা নওশা নিয়ে, দিব না আজ বিয়া ;” বলতে যেন আগুন ছোটে চোখ দুটি তার দিয়া | বরপক্ষের লোকগুলি সব আর যে বরের চাচা, পালিয়ে যেতে খুঁজছে যেন রশুই ঘরের মাচা | মোড়ল এসে কনের চাচায় অনেক করে বলে, থামিয়ে তারে বিয়ের কথা পাতেন কুতূহলে | কনের চাচা বসল বরের চাচার কাছে, কে বলে ঝড় এদের মাঝে হয়েছে যে পাছে! মোল্লা তখন কলমা পড়ায় সাক্ষী-উকিল ডাকি, বিয়ে রূপার হয়ে গেল, ক্ষীর-ভোজনী বাকি! তার মাঝেতে এমন তেমন হয়নি কিছু গোল, কেবল একটি বিষয় নিয়ে উঠল হাসির রোল | এয়োরা সব ক্ষীর ছোঁয়ায়ে কনের ঠোঁটের কাছে ; সে ক্ষীর আবার ধরল যখন রূপার ঠোঁটের পাছে ; রূপা তখন ফেলল খেয়ে ঠোঁট ছোঁয়া সেই ক্ষীর, হাসির তুফান উঠল নেড়ে মেয়ের দলের ভীড় | ভাবল রূপাই—অমন ঠোঁট

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.