লেখার চেয়ে পড়ায় আগ্রহী। ধার্মিক, পরমতসহিষ্ণু।
ধর্মপরিসর ছাড়া পৃথিবীর সকল নেতৃত্বই সমালোচনার আওতাভুক্ত। সমালোচনাবিহীন সকল ধর্মীয় নেতৃত্ব আত্মমুগ্ধতার অন্ধগলিতে পা রাখে, এতেই সে ডুবে মরে; ভক্তবৃন্দরা একে অদৃষ্ট ভেবে তুপ্তি পান এবং নেতা নিজেও ভক্তদের মাঝে অদৃষ্টবাদের বেড়াজাল বৃদ্ধি করার শাস্ত্রীয় প্রয়াস নেন। তখন সকল মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ও দুর্ভোগও স্রষ্টার অপার লীলা বলে আখ্যা পায়, ব্যাখ্যাত হয়।
মহানবি সা.-এর জীবন-পরিচালনায়ও বাহ্যিক কারণ অনুসন্ধানের প্রবণতা ছিল। ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপর্যয় নেমে এলে এর কারণ সম্পর্কে খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, যুদ্ধ-পরিচালনার জন্য নেতার যে নির্দেশ ছিল, তা লঙ্ঘন করার কারণেই এ বিপর্যয় নেমে আসে। অর্থাৎ জগৎ-নিয়ম আধ্যাত্মিকতার মসৃণ পথে এগোয় না, বাস্তবতা ও প্রকৃতির এবড়ো-খেবড়ো সিঁড়ি বেয়ে চলে। আর এপথেই বিপর্যয়ের বাস্তব কারণ নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ রাসুলের জীবদ্দশায়ও সকল কিছু পূর্বাপর জগৎ-নিয়মের সাধারণ কার্যকারণসূত্রেই আবদ্ধ ছিল।
রাসুল সা.ও এভাবেই তা মূল্যায়ন করেছেন। তাই আল্লাহর ওপর আস্থা রেখে আমাদেরও নিজেদের কর্মকৌশলের মূল্যায়ন করতে হবে। প্রতিটি কাজের পূর্বাপর সমালোচনা-আত্মসমালোচনা করতে হবে।
আমাদের এই বাংলাদেশে এবং সমগ্র মুসলিমবিশ্বে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের আত্মসমালোচনা আছে কি-না, জানা নেই। তবে সমালোচনার অনেক পথই খোলা।
যে কোনো ভুল হলে, এর প্রতিক্রিয়ায় নানা রকমের সমালোচনা হয়। ধর্মীয় পর্যায়ের কোনো নেতৃত্বেই সমালোচনা বা আত্ম-সমালোচনার ন্যূনতম স্থান নেই। একে অনুসারীরা ধর্মবিরুদ্ধ মনে করেন। আর এভাবেই নেতৃত্বগুলো দিনদিন অকার্যকর হয়ে আসছে।
সম্প্রতি হেফাজত যে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়, এর প্রকৃতি, পরিমাণ ও কারণ নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি।
যারা এর ভেতরের, তারা যেমন তা অনুসন্ধার করবেন; যারা বাইরের তারাও তা করতে পারেন। আর যাদের অদূরদর্শিতায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হল, তাদেরও উচিত আত্মসমালোচনার পথে এগিয়ে যাওয়া। সমালোচনা বা আত্মসমালোচনা মানে নেতৃত্ব খুইয়ে দেওয়া বা ক্ষয়ে যাওয়া নয়, বরং পেছনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের নির্ভুল সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
এখানে পাঁচ তারিখের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কতিপয় সমালোচনাসূত্র পেশ করা হল। উদ্দেশ্য, সমালোচনা-আত্মসমালোচনার একটি পথ তৈরি করা এবং সে-ভাবেই সংশোধনের পথে এগিয়ে যাওয়া।
(ক) হেফাজত যে দাবিগুলো উত্থাপন করেছে, তা নিয়ে সরকারের কাছেই ধরনা দেওয়া সংগঠনের দায়িত্ব। ক্ষমতাসীন কোনো সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া পেশ করার সময় তার বিপক্ষে যা-তা বক্তব্য দেওয়া অনুচিত এবং অযৌক্তিক। হেফাজত তাই করেছে।
(খ) আমাদের দেশের দেওবন্দ ঘরানার অধিকাংশ আলিম ও দলই আওয়ামী লীগকে বৈমাত্রেয় চোখে দেখে থাকে। এব্যাপারে আওয়ামী লীগও সচেতন।
তাই উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিদ্যমান। ধর্মের স্বার্থে দেওবন্দি ধারার কোনো নেতৃত্বস্থানীয় আলেম এ পর্যন্ত সরকার বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে এই দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ নেন নি। তাদের প্রতিও সরকারের কোনো আস্থা নেই। সরকার তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে থাকে।
(গ) হেফাজতের প্রথম আলোড়ন সৃষ্টিকারী কর্মসূচি ছিল লংমার্চ।
প্রত্যন্ত গ্রমাঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মাদরাসা শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে প্রথমত আঞ্চলিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ ও কর্মসূচি না নিয়ে লংমার্চের মতো একটি বড় রকমের কর্মসূচি দিয়ে দেওয়া হল। এ কারণেই পরবর্তীর কর্মসূচিগুলো তুলনামূলক গৌণ হয়ে পড়ে। তাই একদিনের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি সরকারের জন্য কোনো উদ্বেগের বিষয় ছিল না।
(ঘ) লংমার্চের পর হেফাজত জেলা পর্যায়ে নানা কর্মসূচি পালন করতে থাকে। এসব কর্মসূচি যতটা নিজেদের ও সাধারণ জনতার সচেতনতা-কেন্দ্রিক, তার চেয়ে সরকারের প্রতি হুমকি-ধমকি ছিল বেশি।
এতে সরকার ও এর সমর্থকদের মাঝে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়। গণতান্ত্রিক একটি দেশে জনতাকে নিজেদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে সচেতন না করে, তাদেরকে নিজেদের পক্ষে না টেনে নিয়ে শুধু আনুষ্ঠানিক সভা-সমাবেশের কোনোই মূল্য নেই। অথচ তারা তাই করেছেন। এসব সমাবেশে চার দেয়ালে গণ্ডিবদ্ধ মাদরাসার ছাত্ররা ছাড়া অন্যদের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত কম।
(ঙ) ঢাকা অবরোধের দিন সমাবেশের কর্মসূচি না দিলেও হত।
এটা পূর্বে ছিল না, হুঁট করে সংযোজন করা হয়। কারণ, অবরোধ শেষে নগরের ভেতরে সমাবেশে যাওয়া নিজ সমর্থকদের জন্যও কষ্টকর। দীর্ঘ অবরোধের পর মতিঝিল পর্যন্ত যাওয়া খুব সামান্য কথা নয়।
(চ) বিকল্প হিসাবে শুধু নির্ধারিত পয়েন্টগুলোতেই সমাবেশ হতে পারত। সেখানে কেন্দ্রের পাঠানো বক্তব্য বা নির্দেশিত বক্তব্যই উপস্থাপিত হতে পারত।
আবার এখান থেকেই তারা নিজ নিজ গন্তব্যে রওয়ানা দিতে পারতেন।
(ছ) তবুও আহুত মতিঝিলের সেই সমাবেশের স্টেজে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিচিত ও জাতীয় নেতাদের উপস্থিতি ছিল কম। যদি প্রথম দিনের মতো ঐদিনও তাদের উপস্থিতি সরব ও জোরালো হত, ভিন্ন রকম সিদ্ধান্ত আসতে পারত, পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত।
(জ) হেফাজতের নিজেদের কারণে হোক বা অন্তর্ঘাত সৃষ্টি কারণে হোক, ঢাকা-প্রবেশের নানা পথে জমায়েত কর্মী-সমর্থকরা যখন মতিঝিলে পৌঁছানোর জন্য নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে, তখন তাদেরকে নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে সমাবেশে পৌঁছানোর কোনো তৎপরতা নেতাদের মধ্যে ছিল না।
(ঝ) যারা যে-কোনোভাবে সভাস্থলে উপস্থিত হতে পারলেন, তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে নেতাদের কোনো কার্যক্রম ছিল না।
যখন সারা দেশে গুজব বা খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, রাতে আক্রমণ হতে পারে, তখনও তাদের নিরাপত্তা দেওয়া বা সরিয়ে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় নি।
(ঞ) রাতে এত বড় একটা বিপর্যয়ের পর দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পরও আহত-নিহত-বিপর্যস্ত কর্মী সমর্থকদের জন্য নেতাদের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্যই আসে নি। সারা দেশের কর্মী-সমর্থকরা দীর্ঘ সময় একটি শূন্যতার ভেতর দিয়ে পার হয়। সামান্য একটা আঘাতে এতটা বির্যস্ত হলে এ নেতৃত্ব বা দায়িত্ব নেওয়ার দরকার ছিল না। উদ্যোগ নেওয়ারও দরকার ছিল না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।