ক্ষুদে সাহিত্যিক, সৃষ্টির নেশায় উন্মুখ
উপন্যাস হিসেবে বিষাদ-সিন্ধুর সার্থকতা ও ব্যর্থতা .............
বাংলা সাহিত্যকে যারা সমৃদ্ধ করেছে,অধিক ঋণি করেছে করেছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মীর মশাররফ হোসেন(১৮৪৭-১৯১২)। তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি ‘বিষাদ-সিন্ধু’। শতবর্ষেরও অধিককাল পূর্বে রচিত এই উপন্যাস এখনো বাংলা সাহিত্য পিপাসুদের কাছে এক অনুপম গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ নিঃসন্দেহে অন্যতম।
তাঁর উপন্যাসগুলো হল :
ক.রত্নাবতী (১৮৬৯)
খ. ‘বিষাদ-সিন্ধু’ (১৮৮৫-১৮৯১)
গ.উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০)
ঘ. গাজী মিয়ার বস্তানী (১৮৯৯) (নকশাধর্মী,)
তাঁর এ চারটি উপন্যাসের মধ্যে তাঁকে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি এনে দিয়েছিল ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসটি।
এটি তিন খণ্ডে প্রকাশি হয়েছে। প্রকাশকাল বিন্ন ভিন্ন । যথা:
১ম খণ্ড: মহরম পর্ব (১৮৮৫): মোট পর্ব ২৬টি
২য় খণ্ড: উদ্ধারপর্ব (১৮৮৭): মোট পর্ব ৩০টি
তয় খণ্ড: এজিদ বধ পর্ব (১৮৯০) মোট পর্ব ৫টি
তাঁর এই ‘বিষাদ-সিন্ধু’ গন্থে সর্বমোট ৬১টি পর্ব রয়েছে। তবে সব পর্ব মিলে ১৮৯১ সালে পূর্ণাঙ্গ ‘বিষাদ-সিন্ধু’ প্রকাশ করা হয়। তাঁর এই উপন্যাসে তিনি বাংলা ভাষার নিখঁত ব্যবহার করেছেন।
এজন্যই হয়ত বঙ্কিমচনদ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সম্পর্কে বলেছেন,“তাঁহার রচনার ন্যায়,বিশুদ্ধ বাঙ্গালা অনেক হিন্দুতে লিখিতে পারে না। ইহার দৃষ্টান্ত আদরণীয়।
[উৎস: বাংলা ভাষা সাহিত্যে উল্লেখ্য:মুহাম্মদ দানীউল হক: পৃষ্ঠা ৮৫]
সময় ও ইতিহাস:
হিজরি ৬১ সালের ১০ মহরম কারবালায় সংঘটিত মর্মান্তিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাস। কাহিনী উৎস যাই হোক ,ইতিহাসের সত্যকে মহাকাব্যিক বিালতায় রূপদান করার মধ্যে মীর মশাররফ হোসেনের ব্যতিক্রমী শিল্প চেতনার ভূমিকা পরিস্ফুট। ইতিহাসকে আশ্রয় করে নির্মাণ করেছেন মানবিক সম্ভাবনার শাশ্বত শব্দ ভাষা।
এখানে শিল্পী ইতিহাসের দাস নন,শিল্পের বশ।
উৎস:
‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসের কাহিনী,প্লট, সংলাপ,অলৌকিকতা,চরিত্র চিত্রণে শিল্পী ইতিহাস অপো কিংবদন্তিপূর্ণ উপাখ্যানমূলক পুঁথি সাহিত্য মকতুল হোসেন, জঙ্গনামা,শহীদে কারবালা অনুসরণ করেছেন। এসব গ্রন্থে কারবালার বিষাদ করুণ কাহিনী আরও বিষাদ করার প্রবণতায় শিল্পী পুঁথি রচয়িতাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবে পুঁথি ও ইতিহাসের সত্যকে শিল্পের সত্য রূপান্তরের কারণেতিনি অর্জন করেছেন কালোত্তীর্ণ সিদ্ধি। ফলে পুঁথি সাহিত্যের জগৎ অতিক্রম করে শিল্প সফল ইপন্যাসের মর্যাদা পেয়েছে।
কারণ:
বিষয় নির্বাচন,চরিত্র সৃষ্টি,রোমান্সের ইঙ্গিত,মহাকাব্যিক বিশালতা ও ট্রাজিক বেদনার মর্মন্তুদ বেদনার মধ্য দিয়ে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ মীর মোশাররফ হোসেনের শ্রেষ্ঠ রচনার মর্যদা পেয়েছে।
কাহিনী:
‘বিষাদ-সিন্ধু’র কাহিনীতে লেখক মুসলিম ঐতিহ্যের এক নব রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। অতীত ইতহাসের এক করুণ কাহিনী অবলম্বনে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ রচিত হয়েছে। মুহম্মদ (স) দূত জিব্রাঈলের কাছে থেকে শুনলেন যেÑ মাবিয়ার পুত্র এজিদের হাতে হাসান হোসেনের জীবননাশ হবে। এখান থেকেই ‘বিষাদ-সিন্ধু’ কাহিনী শুরু।
এরপর এজিদের জন্ম,রাজ্য লাভ,জয়নবের রূপমোহে মত্ত হওয়ার মদ্য দিয়ে কাহিনী বিকাশপর্বে প্রবেশ করে ;কিন্তু জয়নবের সাথে হোসেনের ভ্রাতা হাসানের বিয়ের পরপরই শুরু হয় কাহিনীর দ্বন্দ্ব ও বিষাদময়তা। ক্রমে এজিদের চক্রান্তে মায়মুনার মাধ্যমে জাএদা কর্তৃক হাসানের জীবন নাশ। এজিদের সহস্তে ময়মুনা ও জাএদাকে উপুক্ত বিচার,কারবালার প্রান্তরে রক্তয়ী সংঘর্ষ , হোসেনের শিরচ্ছেদ, জয়নালসহ মদিনাবাসীর বন্দীদশা,হানিফা কর্তক জয়নাল উদ্ধার ও এজিদের শোচনীয় পরিণতির মধ্য দিয়ে এই বিষাদাত্মক কাহিনী উপসংহরে এসেছে। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসে একি রোমান্সধর্মী ট্র্যাজিক কহিনী ফুটে উঠেছে।
উপকাহিনী
‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসের কহিনী বড়ই করুণ।
গ্রন্থের সমাপ্তি হয়েছে পাপের কঠিনতম পরিণামের মধ্য দিয়ে। লেখত স্থানে স্থানে কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। ঐতিহাসিক ঘটনাকে গতিময় ও আকর্ষণীয় করার জন্য যেসব উপকাহিনী গড়েছেন,সেসব গ্রন্থের গ্রহনযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব উপকাহিনী মূল কাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এখানেই শিল্পীর পারঙ্গমতা।
চরিত্র বিভাজন:
‘বিষাদ-সিন্ধু’তে বর্ণিত চর্রিগুলোকে দ’ভগে ভাগ করা যায়। যথা:
ক. সৎ সরিত্র অর্থাৎ নীতিপরায়ণ
খ. অসৎ,ধূর্ত অর্থাৎ নীতিহীন
তবে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসে সৎ চরিত্রের হাসান,হোসেন,জয়নাল প্রভৃতি নীতিবান চরিত্র ফ্যাশে,অপরদিকে ধর্মহীন নীতিহীন এজিদ মারওয়ান জাএদা চরিত্র হিসেবে বিশেষ উজ্জ্বল।
এজিদ
‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসে এজিদ চরিত্র আর আর চরিত্র অপো স্পষ্ট ও উজ্জ্বল ও প্রদীপ্ত। সে চিন্তায় অভিব্যক্তিতে,প্রেম ঈর্ষায়,দীপ্তমান। রপজমোহে আত্মবিকৃত এজিদ সকল শক্তির অধিকারী হয়েও এক মর্মান্তিক নিষ্ফলতায় হীনবল।
সে ছিল মুয়াবিয়ার খুবই আদরের। লেখকের ভাষায়Ñ “তুমি আমার একমাত্র পুত্র। এই অতুল বিভব,সুবিস্তৃত রাজ্য এবং অসংখ্য সৈন্য সামন্ত সকলই তোমার। ”
[‘বিষাদ-সিন্ধু’: পৃষ্ঠা ৯: মহরম পর্ব ]
এজিদ পাপী ধর্মদ্রোহী,এবং ইন্দ্রিয় পরবশপরবশÑ সর্বোপরি সে প্রেমে ঈর্ষায় রক্তমাংশের মানুষ। সে সাহসী রণকুশলী বীর,রণেেত্র অকুতোভয় কিন্তু রূপচমোহে তবিত্ষত।
সে জয়নাবের প্রত্যাখ্যানে বিধ্বস্ত।
জাএদা
শিল্পী অত্যন্ত দতার সাথে জাওদা চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন । সে চরিত্রের মাসসিক অবস্থা,নীচতা,দীনতা,জিঘাংসা,ঈর্ষাকে চিত্রিত করে তাকে মানবীয় করে তুলেছেন। সে রূপবতী ও যুবতী কিন্তু স্বামী তাকে আবহেলা করে জয়নাবের রূপে মুগ্ধ হওয়ায় সে স্বামী হšতা করেছে।
মারওয়ান প্রভুভক্ত।
সে যেমন রণকৌশলী,তেমনিপ্রভুর মনোরঞ্জনে সিদ্ধ। ক’নীতিবিদ মারওয়ানই জয়নাবের বিবাহ বিচ্ছেদ,জাএদাকে দিয়ে হাসানের মৃত্যু অনিবার্য করে তুলেছে।
মায়মুনাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন, “ তোমাকে বিশ্বাস না করিলে মনের কথা ভাঙ্গিব কেমনে?
উৎস: প্রাগুক্ত ঐ:পৃষ্ঠা: ৬২
মায়মুনা:বিশেষ এক কার্য উদ্ধারের জন্য সৃষ্ট ময়মুনা চরিত্র শিল্পীর দু’একটা আঁচড়ে
অঙ্কিত হলেও চরিত্রটি যুগোত্তীর্ণ হয়ে মানুষের মুখে মুখে নিন্দিত। সে হাসানকে হত্যা করতে গিয়ে বারবার নিজের বিবেকের সাথে যুদ্ধ করেছে। যেমনÑ “হাসান আমার কে? হাসানকে মারিতে আমার দুঃখ কি?আর ইহাও এক কথা,আমি তো নিজে মরিব না।
আমি কেবল উপল মাত্র।
উৎস: প্রাগুক্ত ঐ:পৃষ্ঠা: ৬৩
সীমার
অর্থলোভী সাহসী কসাই সীমার মধ্যযুগের ইতিহাস থেকে চয়নিত হলেও শিল্পীর চরিতও নির্মাণের পারঙ্গমতায় শতাব্দী হতে শতাব্দী মানুষের মুখে মুখে চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতেও সীমারের মৃত্যু নেই। তাঁর উক্তিগুলো খুব জীবন্ত- “আনপরা মহারাজা এজিদের বিরুদ্ধে হানিফার সাহায়ে মদিনা যাইতেছেন,সেই অপরাধে অপরাধীএবং আমার হস্তে বন্দী। ”
উৎস: প্রাগুক্ত ঐ:পৃষ্ঠা: ৬৩
মাইকেল/বঙ্কিম এর মানস কন্যা
কারবালার প্রান্তরে মহাযুদ্ধের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে লেখকের রোমান্টিক চিত্ত মানব মনের গভীরে প্রবেশ করে বিচিত্র রহস্যকে আবিষ্কার করেছেন।
মাইকেলের রাবণ,মিল্টনের (সটান) এর গুণে ধন্য গুণে ধন্য এজিদ পরিণতিতে ভাগ্যাহত। সীতার আত্মবিরাপ আর জয়নাবের বিলাপে সাদৃশ্য আছে। মাইকেল বা বঙ্কিমের জীবনোপলব্ধির উত্তরাধিকারিণী জাএদা। সে বেঁচে থাকতে স্বামী ভাগ করে নেবে না। কীভাবে তার হৃদয়ের ধন হাসানকে হত্যা করল সে মর্মস্পর্শী দৃশ্য লেখক অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেনÑ “গায়ের ভর গায়ে রাখিয়া,হাতের জোর হাতে রাখিয়া,অল্পে অল্পে দ্বার মুক্ত করিয়া গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া জাএদা দেখিলেন দীপ জ্বলিতেছে।
ইমাম হাসান শয্যায় শায়িত ,জয়নাব বিমর্ষ বদনে হাসানের পদদুখানি আপন বে রাখিয়া শুইয়া আছে। জাএদা পুটুলি খুলতে আরম্ভ করিলেন। খুলিতে খুলিতে খান্ত হইয়া আর খুলিলেন না। হাসানের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। ”
উৎস: বিষাদসিন্ধু: মহরম পর্ব
স্বামীর মুখের দিকে তাকালে সে প্রেমাসিক্ত হয়ে যায় আবার জয়নাবের দিকে তাকালে সে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে।
ঔপন্যাসিক অতি সূক্ষ্মভাবে তার মনের গতিবিধি তথা তার মনের রূপ উন্মোচন করেছেন।
বিষাদসিন্ধুর ভাষা ঊর্মিমুখর ছন্দময়। তাঁর এ উপন্যাসের ভাষা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অয় চন্দ্র সরকার দৃঢ় কণ্ঠে বলেন,“ ‘বিষাদসিন্ধুর’ ভাষা বাঙালি হিন্দু লিখিতে পারিলে আপনাকে ধন্য মনে করত।
উৎস: সাহিত্যের নানা দিক: নুরুল ইসলাম: পরিশিষ্ট- বিষাদসিন্ধু ও মোশাররফ। পৃষ্ঠা ১০০।
আধুনিকতার উপাদান
আধুনিক জীবন এবং আধুনিক মননও এই উপন্যাসে ধৃত হয়েছে। যেমনÑ
ক্স প্রেম এবং রূপজমোহ
ক্স রাজতন্ত্রের সাথে গণতন্ত্রের দ্বন্দ্ব।
ক্স চরিত্রের ট্রাজেডি
ক্স অতি প্রাকৃত বিষয়কে প্রাকৃত করে তোলা
ক্স সপতœীবাদে বিরোধিতা
ক্স কূটনৈতিক বিষয়
ক্স কৃত কর্মের অনুশোচনা
ক্স অস্তিত্বমুখিতা
ক্স মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণ
ক্স অর্থের কু ও সুব্যবহার
ক্স স্বাদেশিকতা
ক্স যুদ্ধবিরোধী চেতনা
এ সবগুলো বিষয়কে তিনি আধুনিকতার ছাঁচে ফেলে আধুনিক করে তুলেছেন।
অলৌকিকতা দোষ কী ?
এসব কিছুর পরেও বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসে যা আপত্তি তা তাঁর অলৌকিকতা। এজিদের সম্মুখ হতে হোসেনের লাশ অদৃশ্র হওয়া,বৃ হতে রক্তরণ,হোসেনেরÍক্তে এজিদের পরিণতি লেখা ইত্যাদি।
অলৌকিকতায় দোষের কিছ নেই ,যদি তা শিল্পসম্মত হয়। বিষাদ সিন্ধুর অরৌকিকতা আজও হাজার হাজার মানুষের মনে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে আছে।
মন্তব্য
উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে,কাহিনী বিনির্মাণে চরিত্র চিত্রণে বিষয় উপযোগী ঝরঝরে গদ্য ভাষা, শিল্পীর জীবনবোধÑ সবকিছু মিলিয়ে বিষাদ সিন্ধু মীর মোশারফের শ্রেষ্ঠ সিসৃার ফসল তো বটেই,বাংলা উপন্যাস সাহিত্যেও অন্যতম সংযোজন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।