আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিজড়া : প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালের এক দুর্ভাগা শিকার

ফারিয়াজ আমার ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাই বিত্তশালী। অথচ আমাকে বেঁেচ থাকার জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হয়। নিজের ভাই-বোনদের দেখার জন্য যখন মন কেঁদে উঠে তখন মাঝে-মধ্যে বাসায় যাই। পাড়া-প্রতিবেশিরা না দেখার জন্য বোরকা পড়ে বাসায় যেতে হয়। কারণ আশেপাশের লোকজন দেখলে পরিবারের মান থাকবে না।

তাই ওরাও চায় না, আমি যেন বাসায় যায়। বাসায় গেলে কখন চলে আসব তাই নিয়ে ওরা উদ্বিগ্ন থাকেন’। অনেকটা ব্যথিত মনে আবেগ আপ্লুত হয়ে কথাগুলো বলছিলেন সিমলা। মানব সমাজে বেড়ে উঠলেও হিজড়া হয়ে জন্ম নেওয়ায় তাঁর এই পরিণতি। শুধু সিমলা নয় তাঁর মতো আরো অগণিত হিজড়া রয়েছে, যারা সমাজ তো দূরের কথা নিজের পরিবারের কাছেই অবহেলিত।

হিজড়া, প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালের এক দুর্ভাগা শিকার ! সামাজিকভাবে এরা অবহেলিত । সুস্থ-সবল হলেও দৈনন্দিন নিত্য কর্ম থেকে শুরু করে সব জায়গায় এই সম্প্রদায় অচ্ছুৎ হিসেবে গণ্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্মপরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা যায় তারাই হিজড়া। রক্তের আর এইচ ফ্যাক্টর, জ্বীনতাত্ত্বিক কারণ, সংক্রমণ ও বিষাক্ততা, মেটাবলিজম ও পুষ্টিগত সমস্যা, মস্তিষ্ক গঠনজনিত সমস্যাও হিজড়া হওয়ার অন্যতম কারণ। এদিকে ২০০৪ সালের বেসরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় ৪০ হাজারেরও অধিক হিজড়া।

এর মধ্যে শুধু চট্টগ্রাম মহানগরীতে অবস্থান করে সাড়ে তিনশ থেকে সাড়ে চারশ জন হিজড়া। নগরীর আমবাগান-ঝাউতলা, মাঝির ঘাট, নিউমার্কেট, আলকরণ, ষোলশহর রেল স্টেশন, বহাদ্দারহাট, সিডিএ আকবর শাহ কলোনী, বার্মা কলোনী, চাক্তাই, কালুরঘাট এবং হালিশহর এলাকায় এসব হিজড়ারা দলবদ্ধভাবে বাস করে। এসব এলাকায় রয়েছে মধুমালা, সীতা, গীতা, নাসু, শাবনূর, শোভাসহ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় হিজড়া । নেতৃস্থানীয় এসব হিজড়াদের অধীন অন্য হিজড়ারা বাস করে। বিভিন্ন হিজড়া অধ্যুষিত এলাকা পরিদর্শনে এবং হিজড়াদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নাগরিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে এসব হিজড়া সম্প্রদায়।

নেই এদের কোন বাসস্থান। তারা ভাড়া করা ঘরে বসবাস করে। আলাপকালে হিজড়ারা অভিযোগ করেছেন, তারা যেখানে বাস করে সেগুলো অস্বাস্থ্যকর। ,নেই কোন পানীয় জলের ব্যবস্থা , নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, হিজড়ারা যেসব ঘরে বাস করে এগুলোর প্রত্যেকটি ঘরের পরিবেশ খুবই স্যাঁতস্যাঁতে।

প্রত্যেকটি ঘরের আকার ১২ থেকে ১৫ ফুট, যেখানে ৩ থেকে ৮ জন পর্যন্ত বসবাস করে। স্যানিটেশন ব্যবস্থা একেবারেই অনুপস্থিত। হিজড়া অভিযোগ করেন, হিজড়া পরিচয় পেলে বাড়ির মালিক বাসা ভাড়া দিতে আপত্তি করেন। তাই তাদেরকে ঘিঞ্জি আকারের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে হয়। এদিকে হিজড়াদের পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে, মৌলিক অধিকার হওয়া সত্ত্বে হিজড়ারা শিক্ষা এবং চিকিৎসা সেবা পান না।

২০০৮ সালের এক হিজড়া জরিপ থেকে জানা যায়, হিজড়ারা সরকারি কোন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা পান না। এছাড়া ক্লিনিক থেকে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ, ফার্মেসী থেকে ৭১ দশমিক ৮৮ শতাংশ, উন্নয়ন সংগঠন থেকে ৩ দশমিক ১৩ শতাংশ, কবিরাজ থেকে ১৪ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং হাতুড়ে ডাক্তার থেকে ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ হিজড়া চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকে। জানা গেছে, হিজড়ারা মূলত নগরীর বিভিন্ন দোকান আর বাজারে গিয়ে টাকা তোলে। এই অর্থকে তারা বলে খড়ারহম বা ছলনা। এছাড়া কোন নবজাতকের জন্ম হলে সেখানে গিয়ে নাচ-গান করে চাঁদা তোলে তারা।

এক শ্রেণীর বিকৃত রুচির মানুষ হিজড়াদের যৌন বিনোদনের উপাদান হিসাবে ব্যবহার করে। এদিকে অনেক নগরবাসীই অভিযোগ করেছেন, হিজড়ারা জোরপূর্বক টাকা আদায় করে থাকে। তারা দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অতর্কিতভাবে উপস্থিত হয়ে টাকা দাবি করে থাকে। চাহিদামত টাকা না দিলে হিজড়ারা রুঢ় ব্যবহার করেন বলেও কুতুব নামে এক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে খুলশীস্থ ওয়ারলেস এলাকায় বসবাসকারী হিজড়াদের নেতা গীতা দৈনিক আজাদীকে বলেন, মানুষ আমাদের ভুল বোঝে।

আমরা তো আর প্রতিদিন টাকার জন্য যায় না। মাঝেমধ্যে যখন যায়, তখন কয়েকটা টাকা বাড়িয়ে দিলে ক্ষতি কি। আজকাল ফকিরকেও তো কেউ দু’এক টাকা দেয় না। আমরা জোর করে টাকা নি ই না। তবে আমাদের বড় কথা বললে আমরা ছেড়ে দিব না কী? আমরাও তো মানুষ।

শাহানু নামে এক হিজড়া জানান, তিনি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে পড়ালেখা বেশিদূর এগোয় নি। রাষ্ট্র যদি তাদের কাজ করার সুযোগ করে দিত তাহলে তারা অন্যের উপর নির্ভর করতেন না। পিংকী নামে এক হিজড়া জানান, ১২ বছর বয়সে পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে হিজড়া পল্লীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদে রয়েছে, ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আওতাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার।

’ এছাড়াও মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা হলো : দাসত্ব হতে মুক্তির অধিকার, ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, কাজের অধিকার, মানসম্মত জীবন-যাপনের অধিকার, আইনের আশ্রয় ও নির্যাতন থেকে মুক্তির অধিকার এবং বিবাহ ও পরিবার গঠনের অধিকার। কিন্তু সংবিধান এবং মানবাধিকারের ঘোষণা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেক হিজড়ায়। হিজড়া সম্মেলন : সমাজের পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু হিজড়া সম্প্রদায়ের অধিকার, উন্নয়ন ও বিকল্প জীবিকায়নসহ তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানকল্পে নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হবে ‘হিজড়া সম্মেলন’। সকাল দশটায় সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, নোঙ্গর সমাজ উন্নয়ন সংস্থা ও বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৭ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.