আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিজড়া ও একটি ঘটনার সারসংক্ষেপ

I am what I am and that's how I would be. No I am not stubborn. I just want to be myself. ঘটনাঃ ভাইয়ের বিয়ের পরের দিন সকালে আমার মায়ের ফোন। ফিস্-ফিস্ করে কান্নাজড়িত কন্ঠে বল্লো “বাসায় হিজড়া এসেছে। মৌসুমিকে ভীষণভাবে মারধর করেছে। বলছে ২০০০০ টাকা না-দিলে যাবেনা। তোমার বাবার সামনে দুজন জামাকাপড় খুলে আজেবাজে কথা বলছে।

আমি কী করবো?” আমি ছিলাম বোনের বাসায়। বাবা-মার সাথে ছিল ভাই এবং ভাইয়ের বৌ। সকালে আমাদের সবার যাওয়ার কথা ঐ বাসায়, তার আগেই এই ঘটনা। বৌয়ের বাড়ির মেহমান আসার কথা সকালে। আমার পালক মেয়ে মৌসুমি ওদের কথা মনে করেই দরজা খুলে দিয়েছে।

ঘরে ঢুকেই চারজন শাড়ী পরা বিশালদেহী হিজড়ে জোরে জোরে তালি বাজাতে শুরু করলো এবং অকথ্য ভাষায় আমার বাবা-মা-কে গালাগালি করতে লাগলো। তাদের আচরণ এবং মুখের ভাষা এখানে লেখার মত না, লিখতে চাচ্ছিওনা। নববিবাহিত দম্পতিকে রুম থেকে বার হতে নিষেধ করা হলো এসএমএস করে। মৌসুমি একপর্যায়ে বলে বসলো “ছি ছি এমন বাজে কথা কি ‘মানুষে’ বলে?” এই কথা বলার সাথে সাথে তার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফেলে তাকে লাথি, এবং মারধোর শুরু করলো তারা। চিৎকার শুনে নিচ থেকে লোকজন এসে ওদের থামালো।

আমার মা ওদের আটকাতে গিয়ে নিজেও জোরে একটা ধাক্কা খেলো। পুলিশ ডেকে এনে ওদের কে ঘটনাস্থল থেকে পরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। এরমধ্যে আমার মা তাদের ৩০০০ টাকা দিয়েছেন। আমার আব্বার অর্ডার অনুযায়ী প্রতিবেশীদের মাধ্যমে তাদের আরও ৫০০০ টাকা দেওয়া হলো। পুলিশের ভাষ্যমতে, ওদের বিচার হবেনা।

ওদের সমঝে চলতে হবে। ওরা এমন করতেই থাকবে, সেটা ইগনোর করতে হবে। ওরা কোথায় যেন ৭ তলা বাড়ি দখল করে একটা কমিউনিটি করে থাকছে আমাদের বাসার কয়েক রাস্তা পরেই। ওদের লীডারকে হাতে না-রাখলে এমন দূর্ভোগ চলতেই থাকবে। বাসায় বিয়ের লাইটিং খোলার জন্য লোক এসেছিল, তাদের ধাক্কা মেরে বিল্ডিং এ ঢুকে তারা সোজা চলে এল আমাদের ফ্ল্যাটে- এই শুনলাম সিকিউরিটি গার্ডের কাছে।

কি করে জানলো যে এত ফ্ল্যাটের মধ্যে আমাদের ফ্ল্যাটেই নতুন বৌ এসেছে? সেটা নাকি কেউ জানেনা। আমার মেয়ে মৌসুমির একটা চোখ ফুলে গিয়েছে, পেটের বামকোণায় লাল হয়ে গিয়েছে। আজ তিনদিন হলো আমার মা খানিক পরপর শিউরে উঠছেন। এর কোনও বিচার হবেনা। কারণ তারা নাগরিক-সুবিধা বঞ্চিত! তাই তারা ডাকাতের পর্যায়ে পড়েনা! ডাকাতের মতই দিনেদুপুরে আক্রমণ করে গেলো তারা, আমাদের প্রতি তাদের ঘৃণা ছাড়া কিছুই নেই, একটা ছোটমেয়েকে এমন ভয়ানকভাবে জখম করে গেল, আমার মা-কে মানসিকভাবে পর্যূদস্ত করে গেল, কিন্তু কেউ ওদের আঙ্গুল উঁচিয়ে বলতে পারবেনা, তোমরা অন্যায় করেছ!! পর্যালোচনাঃ আগে কখনও ওদের নিয়ে ভাবিনি।

বাসার এই ঘটনার পর খুব অসহায় রাগ হয়েছিল। যেখানেই নবদম্পতি, নবজাতক, সেখানেই তাদের এই হামলা, লুটপাট চলতেই থাকবে? এই নাকি তাদের একমাত্র ইনকাম? জাতিসংঘ থেকে নাকি নিয়ম করে দিয়েছে তাদের বকা যাবেনা, টোকা মারা যাবেনা? কিন্তু এটাও কি জাতিসংঘ ওদের শিখিয়ে দিয়েছে যে বর্বরের মত ওরা আমাদের যাচ্ছেতাই অত্যাচার করে যাবে? আমাদের দোষটা কী? ভাবতে বসলাম। ওরা আমাদের চেয়ে আলাদাঃ ওরা প্রাকৃতিকভাবে অন্যরকম। ওদের শারিরীক গঠন অস্বাভাবিক। এই কারণে তারা সুস্থ জীবন-যাপনে অপারগ।

এই হীনমন্যতা নিয়ে তারা বড় হয়েছে, প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। তাদেরকে নিয়ে স্বাভাবিক (?) লোকেদের অবজ্ঞা/টিটকিরির সীমা নেই। জন্মের পর থেকে জেনে এসেছে তারা যৌন-প্রতিবন্ধী এবং সমাজ তাদের জন্যে প্রতিকূল; তাদেরকে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হবে। সংঘবদ্ধ হয়ে দলভারী না করলে টিটকিরি এবং অবহেলার চোটে টেকা দায় হয়ে পড়বে। অন্যকেউ তাদের দূর্বল এবং সংখ্যালঘু বলে অত্যাচার করার আগেই তাই তারা শক্তিমান হিসেবে নিজেদের জাহির করার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়।

আমরা কী করছি? আমরা ওদের এড়িয়ে চলছি। আমরা ওদের ভয় পাচ্ছি। আমরা দূর থেকে ওদের ঘৃণা এবং তিরস্কার করছি। জাতিসংঘের ব্যানারে আমরা ওদের খানিকটা করুণাও করছি এভাবে, “ঠিক আছে তুমি যা-খুশি তাই করতে পারো। তুমি একজন মানুষ হলে নাহয় তোমার বিচার হতো, তা তো আর হচ্ছেনা!” নেগেটিভ এটেনশনও কিন্তু একধরণের এটেনশন! একটা ছোটবাচ্চা যখন বাবা-মার আদর চেয়ে পায়না, তখন সে গ্লাস ভাঙ্গে, দেয়ালে ছবি আঁকে, বাবা-মা এরপর তাকে বকা দেয়, বিনিময়ে সে একটু এটেনশন পায়, কাঁদার সুযোগ পায়।

এরাও কি তাইই করছেনা? ওরা এমন আক্রমণ করে আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে “WE EXIST!”। নাহয় এই জোর করে নেওয়া টাকা দিয়ে জীবন চালাতে কি তাদের ভালো লাগার কথা? শারিরীক ভাবে সামান্য আলাদা হওয়ার কারণে ওদের ‘মন’ তো বদলে যায়নি! এই মানবেতর জীবনযাপন তো ওদের মন থেকে মেনে নিতে পারার কথা নয়! ওদের গায়ে যে পরিমাণ শক্তি, অনায়াসে এরা সিকিউরিটি গার্ডের ক্যারিয়ার করতে পারে, ভাবুন একবার! এরা গড়পড়তার চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখে, কারণ এদের সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। এই বুদ্ধি ওরা কোনও সৃজনশীল কাজে কি লাগাতে পারতোনা? যে কাজ-ই হোকনা কেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ওরা সেটা হয় করতে পারছেনা, কিংবা করতে চাইছেনা। কেন, সে প্রশ্নের উত্তর তো আমাদের কাছেই আছে। আমরা কী করতে পারতাম? খুব সংক্ষেপে বলা যায়, আমরা ওদের “মানুষ” আখ্যা দিতে পারতাম।

আমরা ওদের স্বাভাবিক চোখে দেখতে পারতাম। একজন দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধী কে আমরা কাছে টানছি, যথাসম্ভব সাহায্য করছি, যাতে তারা পিছিয়ে না-পড়ে। কিন্তু একজন সক্রিয়-সক্ষম মানুষকে আমরা তার যৌন-অস্বাভাবিকতার কারণে দূরে ঠেলে দিচ্ছি যাতে তারা সামনে আগাতে না-পারে, কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে আমাদের সাথে সমানতালে চলতে না-পারে!! গুগলে সার্চ দিলে ওদেরকে নিয়ে অনেক লেখা পাওয়া যায়, অনেক গবেষণা করা হয়েছে ওদের নিয়ে। কিন্তু উদ্যোগটা নিচ্ছে কারা? উদ্যোগ বলতে আমি বোঝাচ্ছি তাদের করুণা করা নয়, নিজেদের সমকক্ষ (পরিস্থিতিভেদে বেশি-সমর্থ) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা। তাদের বিকৃতরুচি কিংবা নেগেটিভ চিন্তাধারা বদলাতে না-পারলে তারা এমন জুলুম করেই যাবে।

তাদের মনের অশান্তি থেকে তারা আজ এমন আচরণ করে, যেটা থামাবার জন্যে ওদের আশ্বস্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে আমাদেরই। আমার মৌসুমিকে আমি বোঝাতে চাই, ওরা দানব নয়, ওরা মানুষ। ওদেরকেও যদি বোঝাতে পারতাম, যে আমার মৌসুমি কোনও দোষ করেনি, জন্মগত রাগ এভাবে যার-তার ওপরে ঝাড়তে থাকলে তারা লক্ষ্যহীনভাবে নিজেদের বঞ্চিতই করে যাবে শুধু। আমরাও বিনা-দোষে তাদের রোষের শিকার হতে থাকবো, যেটা আমাদেরও প্রাপ্য নয়! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.