# ঋণের ক্রমবর্ধমান সুদ: ক্রমাগত ঋণে জর্জরিত হচ্ছে দেশ। ১ লক্ষ ৯১ হাজার কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে ঋণের সুদ পরিশাধেই ব্যায় হবে ২৩ হাজার ৩শ ২ কোটি টাকা অর্থাত মোট বাজেটের ১২.২ শতাংশ। ২০০৯-১০ এ সুদ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৮শ ৬৭ কোটি টাকা, ২০১০-১১ তে ১৫ হাজার ৬ শ ২২ কোটি টাকা এবং ২০১১-১২ তে ১৯ হাজার ৭শ ৯৬ কোটি টাকা (সূত্র: সারণী ৬, বাজেট বক্তৃতি ২০১২-১৩) অর্থাৎ ক্রমশই দেশের জনগণের কষ্টার্জিত আয়ের ক্রমবর্ধমান অংশ খরচ হয়ে যাচ্ছে স্রেফ ঋণের সুদ পরিশোধ করার কাজে। তারপরও হুশ নেই শাসক গোষ্ঠীর। ঋণভার আরো বাড়ানোর ধান্দা হচ্ছে।
যেমন প্রস্তাবিত বাজেটের আর্টিক্যাল ২২ এ আন্তর্জাতি বাজারে সোভেরেইন বন্ড বা স্বার্বভৌম বন্ড ছাড়া এবং আর্টিক্যাল ২৩ এ আইএমএফ এর কাছ থেকে এক্সটেন্ডেট ক্রেডিট ফেসিলিটির আওতায় আরো ঋণ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে যার ফলে পরবর্তী বাজেটে আরো বেশি অর্থ ব্যায় হবে সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে।
# জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি: প্রস্তাবিত বাজেটে একদিকে আন্তর্জাতিক মূল্যের সাথে সম্পর্ক রেখে স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয় এবং একই সাথে বিদ্যুতের মুল্য সমন্বয়(অর্থাত বৃদ্ধি) এর কথা বলা হয়েছে এবং এর ফলে যে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এটা স্বীকার করেও পরক্ষণেই আবার আশা প্রকাশ করা হয়েছে মূল্যস্ফীতি নাকি ৫ শতাংশে নামিয়ে আনবে। ফাইজলামির একটা সীমা আছে। এখনই মূল্যস্ফীতি সারাবছর দুই অংকের ঘরে থাকে, বিদ্যুত ও জ্বালানির দাম আরো বাড়ানোর পর মূলস্ফীতি নাকি ৫ শতাংশে নামিয়ে আনবে!(আর্টিক্যাল ২৮)
# জ্বালানি খাতে ভর্তুকী কুইক রেন্টাল খাবে:জ্বালানি খাতে মোট বরাদ্দ ৯ হাজার ৪শ ৯৮ কোটি টাকা যার মধ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বাবদ ১ হাজার ৬শ ৮ কোটি টাকা রেখে বাকি ৭ হাজার ৮শ ৯০ কোটি টাকাই বরাদ্দ করা হবে বিদ্যুত বিভাগে। (সূত্র: সারণী ৭, বাজেট বক্তৃতি ২০১২-১৩) বিদ্যুত খাতে সরকারি ভাবে বিদ্যুত প্ল্যান্ট আর এখন বানানো হচ্ছে না, সেই সাথে বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হচ্ছে- ফলে বোঝাই যাচ্ছে বিদ্যুত খাতের প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা যাবে কুইক রেন্টালের তেল ও বিদ্যুতের পিছনে ভর্তুকী দিতে।
আর খনিজ সম্পদ বাদে সামান্য বরাদ্দের অর্থ হলো পুজির সংকটের কথা বলে বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানির হাতে সাগরের ও স্থলভাগের তেল-গ্যাস ক্ষেত্রগুলো আরো বেশি করে তুলে দেয়ার পরিকল্পনা।
# অবকাঠামো খাতে সরকার বেসরকারিখাতে অংশ গ্রহন আরো বাড়াবে: পিপিপির আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প দেশী-বিদেশী পুজিপতিদের কাছে আকর্ষনীয় করার জন্য ভিজিএফ(ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং),ইভিএফ (ইকোনোমিক ভায়াবিলিটি ফান্ড)ইত্যাদির মাধ্যমে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। (সূত্র: আর্টিক্যাল ৪৩-৪৪)
#কৃষি খাতে বরাদ্দ ক্রমশ কমছে: কৃষিখাতে হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকীর কথা আমরা শুনি কিন্তু এই ভর্তুকী কোথায় যায়, কার কাজে লাগে তার কোন পরিস্কার চিত্র আমরা পাইনা। প্রতিবছরই আমরা দেখি কৃষককে বাড়তি দামে সার,বীজ, কীটনাশক কিনতে হয়,বিএডিসি’র বীজ না পেয়ে হাইব্রিড বীজ কিনে প্রতারিত হতে হয়,ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হতে হয়। বাজেটের অনুপাতে প্রতিবছরই কৃষিখাতে বরাদ্দের পরিমাণ কমছে- এবার বরাদ্দ করা হয়েছে ৮ হাজার ৯শ ৯ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
অথচ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ, ২০০৯-১০ সালে ছিল ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ, ২০১০-১১ সালে ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ, ২০১১-১২ এর সংশোধিত বাজেটে ৫দশমিক ৭৪ শতাংশ। (সূত্র: সারণী ৬, বাজেট বক্তৃতি ২০১২-১৩) অর্থাৎ বেশ ঘোষিত ভাবেই কৃষি ক্রমশ গুরুত্ব হারাচ্ছে শাসক গোষ্ঠীর কাছে।
শিক্ষাখাতেও বরাদ্দ কমছে:প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে ২০০৮-০৯ সালে বরাদ্দ ছিলো ১০.৫%, ২০০৯-১০ এর ১০.৬%, ২০১০-১১ তে ৯.৫, ২০১১-১২ তে ৭.৬% এবং ২০১২-১৩ তে ৮%। আগের বছর বাজেটে ৭.৬% বরাদ্দ থাকলেও শেষ পর্যন্ত ব্যায় করা হয়েছে ৬.০%। (সূত্র: সারণী ৭, বাজেট বক্তৃতি ২০১২-১৩) এই ব্যায়ের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক।
কিন্তু সে দিকে না গিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় ২০১২-১৩ সালের প্রস্তাবিত ৮% ব্যায়ও কি শেষ পর্যন্ত আগের বছরের মতো কাটছাট হবে না?
# কর্মসংস্থান: রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করা। বাজেট বক্তৃতার আর্টিক্যাল ২০৬ অনুসারে প্রতিবছর ১৩.৪ লক্ষ জন শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে অথচ গত তিন বছরে সরকার কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করেছে ১ লক্ষ ৯৯ হাজার পদে। বেসরকারি খাতে এই সময় কত কর্মসংস্থান তৈরী হয়েছে এবং এই কর্মসংস্থানগুলোর গুণগত মান কেমন ছিল সে বিষয়ে কোন বক্তব্য নাই বাজেটে। ভবিষ্যতেও রাষ্ট্রীয় শিল্প ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরীর কোন কথা পাওয়া গেল না বাজেটে। বরং দেশের ভেতরে কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থার বদলে বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি করাকেই অগ্রাধিকার দেয়ার কথা আছে আর্টিক্যাল ২০৭ এ।
আমরা জানি এই জনশক্তি রপ্তানির কাজটিও সরকার দ্বায়িত্ব নিয়ে করে না। বেসরকারি বিভিন্ন দালাল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রমিকদেরকে রপ্তানি করা হয় তারপর সেই শ্রমিকরা কি ভাবে খায়, থাকে, ঘুমায় তার কোন খোজ খবরও কেউ রাখে না যার ফলে বাড়ছে বছর বছর প্রবাসি শ্রমিকের লাশের সংখ্যা। আর্টিক্যাল ২০৫ এ শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ণের জন্য কেবল ১৪০ কোটি টাকার একটি ফান্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের জন্য ৫০ কোটি টাকার ফান্ড দেয়ার কথা বলা হয়েছে যেন দক্ষতা উন্নয়ণ কর্মসূচীকে বেগবান করার জন্য আইন ও নীতি প্রণয়ণ করা যায়!
#রাষ্ট্রায়ত্ব খাতের বদলে বেসরকারি খাতে তেল ঢালাই চলবে:রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের বিকাশের কোন উদ্যোগের কথা এই বাজেটে নাই, আছে বেসরকারি খাতের বিকাশের কথা। আর্টিক্যাল ১৫৫তে বলা হয়েছে :”একটি দ্বায়িত্বশীল ব্যাক্তিখাতের বিকাশই অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। ” আর তার জন্য প্রয়োজনীয় শুল্ক,কর, প্রণোদনা, ঝুকি তহবিল ইত্যাদির নামে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অর্থ পুজিপতিদের হাতে তুলে দেয়ার বিদ্যমান ব্যাবস্থাই চালূ রাখার কথা বলা হয়েছে।
(সূত্র: আর্টিক্যাল ১৫৫)
#চলচ্চিত্র উন্নয়ণ: সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানীর ব্যাপারে যতটা সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ণের জন্য ততটাই ফাপা তার প্রতিশ্রুতি:”এই দুর অবস্থা পরিবর্তনের জন্য আমরা সিনেপ্লেক্স নির্মাণের জন্য প্রণোদনা দিতে মনস্থ করেছি”। কিন্তু সুনির্দিষ্ট বরাদ্দের কথা নেই। তাছাড়া শুধু সিনেমা হল নির্মাণ করলে হয়তো বিদেশী চলচ্চিত্র দেখানো আরাম দায়ক হবে কিন্তু চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ণের জন্য প্রশিক্ষণ, চলচ্চিত্র নির্মাণের অর্থ,প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাচামাল সহজলভ্য করা ইত্যাদি ছাড়া চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ণ সম্ভব নয় আদেৌ। (আর্টিক্যাল ২৪৬)
#সামরিক খাত: কৃষি বা শিক্ষাখাতে বছর বছর বরাদ্দ কমলেও, ভর্তুকী কমানোর কথা বলে বিদ্যুত ও জ্বালানির দাম বাড়ানো হলেও বছর বছর বাড়ছে সামরিক খাতের বরাদ্দ। এই বাজেটে ১২ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে সামরিক খাতে যা গত বছরের তুলনায় ৮৫১ কোটি টাকা বেশি।
(আর্টিক্যাল ২৫২)
#কর ও ভ্যাট: উচ্চবিত্তের কাছ থেকে আদায় যোগ্য করের হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষের কাছ থেকে আদায়কৃতব্য নূন্যতম করের হার ২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। (আর্টিক্যাল ২৬০) মার্চেন্ট ব্যাংকের আয়করের হার কমিয়ে ৪২.৫% এর বদলে ৩৭.৫% করা হয়েছে (আর্টিক্যাল ২৬১)। সরকারি ইপিজেডের পাশাপাশি বেসরকারি ইপিজেডও কর অবকাশের প্রস্তাব করা হয়েছে। (আর্টিক্যাল ২৬৫)প্রত্যক্ষ কর না বাড়ানো হলেও এবং ক্ষেত্র বিশেষে কমানো হলেও,সাধারণ মানুষের ঘাড়ে যে অপ্রত্যক্ষ করের দায় গিয়ে পড়ে, প্রতিটি জিনিস কিনতে গেলেই যে মূল্য সংযোজন কর(মূসক) আমাদেরকে দিতে হয়, সেই মূসক বা ভ্যাটের পরিমাণ কিন্তু কমানো হয় নি বরং বর্তমানে রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় খাত হিসেবে মূসক কে স্বীকৃত দিয়ে আরো বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে বাজেটে।
আম্দানিকারকদের অগ্রীম ৩ শতাংশ কর এবং খুচরা ও পাইকারি ব্যাবসায়ীদের স্থানীয় বিক্রির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ২ শতাংশ কর বাড়িয়ে সকল পর্যায়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে যা শেষ পর্যন্ত পাবলিকের পকেট থেকেই ব্যাবসায়ীরা আদায় করবেন। (আর্টিক্যাল ২৭৬)
২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট পাবেনএখানে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।