অনেক দিন পর বন্ধুর বাসা গেলাম। বন্ধু সরকারী চাকুরী করে। তার আম্মার সাথে কথা হল। বন্ধুর মা আমাকে জানালেন যে সে নাকি কোন কিছু কিনলে কথায় কথায় মানুষকে ভয় দেখিয়ে টাকা কম দেয়, যেখানে সেখানে কমিশন নেয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
বন্ধুর মা আফসোস করে আমাকে বললেন-“আমি চেয়েছিলাম ছেলে আমার সৎ মানুষ হবে।
সৎ পথে উপার্জন করে চলবে। কিন্তু এখন দেখি সে হারাম ইনকাম করে। তাকে মানা করেও কোন লাভ হয় না। ”
বন্ধুকে বললাম – “কিরে তুই নাকি ঘুষ খেয়ে শুধু ফুলে যাচ্ছিস?”
বন্ধু জবাবে বলল-“আমার মা-বাপ গাড়ি বাড়ির স্বপ্ন দেখেন। লোকের ছেলের সাথে তুলনা করেন।
আমি কি করতে পারলাম আর কি পারলাম না এটা নিয়ে সারাদিন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। আমি তো একটা মানুষরে ভাই। সব কিছু শোনার জন্য ধৈর্য্যের একটা সীমা থাকে। এই বেতনে গাড়ির বাড়ি কেমনে হবে? এখন যদি আমি কিছু করতে না পারি, দোষটা আমার ঘাড়ে আসবে। যদি কিছু করতে পারি, তাহলে কি করে কি করলাম, মানুষ এটা দেখবে না, দেখবে আমার সাফল্য।
বন্ধু সততার কোন দাম নেই। সব সময় নিজের স্বার্থটাই দেখতে হয়। ”
বন্ধুর কথার সাথে একমত না হয়ে পারলাম না।
আমার আরেক বন্ধুর বাবা ছিলেন অনেক বড় মাপের সরকারী কর্মকর্তা। তিনি চাইলে অনেক টাকার মালিক হতে পারতেন।
গাড়ি বাড়ির অভাব হত না। শুধু মাত্র সততার কারণে তিনি কিছু করতে পারেন নি। অনেক কষ্টে বাড়ির ছাদ ঢালাই দিয়েছেন। এখনও প্লাষ্টার করতে পারেননি।
উনার অফিসের কেরণীর আজ অনেক টাকা।
সমাজে প্রভাব খাটিয়ে কথা বলেন। টাকা আছে প্রভাব আছে। তাকেই ভয় করে চলতে হয়।
সবার সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য বন্ধুকে নিয়ে বাজারে দিকে গেলাম। কথার প্রসঙ্গে আমাদের কর্মজীবনের প্রসঙ্গটা চলে আসে।
কে কোথায় আছি, কি করছি এই সব বিষয় আলোচনা শুরু হল। আমার বন্ধু পাশ করে ১৫ হাজার টাকার বেতন পাচ্ছে, তাই বন্ধুরা তার প্রশংসা করে শেষ করতে পারছেনা। আমাদের যারা কিছুই করি না, তাদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছেনা। তাকে নিয়ে বাইকে কেউ কেউ ঘুরতে যায়। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখি।
এখানেও দেখা যায়, যার টাকা তার দুনিয়া, বন্ধুত্বের ভালবাসার কোন দাম নাই।
আমাদের এলাকার এক মানুষ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মেম্বার পদে পাশ করলেন। নির্বাচনের আগে তার যে সম্পত্তি ছিল, তাতে নাকি তার ২ বেলা ভাত জুটতো না। পাশ করার ৩ মাস পর সে ৯০ হাজার টাকার একটা বাইক কিনলেন। বড় ভাই তাকে জিজ্ঞাসা করলেন –“আপনার তো ৩০ হাজার টাকার উপরে সম্পত্তি ছিল না, কিভাবে তিন মাসে ৯০ হাজার টাকার একটা বাইক কিনলেন?”
তিনি পাল্টা আমার ভাইকে হুমকি দিলেন।
গ্রামের মানুষ সবাই চুপ। কেউ প্রতিবাদ করে নি। উল্টো আমার ভাইকে দোষারোপ করেছে।
দেশের জনগন খালেদা হাসিনার দুর্নীতি দেখে। গ্রামের মেম্বারের দুর্নীতি দেখে না।
এই ছোট ছোট দুর্নীতি গুলো আমাদের কি জাতীয় উন্নয়নের বাঁধা না???????????
বাংলাদেশের কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের কাছে রাজস্ব বোর্ড থেকে কর প্রদানের নির্দেশ দিয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এসে রাজস্ব বোর্ড অফিসে এসে কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়ে গেছে।
এটাই আমার বাংলাদেশ। আমার শিক্ষক আমাকে শিখায় কিভাবে কর ফাঁকি দিতে হয়, কিভাবে হুমকি দিতে হয়। মাষ্টারসাব ক্লাশে তো ঠিকই মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে ঝড় তুলবেন।
আপনার এই অপকর্মের বিরুদ্ধে কে ঝড় তুলবে?
আজকাল বেসরকারী স্কুল-কলেজে ৫-৭ লাখ টাকার ঘুষ ছাড়া হেডামাষ্টার সাহেব কাউকে নিয়োগ দেন না। তো সেই হেড মাষ্টার সাবের মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা মানায় না।
দেশের উন্নয়ন সবাই চাই। কিন্তু উন্নয়নের জন্য মানুষের সহযোগিতার ২টি হাত পাওয়া যায় না।
আমার কখনও মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে ইচ্ছা করে না।
কারণ কম-বেশি সকল দেশের মন্ত্রী-এমপিরা দুর্নীতি করেন। কিন্তু আমাদের মত সেসব দেশে দুর্নীতি পরায়ণ জনগন খুব কম আছে।
আমাদের দেশের দুর্নীতির মূল উৎস আমরা জনগন। আমি –আপনি জানি আমাদের এলাকার নেতা একজন বড় মাপের দুর্নীতিবাজ, কিন্তু ভোটের সময়, তাকেই ভোট দিয়ে পাশ করাবেন।
আবার সরকারী চাকুরী পেলে ঘুষ ছাড়া কোন কাজ করবেন না।
বেতন বাড়লে আবার দ্রব্যের দামও বাড়াবেন।
আমরা তো সব সময়ই ২টা টাকা কোথায় লাভ হবে সেই সুযোগটা খুঁজি, ২টাকা লাভ করতে গিয়ে মানুষের কি ক্ষতি করি সেটা খেয়াল করি না।
ভাই সংসদে, সভা-সমাবেশে আন্দালিবের মত ভাষণ দেওয়া খুব ইজি, কিন্তু আমার বন্ধুর বাবার মত সৎ থাকা খুব কষ্টের।
জীবনে ব্যাংক ব্যালেন্স করতে না পারার জন্য মানুষের অবজ্ঞা সহ্য করার ক্ষমতা সবার হয় না।
আমি মন্ত্রী এমপি হলে, আমিও স্বপ্ন দেখব সুইস ব্যাংকে আমার একটা অ্যাকাউন্ট থাকবে।
ছাত্রজীবনে আমরা অনেকেই সৎ মানুষ থাকার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু কর্ম জীবনে সেটা স্বপ্নই থেকে যায়। কর্মজীবনের অন্যের উন্নতি আমাদের মনে এক ধরনের হিংসার আগুণ জালিয়ে দেয়। বিশেষ করে আমার নিচের স্তরের কর্মচারী আমার চেয়ে বেশি উন্নতি করলে, নিজের প্রতি এক ধরনের ধিক্কার চলে আসে যে, আমি কেন পারি না?
আমরা সবাই চাই আমার অনেক টাকা হবে,গাড়ি হবে বাড়ি হবে ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স থাকবে। কর্মজীবনের আমরা কেউ ভাবিনা একটু সৎভাবে বেঁচে থাকবো।
বাস্তবতাও ভাবতে সাহায্য করে না। কারণ কর্মজীবনের সাফল্যের প্রমাণ একমাত্র কত টাকা পয়সা আয় করেছি।
পরিশেষে এইটুকু বলতে চাই,
অন্যের সমালোচনা করার আগে আমাদের নিজের সমালোচনা করতে হবে, নিজের বিবেককে প্রশ্ন করতে হবে, আমি-আপনি কতটা ভাল।
আমি-আপনি ভাল হবার চেষ্টা করি, অন্যকেও সাহায্য করি।
মানুষকে আর মানুষের সাফল্যকে টাকা পয়সা দিয়ে পরিমাপ না করে, তার সততা আর কর্মদক্ষতা দিয়ে পরিমাপ করি।
তাহলে হয় তো একটু হলেও পরিবর্তন আসতে পারে।
(বি:দ্র: কোন ভুল হয়ে থাকলে- ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।