আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জনগনের বৈশাখ ....

একজন তরুন.. ঢাকা শহরে রমনার বটমূলে সংগীতানুষ্ঠান; চারুকলায় বর্ণাঢ্য র‌্যালি আয়োজন, চারদিকে বৈশাখী ফ্যাশন সম্পর্কে প্রচার, গ্রামীণফোন নববর্ষ মেলা, ডিজুস ইলিশ-পান্তার আয়োজন, সিটিসেল বাউল উৎসব, প্রাণ ব্যান্ড সংগীত, আরসি কোলা রবীন্দ্র গান, বেনসন অ্যান্ড হেজেস আবৃত্তি, লোক সংগীতের আয়োজনের মাধ্যমে বরণ করা হবে নতুন বছরকে। ‘নাচো, গাও আর ফুর্তি কর’ এটাই প্রধানতম সুর ছিল গত বছরের নববর্ষ উৎসবের। এবারও কি একই পরিস্থিতি থাকবে নববর্ষ উৎসবের? প্রশ্নটার উত্তর পেতে আমাদের আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। একই সময়ে শাসকশ্রেণীর ক্ষমতার কামড়াকামড়িতে এবং স্বার্থোদ্ধারের রাজনীতির ফলে সারা দেশে বিরাজ করছে চরম অরাজকতা, সহিংসতা। হরতাল, ভাংচুর, সরকারী দমন-পীড়ন, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা সব মিলিয়ে মেহনতি শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত এবং স্বল্প আয়ের মানুষ দুর্বিষহ জীবন অতিক্রম করছে।

আমরা দেখি কৃষক নিজ ক্ষেত্রে উৎপাদিত আলু, টমেটোর উৎপাদন খরচ ও দাম না পেয়ে রাস্তায় বস্তা ঢেলে ভাঙ্গা মন নিয়ে বাড়ি ফেরে। শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরিসহ অন্যান্য মৌলিক দাবিতে প্রায় প্রতিনিয়ত বিক্ষোভ করছে। সারা দেশে বিদুৎ, পানি, গ্যাস সংকটের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে এসে নিরাশ হচ্ছে। একদিকে নিজে বাঁচার চিন্তা, অপরদিকে দেশের বাড়িতে অনাহারী পরিবারের চিন্তা; নববর্ষ কি তাদের জীবনে কোনো উৎসবের আমেজ আনতে পারে? অধিকাংশ মানুষ সারাদিন খেটেও পরিবারকে একবেলা ভাতের যোগান দিতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে উৎসব মানে না খেয়ে থাকা।

অনেক আগে কৃষিজীবী মানুষ নতুন ফসল ঘরে উঠানোর সময় নবান্ন উৎসব করতো। যৌথতা ও সামষ্টিক বোধের কারণে এ উৎসবে অংশ নিত কৃষক-কামার-কুমার-তাঁতি-জেলে-ধোপা-নাপিতসহ সব শ্রেণী পেশার মানুষ। পরবর্তী সময়ে সম্রাট আকবরের সময় কৃষকের নতুন ফসল ঘরে উঠানোর পর খাজনা আদায়ের দিন হিসেবে পহেলা বৈশাখ জমিদাররা উদযাপন শুরু করে। তাই পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে উৎসব হতো। এদিন জমিদাররা আগের বছরের পুরনো হিসাব হাল নাগাদ করত এবং কৃষক-প্রজার শোধ করতে হতো ঋণ-দেনা।

ধীরে ধীরে হারাতে থাকে কৃষকের নতুন ফসল ঘরে তোলার উৎসব। পরবর্তীতে বৃটিশ ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তান আমলে তীব্র ঔপনিবেশিক শোষণ ও শাসনের বিপরীতে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে বেগবান করার জন্য নববর্ষকে জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দেয় মধ্যবিত্তরা। নববর্ষ উৎযাপনের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত শেণী শোষণের বিপরীতে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদিন জমিদাররা আগের বছরের পুরনো হিসাব হাল নাগাদ করত এবং কৃষক-প্রজার শোধ করতে হতো ঋণ-দেনা। ধীরে ধীরে হারাতে থাকে কৃষকের নতুন ফসল ঘরে তোলার উৎসব।

পরবর্তীতে বৃটিশ ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তান আমলে তীব্র ঔপনিবেশিক শোষণ ও শাসনের বিপরীতে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে বেগবান করার জন্য নববর্ষকে জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দেয় মধ্যবিত্তরা। নববর্ষ উৎযাপনের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত শেণী শোষণের বিপরীতে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু ১৯৭১ সালে ভারতের হাত ধরে যে স্বাধীনতা অর্জন হয় তা মূলত জাতিকে নতুন করে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। শোষক বদলায় কিন্তু শোষণ বদলায় না। ’৭১ এর আগে যারা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয় তারাই বিশ্বাসঘাতকতা করে ’৭১ পরবর্তী সময়ে শোষকের স্থান দখল করে।

যার প্রতিফলন আমরা দেখি নববর্ষ উৎযাপন অনুষ্ঠানের মাঝ্ওে। ’৭১ এর আগে যে নববর্ষ উৎসব ছিল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের হাতিয়ার, ’৭১ এর পরে সে উৎসবটি পরিণত হয় মেহনতি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এক পোষাকি বা গণবিচ্ছিন্ন উৎসবে। নববর্ষ থেকে সংগ্রামী চেতনাকে বাদ দিয়ে নববর্ষকে ব্যবহার করা হচ্ছে সাংস্কৃতিক নিপীড়নের অংশ হিসেবে। স্যাটেলাইট চ্যানেল ও প্রিন্ট মিডিয়ার বদৌলতে যৌথতা ও সামষ্টিক চেতনার পরিবর্তে আত্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতির ফেনোমেনা আজ তরুণ সমাজকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। ফলে নববর্ষ পরিণত হয়েছে অধিকাংশ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এক উৎসবে।

আজ মেহনতি মানুষের জীবনে উৎসবের কোন স্থান নেই। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এবারের পহেলা বৈশাখ আমাদের এক নতুন মাত্রা নিয়ে হাজির হতে পারে। পহেলা বৈশাখের অন্যতম চরিত্র হচ্ছে এটা বাংলাদেশের সকল মধ্যবিত্তের উৎসবে পরিণত হয়েছে। এবার ভিন্নভাবে উপস্থিত হতে পারে এই আশংকা কিংবা প্রত্যাশা তৈরি করেছে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি। শাসকশ্রেণীর ক্ষমতার কামড়াকামড়িতে এবং তাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে ধর্মীয় উগ্র সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ পহেলা বৈশাখের মত উৎসবের বিরোধী। ইতিপূর্বে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফাতে মোমবাতি প্রজ্জ্বল পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে। তাই হেফাজতে ইসলাম যদি পহেলা বৈশাখ উৎসবের বিরোধীতায় নামে তাহলে অবশ্যই তা নতুন মাত্রা নিয়ে হাজির হবে। ফেসবুক কিংবা ব্লগে বিভিন্ন পোস্ট এবং স্ট্যাটাসে হেফাজতের কর্মীরা জানান দিচ্ছে এটা। অপরদিকে শাহবাগের জাগরণ মঞ্চও পহেলা বৈশাখে মহা সমাবেশের ডাক দিয়েছে।

এক সংঘাতময় পরিস্থিতি। এ সংকটময় পরিস্থিতিতে হতাশার এক বিরাট জায়গা রয়েছে। আমরা চাই না সমাজে এবং রাষ্ট্রে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান। যখন ধর্মীয় মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন তার বিপরীতে প্রগতিশীল শক্তিও নিজের শক্তি সঞ্চয় করে মৌলবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। হতাশার জায়গা হচ্ছে এখানেই।

সত্যিকার প্রগতিশীল এবং বিপ্লবী শক্তির অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের সকল সংগ্রামের মত শাহবাগের গনজাগরণ মঞ্চও আজ প্রতিক্রিয়াশীল শাসকশ্রেণী তার নিজ স্বার্থে কাজে লাগিয়ে চলেছে। একটি সংগঠিত বিপ্লবী শক্তি থাকলে শাহবাগের এই গণজাগরণের চেতনাকে ধারণ করে সমাজ প্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত। যার প্রভাব পড়ত আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রে। এ বিপ্লবী শক্তির অনুপস্থিতিতে যা হবার তা ই হল। ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী শাহবাগের চেতনাকে নিজ রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

ফলে যে চেতনা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত তা আজ দেশে ধর্মীয় মৌলবাদের জন্ম দিয়েছে। একটি সংগঠিত বিপ্লবী শক্তি থাকলে শাহবাগের এই গণজাগরণের চেতনাকে ধারণ করে সমাজ প্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত। যার প্রভাব পড়ত আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রে। এ বিপ্লবী শক্তির অনুপস্থিতিতে যা হবার তা ই হল। ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী শাহবাগের চেতনাকে নিজ রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

ফলে যে চেতনা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত তা আজ দেশে ধর্মীয় মৌলবাদের জন্ম দিয়েছে। পহেলা বৈশাখ বর্তমানে শহুরে মধ্যবিত্তের উৎসবে পরিণত হলেও এটার সর্বব্যাপীতা এবং সার্বজনীনতা গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আরো বেশি গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে হাজির হবে এবার পহেলা বৈশাখ। সমাজে ক্রিয়াশীল বিপ্লবী শক্তির জন্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিপ্লবী শক্তি যদি সমাজকে প্রগতিশীলতার দিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এ উৎসবের চেতনাকে কাজে লাগাতে না পারে তাহলে শাসকশ্রেণী এ থেকে নিজ ফায়দা হাসিলে কোন কার্পণ্য করবে না।

শাসকশ্রেণী সমাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্য নয় বরং বিদ্যমান শোষণমূলক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতেই পহেলা বৈশাখের চেতনাকে কাজে লাগাবে। অতীতে এর ভূরি ভূরি নজির রয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে যা উগ্রজাতীয়তবাদ ও রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ আকারে সামনে এসেছে। উৎসব শুধু মধ্যবিত্তের জন্য নয়। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য মেহনতি মানুষের রয়েছে উৎসবের অধিকার। আমরা জানি, অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, তা আদায় করে নিতে হয়।

আজ আবার সময় এসেছে জনগণের প্রকৃত গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে নববর্ষকে প্রতিষ্ঠা করার। জনগণ নববর্ষ পালন করবে কিন্তু নববর্ষে গান, নাটক, স্লোগান প্রভৃতির মধ্য দিয়ে জনগণ তার উপর প্রতিনিয়ত ঘটে চলা শোষণকে তুলে ধরতে হবে। জীবনের আনন্দ-বেদনার প্রতিফলন ঘটবে উৎসবে। এর সঙ্গে সঙ্গে তারা যাতে শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, সেই চেতনাই হতে পারে নববর্ষ উদযাপনের প্রেরণা। তাহলেই মধ্যবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মেহনতি মানুষের জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্র অর্জনের অসমাপ্ত সংগ্রামের সঙ্গে একই সূত্রে বাধা পড়বে নববর্ষ উৎসব।

অধিকাংশ মানুষের জীবনে উৎসব হিসেবে নববর্ষ সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.