আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আরেক মা

মার তুলনা কেউ নেই। এটা নতুন কথা না। যারা মার আদর পেয়েছে তারা এই ব্যাপারটা আমার থেকে অনেক ভাল বলতে পারবেন। আমি বলব কিভাবে, আমার যে মা নেই। আমাকে আলোতে আনতে যেয়ে মা আধাঁরে চলে গেছে।

আমি শুনেছি আমার দাদি আমার মা মারা যাওয়ার পর আমাকে কোলে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলেছিলেন, দিম নাকি পাপডারে আছাড় মাইরা? আমার বোন তখন আমাকে একটানে তুলে নিয়ে দৌড়ে পাশের বাড়ীতে পলায়েছিল। সেই প্রথম আমি ওর কোলে উঠলাম। ওর বয়স তখন ৯।   আমার বাবা বাংলা সিনেমাতে সৎ মায়েদের ভিলেনের ভূমিকায় দেখে ঘোষণা দিলেন,আবার তার বিয়ের কথা যে বলবে তার আমাদের বাড়ীতে ঢোকা নিষেধ। শুরু হল বাবা আমার আর বোনের নতুন জীবন।

এর পরের চার পাঁচ বছর কি হয়েছিল ঠিক মনে নেই, অনেক ছোট ছিলাম তো। তবে বুদ্ধি হওয়ার পরে নিজেকে যেখানে আবিষ্কার করছি আমার মনে হয় না খুব একটা শান্ত ছিলাম। বোনকে জিজ্ঞাসা করলে, ও এমনভাবে তাকাত যে উত্তর পেয়ে যেতাম। ছোট বেলার যে স্মৃতিটা মনে পরে,আমার বোন ভাতের থালা নিয়ে দৌড়াচ্ছে আমি ওর দ্বিগুণ বেগে দৌড়াচ্ছি। বার বার বোন বোন বলছি শব্দটা একটু বেশিই শ্রুতিমধুর (!)।

কতবার যে ও খুব সুন্দর ভাবে বুঝায়ে বলসে ভাই কত সুন্দর সুন্দর নাম আছে তুই আমাকে দিদি ডাক, দিদিভাই ডাক। আমি নির্বিকার মুখে ওই দিন প্রতি বাক্যে দুইবার বোন ডাকতাম। বাবা চিরকালের ভাবুক টাইপ মানুষ বাসায় এসে প্রতিদিন চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করতেন খাবার খাইছিস বাবু ? আমি হু বলার সাথে সাথে তিনি আনন্দিত মুখে তাকায় থাকতেন। তার কাছে সকল সুখ শান্তির উৎস ছিল ভরা পেট। অথচ এক এক গ্রাস খাবার মুখে ঢুকাতে বোনের এক একটা রাজার গল্প শেষ করতে হত।

ডালিমকুমার, snow white, এসব গল্প বিভিন্ন ভাবে প্রতিবার বলতে হত, নাহলে মুখ হাঁ হত না। ওর কাছেই সব আবদার,মান,অভিমান। ক্লাস টু তে থাকতে এক মেয়েকে এতই ভাল লাগল যে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলসিলাম ওকেই বিয়ে করব। বোন ওই মেয়েকে বলছিল,এই মেয়ে আজকে থেকে বাবু তোমার জামাই বুঝছ? বয়স বাড়তে থাকল উড়নচন্ডী হতে থাকলাম, কিন্তু বখে যাইনি তার একমাত্র দায় তেনার। সন্ধ্যা হলে আমাকে নিয়ে পড়তে বসত।

কোন দিন একটু বেশী খেলাধুলা হয়ে গেলে মার একটাও মাটিতে পড়ত না। ভর্তি পরীক্ষার ভীষন চাপে জীবন যখন ঠোঁটের আগায়, এক কাপ চা এনে পাশে রেখে দুইটা খোঁচা মারা কথা বলত তখন মনে হত নাহ বেঁচে আছি। তিনজনের ছোট্ট সংসার টা তিন চাকার রিকশার মত আস্তে আস্তে কিন্তু শান্তিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক রাজপুত্র এসে বলল এই রাজকন্যাকে আমি চাই। রাজা খুশিমনে কন্যাসম্প্রদান করলেন।

রাজ্য জুড়ে আনন্দ উৎসব খালি একটা ছেলে সেদিন শক্তির শেষবিন্দু দিয়ে ফুটবলটাকে লাথি মারতেই লাগল, মারতেই লাগল। যাব না বাসায় আমি কারও আপন না এই ধরনের বাচ্চাদের অভিমান ভর করল। আমার কাছে এই মেয়েটাই ছোটবেলা থেকে মা হয়ে ছিল। কেউ যে একে নিয়ে যাবে এটা মাথায় আনা হয়নি। ঝোপের পাশে ভাঙ্গা বাড়ীটাতে  কেউ খুঁজে না পেলেও বোন ঠিকই খুঁজে পেল।

এসে বলল, বাসায় যাবি না? আমি শক্ত মুখে বললাম, না। তুই যা তোর জামাই বসে আছে। ও হাসে। আঁচলের নিচে থেকে কিছু খাবার বের করে আমার মুখে দিয়ে বলল,লক্ষী ভাই তোর একা থাকতে কষ্ট হবে তাই নারে? আমি জবাব দেওয়া দরকার মনে করলাম না। ও বলল, ঠিক আসে ওই বাড়ী যেয়ে তোর জন্য একটা বউ পাঠায় দিবনে।

এমন ভাবে বলল রাগতে যেয়ে হেসে দিলাম। বিয়ে হল। ওরা আমার এত দিনের বোনকে নিজেদের সম্পদ বানিয়ে নিয়ে গেল। এখন আমি আর বাবা থাকি। ঘরটা ভীষন ফাঁকা লাগে মাঝে মাঝে।

বোন বলে ডাক দেওয়ার পর টের পাই, ও নাই। নিজের চা তে কতটুকু চিনি লাগবে তাও তো আমি জানি না। অবশ্য সারাক্ষন আমার খোঁজ নিত ফোনে। খাচ্ছি নাকি, পড়ছি নাকি, ফোন ওয়েটিং কেন  "গিরিল ফ্রেন্ড" বানাইসো না! প্রেম করবি না, তাইলে তোগো বাসায় আসমু না ইত্যাদি ইত্যাদি। সময় পার হল অনেক।

একদিন ও বলল, বাবু তোর ভাগ্নে আসছে কিছুদিন পরে। শুনে পিচ্চিদের কাপড় চোপড় মশারি খেলাধুলার জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হলাম। দেখি সবকিছু কেনা হয়ে গেসে। চোখমুখ শক্ত করে বললাম জ্যাম (আমার দেওয়া নাম,ভাগ্নে হলে জ্যাম, ভাগ্নি জেলি) কিন্তু আমার মশারির নিচে থাকবে, ও আমার আনা মশারি দেখে আর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। ডাক্তারি পড়ার সুবাদে মনের খুশিতে হাজার খানেক উপদেশ এক বৈঠকে দিয়ে আসতাম।

মিষ্টি খাওয়া বন্ধ(এইটা তার ফেভারিট জিনিস),শাক-সবজি খাইতে হবে প্রচুর। আরও বহু উপদেশ। আজকে আমার জ্যাম ভাগ্নে পৃথিবীতে আসলেন। যেয়ে দেখি তিনি ভ্রু কুঁচকে চোখ বন্ধ করে আছেন। মনে হয় হসপিটাল জিনিসটা তার ভাল মনে ধরে নাই।

মা-ব্যাটা একসাথে শুয়ে আছে। মনে মনে বললাম, যাহ,আমার মা তোকে দিয়া দিলাম। ভাগ্নে দেখি মুচকি হাসি দিল। বুঝল নাকি পিচকি আমার কথা? ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।