সপ্তম ক্লিওপেট্রা সারা বিশ্বের আলোচিত ব্যক্তিত্ব । তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখা হয়েছে কালজয়ী উপাখ্যান । জর্জ বার্নড শ’ লিখেছেন সিজার ক্লিওপেট্রা, এতে প্রাধান্য পেয়েছেন রোমান্টিসিজিম । শেক্সপিয়র লিখেছেন অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রা । এটিতেও প্রাধান্য পেয়েছে প্রেম ও উচ্চাকাক্সক্ষা ।
আর সেই সঙ্গে তিনি আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন ক্লিওপেট্রার রূপের । হেনরি হ্যাগার্ডের ক্লিওপেট্রায় ফুটে উঠেছে ক্লিওপেট্রার ব্যক্তিত্ব, উচ্চাভিলাস আর কিছুটা নারীসুলভ অসহায়তা । এ ছাড়াও ক্লিওপেট্রার চরিত্র নিয়ে লিখেছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক ড্রাইডেন প্লুটার্ক, ড্যানিয়েল প্রমুখ । যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগের নারী হলেও বিশ্বজুড়ে আজো তাকে নিয়ে কৌতূহলের কোনো কমতি নেই । রহস্যময়ী ক্লিওপেট্রার প্রসঙ্গ আসলেই প্রাচীন মিসর আর রোম সভ্যতার কথা অনিবার্যভাবে ওঠে আসবে ।
এই রূপসী ও তরুণীকে নিয়ে ছড়িয়ে আছে অনেক কল্পকাহিনী আর কিংবদন্তি । মিসর ছিল তখন সবদিক থেকেই সমৃদ্ধ । রোমের দৃষ্টি প্রায় সর্বদাই নিবদ্ধ থাকত সেদিকে, খাদ্য বা অন্য প্রয়োজনে ।
ক্লিওপেট্রা একজন মিশরীয় ফারাও । তিনি ছিলেন প্রাচীন মিশরের সর্বশেষ ফারাও ।
তাঁর মৃত্যুর পর মিশর রোমান প্রদেশের আওতাধীন হয় । ক্লিওপেট্রা ছিলেন প্রাচীন মিশরীয় টলেমিক বংশের সদস্য । মহামতি আলেকজান্ডারের একজন সেনাপতি আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর মিশরে কর্তৃত্ব দখল করেন ও টলেমিক বংশের গোড়াপত্তন করেন । এই বংশের বেশিরভাগ সদস্য গ্রিক ভাষায় কথা বলতেন, এবং তাঁরা মিশরীয় ভাষা শিখতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন । ক্লিওপেট্রা মিশরীয় ভাষা শিখেছিলেন এবং নিজেকে একজন মিশরীয় দেবীর পুনর্নজন্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন ।
১৮ বছর বয়সে মিসরের সম্রাজ্ঞী হলেন সপ্তম ক্লিওপেট্রা । মিসরীয় নিয়ম অনুযায়ী অষ্টাদর্শী ক্লিওপেট্রা (ফিলোপেটর) তার ছোট ভাই ১০ বছর বয়সী ত্রয়োদশ টলেমিকে বিয়ে করে মিসরের রানী হন । কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে ছিল বিরোধ । তখনকার মিসরীয় আইন অনুসারে দ্বৈত শাসনের নিয়মে রানী ক্লিওপেট্রার একজন নিজস্ব সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক ছিল । কাজেই ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করতে হয় তারই ছোটভাই টলেমি-১৩কে, যখন তার বয়স ১২ বছর ।
তখনকার মিশরীয় আইনে ক্লিওপেট্রার একজন আপন সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক ছিল যে কিনা স্বামী, ভাই বা পুত্র যে কেউ হলেই চলতো । ইতিহাসে ক্লিওপেট্রার জীবনে বহু পুরুষের আগমন ঘটেছে , তদ্মধ্যে রোমান বীর জুলিয়াস সিজার, এন্টোনি, হার্মাসীস উল্লেখযোগ্য । ক্লিওপেট্রা নিজের ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য নিজের রূপ-কে কাজে লাগিয়েছেন বারংবার । ক্লিওপেট্রা রূপেও ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী ।
অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা উইলিয়াম শেকসপিয়র রচিত একটি বিয়োগান্তক নাটক ।
১৬২৩ সালের ফার্স্ট ফোলিওতে প্রথম এই নাটকটি মুদ্রিত হয় । এই নাটকে পার্থিয়ান যুদ্ধ থেকে ক্লিওপেট্রার আত্মহত্যা পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ রয়েছে । কেউ কেউ মনে করেন এই নাটকে ক্লিওপেট্রার ভূমিকাটি শেকসপিয়রের নাটকে সর্বাপেক্ষা জটিল নারীভূমিকা । মার্ক অ্যান্টনি মিসরে ক্লিওপেট্রাকে আক্রমণ করতে আসেন এবং তিনি ক্লিওপেট্রার প্রেমে পড়েন । তাদের যমজ সন্তান হয় ।
এদের একজন আলেকজান্ডার হেলিয়স ও অন্যজন ক্লিওপেট্রা সেলেনি । মিসরের সিংহাসন লাভের জন্য অ্যান্টনি খ্রিস্টপূর্ব ৩৬ অব্দে ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করেন । কিন্তু অ্যান্টনি ছিলেন বিবাহিত, তার স্ত্রী ছিলেন সিজারের উত্তরাধিকারী অক্টাভিয়াসের বোন । ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর তার পুত্র সিজারিঅনকে কতিপয় রোমান সিনেটরের ইঙ্গিতে গলাটিপে হত্যা করা হয়, যখন তার বয়স ছিল ১৭ বছর ।
সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশীত হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের ক্লিওপেট্রা বইটির বাংলা অনুবাদ ।
অনুবাদক চমৎকার অনুবাদ করেছেন স্বাবলীল শব্দচয়নে । মিসর সাম্রাজ্যের টলেমি বংশের শেষ সম্রাজ্ঞী ছিলেন সপ্তম ক্লিওপেট্রা ফিলোপেটর । দ্বাদশ টলেমির (নিয়োজ ডায়োনিসাস) তৃতীয় কন্যা ক্লিওপেট্রা ছিলেন অতি বুদ্ধিমতী ও বিদ্বান তবে শিথিল নৈতিকতাসম্পন্ন নারী । তার শরীরে ছিল গ্রিক রক্ত । মিসরের টলেমি বংশে ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার প্রথম মিসরে আধিপত্য স্থাপন করেন আর তার ইতি টানলেন সপ্তম ক্লিওপেট্রা ।
ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রাচীন মিশরীয় ফারাও যুগের অবসান ঘটে যদিও তিনি ছিলেন মেসিডোনিয়ান । মিশরে রোমান শাসনকাল শুরু হয় । টলেমীয়রা মেসিডোনিয়ান হয়েও মিশর শাসন করেন। আর ক্লিওপেট্রা ছিলেন সর্বশেষ ফারাওহ্ । অসীম সুন্দরী ক্লিওপেট্রা ছিলেন বহু গুণে গুণান্বিত এক রমণী ।
তার অনেক গুণের মধ্যে ছিল প্রখর বুদ্ধিমত্তা আর মাতৃভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা । আচার-আচরণের দিক থেকে ক্লিওপেট্রা ছিলেন অনেকটাই সহজ-সরল প্রকৃতির । ক্লিওপেট্রা নয়টি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন । শুধু তাই নয়, তিনি একজন গণিতজ্ঞ ও ভালো ব্যবসায়ীও ছিলেন । অন্যকে আকর্ষণ করার মতো সহজাত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল ক্লিওপেট্রার ।
জন্মগতভাবেই তিনি ছিলেন নেতৃত্ব গুণের অধিকারী ।
৪৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ক্লিওপেট্রা যখন রোমে অবস্থান করছিলেন আর একজন রানী হয়ে তারই অধস্তন এক জেনারেলের সঙ্গে রাজপ্রাসাদে একত্রে বসবাসের কারণে চারদিকে কানাঘুঁষা শুরু হলো । এর মধ্যেই ঘটে গেলো আরেক আশ্চর্য ঘটনা । ক্লিওপেট্রার একটি পুত্রসন্তান হলো । আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসীরা তার নাম দিল সিজারিঅন ।
ক্লিওপেট্রা বলতেন, টলেমি সিজার । কিন্তু সিজারের আইনসম্মত উত্তরাধিকারী এবং ভাগ্নে অক্টোভিয়ান এটা মেনে নিলেন না । সিজার অবশ্য প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতে লাগলেন যে, সিজারিঅন তারই সন্তান । বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যুগের মমি ও নানা প্রত্ননিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে । সেই সঙ্গে উঠে এসেছে ইতিহাসের নানা অজানা অধ্যায়ও ।
কিন্তু রহস্যময়ী ক্লিওপেট্রা যেন রহস্যের আধার হয়েই থেকে গিয়েছিলেন । কিন্তু এবার বোধ হয় সেই রহস্যের জাল ছিন্ন হতে চলেছে । মিসরে টাপোসিরিস ম্যাগনা উপাসনালয়েই মিসরের সর্বশেষ ফারাও শাসক ক্লিওপেট্রার সমাধি পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে ।
এন্টনির মৃত্যুর পর একা হয়ে পড়লেন ক্লিওপেট্রা । কিছুদিনের মধ্যেই ক্লিওপেট্রাকে অক্টোভিয়ানের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো ।
সেখানে অক্টোভিয়ান নিজের বিজয়ে ক্লিওপেট্রার ভূমিকা অনেকটাই হাল্কা করে দিলেন । তিনি বলেন, মিসরের রানীর সঙ্গে তার কোনোরূপ সম্পর্ক, সমঝোতা বা বোঝাপড়ার কোনো বিষয় নেই । ক্লিওপেট্রার শাসনকাল শেষ হয়ে গেছে । এখন তাকে ক্রীতদাসী হিসেবে শহরের রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শন করা হবে । তবে এরকম কিছু ঘটার আগেই ক্লিওপেট্রাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করা হলো ।
ক্লিওপেট্রাকে মারার জন্য আনা হলো চরম বিষাক্ত সাপ 'অ্যাসপ' (মিসরীয় কোবরা । একে জীবন-মৃত্যুর ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়)। ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে সেই কোবরাকে আনা হলো ক্লিওপেট্রার সামনে। এই সাপের কামড়েই ৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ১২ আগস্ট ক্লিওপেট্রা মারা গেলেন । মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৩৯ বছর ।
মিসরীয় ধর্মমতে সর্পদংশনে মৃত ব্যক্তিরা হবেন অমর । আর এভাবেই ক্লিওপেট্রা মৃত্যুকালীন ইচ্ছা পূরণ করলেন, যা কেউ কোনোদিন ভুলে যাবে না । আবার আরেকটি মতানুসারে পরাজয়, প্রেমিক এবং রাজ্য হারানোর শোকে ক্লিওপেট্রা তার ব্যক্তিগত কক্ষে একটি সাপ আনিয়ে আত্মহত্যা করেন । সে সময়ে তার সঙ্গে দুই সহচরও আত্মহত্যা করেন । ইতিহাস বলে, ক্লিওপেট্রার সঙ্গে তার দুজন সখী বা সহচরীও মারা যান ।
কিন্তু একটি সাপই যে তিনজনের মৃত্যুর জন্য দায়ী বা সেখানে তিনটি সাপ আনা হয়েছিল কিনা সেটাও চিন্তার বিষয় ? এমনও সন্দেহ ওঠে, সেই সাপটি আসলেই বিষাক্ত ছিলো কিনা, আর সাপরে কামড়েই যে তিন নারীর মৃত্যু হয়েছে সেটাই বা নিশ্চিত করা গেলো কিভাবে ? তাছাড়া যে সাপটির কথা ইতিহাসে বলা হয়েছে, তার সঙ্গে অ্যাসপ বা মিসরীয় গোখরো সাপের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়, যা সাধারণত ৬ ফিট লম্বা হয়ে থাকে ? এ ধরনের একটি সাপকে সেই কক্ষে আনা হলেও তার জন্য যে ধরনের বড় ঝুড়ি বা পানির জগের প্রয়োজন হয় তা সেখানে ছিল না ।
মার্টিনেজ বলেন, তিনি ১৪ বছর ক্লিওপেট্রা সম্পর্কে পড়াশোনা করেছেন এবং তার বিশ্বাস, ক্লিওপেট্রার মৃত্যু ছিল একটি ধর্মীয় ঘটনা এবং ভাইপার জাতের ক্ষুদ্র বিষধর সাপের দংশনে তিনি মারা গিয়েছিলেন । এছাড়া তাকে এই মন্দিরেই সমাহিত করা হয়েছিল । রোমান ঐতিহাসিক প্লুটার্কের লেখাতেও এটা রয়েছে, যে ক্লিওপেট্রাকে এন্থনির সঙ্গেই সমাহিত করা হয়েছিল । তবে সত্যি তারা এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে ।
যদি সত্যি তাই হয় তাহলে এই টাপোসিরিস ম্যাগনা সারাবিশ্বের প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য সেটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে । সেই সঙ্গে ক্লিওপেট্রার রহস্যময় জীবন আর তাকে নিয়ে রটনা-ঘটনারও অনেক সত্য প্রমাণ বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা করছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা ।
ক্লিওপেট্রার এই ব্যক্তিত্ব, রূপ, গুণাবলীর কাহিনী সমগ্র আফ্রিকা, মধ্যএশিয়া ও ইউরোপজুড়ে বিগত দুই হাজারেরও বেশি বছর যাবত ঘরে ঘরে আলোচনার বিষয় হয়ে আছে । নাটক, থিয়েটার, গল্প, উপন্যাস, মডেলিং, চলচ্চিত্র এমনকি মেয়েদের ব্যক্তিগত স্টাইল ও রূপচর্চ্চার ক্ষেত্র পর্যন্ত দখল করে আছে ক্লিওপেট্রা । আর এভাবেই ক্লিওপেট্রা সর্বকালের সৌন্দর্য্যের শ্রেষ্টতম প্রতীক হয়ে রইলেন ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।