হুমায়ন একটা টাউট আজ তা আবার প্রমাণিত হলো। সাথে আছে সেই চেনা প্রথম আলো আর সৈয়দ মনজুরূল ইসলাম।
এরা সুপরিকল্পিতভাবে ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযু্দ্ধকে বিকৃত করে আসছে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যা সম্পর্কিত ভুল ও আপত্তিকর তথ্য সংশোধন না করা পর্যন্ত জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ উপন্যাস প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে কেন ভুল সংশোধনের নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিষয়টি আদালতের নজরে আনলে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে মঙ্গলবার এ আদেশ দেন।
১২ দিনের মধ্যে তথ্যসচিব ও শিক্ষা সচিবকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এরই মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘দেয়াল’ উপন্যাসের দুটি অধ্যায় প্রকাশ করেছে দৈনিক প্রথম আলো তার শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকীতে।
একই সঙ্গে উপন্যাসটির ওপর প্রশস্তিমূলক একটি নিবন্ধও প্রকাশ করা হয়েছে যা লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
উপন্যাসটির দুটি অধ্যায় প্রকাশিত হওয়ার পর ফেসবুক-টুইটার-ব্লগসহ স্যোসাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে।
তাদের অভিমত একটি দৈনিক সংবাদপত্র ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়ে লেখা এমন একটি উপন্যাস প্রকাশ করে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়ই দিয়েছে।
ঘৃণার দেয়াল গড়বেন না প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ
ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর
বিদগ্ধ পাঠক সমাজের অনেকের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখি নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। হুমায়ূন সাহিত্য নিয়ে অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ স্যার একবার আমাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ওতো স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা ছেলেপেলে, বুয়া এদের জন্য লিখে’।
আমি অবশ্য হুমায়ূন আহমেদকে অন্যভাবে দেখি। লেখালেখিতে অভাবিত শক্তি-নৈপুন্য-মুন্সিয়ানার গুণে তিনি বাংলাদেশের পড়াশুনার জগতকে আমুল পাল্টে দিয়েছেন।
আমাদের ছেলেবেলায় আমরা দস্যু বনহুর, কুয়াশা, মাসুদ রানা এসব পড়তাম। আর আজকের তরুণরা হুমায়ূন আহমেদ দিয়ে শুরু করেন। এক সময় বাংলা একাডেমীর একুশের বইমেলা কলকাতাকেন্দ্রিক লেখকদের বইয়ের দাপটে ঠাসা ও নির্ভরশীল ছিল। হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, জাফর ইকবাল, সেলিনা হোসেন, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, তসলিমা নাসরিনদের আবির্ভাব ও বিকাশের পর সে ধারা পালটে গেছে। এখন বইমেলায় পাঠকরা ভিড় করে এদের বই কিনে পড়েন।
মেলায় হুমায়ূন আহমেদ যেদিন যে স্টলে বসেন সেদিন সে স্টলের সামনে অটোগ্রাফ শিকারিদের লম্বা লাইন পড়ে যায়। বাংলাদেশের প্রকাশনা ব্যবসা, অনেক প্রকাশনা এদের লেখালেখি-বইয়ের ওপর নির্ভরশীল। যে যেভাবেই দেখুন না কেন, এসব অর্জন কিন্তু একেবারেই ফেলনা নয়।
লেখালেখির মাধ্যমে নিজের জীবনও পালটে গেছে হুমায়ূন আহমেদের। শুধু লেখালেখি আর বই বিক্রির টাকায় যে ভালো থাকা যায়, বাংলাদেশে সে এই বিশ্বাসটিও তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আমি বাংলাবাজারে গেলে আমার এক প্রকাশক প্রথমে জানতে চাইতেন, ভাত খাবো কীনা! না বললেও জোর করে কোন ভাতের হোটেলে নিয়ে যেতে চাইতেন। তখন মনে হতো প্রকাশকদের ধারণা লেখকদের পকেটে ভাত খাবার টাকাও নিয়মিত থাকে না!
আমাদের দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-পেশাজীবীরা লেখালেখিসহ নানাকিছুতে পরিচিত-জনপ্রিয় হয়ে গেলে শিক্ষকতা বা পেশার মূল জায়গাটি বাদ দিয়ে জনপ্রিয়তার জায়গাটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। শিক্ষকতা বা পেশার মূল জায়গাটিকে অবহেলা করেন, এভাবে ছাত্রদের ঠকান। হুমায়ূন আহমদ কিন্তু তা করেননি। লেখালেখি, টিভি নাটক-চলচ্চিত্র এসবের ব্যস্ততার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটিই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।
মৌলিক লেখালেখির পাশাপাশি কলাম লিখেন পত্রপত্রিকায়। ক্রিকেট থেকে শুরু করে নানান বিষয় থাকে তার কলামে। খুবই সহজ সরল প্রকাশ ভঙ্গি ও হিউমারের কারণে তার এসব কলাম পাঠকরা গোগ্রাসে গেলেন। এক সময় বলা হতো আব্দুল গাফফার চৌধুরী যেদিন যে পত্রিকায় কলাম লিখতেন সে পত্রিকার কাটতি বেড়ে যেত। এখন সে অবস্থা হুমায়ূন আহমেদের।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য আমেরিকাবাসী হয়ে যাওয়াতে গত বইমেলার সময় তিনি দেশে এবং মেলায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। কিন্তু তার লেখালেখি, বই প্রকাশ, মেলায় সর্বোচ্চ বিক্রিত বইয়ের তালিকা থেকে তার নাম মুছে দেওয়া বা যাওয়া--- এসবের কোনোটাই ঘটেনি।
আমেরিকায় হুমায়ূন আহমেদের যেখানে চিকিৎসা চলছে সেটি কতটা ব্যয়বহুল তা ওয়াকিফহালরা জানেন। কিন্তু কোথাও টাকার অভাবে তার চিকিৎসা আটকে থাকেনি বা কারও কাছে হাত পাততে হয়নি। এর কারণ তার পাঠকপ্রিয়তা, বই বিক্রি, লেখালেখির আয়।
গত বইমেলায় তার বই বিক্রি অব্যাহতভাবে শীর্ষে থাকার পেছনে বিদেশে তার চিকিৎসাব্যয় নিয়ে তার পাঠক মানসের সাপোর্টের বিষয়টিও কাজ করে থাকতে পারে। এমনিতে আমাদের দেশের গড়পড়তা প্রায় সব মানুষ বা সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো ক্যান্সারের মতো ঘাতকব্যাধির পাল্লায় পড়লে ব্যয়বহুল চিকিৎসার টাকা কী করে জোগাড় হবে সে দুশ্চিন্তাতেই অর্ধেক মরে যান। সাবিনা ইয়াসমিন, আজম খানের চিকিৎসার টাকার জন্যেও মানুষের কাছে হাত পাততে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ ভাগ্যবান। তার চিকিৎসাসহ সবকিছু যে ঠিকমতো চলছে এর বড় কারণ তার পাঠক।
পাঠকের শক্তি। সাপোর্ট।
হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখি নিয়ে তার নিজস্ব সরল কিছু স্বীকারোক্তি আছে। যেমন একবার নিজেই বলেছেন, তিনি টাকার জন্য লিখেন। আবার এক জায়গায় বলেছেন, গল্পটা মানুষের পাঠ উপযোগী করে লিখতে হয়।
পাঠক যে কোনকিছু গড়পড়তা একটি সরলরেখায় চিন্তা করে। সে চিন্তায় তার লেখা এগোলেও হঠাৎ করে বিপরীতমুখী চিন্তার পথে গল্পটা এগিয়ে নিয়ে গেলে প্রথম পাঠকের খটকা লাগলেও পরে সে ধারাটিকে পছন্দ করে সে। এভাবেই একটি বই তথা সাহিত্য জনপ্রিয় হয়।
হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ উপন্যাসটিকে কেন্দ্র করে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তা দেখেশুনে তার বলা সে কথাগুলোই মনে পড়েছে। ‘দেয়াল’ উপন্যাসেও তিনি কী তার লেখালেখির সেই টেকনিকটির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন? যদি তা হয়ে থাকে তাহলে বিপদ।
কারণ দেয়ালের বিষয়বস্তু রাজনৈতিক। ঐতিহাসিক। সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ট্র্যাজিক হত্যাকান্ডটি জাতির আবেগের সঙ্গে জড়িত। এটি কোনো `হিমুসমগ্র` নয়। `দেয়াল’এর যতটা এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাতে বেশ কিছু অসঙ্গতি অথবা ঐতিহাসিক ভুল তথ্য চিহ্নিত করা গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মুক্তিযোদ্ধা বলে উল্লেখ করে তাদের প্রতি এক ধরনের সফট কর্নার বা সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা আছে দেয়ালে। আত্মস্বীকৃত খুনিদের অন্যতম মেজর ফারুক যুদ্ধের শেষ দিকে এসে পক্ষ নিলেও সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার সময়-সুযোগ পাননি। কিন্তু তার মুখে বলা হয়েছে, যুদ্ধের গল্প! ফারুককে বলা হয়েছে পীর বংশের ছেলে, তৎকালীন গদিনশীন পীর একজন! কিন্তু সেটি তিনি না, তার ভায়েরা ভাই আরেক আত্মস্বীকৃত পলাতক খুনি রশীদ। শিশু রাসেলের হত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে সে শেখ কামাল, শেখ জামালের স্ত্রীদের কক্ষে একটি আলনার পিছনে লুকিয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে স্বীকৃত, আদালতে নথিভূক্ত তথ্যটি হচ্ছে, শিশু রাসেল আশ্রয় নিয়েছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের একজন গৃহপরিচারিকা রমার কাছে।
তাকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পেয়ে টুঙ্গিপাড়ার গ্রামবাসী তার গ্রামের বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়ির সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়! হুমায়ূন আহমেদ কোনোদিন টুঙ্গিপাড়া গেছেন কীনা, সেখানকার গ্রামবাসীর সঙ্গে ঘটনা নিয়ে কথা বলেছেন কীনা তা আমার জানা নেই। কিন্তু এ সংক্রান্ত রিপোর্ট করতে বিভিন্ন সময়ে আমি সে গ্রামে গিয়েছি, এবং যত গ্রামবাসী লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের কেউ কিন্তু কখনও এ রকম তথ্য বলেননি। এমনকি টুঙ্গিপাড়া-গোপালগঞ্জ বিএনপির কোনো নেতাকর্মীও না। এখন একজন বিদেশি লিখেছেন বলে তা নিজের দেশে যাচাই’র সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা হুবহু লিখে দেওয়া কী তার মাপের একজন লেখকের ঠিক হয়েছে?
আমি এক বিদেশি পর্যটক-লেখকের লেখায় এক সময় কিছু হাস্যকর অসঙ্গতি দেখেছিলাম।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল ঘুরে তিনি তার লেখায় লিখেছিলেন, দেশটি গরিব হলেও গ্রামের কৃষক যুবকেরা জিন্সের প্যান্ট পড়ে হালচাষ করে! গ্রামের এক বাড়িতে গিয়ে সে লেখক বিয়ারের ক্যান দিয়ে তৈরি কুপি জ্বলতে দেখেন। সে লেখক তার লেখায় লিখেছিলেন, বাংলাদেশের গ্রামবাসী লোকজন এত বিয়ার খায় যে তাদের ঘরের কুপি দেখেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়!
আসলে ওই পর্যটক-লেখক যা দেখেছেন তা নিয়ে উপযুক্ত লোকের সঙ্গে কথা বলে যাচাই না করে লেখাতেই এ ধরনের অসঙ্গতি ঘটেছে। লুঙ্গির চেয়ে পুরনো কাপড়ের মার্কেটের জিন্সের প্যান্ট যে দামে সস্তা তা ঠিকমতো আলাপ করে লিখলে এমন ঘটতো না। আমি যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের গ্রামজীবন চিনি-জানি সে কারণে অসঙ্গতির বিষয়টি ধরতে পারি। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তেমন লিখে থাকলে তা নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুর খুনি কোনো পক্ষের বলা তথ্যে লিখেছেন।
বিভিন্ন সময়ে তিনি বাংলাদেশ সফর, এখানে কাজ করলেও তিনি কখনো টুঙ্গিপাড়া গেছেন বা সেখানকার গ্রামবাসী কারও ইন্টারভ্যু করেছেন, এমন কোন তথ্য তার কোনো লেখায় পড়েছি বলে মনে পড়ে না। এমন তথ্য যাচাই’র সুযোগ হুমায়ূন আহমেদের থাকলেও তিনি বিষয়টির যাচাই করে না থাকলে এ ব্যাপারে তার আত্মপক্ষ সমর্থনে কী বলার আছে জানতে ইচ্ছে করে।
হুমায়ূন আহমেদের লেখাটি নিয়ে এর মাঝে অনলাইনে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ব্লগে আলোচনা-সমালোচনার ধুম লেখেছে। প্রিয় ব্লগারদের একজন অমি রহমান পিয়াল এ ব্যাপারে বাংলানিউজেও লিখেছেন। অনেকে এমনও বলছেন, লেখক যে উদ্দেশে বইটির দু’কিস্তি বাজারে ছেড়েছেন তাতে তার উদ্দেশ্য সফল! এতে করে তার এই বইটিরও বাজার কাটতির অগ্রিম নির্ধারিত হয়ে গেছে! ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃতির অভিযোগে বইটির প্রকাশিত অংশ বিশেষ এর মাঝে আদালতে নিয়ে গেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
আদালত থেকে এ ব্যাপারে হয়তো একটি সিদ্ধান্ত আসবে। কিন্তু আমি বিষয়টি রাখতে চাই হুমায়ূন আহমেদের বিবেকের আদালতের কাছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে হুমায়ুন আহমেদ ‘দেয়াল’ নামের উপন্যাস লিখছেন, এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের অনেকের মতো আমিও অপেক্ষায় ছিলাম। তিনি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তার মাপের লেখকের কাছে এ নিয়ে উচ্চাশার যৌক্তিক অনেক কারণ আছে।
মুক্তিযুদ্ধ তার উপন্যাস-নাটক-চলচ্চিত্রে আগেও এসেছে। তার নাটকে ময়না পাখির মুখে বলানো ‘তুই রাজাকার’ দেশজুড়ে কী বিশাল প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল, তা রাজাকার-স্বাধীনতাবিরোধী আর তাদের পরিবারের লোকজন জানে। কিন্তু এ কথাও সত্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার কোনো লেখা তারই অনুজ জাফর ইকবালের ‘আমার বন্ধু রাসেল’ এর মতো এতটা সর্বজনসমাদৃত বা ইতিহাসনিষ্ঠ হয়নি। ছেলেবেলার বন্ধু রাসেলের কথা বলতে গিয়ে যেন গোটা মুক্তিযুদ্ধের গল্পটিই একনিষ্ঠভাবে বলে গেছেন জাফর ইকবাল।
হুমায়ূন আহমেদ হয়তো বলতে চাইবেন ‘দেয়াল’ একটি উপন্যাস।
ইতিহাস গ্রন্থ নয়। কিন্তু দেয়ালের ঘটনা-চরিত্রসমূহ, নায়ক-ভিলেন এরাতো সব রাজনৈতিক-সামরিক-বেসামরিক এবং ঐতিহাসিক। তাই এটি লিখতে গিয়ে ইতিহাসের বিচ্যুতি-অসঙ্গতি কাম্য নয়।
একটি ঘটনা একেকজন একেকরকম বলতে পারেন। হুমায়ূন আহমেদ তার লেখায় অনাবিষ্কৃত-অলিখিত নতুন তথ্যও দিতে পারেন।
কিন্তু তা হতে হবে বিশ্বস্ত তথ্য নির্ভর। বিদেশি কারও তথ্য ব্যবহার করলে সেটির সত্যতা দায়িত্বশীল সূত্রগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে যাচাই করে নেওয়া যায়। তেমন যাচাইয়ের সুযোগ তার আছে। তিনি যদি সে সুযোগটি না নিয়ে থাকেন অথবা নিতে না চান, তাহলে তা কিন্তু গড়বে ভিন্ন এক দেয়াল।
বাংলাদেশের জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটির ইতিহাস বিকৃতির দায়ে পড়বেন তিনি।
সে দায় কিন্তু এড়াতে-উপড়াতে পারবেন না। এ অবস্থায় দেয়ালের বাণিজ্যিক সফলতার অর্থে হয়তো তার চিকিৎসাব্যয় মেটানোর আরেকটি বড় উৎসের সৃষ্টি হবে! কিন্তু এমন উৎসের টাকায় নিজের জীবন বাঁচানোর চিকিৎসার কাজে লাগাবেন না প্লিজ, প্রিয় হুমায়ুন আহমেদ! আপনার তো অনেক আছে। আপনাকে আমরা যারা পছন্দ করি-ভালোবাসি সেখানে দাঁড় করাবেন না কোনো ঘৃণার দেয়াল।
আশা করি, দ্রুত বিষয়টি নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়ে দেশের মানুষের কাছে আপনি আপনার অবস্থান স্পষ্ট করবেন।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১০৩০ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১২
হুমায়ূন আহমেদ, দেয়াল এবং দায়মুক্তি…
অমি রহমান পিয়াল, অতিথি লেখক
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
হুমায়ূন আহমেদ ঠোঁটকাটা লোক।
বেস্ট সেলার তালিকায় ধারাবাহিক অধিষ্ঠানের সময়ই এক স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন যে, তিনি টাকার জন্য লেখেন। তিনি গল্প বলেন, গল্প লোকে পছন্দ করে, সে গল্পের তুমুল কাটতি। ব্যাপারটা এ পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু গোল বাধলো যখন তিনি ইতিহাস নিয়ে গল্প বানাতে শুরু করলেন।
একাত্তরভিত্তিক তার অনেক বইয়ের একটি ‘জোছনা ও জননীর গল্প’।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই উপন্যাসে অনেক চরিত্র ঐতিহাসিক; তাদের অস্তিত্ব এখনও জাজ্বল্যমান আমাদের চেতনায়। হুমায়ূনের পাঠকশ্রেণী ওই নন-ফিকশনাল ফিকশনের তফাৎটা ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা এটাকে সত্যিকার ইতিহাস মেনেছেন। এর মধ্য দিয়ে হুমায়ূন একটি চরম বিতর্কিত কাজ করেছেন যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে গেছে।
প্রথমত তিনি উল্লেখ করেছেন ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলেছেন।
এটি প্রমাণিত মিথ্যাচার। এর স্বপক্ষে কয়েকজন ঘুনেধরা রাজনীতিক এবং স্বাধীনতাবিরোধী বুদ্ধিজীবী ছাড়া কারো সোচ্চার দাবি নেই। এবং তারা এর পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেন নি। সেই সমাবেশে উপস্থিত আরো লাখো শ্রোতার কেউ তাদের এই দাবির সত্যতাকে সমর্থন করেননি। দ্বিতীয় যে অন্যায়টি করেছেন, তা তার সেই উপন্যাসের খলচরিত্রটির যাবতীয় অপকর্ম (পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে) বর্ণনার পরও তার জন্য একটা সফট কর্নার তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন।
সুবাদে যা দাঁড়িয়েছে তার ফলে পাঠকদের একটা বড় অংশ শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি মানে; কারণ হুমায়ূন লিখেছেন শেখ মুজিব নাকি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলেছেন তার ভাষণে।
অন্যদিকে রাজাকারিতার চূড়ান্ত করার পরও সেটা যে নিতান্তই পরিস্থিতির চাপে করা হয়েছে এমন একটা ধারণারও জন্ম দিয়েছেন হুমায়ূন। অনলাইন ফোরামগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-বিকৃতি রোধে আমাদের যে নিত্য লড়াই, তাতে বিপক্ষ শক্তির একটা বড় অবলম্বন এখনও ‘জোছনা ও জননীর গল্প’।
হুমায়ূন ক্যান্সার আক্রান্ত, চিকিৎসা চলছে। এর মধ্যেই তিনি ঘোষণা দিয়ে লিখছেন ‘দেয়াল’ নামে একটি উপন্যাস।
এটিও রাজনৈতিক উপন্যাস, এবং এর পটভূমি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড। এ বিষয়ে এরই মধ্যে প্রমোশনাল কাজকর্ম চলছে। একটি পত্রিকা তার সেই প্রকাশিতব্য উপন্যাসের দুটো অধ্যায় ছাপিয়েছে। সঙ্গে তাদের পোষা বুদ্ধিজীবীদের একজনকে দিয়ে একটি সম্পূরক লেখা ছাপিয়েছে এর ঐতিহাসিক সত্যতা ও মানগত উৎকর্ষের সমর্থনে।
শুক্রবার গোটা দিনটিই ফেসবুক এবং ব্লগগুলো উত্তাল ছিলো এই নিয়ে।
কারণ হুমায়ূন আবারও ইতিহাস-বিকৃতি ঘটিয়েছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যের নির্মম হত্যাকাণ্ডটির পরই এই দেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অধিষ্ঠান ঘটে। রাতারাতি না হলেও ধীরে ধীরে, অনেক বছর ধরে। সে সময়টাতে এই হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করতে যেসব অপপ্রচার চলে সেসবেরই একটি ছিলো হত্যাকারীরা সব মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। নাটের গুরু খন্দকার মোশতাক আহমদ তাদের `সূর্যসন্তান` আখ্যা দিয়ে রীতিমতো ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পাস করিয়ে নেয় যাতে এই খুনীদের কোনোরকম আইনি ঝামেলায় পড়তে না হয়।
তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়।
হুমায়ূনের দেওয়া দায়মুক্তিও সেই অধ্যাদেশের আদলেই হয়েছে। প্রকাশিত ওই নির্বাচিত অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন: … মেজর ফারুক দলবল নিয়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর জঙ্গলে। তাঁর শীতকালীন রেঞ্জ ফায়ারিংয়ের শিডিউল। মার্চ মাসে শীত নেই।
চামড়া পোড়ানো গরম পড়েছে। সকালবেলা মাঝারি পাল্লার কামানে কয়েক দফা গুলি চালানো হয়েছে। জওয়ানরা তাঁর মতোই ক্লান্ত। তিনি সুবেদার মেজর ইশতিয়াককে ডেকে বললেন, আজকের মতো ফায়ারিং বন্ধ।
ইশতিয়াক বলল, স্যারের কি শরীর খারাপ করেছে?
ফারুক বললেন, আই অ্যাম ফাইন।
গেট মি এ গ্লাস অব ওয়াটার।
তাঁর জন্য তৎক্ষণাৎ পানি আনা হলো। পানির গ্লাসে বরফের কুচি ভাসছে। ফারুক গ্লাস হাতে নিয়েও ফেরত পাঠালেন।
ইশতিয়াক বলল, স্যার, পানি খাবেন না?
ফারুক বললেন, না।
একজন সৈনিক সর্ব অবস্থার জন্য তৈরি থাকবে। সামান্য গরমে কাতর হয়ে বরফ দেওয়া পানি খাবে না।
বরফ ছাড়া পানি নেই?
না। মুক্তিযুদ্ধের সময় একনাগাড়ে দুই দিন পানি না খেয়ে ছিলাম।
ইশতিয়াক বলল, পানি ছাড়া কেন ছিলেন, স্যার? বাংলাদেশে তো পানির অভাব নেই।
যেখানে ছিলাম, সেখানে সুপেয় পানির অভাব ছিল। সবই পাটপচা নোংরা পানি। ভাগ্যিস, পানি খাইনি। যারা খেয়েছিল, তারা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সেবার আমাদের হাতে অল্পবয়সী একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ধরা পড়েছিল।
তার সঙ্গে ছিল বোতলভর্তি পানি। দাঁড়াও, তার নামটা মনে করি। এস দিয়ে নাম। ইদানীং কেন যেন পুরোনো দিনের কারোর নামই মনে পড়ে না। যাক, মনে পড়েছে।
শামস। রাজপুত্রের মতো চেহারা। মাইকেল এঞ্জেলোর ডেভিডে খুঁত থাকলেও তার কোনো খুঁত ছিল না। খাঁড়া নাক, পাতলা ঠোঁট, মাথার চুল কোঁকড়ানো, আবু লাহাবের মতো গায়ের রং। …
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র, সেনাবাহিনীর দলিলপত্র, কোথাও ফারুক রহমান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত নন।
তিনি কলকাতায় রিপোর্ট করেছেন ১২ ডিসেম্বর। তখন ঢাকা-কিশোরগঞ্জ-খুলনা বাদে প্রায় পুরো দেশই স্বাধীন। বিজয়ের চারদিন আগে তাকে আর যুদ্ধে যোগ দেওয়ার কষ্ট করতে হয়নি। নভেম্বরে যোগ দিয়েছিলেন তারই ভায়রাভাই এবং খুনের সহযোগী কুচক্রী কর্নেল রশীদ। হুমায়ূন এই ফারুককে দিয়ে রূপবান একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে হত্যা করিয়েছেন, যে ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে প্রচুর ধর্ষণের অভিযোগ এবং সেসব ধর্ষণে সে বিকৃত মানসিকতার নজির রাখতো।
দুদিন পানি না খেয়ে থাকা ফারুকের জীবন বাঁচানোর পরও সে তাকে মারতে দ্বিধা করে না। তো ফারুক একজন টাফ গাই, নীতিবান মুক্তিযোদ্ধা! এইভাবেই মিথ্যা ইতিহাস দিয়ে একজন কুখ্যাত খুনীর প্রতি তার সরল পাঠকদের মধ্যে মমতার বোধ জাগানোর অপপ্রয়াস নিয়েছেন হুমায়ূন।
বিকৃতি আরো আছে। এর মধ্যে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকেও টানা হয়েছে যেন হাটহাজারির ঘটনা মাসকারেনহাসকে বলেছেন ফারুক। এই পুরা টুইস্টটা আমাদের ইতিহাসের জন্য একটা বিপজ্জনক বার্তা।
কারণ এই দেশের রাজনীতি এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তিতে বিভক্ত। সেই বিভক্তিতে এই বিকৃতি একটি ভয়ংকর উপাদান হয়ে শক্তিশালী করবে স্বাধীনতাবিরোধীদের যাবতীয় অপপ্রচারকে। অল্পতেই বিভ্রান্ত উঠতি প্রজন্ম এদের যাবতীয় মিথ্যাচারকেই সত্য ভাববে।
যে প্রকাশনী ও যে পত্রিকাটির তরফে হুমায়ুন এত লাইমলাইট পাচ্ছেন তাদের অভিসন্ধি এই সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে গত ক’বছর ধরেই সন্দেহজনক। সম্প্রতি অদিতি ফাল্গুনী নামে এক লেখিকা এক কল্পিত মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরিকে উপন্যাস বানিয়ে ইচ্ছামতো স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের পরিস্থিতির বিকৃত উপস্থাপন করে সেই পত্রিকা-প্রবর্তিত পুরস্কার জিতে নিয়েছেন।
সেই পত্রিকায় কর্মরত একজন নামী লেখকও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন এবারের বইমেলায় এবং তিনিও বিভ্রান্তির কৌশল নিয়েছেন। তো পরিকল্পিত এই প্রোপাগান্ডায় সর্বশেষ অন্তর্ভুক্তি হুমায়ূন।
এই বই লিখে হুমায়ুন কি তার চিকিৎসাব্যয়ের নির্ভরতা পাবেন? স্রেফ টাকার জন্য একটা দেশের ইতিহাসের বিকৃতিতে ভূমিকা রাখবেন? প্রশ্নগুলো উঠছে, কারণ ঘটনাক্রম তা সমর্থন করছে। হুমায়ুন আমাদের সেরা সম্পদদের একজন, কিন্তু তিনিও যদি নিজেকে এভাবে বিকিয়ে দেন তখন আমাদের আস্থার জায়গাগুলো বড্ড দুর্বল হয়ে পড়ে। তার ভক্তদের একাংশ তার হয়ে লড়েছেন আমাদের অভিযোগের বিপরীতে।
তাদের কথা কয়টা অধ্যায় পড়েই আমরা অতিরিক্ত স্পর্শকাতর প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলেছি। পুরোটার জন্য অপেক্ষা করা উচিত। রাজনৈতিক কেউ কেউ তো বললেন, আরে মেনে নেন এটুকু, সামনে জিয়াকে ধুয়ে দিয়েছে, ভাসানী ওসমানী কেউ বাদ পড়েনি! এসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। অন্যায় হচ্ছে, মিথ্যাচার হচ্ছে, বিকৃতি হচ্ছে তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ মিলেছে, প্রমাণ দিয়েই তা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর ভাত সেদ্ধ হলো কিনা সেটা জানতে গোটা হাঁড়ি হাতাতে হয় না, দুয়েকটা চাল টিপলেই যথেষ্ট।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।