যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবী করছি গতকালের পোষ্টে রাজনৈতিক সংহিসতার বিচার বিষয়ে কথা বলার সময় যথারীতি একদল আওয়ামী বিএনপি ইত্যাদিতে আলোচনা টেনে নিয়ে গিয়ে যুক্তি দেখাচ্ছিলো যেহেতু আগের বিচার হয়নি - তাই এই বিষয়ে
কথা বলে লাভ নেই। বিষয়টা অনেকটা এমন যে একই অপরাধ আওয়ামীলীগ করেছে - সুতরাং বিএনপি করলে দোষ কি!
কিন্তু এখানে একটা বিষয় লক্ষনীয় - যা বিএনপির সমর্থকরা এড়িয়ে যেতে চায় - ফলে এদের আলোচনা সমালোচনার কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠে বিরোধী পক্ষ - তা হলো ক্যান্টম্যান্টের জন্মে নেওয়া দলটি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী সময় ক্ষমতায় থাকলেও একটা গনতান্ত্রিক দল হিসাবে বিকশিত হতে পারেনি। এর সবচেয়ে বড় লক্ষন হলো - এরা গনতন্ত্রের প্রধান স্থম্ভ "আইনের শাসন" বিষয়ে উদাসীন এবং বিশেষ করে "বিচার" প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী না। এদের দীর্ঘ শাসনামালে এর সবচেয়ে উপেক্ষা করেছে "বিচার" বিষয়টিকে।
সেই আলোচনায় বিএনপির আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা এবং উদাসীনতার কিছু উদাহরন দিয়েছিলাম -
১) দালালদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের মাধ্যেম জেনারেল জিয়া ৩০ লক্ষ শহীদদের সাথে প্রতারনা করেছেন।
মানবতার বিরুদ্ধে এতো বড় অপরাধ করেও অনেকে জিয়ার রাজনৈতিক সংগী হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাশীন হয়েছে (যেমন শাহ আজিজুর রহমান, জুলমত আলী, আব্দুল আলীম ইত্যাদি)।
২) ১৫ই আগস্ট আর ৩ নভেম্বরের হত্যাকান্ডের বিচার তো দুরে থাক - খুনীদের পুরষ্কৃত করা হয়েছে। তাদেরকে বিচারের থেকে বাঁচানোর জন্যে ইনডেমনিটি দেওয়া হলো। যা প্রচলিত ক্রিমিনাল আইন এবং সামরিক বাহিনীর আইনে স্থবির করা হয়েছে। বিচার প্রার্থীদের বিচারে বাঁধা দিয়ে মানবাধিকার লংঘন করা হয়েছে।
৩) ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে জিয়া সেনা/বিমানবাহিনীর অফিসার আর সৈনিকদের গোপনে হত্যা করা হয়েছে - এখানে আইনের শাসনকে পুরোপুরী উপেক্ষা করা হয়েছে।
৪) জিয়ার একক সিদ্ধান্তে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে এড়িয়ে তাহেরের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ন প্রহসন করে।
জিয়ার মৃত্যুর পর তার দল একই ধারা অব্যহত রেখেছে -
৫) জিয়ার হত্যাকারী হিসাবে কোর্ট মার্শাল করে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে - (একজন প্রেসিডেন্ট হত্যার পর হত্যাকারীরা পুরষ্কৃত হলো আর আরেক জন্যে হত্যায় ন্যায় বিচার বঞ্চিত হলো)। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত করা হয়নি বা কোন রকমের আত্নপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। যা আইনের শাসনের পরিপন্থী।
৬) জে. মঞ্জুরকে হত্যা করে জিয়ার হত্যাকারী এবং ষড়ডন্ত্রকারীরা পার পেয়ে গেলো - তার জন্যে যে মামলা হয়েছে - খালেদা জিয়ার সরকারের প্রবল অনীহায় সেই মামলার মৃত্যু হলো। এই বিষয়ে পরবর্তী দুই টার্মের ক্ষমতায় আসা বিএনপি তদন্ত করা বা সত্য বাহির করার কোন আগ্রহ দেখায়নি। যদিও জনগনকে সত্য জানানো আইনের শাসনের অংশ।
৭) বিচার বিভাগকে এড়িয়ে "অপারেশন ক্লিন হার্ট" পরিচালনা করে অর্ধশতাধিক মানুষকে হত্যা করে বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি দেওয়া হলো। বিচার প্রার্থীদের আবারো বিচার চাইতে বাঁধা দিয়ে আইনের শাসনকে উপেক্ষা করা হলো।
৭) বিচার বিভাগকে এড়িয়ে বিনা বিচারের হত্যার দায়িত্ব দিয়ে রেব বানানো হলো। এইটা সুস্পষ্ট ভাবে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। স্বচ্ছতা আর জবাবদিহীতার অভাবে রেব কোন দিনই মানবাধিকারের এবং আইনের শাসনের মাপকাঠিতে গ্রহনযোগ্য বিবেচিত হবে না।
৮) বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে সহিংস ঘটনা ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলার বিচারকে বাঁধাগ্রস্থ করা এবং আসল অপরাধীদের বাঁচানোর জন্যে আলামত ধ্বংশ করা এবং জজ মিয়া নাটক তৈরী হলো।
৯) ১০ ট্রাক অস্ত্র চালানের মামলাকে হাস্যকর ভাবে চার্জসীট দিয়ে একটা লোক দেখানো বিচারের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করা হলো।
১০) শেরাটনের সামনে বাস পোড়ানোর এবং জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মানুষ মারার মামলায় একটা মিথ্যা চার্জশীট দিয়ে বিরোধীদলের উপর দায় চাপানোর জন্যে যে লোককে স্বাক্ষী বানানো হলো - সে সেই সময় রমনা থানায় আটক ছিলো - ফলে মামলাটি মিথ্যা স্বাক্ষীর করনে বাতিল হয়ে যায়।
১১) আনসার -ভিডিপি বিদ্রোহ দমনের জন্যে সেনাবাহিনী ব্যবহার করে নির্বিচারের হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আইনের শাসনকে অবজ্ঞা করা এবং সেই বিষয়ে তদন্ত করার জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির রিপোর্ট জমা না দিয়ে বহাল তবিয়তে ২০ বছর চাকুরী করা।
১২) সিলেটে বৃটিশ হাই কমিশনারের উপর বোমা হামলা বিচারকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা।
১৩) অর্থনীতিবিদ কিবরিয়ার হত্যার মামলার জন্যে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া ( যা মুলত দলীয় কোন্দলের কারনেই করা হয়েছে)। পুরো মামলাটিকে মিথ্যার উপর সাজিয়ে আসল অপরাধীদের বাঁচিয়ে দেওয়া চেষ্টা করা।
১৪) সকল প্রকার রাজনৈতিক সহিংসতা (যেমন ডা: ইকবাল, শাওন, ইত্যাদির ) বিরুদ্ধে বিচার দুরে থাকুক - তদন্ত পর্যন্ত করতে অনীহা।
১৫) ১৯৯১ সালে নির্বাচনে "বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪" কে কালো আইন হিসাবে ঘোষনা দিয়ে তা বাতিলের অংগীকার করলেও ক্ষমতায় এসে তা বাতিল না করে সন্ত্রাস দমন আইন নামে আরেকটা আইন করে পুলিশ এবং প্রশাসনের জন্যে দূর্নীতি অবাধ দ্বারখুলে দেওয়া হয়।
এইগুলা তো জাতীয়ভাবে হাইপ্রোফাইল ঘটনা - স্থানীয়ভাবে হাজার হাজার মামলার এই করুন পরিনতি হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে বিএনপি বেশী সময় দেশ শাসন করেছে এবং বিচারের প্রতি তাদের অনীহা এবং বিচার বিভাগকে নিজেদের দলীয় অনুগত করার জন্যে সার্টিফিকেট জাল করা বিচারপতি নিয়োগের মতো ন্যাক্কারজনক কাজ করেছে।
সুতরাং বাংলাদেশে আজ যে অরাজকতা - আইন মানা বা আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তার দায় অনেকাংশে বিএনপির উপর বর্তায়।
বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে আলাদা করার যে দাবী তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে - সাথে সাথে বিচার বিভাগ এবং শাসন বিভাগকে দলীয় করন করা ফলাফল দেখি জাতীয় পর্যায়ের নেতারও পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়ায়। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার সময় এরাই পারতো এই বিষয়গুলো ঠিক করতে।
সময় এসেছে বিএনপির আত্নসমালোচনা করার। অতীতের ভুল গুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে একটা আধুনিক মধ্যপন্থী গনতান্ত্রিক দল হিসাবে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হউক - যাদের ভোটের জন্যে উগ্রডান আর যুদ্ধাপরাধীদের উপর নির্ভরশীল হতে হবে না আর আদর্শ হিসাবে আওয়ামী আর ভারত ভীতিকে নির্ভর করতে হবে না। জনগন বিএনপির আদর্শ আর কর্মসূচীতে আকৃষ্ট হয়েই বিএনপিকে ভোট দেবে - এন্টি আওয়ামীলীগ ভোটের জন্যে তাদের রেন্টুর ইতিহাস প্রচার করতে হবে না -- সমর্থকরা বিএনপির অতীতের ভুলক্রুটগুলোকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে নিজেদের হাস্যকর মানুষের পরিনত করবে না - বিএপির কর্মীরা ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কথা বলবে না - মুক্তিযুদ্ধকে অবিকৃতভাবে গৌরবের বিষয় হিসাবে ধারন করতে গর্ববোধ করবে - এই আশাই করছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।