স্বপ্নবাজ। একটা রাতের রংধনুর স্বপ্ন দেখি...। -কিঙ্কর আহ্সান রাতের রংধনু (১)
-কিঙ্কর আহ্সান
সাল বলতে ইচ্ছে করছেনা। তারিখটা জুলাই মাসের ছয়। মায়ের মুখে শুনে যতটা কল্পনা করেছি তাতে দৃশ্যটা খুব একটা জোরালো নয়।
আবছায়া সব। তবুও নিজের মত করে চেষ্টা চালাচ্ছি। সেদিন বাইরে তুমুল বৃষ্টি। মেঘগুলো রাগে, ক্ষোভে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছে। শহরের প্রানে- ছোট্ট একাকী একটি বাড়ি।
পানি সরিয়ে নেয়ার পর্যাপ্ত সুবিধে না থাকায় বাড়ির সামনে জমা হয়েছে হাটু সমান পানি। এই অসময়ে প্রবসব বেদনায় কাতর কোন এক রমণীকে নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং সেই সাথে বিব্রত তার স্বামী। বেচারা বদলির চাকরি। এ শহরের কেউই তেমন পরিচিত নয়। মেয়েলি এসব ব্যাপারে তিনি একেবারেই অনভিজ্ঞ।
তার প্রথম সনতান হয়েছিল শ্বশুরবাড়ি। ডাক মারফত তিনি সে সংবাদ পেয়েছিলেন দু'দিন পর। সেবার তিনি নিশ্চিনত ছিলেন। এবার ঝামেলা হয়ে গেল। স্ত্রী কে বারবার বলা সত্বেও সে বাপের বাড়ি যেতে রাজি হয়নি।
সেখানে নাকি ভাইয়ের বউরা অযতœ করে। চৌপর দিন শোনায় নানান কথা।
তার প্রথম সনতান প্রমার চোখে পানি। মেয়েটার বয়স এবার সাতে পড়ল। সে এসব ব্যাপারের সাথে পরিচিত নয়।
কিছুটা আতংক ভর করেছে তার মনে। সে ভাবছে মা তাকে ছেড়ে চলে যাচেছ। অবশ্য চলে যাওয়ার মত যথাযথ কারনও তার শিশু মন তৈরি করে ফেলেছে। গতকাল খালি গায়ে সে খেলার সাথীদের সাথে পুকুরে নেমে স্নান করেছে। পোশাকের প্রতি এমন অবহেলা মা সহ্য করতে পারেনা।
সে যে মেয়ে এবং প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে এটা তাকে পদে পদে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে।
রমণীর আর্তচিৎকার ঝুমঝুম বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। তার স্বামী আর সি'র হয়ে থাকতে পারলেন না। জোরালো বৃষ্টির মধ্যেই ভিজতে ভিজতে বাইরে বেরোলেন যানবাহনের খোজে। পথে কোন যানবাহনের দেখা নেই।
মাঝে মাঝে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে যাওয়া দু-একটা রিকশা চোখে পড়ে। হুড উঠানো সে সব রিকশা আগেই মানব মানবী দ্বারা পূর্ণ হয়ে আছে। তবুও প্রমার বাবা রিকশার ব্যাবস'া করে ফেললেন। একটা নয়, একেবারে দুটো। প্রমা আর তার মা উঠে পড়ল একটা রিকশায়।
তার চিৎকারে এখন কিছুটা বিরতি। মনে হয় ক্লান-। অথবা এটা হতে পারে জ্ঞান হারানোর পূর্ব মুহূর্ত। সাত বছরের মেয়েটি অসাধারন দক্ষতার সাথে তার মাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। প্রমার বাবা পিছনের রিকশায়।
জল কেটে কেটে রিকশার চাকা এগিয়ে যাচ্ছে ধীর গতিতে। এখন বিকেলের শেষ ভাগ। আকাশের কোনো সীমানায় সূর্যের আলোর ছিটেফোটাও নেই। অন্ধকার চেপে বসেছে পরিবেশে। পথের পাশে প্রায় সব দোকানই বন্ধ।
সবকিছুই নীরব, নিথর হয়ে আছে। তার মধ্যে ঝিঝির বেসুরো ডাক বড় কর্কশ হয়ে বাজছে। প্রমারা যখন হাসপাতালে পৌছাল তখন তার মায়ের অবস'া বড্ড খারাপ। নিরীহ, মুমূর্ষু রোগীর আকার ধারন করেছে তার ভঙ্গি। মুখ থেকে ক্ষীন গোঁ-গোঁ আওয়াজ বের হচ্ছে।
পরিসি'তি সামলে নেয়ার ব্যাপারে প্রমার বাবার সুনাম আছে। তিনি এসব ব্যাপারে অত্যন- পটু। দ্রুত অটির ব্যবস'া হল। সাথে ডাক্তার। বাইরে আধার ঘন হয়ে ঘিরে ধরেছে চারপাশটা।
প্রমার বাবা ঘড়িতে সময় দেখলেন। ছয়টা বেজে পঁচিশ মিনিট। দিনের হিসেবে মাত্র সন্ধে নামার কথা। কিন' বাইরে অশরীরা রাত তার ভয়াল থাবা বাড়িয়ে বসে আছে। আজকের এই দিনে আরও কি কি দুর্যোগ নেমে আসে কে জানে।
সুসংবদটা দিলেন ডাক্তার’ই। তার ছেলে হয়েছে। স্বাস'্য অত্যন- ভালো তবে নাকটা লম্বাটে। প্রমার বাবা সংবাদটা শুনে আনন্দিত হলেন কিনা বোঝা গেল না। তবে অটির পাশে দাড়িয়ে আযান দেয়া শুরু করল কর্কশ কন্ঠে।
জোর শব্দে। প্রমা ছুটে গেল মায়ের কাছে। দেখল ফুটফুটে একটা ছেলের হাত পা ছোড়ার চেষ্টা। এ’ই কি তার ভাই! কি সুন্দর ঘ্রান শরীরে। নাক ডুবিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে সারাক্ষন।
ছোট ছোট হত-পা। লিলিপুটের মতন। এই ছেলেটাই এতদিন ধরে তার মায়ের উদরে অবস'ান করছিল! তবে তো বড় দুষ্টু এই ছেলে। মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আচ্ছা করে শাসি- দিতে হবে।
তবে প্রমা তা করল না। আঙ্গুল দিয়ে ভাইয়ের নরম গাল ছুয়ে দিতে লাগল ধীরে ধীরে। তখনও বাইরে প্রমার বাবার আযান শোনা যাচ্ছে। বাতাসে ভেসে আসছে প্রার্থনার জন্য বিধাতার ডাক। আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর।
লা ইলাহা...
খ.
“ কহিলাম জন্মের কথা,শুনেছি যা মায়ের কাছে।
শৈশবের কথা মনে নেই বেশি,টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি ভাসে। ”
শুরুটা কেমন যেন ন্যাতানো হল। ম্যাড়ম্যাড়ে। তাই এক লাফে অনেক দুর চলে এলাম ।
আসতেই হল । কারণ স্মৃতি কিংবা মনে রাখার মত ক্ষমতা যখন আমার আসল তখন আমি বরিশালে। বয়স ছয় কি সাত। কিংবা তারও কম। কুষ্টিয়া, মাগুরা, খুলনা এবং অবশেষে বরিশাল এসে বাবা থিতু হলেন।
শহরটা তার পছন্দ হয়ে গেল। ধার দেনা করে এক টুকরো জমি কিনলেন এবং আশ্চর্য হলেও সত্য মোটামুটি জোড়া তালি দিয়ে একতালা একটি দালান দাড় করিয়ে ফেললেন। জ্ঞান হওয়ার পর জানতে পারলাম আমার নাম রাখা হয়েছে স্বপন। মন্দ নয়। স্বপ্ন মারফত কি আমার আগমন।
জানা নেই। পিতার দেয়া নাম। যৌবনে তিনি সাহিত্যের দিকে কিছুটা ঝুকেছিলেন। কালের বিবর্তনে সে ঝোক কেটে যায়। তবে নামটি মন্দ বাছেন নি।
ভালই লাগে আমার। সবাই বলে আামি দেখতে নাকি মায়ের মত হয়েছি। মায়ের মত কোকড়ানো মাথার চুল। ঠিকঠাক চালিয়ে নেয়ার মত মিষ্টি একটা চেহারা। স্বভাবে আমি দুষ্ট প্রকৃতির।
বাড়ির বাইরেই সময় কাটাই বেশি। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের পেছন দিকেই আমাদের বাড়িটা। এ পাড়াটা এখনও মানুষজনে ভরে ওঠেনি। কাঁচা রাস-া। আশেপাশের অনেক জমিতেই ধানের চাষ হয়।
ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে দু-একটা টিনের ঘর। আমাদের বাড়ির সামনে বসি-। নাম সবুজ কুটির। এখান থেকে ঝি এসে কাজ করে বাড়িতে। সমবয়সী কয়েকটা ছেলে আছে বসি-তে।
ওদের সাথেই থাকি সারাক্ষন। ফুটবল খেলি। কাগজ দিয়ে বিড়ি বানিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে খাই। মার্বেল নিয়ে পড়ে থাকি। জয়ী জয়ী আর খাটুনি- খেলা।
খেলি বউ ছি,এলাটিং-বেলাটিং,বোম-বাষ্টিং,দাড়িয়াবান্দা আরও কত কি! ভাষাটাও হয়ে উঠেছে চাঁছাছোলা। নিত্যনতুন শেখা হয় গালি। সেগুলো নানা জায়গায় প্রয়োগ করি। সবকিছু রঙিন রঙিন। আহ্ জীবন!
বাবার মার খাই নিয়মিত।
হাতের কাছে তিনি যা পান তাই দিয়ে মারেন। একবার রাগ করে ডালের চামচ ছুড়ে মারলেন আমার দিকে। অল্পের জন্যে বেঁচে গিয়েছিলাম সেবার। মারতে অবশ্য মা’ও কসুর করেন না। পড়া ঠোটস' না হলে ইচ্ছেমত পেটান।
মার খেতে খুব একটা খারাপ লাগেনা। একটানা মারের পর দুজনেই আদর করেন আমাকে। দোকান থেকে কিনে আনা হয় ভুনভুনি কিংবা হাওয়া বিস্কুট। বোনটা একদম ঘরকুনো। পথে পথে দেদারসে বিক্রি হয় লেইসফিতা।
সব মেয়েরা পেছনে ছোটে। শুধু আমার বোনেরই এসব দিকে কোন আগ্রহ নেই। সঙ্গী-সাথী বলতে তার তেমন কেউ নেই। ভর্তি হয়েছে বরিশাল বালিকা বিদ্যালয়ে। ইশকুলেও তার ভালো বন্ধু আছে বলে মনে হয়না।
কদিন পর পর বোনের সাথে মারামারি হয়। তবে মেয়েটা লক্ষী। হাত খরচের টাকা থেকে টাকা দেয় আমাকে। সেই টাকা দিয়ে আমি পাপড়,কটকটি কিংবা সেকারিনের আইসক্রিম কিনে খাই। রং দেয়া পঞ্চাশ পয়সা দামের আইসক্রিম খাওয়ার পর পুরো জিহ্্বা লাল হয়ে যায়।
বোন তখন আমাকে দেখে হাসে। আমি রেগে গিয়ে বোনের চুল টেনে ধরি। হাতে চলে আসে মুঠো ভরা চুল। এরপর মায়ের কাছে নালিশ। অতঃপর মার।
প্রমা পড়াশোনায় তেমন ভালোনা। বাবা ব্যস- বড়। মেয়ের পড়াশোনার দিকে খোজ রাখা তার পক্ষে কষ্টকর। মা প্রায় সময়ই অসুস' থাকে। আমার জন্মের সাথে সাথেই মায়ের এ অসুস'তা।
অনেক চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হয়েছে। বাদ পড়েনি পীর,ফকিরও। সমাধান মেলেনি কিছুতেই। বেশিরভাগ সময়ই তার মেজাজ খিটখিটে থাকে। মন যখন ভালো থাকে তখন আমাদের খুব আদর করেন।
কাগজ দিয়ে তৈরি করে দেন নৌকো,ফুল,পাখি আরও কত কি! কোলে নিয়ে বলেন,‘বাবারে আমি একটু পাগল আছি। আমার ওপর তোরা কখনও রাগ করে থাকিস না। কখনও না। ’কাগজের তৈরি জিনিষগুলো আমি যতœ করে রেখে দেই। মায়ের ওপর মাঝে মাঝে অভিমান হয়।
তবে তার ওপর রাগ করে বেশীক্ষন থাকতে পারিনা। ভালবাসি যে খুব তাই। মার্বেল খেলার ঝোকটা বেড়ে যাচ্ছিল দিনকে দিন। এক টাকায় দশটা মার্বেল। বয়াম ভর্তি করে জমাতাম।
বাড়ির সামনের খোলা মাঠটায় বসি-র বড় ছেলেরা খেলত। আমাদের নিতনা ওদের সাথে। কাছ থেকে দাড়িয়ে খেলা দেখতাম। মাঠের আশেপাশে বড় কোন গাছ ছিলনা। জায়গাটা কিছুটা নিচু হওয়ায় সামান্য বৃষ্টি হলেই জলের নিচে চাপা পড়ত।
কোন আড়াল না থাকায় সন্ধে হলেই মাটিতে ছোট্ট একটা গর্ত করে তাতে মূত্র ত্যাগ করত। লাইন ধরে দাড়িয়ে হি হি করে হাসত বেল্লিকগুলো। এমন বেলাজপনায় কি আনন্দ আছে কে জানে। খেলার সময় দু-একটা মার্বেল পড়ে যেত গর্তে। সবাই চলে যাওয়ার পর নোংরার মধ্যে হাত ডুবিয়ে মার্বেলগুলো তুলে আনতাম আমি।
মার্বেলের প্রতি এমনই লোভ ছিল আমার। পুরোনো সেই কথা মনে পড়লে এখন গা গুলিয়ে ওঠে। কিন' তখন কোন সমস্যাই হতনা। বাড়ি ফিরেই স্যাভলন দিয়ে হাত ধুয়ে নিতাম।
ইশকুলে কিছুতেই যাবোনা আমি।
কে যায় অমন পঁচা যায়গায় মরতে। মাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিলাম না খেয়ে মরে যেতে রাজি তবুও ইশকুলে যাবোনা। মা অনেক বোঝালেন। কিন' লাভ নেই। একদিন বাড়ি ফিরতেই চড়,থাপ্পর মারা শুরু করলেন বাবা।
এলোপাথাড়ি মার খেয়ে ছুটে পালালাম বাড়ির বাইরে। বড্ড অভিমান হল বাবার ওপর। সকাল হতে উপোস। দুপুরেও ফিরলাম না বাড়িতে। ক্ষিধেতে প্রান যায় যায়।
সন্ধে নামল। দমকা হাওয়ার মত ছড়িয়ে পড়ল আধার। আমাদের বাড়ির কিছুটা দুরেই একটা অফিসের নির্মান কাজ চলছিল। মিস্ত্রিরা চলে যেতেই সুনসান হয়ে গেল জায়গাটা। গিয়ে লুকালাম আমি সেখানে।
জমা করে রাখা বালির ওপর শুয়ে দিলাম ঘুম। নিশ্চিনে-র ঘুম। ততক্ষনে বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে গেছে। খুজতে বেড়িয়েছে সবাই। মা কান্নাকাটি করছে।
আমার গায়ে হাত তোলার কারনে বকছে বাবাকে। বাবাও দিশেহারা হয়ে ছুটছে আমার জন্যে। এসব অবশ্য বোন প্রমার কাছে শোনা। পরে যখন খুজে পেল আমাকে তখন কি আদর। ইশ, রোজ রোজ
যদি এমন হারিয়ে যেতে পারতাম।
সেদিন বাবা একটুও বকলেন না। আমাকে কোলে নিয়ে বরান্দায় পায়চারি করছিল সারারাত। বাবার প্রতি আমার অভিমান ভেঙে ভেঙে অশ্রু হয়ে ঝরছিল চোখ হতে। গালে আলতো করে চুমু দিতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলাম আমি। সে’কি তুমুল কান্না।
বাবা হেসে বলছিল,‘বোকা ছেলে যেতে হবেনা স্কুলে। কিন' আমি যে চাইনা তুই পড়াশোনা কম করে আমার মত গরীব কেরানি হ। এতে যে অনেক কষ্ট। ’ কিছু না বুঝেই সেদিন আমি বাবাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। হয়তো বুঝেওছিলাম বাবার কষ্টটা।
শিশুরা অনেক কিছু বোঝে। কসম বলছি ,বাবা তোকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। এ ভালোবাসার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে শ্রদ্ধা।
গ.
ছোট্ট একটা মাছরাঙা।
নরম,কচিঁ পা দিয়ে জাপটে ধরেছে সরু বাশেঁর ডগা। বাশঁটার অবস'ান পুকুরের ঠিক মাঝখানটায়। কাদার বুকে পোতা তার চরন। শ্যাওলা পড়ে জলের রং হয়েছে হালকা সবুজ। তার মাঝেই তৃষ্ণার্ত দুটি চোখ খুজছে অন্ন।
হ্ওায়ায় দুলে উঠছে জল। ছোট ছোট ঢেউ হয়ে বৃত্তাকারে পৌছে যাচ্ছে পাড়ে। মাটিতে ধাক্কা লেগে ঘটছে তার দুর্বল কায়ার ছন্দপতন।
একটি বালক বসে আছে । ঘাটের শেষ বাকটায়।
পা দুটো তার জলে ডোবানো। দু-একটা করকিনা খাবার মনে করে ঠুকরে দিচ্ছে সেটা। তারপর নিমিষেই আশাহত হয়ে চলে যাচ্ছে নিজ নিজ কাজে। বালকটির বিদ্যালয় ভালো লাগেনা। প্রতিদিন কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ক্লাস করতে যাওয়া একঘেয়েমির ব্যাপার।
বিদ্যালয়ের ছেলেগুলোও জানি কেমন। প্রত্যেকের সাথে জুড়ে দেয়া আছে একটি করে নাম্বার। এগুলোকে বলে রোল নাম্বার। কি আজব। বালকটি ছাত্র খুব একটা খারাপ না।
বাংলা,ইংলিশে তার নাম্বার ভালই তবে গনিতটা একেবারে দুর্বোধ্য। পড়াশোনা জিনিষটা অতি বিরক্তিকর। বড্ড বেশী না ভালো লাগার জগতে বিচরন এখন তার। আজকাল শখ ঘুড়ি ওড়ানোর । ঘুড়ি বানাতে ওস-াদ এই বালক।
ব্লেড দিয়ে পলিথিনের শরীর কেটে কেটে তাতে ফুটিয়ে তোলে ঘুড়ির অবয়ব। অদ্ভুত সব নাম এসব ঘুড়ির। ময়না,ময়ুরী,কাকাতুয়া,লাল ঝুটি মোরগ আরও কত কি। ঘুড়ি কিনতে আসে পাড়ার তাবত ছেলের দল। বাজারের চেয়ে এই ঘুড়ির দাম কম।
পলিথিন,শলা আর সুতোর পাশাপাশি ঘুড়িপ্রতি মজুরি হিসেবে পঞ্চাশ পয়সা দিতে হয়। বিকেল হলেই ঢাউস আকাশটা ঢেকে যায় অসংখ্য ঘুড়িতে। ঘুড়িগুলো উড়তে থাকে। মস- বড় আকাশের ক্ষনস'ায়ী অলংকার হয়ে। মাঞ্জা দেয়া সুতোগুলো নামে যুদ্ধে।
যে ঘুড়ি স্বাধীন হয়ে ছিড়ে ফেলে বন্ধন তার জন্যে নেই কোন বাহবা। এ সময়টায় ভীড় জমে যায়। ছেলে বুড়ো সবার চোখ থাকে আকাশে। এক সময় সন্ধ্যে নামে। পোষা ঘুড়িগুলো নেমে আসে আকাশ হতে।
অনেক কসরতের পর তাদের একটু বিশ্রাম দেয়া হয়। সবাই যায় বাড়িতে। আলো দুর করা সংকীর্ন বাতিগুলো জ্বলে ওঠে ধীরে ধীরে। কী দুর্বল ঐ কৃত্রিম আলো!বালকটি তখনও মাঠে। তার বুনো ঘুড়িটা কিছুতেই ফিরতে চায়না বাড়িতে।
ঠিক তার মনের মতন। মর্ত্যের বুক তার আর ভালো লাগেনা। সে হারাতে চায়। সবুজ মাঠ,ভাঙাচোড়া পথ কিংবা রাতের গভীরে।
প্রতিদিনই লোডশেডিং।
বাড়ির কাজের লোক মনজু হারিকেনের চিমনিগুলো ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে রাখে। বালকটি পড়তে বসে। কিন' তার চোখ,মন থাকে অন্য কোথাও। তাকে একা রেখে কিশোরীর নগ্ন চোখের পলকের মতন তিরতির করে কাঁপতে থাকে হারিকেনের আগুনের শিখাটা। জানালার ফাক গলে এসে পড়ে চাঁদের আলো।
বিশাল আকাশটায় তারারা ঘুরতে থাকে একেকটা ভো-কাট্টা ঘুড়ি হয়ে। এক সময় বালকটির চোখে ভর করে রাজ্যির ঘুম। টেবিলে বইয়ের ওপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। তারপর মা এসে ভাঙায় কাঁচা ঘুম। ভাত মেখে তুলে দেয় মুখে।
ঘুম ঘুম চোখে বালকটি জাবর কাটার মতো ভাত চিবুতে থাকে। শেষ লোকমাটা না খাওয়াটা পর্যন- ছাড় নেই। শেষ লোকমাটা হচ্ছে বলভাত। এটা খেলে শরীরে অসুরের শক্তি আসে। এমনই ধারনা মায়েদের।
নতুন বছর,নতুন করে কিছু শুরু করা এমন ভাবনা জোরালো নয় বালকটির মনে। সে শুধু জানে আরেকটি ধাপ পার হলো ক্লাসের। পড়াশোনার চাপ বাড়ার সাথে সাথে কপালে জুটবে নতুন কিছু বই। নতুন বইয়ের গন্ধ শোকা দারুন এক আনন্দের ব্যাপার। বই কিনে দেয়ার পর বালকটি সারাক্ষন বই নিয়ে থাকে।
বালিশের পাশে বই রেখে ঘুমায়। বইয়ে দেয়া হয় মলাট। ক্যালেন্ডারের সাদা পিঠ বইয়ের মলাট হয়ে তাকিয়ে থাকে বালকটির দিকে। সাদা জমিন আকাবুকিতে ভরে যেতে সময় লাগেনা। ছোট্ট সেই জায়গায় বিশাল এক স্বপ্নের পৃথিবী একে ফেলে বালকটি।
খুব ভোরেই জেগে ওঠে বাড়ির সবাই। ডিমের কুসুমের মত সূর্যটা আকাশে জায়গা করে নেয় ধীরে ধীরে। দুধের পাতলা শরের মতো বাতাসে ভাসে হালকা কুয়াশা। মাটির বুক হতে জেগে ওঠে লজ্জ্বাবতী ঘাসগুলো। তাড়াহুড়ো করে শিশিরে করে স্মান।
বালকটির ঘুম সহজে ভাঙেনা। মায়ের জোরাজুরিতে উঠতেই হয়। বই-খাতা গুছিয়ে কোনো রকমে চলে যায় স্কুলে। গিয়েই সমাবেশ। হাত উচিয়ে শপথ।
হাত ব্যাথা হয়ে যায়। বালকটি মার খায় খুব। শিক্ষকদের বকাঝকা প্রতিদিনকার রুটিন। টিফিনের ঘন্টা পড়লেই সে চলে যায় স্কুলের পেছনের জংলা জায়গাটায়। সেখানে ঘন ঝোপঝাড় আর আগাছার সারি।
মাঝে মাঝে দেখা যায় গুই সাপ আর বেজির পালিয়ে যাওয়া। জঙ্গলের একটু ভেতরেই হিন্দুদের পুরনো মঠ। ভেঙেচুড়ে একাকার। ইট সিমেন্টের শরীর হতে বের হওয়া অসংখ্য শিকড় জড়িয়ে ধরে আছে মঠটাকে। সেখানে গিয়ে বসে থাকে বালকটি।
কিন' বেশিক্ষন থাকা সম্ভব হয়না। দুষ্ট ছেলেগুলো চলে আসে। তারা মৌচাকে ঢিল মারে। লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট টানে। মেয়েদের নগ্ন ছবি দ্যাখে আর অসভ্যের মত হেসে ওঠে।
ধিঙ্গি ছেলেগুলোর কোন লজ্জ্বা শরম নেই। বালকটির ভালো লাগেনা এসব। তার মন ছটফট করে। কখন যে পড়বে ছুটির ঘন্টা। অপেক্ষায় অপেক্ষায় কেটে যায় বালকটির সময়।
সামনে ভর্তি পরীক্ষা। জিলা স্কুলে ভর্তি হতে হবে। দিন-রাত শুধু পড়াশোনা। ঘুড়ি বানানো হয়না। আকা হয়না কোন ছবি।
কাগজের নৈাকা,উড়োজাহাজ,পাখিগুলো অনাদরে পড়ে থাকে। বালকটির মা সারাক্ষন বসে থাকে ছেলের পাশে। পড়াশোনার তদারকি করে। তার শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছেনা। তবুও ছেলেকে হাতছাড়া করতে রাজি নয়।
একটু লড়াই না হয় করল আদরের ছোট্ট ছেলেটির জন্যে।
হুট করেই ঘটে গেল ঘটনাটা। আর দশ-পাঁচটা দিনের মত সেদিনও খেতে বসেছিল সবাই। হাসি ঠাট্টায় উঠেছিল মেতে। বালকের পাতে ছিল লাল শাক।
শাক দিয়ে মাখিয়ে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিল মা। লাল রং এ ডুবে থাকা ভাত ধীরে ধীরে চিবুচ্ছিল সে। ঠিক তখনই মায়ের কাশি শুরু হল। কাশির সাথে পড়তে লাগল দলা দলা রক্ত। রক্ত আর লাল শাক মিশে অদ্ভুত সুন্দর এক ছবি তৈরি হল প্লেটের বুকে।
বালকটি তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। শাক মাখানো ভাত আর রক্তের মাঝের পার্থক্যটা ঠাওর করতে পারছিলনা কিছুতেই। নিমিষেই বমি করে ভাসিয়ে দিল সব। একদম সব।
পাঁচদিন হল হাসপাতালে আছে বালকটি ও তার মা।
এখানকার পরিবেশ তেমন একটা খারাপ নয়। মনে হয় মৃত্যদূত এসে আড্ডা জমায় সদা। পুরো হাসপাতাল জুড়ে ফিনাইলের গন্ধ। বালকটির শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। মাকে বিছানায় রেখে সে জানালার দিকে ছুটে যায়।
প্রানভরে নেয় মুক্ত বাতাসের স্বাদ। জানালা দিয়ে তাকায় বাইরে। অসংখ্য ঘুড়ি দখল নিয়েছে আকাশটা। সে চোখ বুজে হাত বাড়ায় শুন্যে। কোন এক ভো-কাট্টা স্বাধীন মনঘুড়িকে ধরার জন্যে।
কিন' তা সবসময় হাত ফসকে চলে যায়। চলে যায় ধরাছোয়ার বাইরে। দৃষ্টি থেকেও দুরে। অনেক দুরে...। (চলবে......)
* পুরনো লেখা ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।